৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯
নভেম্বর বিপ্লবে প্রমাণিত হলো মার্কসবাদের ঐতিহাসিক সত্যতা
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
মার্কস লিখেছিলেন, ‘‘দার্শনিকেরা কেবল দুনিয়াটাকে ব্যাখ্যাই করেছেন বিভিন্নভাবে। কিন্তু আসল কথাটা হলো একে বদলাতে হবে।’’ (থিসিস অন ফুয়েরবাখ) মার্কসের সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের প্রথম সফল রূপায়ণ রাশিয়ার মহান নভেম্বর বিপ্লব। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লবের তোপধ্বনি সারা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে, সমস্ত মেহনতি মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘোষণা করল এক নতুন যুগের।
মহান নভেম্বর বিপ্লব ইতিহাসের প্রথম সাফল্যজনক সর্বহারার বিপ্লব। এই বিপ্লবের বিজয় পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশের মানব সমাজকে শৃঙ্খলমুক্ত করল। সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিকে আঘাত করে সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রার সূচনা করল। প্রায় ৭০ বছর আগে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ প্রকাশ করে মার্কস-এঙ্গেলস ভবিষদ্বাণী করেছিলেন যে, পুঁজিবাদী সমাজ ইতিহাসের অবক্ষয়িত শক্তি, তাকে অনিবার্যভাবেই পথ ছেড়ে দিতে হবে আগামী দিনের সুমহান কমিউনিস্ট সমাজের কাছে। নভেম্বর বিপ্লব সেই ঘোষণাকেই রূপায়িত করল। মানব প্রতিভার শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার মার্কসবাদকে বাস্তবায়িত করল। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর শুরুতে মার্কস ও এঙ্গেলস ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন - ‘‘ইয়োরোপ কমিউনিজমের ভূত দেখছে।’’ সেই ভূতকে ঠেকানোর জন্য বুর্জোয়াশ্রেণির প্রচেষ্টারও অন্ত ছিল না। অনেক বুর্জোয়া তাত্ত্বিক একে অবাস্তব জীবন দর্শন হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও করেছিলেন। মহান নভেম্বর বিপ্লবের বজ্রনির্ঘোষ সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাকে চুরমার করে দিয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের মতবাদের ঐতিহাসিক সত্যতাকেই প্রামণিত করল। বর্তমান দুনিয়ায় এই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এখন কোটি কোটি মানুষের জীবনের বাস্তব জীবনদর্শন। অন্ধকারময় সমাজের সামনে একমাত্র আলোকবর্তিকা।
।। দুই ।।
যে বিপুল শক্তিসম্পন্ন বিপ্লবী তত্ত্বের রূপায়ণ ঘটেছে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্যদিয়ে তার প্রথম অবিষ্কার মার্কস ও এঙ্গেলসের। মানব সভ্যতার বিকাশের এক বিশেষ স্তরে বাস্তব জগতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও মানুষের চিন্তা জগতের শ্রেষ্ঠতম ফসলগুলিকে বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মান দর্শন, ইংরেজদের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক মতবাদগুলি ও ফরাসি সমাজতন্ত্রের ধারণাগুলিকে আহরণ করেছিলেন তাঁরা, আর এই সবকিছুর মধ্য থেকে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন মানব সভ্যতার সব চেয়ে অগ্রসর, সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক, সত্য ও বিপ্লবী মতবাদ মার্কসবাদ।
এই মতবাদের প্রধান বিষয়গুলি তিনটি -
