E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৪ মার্চ, ২০২২ / ১৯ ফাল্গুন, ১৪২৮

সোচ্চার চিন্তা

ক্রিকেট, নিলাম এবং বাজার অর্থনীতি

পল্লব সেনগুপ্ত


আইপিএল-এ ক্রিকেটারদের নিলাম।

জীবনানন্দ দাশের একটা সুপরিচিত কবিতা - ‘১৯৪৬-৪৭’ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে এনে এই লেখাটা শুরু করলাম! তার একটা বড়ো কারণ, উদ্ধৃত অংশটার মধ্যে এমন কিছু শব্দ এবং অর্থের ব্যঞ্জনা আছে, যা আজকের ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতেও বিশেষভাবে তাৎপর্যময়। লাইনগুলো একবার স্মরণ করলেই কথাটা যে কতটা ঠিকঠাক বলছি সেটা বোঝা যাবে নিশ্চিতভাবে!... লাইনগুলো উদ্ধৃত করছি নিচেঃ
‘‘নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব - অথবা যা নিলেমের নয়
বহুকে বঞ্চিত করে দুজন কি একজন কিনে নিতে পারে;
সকলের জন্যে নয়, অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দুজনের হাতে
পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকেদের দাবী এসে
সবই নেয়...’’


নিশ্চয়ই মনে-মনে ভাবছেন যে, হঠাৎ সাম্প্রতিক ভারতের প্রেক্ষিতে এই কোটেশনের কী এমন গুরুত্ব আছে - যাকে তাৎপর্যময় বলেছি! আছে। এদেশে এখন নিলাম-ওরফে-নিলেমের যে বড়োই হাঁকডাক, বাড়বাড়ন্ত! ‘ভারতের জান্তব পল্টনের’ দু-চার পিস গেরুয়াধারী গুন্ডা ইতরতার চূড়ান্ত করে মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী কিছু মহিলাকে ‘ভার্চুয়াল’ নিলামে তুলেছিল মাত্র কিছুদিন আগেই। ‘বুল্লি বাই’ নামক সেই বাঁদরামি মহামান্য আদালতের দাবড়ানিতে আপাতত স্থগিত আছে অবশ্য। খাস কেন্দ্রীয় সরকারের উদযোগেই তো রেল স্টেশন থেকে এয়ার পোর্ট এবং বন্দর অবধি ‘প্রাইভেটাইজেশন’-এর নামে, বস্তুতপক্ষে তাঁদের আসল মনিব (জীবনানন্দের বিদ্রূপসিক্ত ভাষায়) ‘উঁচু লোক’-দের ‘দাবি’ মেটাতে নিলামেই তুলে দেওয়া হচ্ছে! জীবনবিমা থেকে রেলগাড়ি, ব্যাংক থেকে হাসপাতাল - ইউনিভার্সিটি, কলেজ, স্কুল - সর্বত্রই তো রাষ্ট্র পরিচালনার আওতা থেকে সরিয়ে ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে গিয়ে বা যেতে দিয়ে ‘উঁচু’ লোকেদের ধনসম্পত্তির আরও রমরমা ঘটতে দেওয়া হচ্ছে যে, সেও তো প্রকৃত প্রস্তাবে ‘নিলেম’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। ঘোরতর মোদি-বিরোধী বলে সর্বদা নিজেকে জাহির করা দিদি-সরকারও তো স্কুলশিক্ষা নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্যে যে খসড়া বানিয়েছে, তাও কিন্তু মোদি সরকারের নিলেমের ডাক (বা, ঢাক)-এরই নিখুঁত প্রতিধ্বনি! কেন্দ্রের নিলেম-বাদ্যির পিছনে রাজ্যের ট্যামটেমিও তো ‘‘নিলামওয়ালা ছে’ আনা, যা লেবে তা ছে’ আনা’’ গানের সঙ্গে ট্যানাক-ট্যানাক শব্দে বাজতে শুরু করতে চলেছে অচিরেই।

।।দুই।।

আসলে, আজকে এই দুর্মুখ (না-কি, দুর্লেখনী!) বৃদ্ধের কলমের নিবটা উঁচোনো আছে সদ্য-সদ্যই যে নিলাম নিয়ে আমজনতাকে উচ্চকিত করে তুলেছেন জনাদশেক ‘উঁচু’ আদমি এবং/কিংবা তাঁদের তিমি-তিমিঙ্গিল সাইজের বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সেই দিকে। আমি বলছি আইপিএল নামক খেলার দুনিয়ায় বৃহত্তম নিলামদারি মঞ্চে যে সব লাভ-লোভ-আশা-হতাশার নাটক হলো দু-দিন ধরে - সেটার কথাই।

