E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৪ মার্চ, ২০২২ / ১৯ ফাল্গুন, ১৪২৮

পৌর নির্বাচনেও ভোটের নামে প্রহসন

তার মধ্যেও জনগণের প্রতিরোধ ও বিক্ষোভ


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস জমানায় কোনোভাবেই যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আরও একবার স্পষ্ট হলো সাম্প্রতিক ১০৮টি পৌরসভার নির্বাচনে। এই দল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সব ক’টিতেই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে নির্বাচনগুলি‍‌কে প্রহসনে পরিণত করেছে। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত, পৌরসভা থেকে শুরু করে সমবায়, স্কুল-কলেজ কমিটির নির্বাচন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ইত্যাদি সমস্ত নির্বাচনেই শাসকদল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে গায়ের জোরে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে রাজ্যে কলঙ্কের নজির তৈরি করছে। বিরোধী দল‍‌ থেকে শুরু করে রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, আদালত - সর্বস্তরে প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও শাসকদল ও সরকারের কোনো সংবিৎ ফেরেনি। এর আগে ৫টি পৌরসভায় বিরোধী প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দিয়ে গায়ের জোরে জিতে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। এক্ষেত্রেও ন্যক্করজনক ভূমিকা ছিল পুলিশের।

পশ্চিমবঙ্গে সদ্য সমাপ্ত ১০৮টি পৌরসভা নির্বাচনকে যেভাবে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে, তার তীব্র নিন্দা করেছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। ২৮ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো বলেছে, তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য প্রশাসনের যোগসাজশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এমন পর্যায়ে রিগিং হয়েছে যে, নির্বাচনের শেষ পর্বে কমিশনের এক আধিকারিক স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের এমন লজ্জাজনক ও আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পার্টির প্রার্থী, কর্মী এবং গণতন্ত্র প্রিয় মানুষদের অভিনন্দন জানিয়েছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের স্বৈরাচারী আক্রমণের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই চালাচ্ছেন তাঁদের প্রতি সংহতি ও সমর্থন জানাতে দেশব্যাপী গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের কাছে আবেদন জানিয়েছে সিপিআই(এম)।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০৮টি পৌরসভার নির্বাচনে বাইরে থেকে দুর্বৃত্তদের এনে বিরোধী দল ও তাদের এজেন্ট এবং প্রার্থীদের মারধর করে, ভোটারদের হুমকি দিয়ে ভোটদানে বিরত রেখে যথেচ্ছ ছাপ্পা ভোট ও রিগিং করে গোটা ভোট প্রক্রিয়াকে কার্যত প্রহসনে পরিণত করেছে শাসকদল। এদিন ভোটপর্ব শুরুর পর থেকেই শাসকদলের দুর্বৃত্তদের তাণ্ডবে সুষ্ঠু ভোটদান ব্যাহত হয়ে পড়ে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বামফ্রন্ট সহ বিরোধীদলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে ভুরি ভুরি অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কমিশনের কোনো সদর্থক ভূমিকা দেখা যায়নি। পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ স্থবির থেকে প্রকৃতপক্ষে শাসক দলকেই মদত দিয়ে গেছে। এদিন দেখা গেছে তৃণমূলের বাইক বাহিনীর হামলায় শুধু সিপিআই(এম) কর্মী এবং প্রার্থীরাই আক্রান্ত হননি, এদের হামলার শিকার হয়েছেন অন্যান্য বিরোধী দল এমনকী সাংবাদিকরাও। আক্রান্ত হয়েছেন মহিলারাও। এই দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া গুলিতে কামারহাটিতে একজন পুলিশ কর্মীও আহত হয়েছেন। সারাদিনের এই ভোট সন্ত্রাস, ভোট লুট, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি একের পর এক ঘটনার পর বিকেলে নির্বাচন কমিশনের এক আধিকারিক বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘একটা সময়ের পর আমাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না।’ অথচ মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য শোনা না গেলেও রাজ্য পুলিশের ডিজি এই সমস্ত ঘটনাকে আড়াল করে বলেছেন, রাজ্যে নাকি খুব সুন্দরভাবে ভোট হয়েছে। কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হননি। যেকোনো নির্বাচনের পর প্রথা অনুযায়ী যেখানে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও আনুষঙ্গিক বিষয় সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জনগণকে জানানোটাই প্রথা, সেখানে তাদের পক্ষ থেকে কোনো কথা শোনা যায়নি। প্রথা বহির্ভূতভাবে রাজ্য পুলিশের ডিজি সরকারের স্তাবকতা করতে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে চূড়ান্ত মিথ্যাচার করেছেন।