(১) মার্কস-এঙ্গেলসই প্রথম বস্তুবাদের সঠিক দার্শনিক ব্যাখ্যা উপস্থিত করলেন - চিরায়ত ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে ও বস্তুবাদের যান্ত্রিক ও বিকৃত ধারণাগুলির বিরুদ্ধে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে, মানব সভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণে এক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত করলেন। ‘‘যার মূলকথা হলো বাস্তব এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে জগতের আমরা অংশ তাই একমাত্র সত্য। আমাদের চেতনা বা চিন্তাকে যতই অতীন্দ্রিয় মনে হোক না কেন, এগুলি প্রকৃতপক্ষে বাস্তব দেহযন্ত্র অর্থাৎ মস্তিষ্ক প্রসূত। বস্তু চেতনা প্রসূত নয়, পরন্তু চেতনা নিজেই বস্তুর মহত্তম ফল।’’ এবং ‘‘সমগ্র প্রকৃতি; ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম, ধূলিকণা থেকে সূর্য প্রতিষ্ঠা, সজীব কোষ থেকে মানুষ পর্যন্ত নিয়ত আবির্ভূত ও প্রবাহিত হচ্ছে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে গতি ও পরিবর্তনের মধ্যে আছে।’’ (‘ডায়েলেকটিক্স অব নেচার’ - এঙ্গেলস)।
(২) পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল ‘রহস্য’ অর্থাৎ ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব’ আবিষ্কার করলেন। যাকে বলা যেতে পারে, মার্কসের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের চাবকাঠি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির সামগ্রিক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের পতনের অবশ্যম্ভাবিতা ও সর্বহারার বিপ্লবের অনিবার্যতাও প্রমাণ করলেন।
(৩) মানব ইতিহাসের সামগ্রিক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে মার্কস-এঙ্গেলস শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বও আবিষ্কার করলেন। ‘‘আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে (আদিম গোষ্ঠী সমাজ ছাড়া) তাদের সকলের ইতিহাস হলো শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।’’ আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজও মূলত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত - বুর্জোয়া ও সর্বহারা। এর মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম অনিবার্য। সর্বহারা শ্রেণির লক্ষ্য হবে বুর্জোয়াশ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা এবং শাসকশ্রেণি হিসাবে নিজেকে রূপান্তরিত করা। এ সম্পর্কে মার্কস লিখেছেন - ‘‘আমি নতুন যা প্রমাণ করেছি তা হলো - (১) উৎপাদন বিকাশের এক বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরে শ্রেণিগুলির অস্তিত্ব আবদ্ধ। (২) শ্রেণিসংগ্রাম নিশ্চিতভাবে সর্বহারার একনয়াকত্বে নিয়ে যায়। (৩) এই একনায়কত্ব নিজেই সর্বশ্রেণির অবলুপ্তি এবং শ্রেণিহীন সমাজের উত্তরণও ঘটায়।’’ (মার্কসের চিঠি ওয়েডমেয়ারের কাছে, ১৮৫২)।
।। তিন ।।
১৮৪৪-৪৫ সালেই মার্কস উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমসাময়িক বস্তুবাদী চিন্তাবিদদের অধিকাংশের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার একটি দিক হলো, তারা বাস্তবক্ষেত্রে বৈপ্লবিক কাজকর্মের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতেন। ইয়োরোপ জুড়ে তখন বুর্জোয়া শ্রেণির পাশাপাশি সর্বহারা শ্রেণিরও সংগ্রামের মধ্যে ঢেউ বইছে। মার্কস সঠিকভাবেই বুঝলেন এই সংগ্রামের মধ্যে বাস্তবে অবতীর্ণ না হতে পারলে বস্তুবাদী চিন্তা দুর্বল, একপেশে ও জীবনহীন হয়ে পড়বে। তিনি তাঁর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দার্শনিকতার সঙ্গে শ্রমিক সংগ্রামের বাস্তব কৌশলগত সমস্যাগুলিকে যুক্ত করলেন। এই প্রসঙ্গ আলোচনায় লেনিন তাঁর ‘কার্ল মার্কস’ প্রবন্ধে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। ‘দি পভার্টি অব্ ফিলসফি’তে মার্কস ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি গঠন করার মধ্য দিয়ে মজুরির জন্য সংগ্রামে শ্রমিকরা জড়ো হচ্ছে, পুঁজির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, সংগ্রাম প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। শেষপর্যন্ত সেই সংগ্রাম রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপান্তরিত হচ্ছে। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে এই বাস্তব রাজনৈতিক সংগ্রামের কর্মসূচি আরও নির্দিষ্ট হয়েছে। আশু সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্টদের শেষ লক্ষ্যে পৌঁছবার আহ্বানও জানানো হয়েছে। এই প্রশ্নে বিপুল গুরুত্ব পেয়েছে মতাদর্শগত সংগ্রাম। মার্কস-এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, গোটা ইয়োরোপের বর্জোয়ারা পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভিত্তির উপর গড়ে তুলেছে বুর্জোয়াদের মতাদর্শ। বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠান হলে এই মতাদর্শের প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। বুর্জোয়ারা সমাজতন্ত্রের ধারণাকে বিকৃত করেছে, অপরদিকে ইয়োটোপীয় (কাল্পনিক) পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের ধারণাও কম শক্তিশালী নয়।
‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে মার্কস-এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করলেন এই বিকৃত সমাজতন্ত্রের ধারণাগুলির মূল লক্ষ্য হলো - একটি সাধারণ নিয়মতান্ত্রিক সংস্কার। পুঁজি ও মজুরিশ্রমের সম্পর্কে পরিবর্তন নয়। শ্রেণিসংগ্রাম নয়। বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কের কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখাই এর মূল লক্ষ্য। কারণ তা পরিবর্তন করার লক্ষ্য মানে বিপ্লবের লক্ষ্য। মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ‘‘সমাজতান্ত্রিক বুর্জোয়ারা আধুনিক সামাজিক অবস্থার সুবিধাটা পুরোপুরি চায়, চায় না তৎপ্রসূত অবশ্যম্ভাবী সংগ্রাম ও বিপদটুকু। তারা সমাজের বর্তমান অবস্থা বজায় রাখতে চায়। কিন্তু তার বিপ্লবী ও ধ্বংসকারী ‘উপাদানসমূহ বাদ দিয়ে’। (কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো)।
মার্কস ও এঙ্গেলস, এই দুই মহান চিন্তানায়ক তাঁদের জীবনব্যাপী সমাজ পরিবর্তনের সমস্ত ঘটনায় সর্বহারা শ্রেণিসংগ্রামের একনিষ্ঠ যোদ্ধা হিসাবে গৌরবময় জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যে সংগঠনের ম্যানিফেস্টো হিসাবে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ প্রকাশিত হয়েছিল সেই সংগঠনের নাম ‘কমিউনিস্ট লিগ’। এর কর্মসূচি রূপায়িত করা, সংগঠনকে গড়ে তোলা ও ক্ষুদ্র হলেও এর মাধ্যমে এক বিপ্লবী সংগ্রাম বাহিনী হিসাবে সর্বহারার আন্দোলনকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁরা। ১৮৬৪ সালে মূলত মার্কস ও এঙ্গেলসেরই প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতি প্রথম আন্তর্জাতিক। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার প্রথম উজ্জ্বল পতাকা। কিন্ত তাঁদের জীবিত কালে সর্বহারার সফল বিপ্লব সমাধা হয়নি। কিন্তু সমাজ বিকাশের গতিধারাকে ব্যাখ্যা করে বিপ্লবের যে অনিবার্যতার কথা তাঁরা বলে গিয়েছিলেন - সেই বিপ্লবী মতবাদের প্রথম সফল রূপায়ণ হয়েছে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
।। চার ।।
মার্কস-এঙ্গেলস, পুঁজিবাদের সামগ্রিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ‘‘আজকের দিনে বুর্জোয়াদের মুখোমুখি যে সব শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে শুধু প্রলেতারিয়েত হলো প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। অপর শ্রেণিগুলি আধুনিক যন্ত্র শিল্পের সামনে ক্ষয় হতে হতে লোপ পায়। প্রলেতারিয়েত হলো সেই যন্ত্রশিল্পের বিশিষ্ট ও অপরিহার্য সৃষ্টি।’’ পুঁজিবাদের বিকাশের নানা পর্যায়ের মধ্যদিয়ে সর্বহারা শ্রেণিকেও যেতে হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে তারা দেশময় ছড়ানো, এলেমেলো জনতামাত্র, পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ছত্রভঙ্গ। তখনও ইতিহাসের সমস্ত গতিটি বুর্জোয়াশ্রেণির হাতের মুঠির মধ্যে। যন্ত্রশিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সর্বহারারা শুধু সংখ্যায় বাড়ে না, নিজেদের শক্তিকেও তারা উপলব্ধি করে। