৫৯ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৪ মার্চ, ২০২২ / ১৯ ফাল্গুন, ১৪২৮
গো-রাজনীতিই এখন বুমেরাং
শান্তনু দে
গোরক্ষার নামে মেরুকরণের রাজনীতির যে ফয়দা একদিন বিজেপি তুলেছে, এখন সেটাই দলের মাথা ব্যথার অন্যতম বড়ো কারণ।
ছ’দফা ভোট হয়ে গিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। বাকি আর একদফা। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় শুরু। তারপর পশ্চিম থেকে বুন্দেলখণ্ড হয়ে ভোটগ্রহণ যত এগিয়েছে পূর্বদিকে, ততই বেওয়ারিশ গোরু, ‘আওয়ারা পশু’ নিয়ে ক্ষোভের পারদ চড়েছে। গো-রাজনীতি করতে গিয়ে উলটো ফল টের পেয়েছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের সভার আগে গোরু ছেড়ে অভিনব প্রতিবাদ দেখিয়েছেন বারাবাঁকির কৃষকরা। আর সেই ভিডিয়ো মুহূর্তে ভাইরাল। ঘুরেছে নেটমাধ্যমে।
ব্যাকফুটে নরেন্দ্র মোদি। আড়াই মাস আগে বারাণসীর সভায় যে মোদি বলেছিলেন, ‘গোরু নিয়ে কথা বলা অনেকের কাছে অপরাধ হতে পারে, কিন্তু আমাদের কাছে গোরু পবিত্র, মায়ের মতো’, সেই তাঁকেই উন্নাওয়ের সভায় প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে, ‘ভোটের ফলপ্রকাশের পরে এই সমস্যার সমাধানে তৈরি হবে নতুন নীতি।’
কারণটা একেবারে সহজঃ যোগী সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই রাজ্যে বেড়ে গিয়েছে গোরক্ষা বাহিনীর তাণ্ডব। রাজ্যে গোহত্যায় নিষেধাজ্ঞা। বন্ধ হয়ে গিয়েছে গবাদি পশুর বাজার, কসাইখানা। স্বঘোষিত গোরক্ষকদের চোখরাঙানিতে লাটে উঠেছে গোরু বিক্রি। এর ফলে বয়স্ক গবাদি পশুদের নিয়ে ঘোর সমস্যায় কৃষকরা। চাষে লাঙল টানার কাজে অক্ষম বা দুধ দিতে বন্ধ করে দেওয়া গোরু নিয়ে কৃষক, পশুপালকরা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। আগে জবাইয়ের জন্য বিক্রি করে দিতেন। এখন তা হচ্ছে না। এদিকে বয়স্ক গবাদি পশুকে গোয়ালে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো আর্থিক সংস্থানও বেশিরভাগ কৃষকের নেই। তাই কাজে অক্ষম গোরু, মোষকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়াই ইদানীংয়ের রেওয়াজ। কিন্তু তাতেও সমস্যা বিস্তর। সেই বেওয়ারিশ গোরুই আবার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়ছে চাষের খেতে। নষ্ট করছে কৃষকের বহু পরিশ্রমের ফসল। আওয়ারা গোরু যাতে ফসলের ক্ষতি না করতে পারে, সেজন্য রাত জেগে দিতে হচ্ছে খেত পাহারা। পাশাপাশি, খেত ঘিরতে কাঁটাতারের বেড়া। আর তাতে ব্যাপক খরচ! যদিও, তাতে নিস্তার নেই। এইসব অভুক্ত বেপরোয়া গোরুকে কাঁটাতারও আটকাতে পারছে না। তাছাড়া, যখন-তখন হাইওয়ে আটকে বসে থাকার ফলে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা। গ্রামে কৃষকদের তাড়া খেয়ে বেওয়ারিশ গোরুর পাল শহরের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে খাবারের সন্ধানে।
যোগীর রাজ্যে সবচেয়ে দুর্দশায় গোরু আর কৃষকরা। অভুক্ত গোরু, অনাহারে কৃষক। নীতি আয়োগের দারিদ্র্য-সূচকে তিন নম্বরে উত্তরপ্রদেশ। যোগীর রাজ্যে দারিদ্র্য সীমার নিচে মানুষের সংখ্যা ৩৭.৭৯ শতাংশ। নীতি আয়োগের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সূচকে দেশের মধ্যে শেষ সারিতে উত্তরপ্রদেশ। যে নীতি আয়োগের অধ্যক্ষ প্রধানমন্ত্রী নিজে!