তবে এটাও লক্ষণীয় দিক যে, নির্বাচনের দিন শাসকদল তৃণমূলের যথেচ্ছ ভোট লুট, হামলা-সন্ত্রাসে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও দেখা গেছে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে। এদিন ভোট চলাকালীনই লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঘটনাও সামনে এসেছে। কোথাও বহিরাগত দুষ্কৃতীদের মানুষ তাড়া করে এলাকা ছাড়া করেছে, কোথাও বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়েও ভোটাররা ভোট প্রদানে জেদি মনোভাব নেওয়ায় দুষ্কৃতীরা পিছু হটেছে। বুথ দখলে এসে মানুষের এই প্রতিরোধের মুখে পড়ে তৃণমূলকে নৃশংস হামলা চালাতে হয়েছে। বোমা-গুলি চালিয়ে ভোটপর্বকে হিংস্রতার বিভীষিকায় পর্যবসিত করেছে। তার মধ্যেও বাঁকুড়া, সোনামুখী, বিষ্ণুপুর পৌরসভা সহ মেদিনীপুর, খড়্গপুর, জলপাইগুড়ি, বারাসত, শান্তিপুর, কল্যাণী, তাহেরপুর, কামারহাটি প্রভৃতি বিভিন্ন পৌরসভায় প্রতিবাদী মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিরোধের মুখে পড়েছে শাসকদলের দুর্বৃত্তরা।

গণতন্ত্রকে এভাবে ভুলুণ্ঠিত করার প্রতিবাদে বামফ্রন্ট সহ কংগ্রেস এবং আইএসএফ প্রতিবাদে সরব হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেয় বামফ্রন্ট। ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোটপর্ব সমাপ্ত হবার পর এক বিবৃতিতে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, রাজ্য বামফ্রন্ট মনে করে আজ রাজ্যের ১০৮টি পৌরসভার নির্বাচনে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। বিভিন্ন পৌর এলাকায় নাগরিকদের নিজের ভোট নিজে দেওয়ার ক্ষেত্রে শাসকদল তৃণমূল নানা ধরনের সন্ত্রাসমূলক কৌশলে ভোটাধিকার হরণের বেপরোয়া চেষ্টা চালিয়েছে। এসত্ত্বেও যারা সাহসের সঙ্গে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য শেষ পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন রাজ্য বামফ্রন্ট তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছে।

এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, রাজ্য প্রশাসনের সহযোগিতায় তৃণমূল আজ ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু হবার পর থেকেই যেভাবে ভোটারদের ভোটদানে বাধা দিয়েছে ও নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে অশনি সংকেত।

২৮ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের সব পৌর এলাকায় গণতন্ত্র হত্যা বিরোধী দিবস পালনের আহ্বান জানায় বামফ্রন্ট।

সেই অনুযায়ী রাজ্য বামফ্রন্টের ডাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ-অবস্থান কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে। এদিন যেসব ওয়ার্ডে ও বুথে ভোট লুট ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, সেই সব জায়গায় ভোট গণনা স্থগিত রেখে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানায় বামফ্রন্ট। নির্বাচন কমিশন দপ্তরে ডেপুটেশন দিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা তো সব জানেন, ভিডিয়োতে দেখেছেন। বুথে বুথে সাধারণ মানুষ ভোটদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এখনই বিভিন্ন জায়গায় স্ক্রুটিনির ফলাফল নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করুন। তা না হলে বুঝতে হবে, এই যে গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলছে, তা আপনি সমর্থন করছেন। বিমান বসু আরও বলেন, গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে আর নির্বাচন কমিশন নখদন্তহীন হয়ে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কোনো উদ্বেগ নেই। এত নির্লিপ্ততা কেন? কীসের জন্য?