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের অভ্যুদয় শ্রমিকশ্রেণির এই দ্বিতীয় স্তরের লক্ষণ। শুরু হয় শ্রেণিসংগ্রাম। শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন যখন ‘বিরাট সংখ্যাধিক্যের আত্মসচেতন স্বাধীন আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে থাকে, যখন সর্বহারাশ্রেণি উপলব্ধি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা জয় করা সর্বহারা শ্রেণির পক্ষে এক মহান কর্তব্য হিসাবে উপস্থিত হয়েছে’, যখন ‘ইতিহাসের সমস্ত গতিকে তত্ত্বের দিক থেকে বুঝতে পারার স্তরে নিজেদের তুলতে পেরেছে’ তখন সর্বহারাশ্রেণি নিজের মুক্তির জন্য, গোটা সমাজের মুক্তির জন্য ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসাবে এগিয়ে যাবেই।
সর্বহারাশ্রেণির এই ঐতিহাসিক ভূমিকার লক্ষ্যে বাস্তব পরিকল্পনা হিসাবে; ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন যা হলো ‘কমিউনিজমের স্কুল’ তার গুরুত্ব এবং শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির প্রয়োজনীয়তা এবং তার মূল নীতিগুলির প্রাথমিক রূপরেখা মার্কস-এঙ্গেলসই রচনা করে গেছিলেন।
রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের অন্তরালে শ্রমিকশ্রেণির এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধারাবাহিকভাবেই মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। এই সংগ্রামের প্রধান সংগঠন ও তাত্ত্বিক ছিলেন মহান লেনিন। প্রাক্ বিপ্লব রাশিয়ায় অত্যাচারী জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন মতবাদের দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। মার্কসবাদী চিন্তার একটি ধারাও অনিবার্যভাবে গড়ে উঠেছিল। কমরেড লেনিন তাঁর তরুণ বয়সেই মার্কসবাদী দর্শনের আলোয় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। শক্তিশালী ‘নারদনিক’ মতবাদের বিরুদ্ধেই তিনি প্রথম কলম ধরেছিলেন। যে মতবাদের মূল কথা ছিল রাশিয়ার পুঁজিবাদী বিকাশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, সমাজবিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে নাকচ করা। তাঁরা সংগ্রামের মধ্যে কৃষক জনতার ওপরই কেবল নির্ভরতার কথা ও পন্থা হিসাবে সন্ত্রাসবাদের অনুসরণ করতেন। লেনিন প্রথমেই নারদনিকদের মতাবাদকে খণ্ডন করেন। পূর্ব সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত অবস্থায় (১৮৯৭-৯৯) রচনা করলেন ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’। এই গ্রন্থ রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক আন্দোলনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করল। প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদের মৌলিক সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়েই রাশিয়ায় জারতন্ত্রের উচ্ছেদ ও মুক্তির লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণির কর্তব্যকে নির্দিষ্ট করল। রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রাক্কালে ‘কি করিতে হইবে’ গ্রন্থখানি শ্রমিক আন্দোলনের সামনে মশাল তুলে ধরল। শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে সমস্ত দক্ষিণ ও বামপন্থী সুবিধাবাদী ঝোঁকের বিরুদ্ধে, ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রামের চরিত্র ও ইতিকর্তব্য, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত সংগ্রামের গুরুত্ব সর্বোপরি শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণী বাহিনীর নতুন ধরনের বিপ্লবী পার্টি ও তার বিপ্লবী লক্ষ্য