আমেরিকায় দাস ব্যবসায়ীরা বন্দী কালো মানুষদের নিলাম ডাকছে।

আইপিএল নামক এই ‘গ্রেটেস্ট ক্রিকেট সার্কাস অন আর্থ’-এর এবারের নিলামে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ৬০০-র সামান্য কিছু কম নামী-অনামী প্রতিষ্ঠিত সদ্য দাঁড়ানো (কিংবা দাঁড়াতে উৎসুক) ক্রিকেটার নিজেদেরকে নিলামে তুলেছেন। মানুষকে একদা নিলামে তুলত ইয়োরোপ-আমেরিকার দাসব্যবসায়ীরা। সেখান থেকে সেই অভাগা ‘কালো’ মানুষদেরকে দরদাম পুষিয়ে কিনে নিত ‘শাদা’ মনিবরা। তারপরে ইতিহাস তো যাঁরা শ্রীমতী হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র লেখা বিখ্যাত ‘‘আংকল টম’স কেবিন’’ উপন্যাসটা পড়েছেন, তাঁরা সবাই জানেন। নিলামে-ওঠা সেইসব হাজার-হাজার দাসদাসীদের যে কী করুণ পরিণতি হতো, সে তো দুনিয়ার মানুষ জেনেছে। ইতিহাসের সেই করুণ নির্মম অধ্যায়ে যে নিলাম ডাকাডাকি হতো, সে সব ক্ষেত্রে যাঁদেরকে নিলামে চড়ানো হতো, তাঁরা অবশ্য নিজেদের ইচ্ছেয় তাতে চড়তেন না - তাঁরা ছিলেন পরিস্থিতির নিরুপায় ‍‌শিকার। কিন্তু এই আই পি এল সার্কাসের নিলামে যাঁদের নামের সঙ্গে লাখ-লাখ, কোটি-কোটি টাকার ‘গাজর’ ঝুলিয়ে হাঁকাহাঁকি হলো (প্রতিবছরই অবশ্য তা হয়), তাঁরা তো স্বেচ্ছায় নিজেদের নিলামের সওদাগিরির পাল্লায় তুলেছেন অর্থলাভের তাড়নায়! নিজের যোগ্যতা, ক্ষমতা, প্রতিভার মূল্যায়ন এভাবেই করতে ব্যাকুল হয়েছেন; আত্মসম্মানের অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে। দশটা দলে মোটামুটি যে দুশো মতো নিলামি ‘তারকা’ (অথবা, ‘পিদিম’ বা ‘টুনি বাল্‌ব’) ঠাঁই জোটাতে পারলেন, তাঁদের বাইরে বঞ্চিতের, হতাশের দলে থাকা বাকি চারশো জনের মতো ক্রিকেটার রইলেন, তাঁদের সবায়েরই যোগ্যতা, দক্ষতা - যাঁরা বিকিয়েছেন বা নিজেদেরকে বিকোতে পেরেছেন, তাঁদের থেকে কম - এমনটা কিন্তু নয়। কৃতী খেলোয়াড় অথচ নিলামে যাননি, এমনদের সংখ্যাও অজস্র। এ একটা বিচিত্র ভুলভুলাইয়া, যেখানে বহু প্রতিষ্ঠিত, প্রখ্যাত ক্রিকেটার - দেশি এবং বিদেশি - অখ্যাত, স্বল্পখ্যাত অনেকের চেয়েই ঢের-ঢের কম টাকা পেয়েছেন। রেস-খেলুড়েদের জবানিতে একটা লব্‌জ হরহামেশাই শোনা যায়ঃ ‘হর্সেস ফর কোর্সেস’ (মাঠ বুঝে ঘোড়া বেছে-নেওয়া) - এখানেও অবশ্য ক্রেতাদের সেইরকম একটা মানসিকতা সক্রিয় ছিল সম্ভবত। তারপর দলগুলোর মালিক-মালকিনদের মধ্যে ক’জন যে নিজেরা ক্রিকেট নামক জনপ্রিয় তবু অতি-জটিল খেলাটার সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ণ ব্যাপার-স্যাপারগুলো বোঝেন তা জানিনে (সম্ভবত কেউই বোঝেন না) - তাই তাঁদের নির্ভর করতে হয় নিজস্ব নাজির-মুৎসুদ্দি হিসেবে যাঁরা এক্ষেত্রে নিযুক্ত হন, তাঁদের উপর। সেখানে ব্যক্তিগত রুচি, মরজি, স্বার্থ এবং লুক্কায়িত কিছু-কিছু মহলের দেখানো ভয় এবং/অথবা দেখানোও খুব ক্রিয়াশীল থাকে। ক্রিকেট যাঁরা সত্যিই বোঝেন, তাঁরা যে ডাকাডাকির সময়ে থাকেন না, তা নয়। তবে, বহু-বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা নিরুপায়ঃ কর্তাদের ইচ্ছায়/আদেশে কর্ম সম্পন্ন করতে হয় তাঁদের। তা নইলে, যে ঋদ্ধিমান সাহাকে তাবড়-তাবড় ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ বিশ্বের অন্যতম সেরা উইকেট কিপার বলে গণ্য করেন, তাঁকে শেষবেলা অবধি পড়ে থাকতে হয়? তাঁর চেয়ে ঢের জুনিয়র এবং অনেক কম পরিচিত উইকেট কিপাররা বহু আগেই ডাক পেয়ে যান অনেক বেশি টাকার গ্যারান্টি পেয়ে। এমন কথা মনে করেন যদি কেউ যে, ভারতীয় ক্রিকেট মহলে চিরাচরিত ‘বঙ্গালখেদা’-জাতীয় ব্যাপারটার সূত্রেই (সৌরভ গাঙ্গুলি এখন বিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও) এমনটা ঘটেছে। ঋদ্ধিমানকে তাঁর বহু বিরল কৃতিত্ব সত্ত্বেও (একটা বিশ্ব রেকর্ডও আছেঃ বিপক্ষের এক ইনিংসে দশটা উইকেট ফেলে দেবার - ক্যাচ ধরে বা স্টাম্পড করে - এমন আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে!) তাঁকে এভাবেই ব্রাত্য করে রাখা হয় ভারতীয় দলে, এবং অধুনা নিলামেও।... নিলামের মাহাত্ম্য গাইছি না, শুধু ব্যাপারটা যে কী পরিমাণ ধোঁকার টাটি সেইটে বোঝাতে। বিশ্বের সেরা অল রাউন্ডার বলে চিহ্নিত শাকিব-আল-হাসানকে কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি নিতে চায়না, সেই রকমই অদৃশ্য সুতোর টানের বাবদেই। ছোটো ফর্ম্যাটের ক্রিকেট ‘ইউনিভার্সাল বস’ বলে যাঁকে মান্য করা হয়, সেই ক্রিস গেইলও একবার ‘অবিক্রীত’ থেকে গিয়েছিলেন বলে মনে পড়ছে। অথচ, সম্পূর্ণ অচেনা - মাত্র ১৭ বছর বয়সি এক কিশোর - যাকে তার স্বদেশ আফগানিস্তানেও বিশেষ কেউ চেনে না, সেও বিশ লাখপতি হয়ে গেল এবারে, অবশ্যই কোনও অলক্ষ ইঙ্গিতে!

