৫৯ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৪ মার্চ, ২০২২ / ১৯ ফাল্গুন, ১৪২৮
সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য ২৩তম সম্মেলন
সন্ত্রাস ভেদ করে জনশক্তির চেতনার প্রকাশ
সুকান্ত বসু
সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখছেন প্রকাশ কারাত।
জনগণের সঙ্গে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান ঘোষিত হয়েছে সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য ২৩তম সম্মেলনে। ২৪ ফেব্রুয়ারি কুল ছাপানো বিবেকানন্দ ময়দানের সমাবেশ এবং ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিনিধি অধিবেশন ছিলো সংগ্রামী মেজাজে প্রত্যয় দৃঢ়। আগরতলা টাউনহলে কমরেড বাজুবন রিয়াং, বিজন ধর, গৌতম দাশ মঞ্চে শুরু হওয়া সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য ২৩তম সম্মেলনে গোটা রাজ্য থেকে মোট ৩২১ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। দু’দিনের অধিবেশনে ৪৪ জন প্রতিনিধি তাঁদের আলোচনায় দৃঢ়তার সাথে বলেছেন বিজেপি-আইপিএফটি জোট শাসনে ভূলুণ্ঠিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে আরও বেশি বেশি মানুষকে যুক্ত করার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। ফ্যাসিস্টসুলভ আক্রমণ-সন্ত্রাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা উঠেছে প্রতিনিধিদের আলোচনায়। নেতৃবৃন্দ এবং প্রতিনিধিরা জাতি-উপজাতিসহ অন্য অংশের জনগণের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য এবং এ রাজ্যের গণআন্দোলনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কথা বলেছেন। ইতিহাসকে বিকৃত করা এবং কমিউনিস্টদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ইতিহাসকে ভূলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক বার্তা উচ্চারিত হয়েছে সম্মেলনে। বর্তমান বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারকে হঠানো সম্ভব - এই বার্তা ঘোষিত হয়েছে সম্মেলনে।
হার না মানার চেতাবনি
জনস্রোতে ঘুরে দাঁড়াবার ডাক ঘোষিত হয়েছে বিবেকানন্দ ময়দানের সমাবেশে। বাধা ছিলো প্রতি পদক্ষেপে। গাড়ি আটকে দেওয়া, রাত অবধি হুমকি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রমণ, রেলস্টেশনে আক্রমণ। শাসকদলের তরফে সবরকম চেষ্টা ছিলো বালির বাঁধ দিয়ে উত্তাল জনস্রোতকে আটকে রাখার। মৃত্যুকে যারা ভয় পায় না, তাদের আটকে রাখার সাধ্য কার? আতঙ্কিত শাসক চেয়েছিলো গত ৪৭ মাসের মধ্যেই আরেকবার হুমকি আর চোখ রাঙানিতে প্রতিবাদী মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে। কিন্তু ত্রিপুরার স্রোতস্বিনী পাহাড়ি ঝর্ণার মতোই সব বাধা চুরমার করে মানুষের ঢেউ ভাসিয়ে দিলো রাজধানী আগরতলাকে। দূর দুরান্ত থেকে কোথাও বা রাত, কোথাও বা সকালে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছেন মানুষ। জনস্রোতে মনোরথের ঠিকানা খুঁজে নেবার পদচারণায় ৪ বছর পর লাল স্রোতে টগবগ করলো আগরতলা শহর। সিপিআই(এম)’র ত্রিপুরা রাজ্য ২৩তম সম্মেলন উপলক্ষে জনসমাবেশে বিবেকানন্দ স্টেডিয়াম উপচে, রাস্তা ছাপিয়ে মানুষের মেজাজ, মুহুর্মুহু স্লোগান আর করতালি জানান দিলো ৪৭ মাসের দুঃসহ দুঃশাসনের রাতের বৃন্ত থেকে নতুন ভোর ছিনিয়ে আনার প্রতিজ্ঞায় টানটান এ রাজ্যের মানুষ। প্রস্তুত ভোটের অধিকার থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কাজের অধিকার, গত ৪ বছরে লুট হয়ে যাওয়া সব হকের হিসেব বুঝে নিতে। আর সেই টানটান চেতনাকেই যেন রাতের অন্ধকারে মশালের মতো জ্বেলে ফিরে গেছেন ত্রিপুরার লড়াকু জনতা। ফিরে গেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আগামীর জানকবুল লড়াইয়ের রসদ মনে, মগজে পুরে।
আত্মবিশ্বাসের ভিত
প্রতিনিধি সম্মেলনের শুরুতে প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান মানিক দে সম্মেলন ও তাকে কেন্দ্র করে সমাবেশকে সফল করতে যারা আর্থিক ও অন্যান্যভাবে সাহায্য করেছেন তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিবেকানন্দ ময়দানে জনসমাবেশে ব্যাপক সংখ্যায় জনগণের অংশগ্রহণ আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। আক্রমণের মধ্যেও মানুষ রাস্তায় নামছেন। আক্রমণের সামনে মাথা নত করছেন না। আগামীর সংগ্রামকে শক্তিশালী করার প্রত্যয় নিয়ে সম্মেলন থেকে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন যুদ্ধের সেনাপতিরা। সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্রতিনিধি অধিবেশনের উদ্বোধন করেন। পার্টির রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদনে বিজেপি শাসন অবসানে বেশি বেশি মানুষকে সমবেত করার ডাক দিয়েছেন।
চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ডাক
সমাবেশ ও প্রতিনিধি সম্মেলনে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, হিংসা শেষ করে গণতান্ত্রিকভাবে নিরপেক্ষ ভোট হলে এটা নিশ্চিত বিজেপি হারবে, বামপন্থীরা জিতবে। আবার বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। এই পরিবেশ আনতে হলে আজ হিংসার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমরা এই লড়াই লড়বো গণতান্ত্রিকভাবে। আমরা লড়বো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, সাংবিধানিক অধিকারকে বজায় রাখার জন্য। ত্রিপুরায় বামপন্থীদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক। সমাবেশের সংগ্রামী মেজাজে আপ্লুত সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক বলেন, সন্ত্রাস ভেদ করে যেভাবে এই সমাবেশে জনগণ উপস্থিত হয়েছেন গোটা দেশের পার্টির তরফ থেকে এই চেতনাকে সংগ্রামী লাল সেলাম। বিজেপি সরকার আসার পর থেকে ত্রিপুরায় আমাদের ২২ জন সহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। গত রাজ্য সম্মেলনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ জন সহকর্মী খুন হয়েছেন। শাসকদল আমাদের অফিস ভেঙেছে, পুড়িয়েছে। বাম নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা হয়েছে। হুমকি দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে আগামীর কর্তব্যের দিকনির্দেশ তুলে ধরেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেন, আজ আমাদের দেশ এবং পার্টির সামনে গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গত পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে এ পর্যন্ত ৪ বছরে দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী প্রবণতা আরও শক্তিশালী হয়েছে। বিজেপি সরকারে থাকার সুযোগে আরএসএস-এর এই হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে চলেছে। সেইসঙ্গেই এই সরকার দেশের সম্পদ বিক্রি করে, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের ঢালাও বেসরকারিকরণ করে, শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী আইন বাতিল করে, নতুন শ্রমকোড চালু করে, পছন্দসই কর্পোরেটদের জন্য ধান্দার ধনতন্ত্রকে উৎসাহিত করে নয়া উদারবাদী অর্থনীতিকেই আরও আগ্রাসী কায়দায় কার্যকর করছে এবং তার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দুর্নীতিকে আইনি বৈধতা দিতে চাইছে। আর তার সঙ্গেই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকারের ওপর আধিপত্যবাদী আক্রমণও গত ৪ বছরে তীব্রভাবেই বেড়েছে। দ্বিতীয় দফায় মোদি সরকার ক্ষমতা দখল করেই সংবিধানের উপর এক প্রবল আক্রমণ নামিয়ে এনে দেশের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে দিয়েছে, সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদকে বাতিল করেছে সেই আরএসএস এর ফ্যাসিস্টসুলভ হিন্দুত্বের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তারপরেই আনা হয়েছে সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। সেই সঙ্গেই সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ব্যবহার করে সরকার নিজেই অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ শুরু করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, আর্থিক সার্বভৌমত্ব, সামাজিক ন্যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, যা আমাদের সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ, তার সবক’টির উপরেই এক লাগাতার ভয়ানক আক্রমণ চলছে। সংসদ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, সিবিআই সহ সব সাংবিধানিক সংস্থার অধিকার খর্ব করে, সরকার ও দলের স্বার্থে এদের অপব্যবহার করে সেই হিন্দু রাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডাকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সরকার, সংসদকে চলতে না দিয়ে খর্ব করা হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্বকে।
গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্য