সম্পর্কে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হলো। বলাবাহুল্য বিপ্লবের প্রস্তুতিতে বিপ্লবী পার্টির সঠিক বিপ্লবী ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামই মহান নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। মার্কস-এঙ্গেলস বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে সর্বহারার যে ভূমিকার কথা বলেছিলেন, রাশিয়ার সর্বহারা শ্রেণি গৌরবের সঙ্গে সেই ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন, সফল করতে পেরেছেন মানব ইতিহাসের প্রথম সফল বিপ্লব। যে বিপ্লব একশ্রেণি কর্তৃক আর এক শ্রেণিকে শোষণের ধারাবাহিক ইতিহাস থেকে মানব সমাজকে মুক্ত করল। আর এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিল সর্বহারাশ্রেণি। যাদের ‘শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছুই নেই’। পুঁজিবাদী সমাজের সমাধি খননকারী এই শ্রেণিই যে আগামী দিনের ইতিহাসের স্রষ্টা নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা বাস্তবে প্রমাণিত হলো।
।। পাঁচ ।।
মার্কস ও এঙ্গেলস যখন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ রচনা করছেন তখন জার্মানিতে বুর্জোয়া বিপ্লবের যুগ। এই বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পর্কে সর্বহারাশ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে? কমিউনিস্টরা কী ভূমিকা গ্রহণ করবে? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তখনই উত্থাপিত হয়। সর্বহারাশ্রেণি তখনও বুর্জোয়া বিপ্লবের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেনি। তবুও বুর্জোয়াদের সঙ্গে রাজতন্ত্র, সামন্ত জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই কমিউনিস্টদের দায়িত্ব বলে চিহ্নিত করেছিলেন মার্কস-এঙ্গেলস। কারণ ‘‘জার্মানির বুর্জোয়া বিপ্লব হবে অদূরবর্তী সর্বহারা বিপ্লবের ভূমিকামাত্র।’’ কারণ ইতিহাসের গতি দাঁড়িয়ে থাকবে না। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লবের মতবাদই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁরা।
মার্কস-এঙ্গেলসের এই সিদ্ধান্তকে সাম্রাজ্যবাদের যুগে ইতিহাসের নতুন পটভূমিতে চূড়ান্ত সাফল্যে উন্নত করলেন লেনিন। সাম্রাজ্যবাদের যুগ হলো সর্বহারা বিপ্লবের প্রাক্কাল। এই যুগে বুর্জোয়া বিপ্লবের নেতৃত্ব করবে সর্বহারাশ্রেণিই। বুর্জোয়ারা নয়। পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের যুগে বুর্জোয়াদের সেই ভূমিকা অবলুপ্ত হয়েছে। ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল ডেমোক্রাসির দুই কৌশল’-তে লেনিন সুসংহত সিদ্ধান্ত টানলেন, ‘‘স্বৈরতন্ত্রের প্রতিরোধকে বলপ্রয়োগে চূর্ণ করার জন্য এবং বুর্জোয়া শ্রেণির অনিশ্চিত মনোবৃত্তিকে পঙ্গু করে দেবার জন্য কৃষক সাধারণের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে প্রলেতারিয়েত শ্রেণিকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে পূর্ণ সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে হবে।’’ পরবর্তী স্তরে, - ‘‘বুর্জোয়াশ্রেণির প্রতিরোধকেও বলপ্রয়োগে চূর্ণ করার জন্য এবং কৃষক সম্প্রদায় ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের অনিশ্চিত মনোবৃত্তিকে পঙ্গু করে দেবার জন্যও জনগণের মধ্যে যারা আধা-প্রলেতারিয়েত তাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে পূর্ণ সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে হবে।’’
১৯১৭ সালের মার্চ বিপ্লবের সাফল্য মাঝপথে থেমে যায়নি। নভেম্বর বিপ্লবের চূড়ান্ত সাফল্যে উন্নীত হয়েছে। বিপ্লবী রণনীতির এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে মহান নভেম্বর বিপ্লব।
(আগামী সপ্তাহে সমাপ্ত)
[দেশহিতৈষী’র ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত।]