বছরতিনেক আগে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেছিলেন, ‘গাউ মাতা কে সম্মান মে ইয়ে সরকার কভি পিছে নাহি হটেগি’। বাজেট পেশ করতে গিয়ে সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছিল, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ গোরুরা! গোয়েল ঘোষণা করেছিলেন ‘রাষ্ট্রীয় গোকুল মিশন’। বরাদ্দ করেছিলেন ৭৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পেনশনের জন্য মাত্র ৫০০ কোটি টাকা।
উত্তরপ্রদেশঃ মোদি-যোগীর ‘ডবল ইঞ্জিন’! প্রতিটি পশুর জন্য দিনে ৩০ টাকার প্রকল্প এনেছে যোগী সরকার। যদিও তা কৃষকের হাতে পৌঁছায় না। অধিকাংশই চলে যায় দালালের পকেটে। তাছাড়া, কৃষক হাতে পেলেও পশুখাদ্যের দাম যেখানে কুইন্টাল প্রতি ১,৫০০ টাকা, সেখানে প্রতিটি পশুর জন্য মাসে ৯০০ টাকায় কিছুই হয় না। গোরু সুরক্ষায় সরকার শুধু নাটকই করে চলেছে, বাস্তবে গোরুরা সবচেয়ে দুর্দশায়।
২০১৯, পশুসুমারির হিসেবে, ‘২০১২-১৯ এই সময়ে উত্তরপ্রদেশে গৃহপালিত গোরুর সংখ্যা কমেছে ২.৭৫ শতাংশ, যেখানে সারা দেশে বৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশ। অন্যদিকে, এই সময়ে গ্রামীণ-উত্তরপ্রদেশে বেওয়ারিশ গোরুর সংখ্যা বেড়েছে ১১৭ শতাংশ! ২০১২-তে যেখানে ছিল ৪ লক্ষ ৯৫ হাজার, ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১০ লক্ষ ৭০ হাজার।’ জানিয়েছে আইনজীবী, সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি পোর্টাল আর্টিকেল-ফোরটিন।
গো-সুরক্ষার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে যোগী সরকার। রাজ্যে ৫ হাজারের বেশি গোশালা খুলেছে। বেওয়ারিশ গোরু দত্তক নেওয়ার জন্য মাসিক অর্থ সাহায্য ঘোষণা করেছে। ২০১৭-তে গোরু বিক্রি বেসরকারিভাবে বন্ধ করার পর থেকে আদিত্যনাথ দাবি করে আসছেন, গোরু একটি ‘পবিত্র’ প্রাণী, সেকারণে চারবছর (২০১৭-২০) তিনি এজন্য ৭৬৪ কোটি টাকা খরচ করেছেন। ২০২০-২১’র রাজ্য বাজেটে এই খাতে ৩৯০ কোটি টাকা সংস্থান রেখেছেন। সবমিলিয়ে খরচ করেছেন ১,১৫৪ কোটি টাকা! মুখে গো-ভজনা করলেও এইসব গোশালায় না খেতে পেয়ে বহু পশুর মৃত্যু হচ্ছে।
বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচের এই আশঙ্কার কথা পাঁচবছর আগেই শুনিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিক অধ্যাপক বিকাশ রাওয়াল। গবেষণা করে বলেছিলেন, দশ বছরে বেওয়ারিশ পশুর সমস্যা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে যে, এই সব গোরু পালন করতে খরচ হবে প্রতিরক্ষা খাতের দেড় গুণ অর্থ! এখন সরকার পশুপালন, ডেয়ারি ক্ষেত্রে যে খরচ করে, ব্যয় করতে হবে তার ৩৫ গুণ! রাওয়াল বলেছিলেন, ‘আসলে এর পিছনে কোনো দিনই বিশেষ অর্থনীতি ছিল না। ছিল শুধু মানুষকে হেনস্তা করা, গোরক্ষার নামে রাজনীতি করা।’ সরকারি হিসেবে বেওয়ারিশ পশুর সংখ্যা আদৌ ঠিক না কি, আসলে সংখ্যাটা তার থেকেও বেশি, তা নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন।
বেওয়ারিশ গোরু যে বড়ো ইস্যু, বিরোধীরাও তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন। যদিও ভেবেচিন্তে সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলছেন। সমাজবাদী পার্টি যেমন ঘোষণা করেছে, দল জিতলে ষাঁড়ের গুঁতোয় কারো মৃত্যু হলে, তার পরিবারকে দেওয়া হবে ৫ লক্ষ টাকা। কংগ্রেস নির্বাচনী ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বেওয়ারিশ গোরুর তাণ্ডবে খেতের ক্ষয়ক্ষতি হলে প্রতি একরের জন্য দেওয়া হবে ৩ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ। ছত্তিশগড়ে ভূপেশ বাঘেলের মতো উত্তরপ্রদেশেও নেওয়া হবে ‘গোধন নয়া যোজনা’, কৃষকদের থেকে কিলোপ্রতি গোবর ২ টাকায় কিনবে সরকার।
সবমিলিয়ে তুমুল অস্বস্তিতে বিজেপি। বেওয়ারিশ গোরুই এখন মোদি-যোগীর মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।