কমিশন দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেন, কমিশনকে তার ভূমিকা পালন করতে হবে। মাথা নুইয়ে ফেলা চলবে না। কমিশনার একটা বয়ান লিখে দিন যে, রাজ্যজুড়ে এই ব্যাপক ভোট লুটের ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন নিতে পেরেছে। মানুষের অধিকারের ওপর আক্রমণ হলে তা প্রতিহত হবেই। আসলে মুখ্যমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন। তাই আক্রমণ নেমে আসছে।

সূর্য মিশ্র বলেছেন, আমরা নির্বাচন কমিশনারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভিডিয়োগুলো কি দে‍‌খেছেন? কমিশনার বললেন, দেখেছি। তাহলে বুথে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে যারা, তারা অবাধে ঘুরে বেড়ায় কী করে? তারা গ্রেপ্তার হয় না কেন? অথচ ছাত্র-যুবরা আন্দোলন করলে গ্রেপ্তার হয়। ছাত্রকে হত্যা করে পুলিশ। তথ্য অনুসন্ধান করতে গেলে সাংবাদিকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনার কাকে রক্ষা করতে চাইছেন? মানুষের অধিকারের উপর আক্রমণ হলে প্রতিবাদ হবেই।

এদিনের এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বিমান বসু, সূর্য মিশ্র ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি, আরএসপি’র সর্বভারতীয় সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য সহ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হাফিজ আলম সইরানি, আরএসপি নেতা অশোক ঘোষ, সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, মৃদুল দে, সুজন চক্রবর্তী, মিনতি ঘোষ, কনীনিকা ঘোষ প্রমুখ।

এদিন তৃণমূলের ভোট সন্ত্রাস ও লুটের বিরুদ্ধে কলকাতার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন জলপাইগুড়িতে মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ মিছিল আটকে ব্যাপক লাঠি চালায় পুলিশ। এই ঘটনায় আহত হন সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য সহ পার্টি কর্মী, ছাত্র-যুব-মহিলা।

ভোট লুটের প্রতিবাদে এদিন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বারাসত, বনগাঁ, বারাকপুর ও বসিরহাট মহকুমা শাসকের অফিসের সামনে বি‍‌ক্ষোভ অবস্থান হয় এবং স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বারুইপুর, গড়িয়া, যাদবপুরের সন্তোষপুর, ভাঙড়ের ঘটকপুকুর, উস্তি, নোদাখালি, সাগর সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে।

হাওড়া জেলায় বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে উলুবেড়িয়া মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। অবস্থান বিক্ষোভে বক্তব্য রাখেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক দিলীপ ঘোষ সহ বামফ্রন্টের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। হুগলি জেলার শ্রীরামপুর, চন্দননগর, আরামবাগ ও চুঁচুড়া মহকুমায় অবস্থান বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। শ্রীরামপুর কোর্টের সামনে অবস্থান বিক্ষোভে বক্তব্য রাখেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক দেবব্রত ঘোষ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

এদিন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি, তমলুক, এগরা এবং হলদিয়াতে বিক্ষোভ মিছিল এবং মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ সভা, অবস্থান সংগঠিত হয়েছে। গণতন্ত্র হত্যাকারী তৃণমূল ও দলদাস রাজ্য প্রশাসনকে ধিক্কার জানিয়ে ঝাড়গ্রাম শহরে মিছিল করে মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে সভা করে জেলা বামফ্রন্ট। এই কর্মসূচি থেকে তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের ধিক্কার জানিয়ে রাজ্যে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাধারণ মানুষকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপর হামলার নিন্দা করা হয়। এখানে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক প্রদীপ সরকার, পার্টিনেত্রী মধুজা সেনরায়, সিপিআই’র জেলা সম্পাদক মনোরঞ্জন ঘোষ প্রমুখ।