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত সমাবেশ ও প্রতিনিধি সম্মেলনে বলেছেন, সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষায় সব গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্য দরকার। আর সেই কাজ করতে গেলে আজ সবচেয়ে জরুরি সিপিআই(এম) তথা বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি। জাতি উপজাতি ঐক্য রক্ষা করে ত্রিপুরাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে একমাত্র সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টই। জরুরি হলো সংগঠনকে চাঙ্গা করা। কারণ এই কাজের মাধ্যমেই আমরা জনগণের সঙ্গে আমাদের জীবন্ত সম্পর্ক ধরে রাখতে পারবো। শত্রুরা আমাদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতেই এত হামলা করছে। তারা চায় পার্টিকে জনগণ থেকে আলাদা করে দিয়ে আমাদের ধ্বংস করতে। জনগণের সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্ক ধরে রাখতে না পারলে আমরা যেমন আমাদের বক্তব্য তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারবো না, তেমনি জনগণের মধ্যেও এই আস্থা তৈরি হবে না যে, আমরা তাদের পাশে লড়াইয়ের ময়দানে আছি। তাই ত্রিপুরায় এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে হবে আমাদের। কী করে এমজিএন রেগা সহ এই সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অপশাসনের প্রশ্নে মানুষকে একজোট করে আমরা লড়াইয়ে নামাবো সেজন্য বিভিন্ন সাংগঠনিক প্রয়াস নিতে হবে। সদস্যদের রাজনৈতিক মতাদর্শগত চেতনার মান উন্নত করে আমরা এগোতে পারবো। পার্টিতে তরুণ প্রজন্মের সদস্য, মহিলাদের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। সর্বক্ষণের কর্মী নিয়োগ, তাদের গুণগত মানের উন্নয়ন, যথাযথ নির্দেশ দেওয়া এবং কাজের চেকআপে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও সক্রিয় হতে হবে। এর কাঠামোকে নিচুতলা পর্যন্ত প্রসারিত করে একে ব্যবহার করতে হবে। যখন আমাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক সাংগঠনিক কাজ বাধার মুখে পড়ছে, তখন সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের রাজনৈতিক প্রচার ও আন্দোলনের নতুন হাতিয়ার হতে পারে। প্রকাশ কারাত বলেন, এই কঠিন সময়ে গণসংগঠনগুলির সদস্য সংখ্যা বেড়েছে। এটা উৎসাহজনক। এর অর্থ পার্টির কাজ বাড়ছে, গুণগত মানের উন্নয়ন হচ্ছে। এই সাফল্যকে সংহত করে, জনগণের সঙ্গে আরও জীবন্ত সম্পর্ক তৈরি করেই আমরা আজকের কঠিন সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো।
প্রতিরোধের দুর্জয় ব্যারিকেড
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য ত্রিপুরা বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার সমাবেশ ও প্রতিনিধি সম্মেলনে বলেছেন, ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের দুর্জয় ব্যারিকেড গড়ে তুলুন। সমাবেশকে ঐতিহাসিক রূপ দিতে নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা ও মোকাবিলা করে আসা রাজ্যের হাজার হাজার মানুষকে সিপিআই(এম)-র পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে মানিক সরকার বলেছেন, ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। রাজ্যে পার্টি সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন মানিক সরকার। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসছে। একে কাজে লাগাতে হবে। বৃহত্তর আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। জনবিরোধী ও বিভেদকামী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।
দুর্বার আন্দোলনের বার্তা
২৩তম রাজ্য সম্মেলনে তিনটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কাজ-খাদ্য এবং কর্মসংস্থানের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন, জাতি-উপজাতি জনগণের গণতান্ত্রিক ঐক্যকে আরও সম্প্রসারিত করা এবং গণতন্ত্র, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম তীব্র করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২০১৮ সালের ৩ মার্চ থেকে বিরোধী দলসমূহের পার্টি অফিস, মিছিল-মিটিং, বাড়ি-ঘর এবং স্থায়ী সম্পত্তির উপর যে আক্রমণ ও লুট শুরু করেছিল তা এখনও অব্যাহত আছে। পার্টির রাজ্য দপ্তর থেকে শুরু করে অসংখ্য পার্টি অফিসে আক্রমণ, আগুন লাগিয়ে দেওয়া এবং জবরদখল করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো এফআইআর নেয়নি - নেওয়া হলেও কোনো প্রকার তদন্ত বা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং বাইক বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত, আহত পার্টি কর্মীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। ত্রিপুরা বিধানসভার বিরোধী দলনেতাসহ একাধিক বিধায়ক, এডিসি সদস্য এবং অসংখ্য পার্টির নেতা-কর্মী দৈহিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, গুরুতর আহত হয়েছেন এবং অনেকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। এর বিরুদ্ধে পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি, করছে না। বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার কায়েম হবার পর পার্টির প্রথম সারির ২২ জন কর্মী খুন হয়েছেন। তার মধ্যে এই ৩৯ মাসে ১৭ জন। ৩,২৬৪ জন কর্মী দৈহিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বহির্রাজ্যেও উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে হয়েছে। কয়েকজন চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন।
ত্রিপুরায় এই সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান প্রায় শূন্যের কোঠায়। বেকারির ক্ষেত্রে সারা দেশের মধ্যে ত্রিপুরা এখন দ্বিতীয় স্থানে। শিক্ষা দপ্তরে ছাঁটাই হওয়া ১০,৩২৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে গ্রুপ ডি থেকে উপরের স্তর পর্যন্ত এই সময়ে আরও প্রায় ১৫ হাজার সরকারি কর্মচারী অবসরে চলে গেছেন। তার তুলনায় শিক্ষাসহ অন্যান্য কয়েকটি দপ্তরে যে নিয়োগ হয়েছে তা যৎসামান্য। তাও বেশির ভাগ আউটসোর্সিং করা, যাদের একটি ভালো অংশ ভিন রাজ্যের যুবক-যুবতী। জাইকা, ইন্দো-জার্মান প্রজেক্টসহ আরও কয়েকটি প্রকল্প থেকে ছাঁটাইকৃত প্রায় দেড় হাজার কর্মীকে পুনর্নিযুক্তি দেওয়া হয়নি। এক কথায় কর্মসংস্থানে চরম মন্দা চলছে। রাজ্যের শত শত যুবক-যুবতী বহির্রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। অভাব এবং হতাশার কারণে আত্মহত্যা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনাও বাড়ছে।
তিপ্রা মথা পরিচালিত এডিসি’র বয়স ১০ মাস হয়েছে। তিপ্রা মথা তাদের পূর্বসূরী টিইউজেএস এবং আইএনপিটি’র পদাঙ্ক অনুসরণ করেই জনগণের স্বার্থকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছে। এডিসি প্রশাসনও রাজ্য সরকারকে অনুসরণ করে অনুৎপাদক খাতে তাদের যৎসামান্য বরাদ্দের অপচয় করে আনন্দ ফুরতি এবং লুটপাটে মেতেছে। ইতিমধ্যেই এডিসি’র উঁচু তলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজন-পোষণের প্রশ্নে অভিযোগের আঙুল উঠছে। পাহাড়ে যেখানে তিপ্রা মথা শক্তিশালী সেখানে ভিলেজ কমিটির কাজের উপর বিজেপি’র বাইক বাহিনীর মতোই তিপ্রা মথা লুটের থাবা বসাচ্ছে। গত ২৯-৩০ নভেম্বর ২ হাজার লোক নিয়ে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবিতে তিপ্রা মথা দিল্লি অভিযান কর্মসূচি করেছে। সেখান থেকে কোনো সদর্থক আশ্বাস না পাওয়ায় ফিরে আসার পর তৎপরতা কিছুটা কমেছে। এই ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিছুটা ধীরে হলেও তিপ্রা মথা প্রভাবিত নতুন প্রজন্ম এবং বুদ্ধিজীবীরা গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের অবাস্তবতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। সিপিআই(এম) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরী তাঁর প্রতিবেদনে শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের কথা বলেন।
নতুন রাজ্য কমিটি
সিপিআই(এম) রাজ্য ২৩তম সম্মেলন থেকে ৭০ জনের রাজ্য কমিটি গঠিত হয়েছে। সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন জীতেন্দ্র চৌধুরী। ১৬ জনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। রাজ্য কমিটিতে নতুন এসেছেন নয় জন। তারা হলেন বিশ্বরূপ গোস্বামী, অজিত দাস, অরুণ ত্রিপুরা, নির্মল বিশ্বাস, রেহেনা বেগম, বিজিতা নাথ, শ্যামল দে, স্বপ্না দত্ত, সমর চক্রবর্তী। রাজ্য কমিটিতে মহিলা রয়েছেন আট জন। সেচ্ছাসেবকরা সম্মেলনে অতন্ত্র প্রহরীর ভূমিকায় ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মীদের গানেও ছিলো লড়াই এগিয়ে নেবার অঙ্গীকার। সম্মেলনের শেষ দিনে সম্মেলন স্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মধ্যে সংঘর্ষ বাধে ও একে কেন্দ্র করে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। শাসক বিজেপি সিপিআই(এম)’র বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ায়। কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এসডিপিও’র কাছে ডেপুটেশন দিয়েছে সিপিআই(এম)।