এই সূত্রেই আরও একটা কথা বলি। প্রতিষ্ঠিত ‘ঝুনো’ হয়ে যাওয়ারা এভাবে নিজেদেরকে নিলেমে না হয় তুলছেন, তুলুন। কিন্তু এইভাবে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগেই যে এমন করে অর্থলাভের লোভানিতে হাবুডুবু খেতে দেখা যা‍‌চ্ছে; সেটাও তো খুবই মারাত্মক ব্যাপার। ভালো খেলার মানদণ্ড কী শুধুই লাখ-বেলাখি হতে পারা? ক্রিকেট জগতেরই প্রচলিত একটা কথাই যে বলতে ইচ্ছে করছেঃ ‘দিস ইজ নট ক্রিকেট!’

এই আইপিএল উন্মাদনার সূত্রে আরও একটা খুব গুরুতর কথা বিচার্য করতে হবে। যে দলগুলো খেলছে - ১০টা মোট - তাদের নামগুলো এক-একটা বড়ো শহর কিংবা কোনো কোনো রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে - যাতে ওই শহর বা রাজ্যের মানুষদের ব্যাপক সমর্থনে টিভিতে টিআরপি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ব্রান্ড বিজ্ঞাপনের পরিমাণও সেখানে রমরমিয়ে বাড়বে এবং ফলত, চ্যানেলগুলোর, কোম্পা‍নিগুলোর এবং দলগুলোর মালিকদের - সকলেরই মুনাফা ব্যাপক হারে বাড়বে। অর্থাৎ, ক্রিকেট সম্বন্ধে ভারতীয়দের অনুরাগ এবং নিজের শহর বা রাজ্য সম্পর্কে আবেগকে ভাঙিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির পরিপোষণ করারই একটা চমৎকার ‘খুড়োর কল’ হলো এই আইপিএল। বাজার-অর্থনীতির একটা অসাধারণ ধোঁকাবাজি ছাড়া একে আর কী বলবেন?

আরও একটা কথাঃ এই সব বিশেষ বিশেষ শহর বা রাজ্যের হয়ে খেলার জন্য যাঁদেরকে নামানো হয়, তাঁরা ক’জন সেই-সেই শহর বা রাজ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য টানে বাঁধা। যাকে এ বছর কলকাতা নাইট রাইডার্স কিনল, তো সামনের বারে হয়তো বেঙ্গালুরু কিংবা পাঞ্জাবের নামাঙ্কিত দলটা কেনার জন্যে মুখিয়ে থাকবে। হয়তো কিনেও ফেলবে। নইলে দেখুন না, এই কলকাতা নাইট রাইডার্সে কি একজনও কলকাতার ছেলে আছে? মহম্মদ শামি, ঋদ্ধিমান সাহাকে তাহলে গুজরাটের টিমে ঠাঁই পেতে হলো কেন? জাতীয় দলের দরজায়-কড়া-নাড়া অভিমন্যু ঈশ্বরন বা শাহবাজ আহমেদ কি ঈশান পোড়েল কলকাতার দলে ডাক পান না কেন?... কলকাতারই তো ছেলে তাঁরা... তাই না? তা হলে?

আসলে এই আইপিএল - নিলাম-মুনাফা-ধোঁকাবাজি - এদের এককথায় বলতে পারি বাজার-অর্থনীতির নতুন ব্যবসাদারি।