৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯
বাংলার চিন্তাচেতনায় নভেম্বর বিপ্লব
মালিনী ভট্টাচার্য
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ মুজফ্ফর আহ্মদের রাজনৈতিক জীবনের আদিপর্ব নিয়ে সুচেতনা চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যবান বইটির এক কোণে তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের ডায়েরি থেকে এক ভিন্নরকম মানুষের উল্লেখ পাই। হবিবুল্লাহ খান নামে ম্যাট্রিক ফেল এই তরুণ মুজফ্ফরের মতোই নোয়াখালি থেকে কলকাতায় এসে ১৯২০ সালে পুলিশের নজরে পড়েন, কারণ তিনি খিলাফত আন্দোলনের এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন; প্রকাশ্য আলাপচারিতায় বলশেভিকবাদের এবং ইসলামের বিশ্বজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে প্রায়ই আবেগপূর্ণ ভাষণও দিতেন। পুলিশ শেষতক সাব্যস্ত করে প্রকৃতপক্ষে নিরীহ, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গেঁয়ো ছেলেটি শহরে এসে হাভাতে পরিস্থিতিতে কিছুটা মস্তিষ্কবিকৃতির ফলে ভ্রান্তিবিলাসে মগ্ন।
হবিবুল্লাহ-র হয়তো মাথা খারাপই ছিল। কিন্তু একদিকে নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণ সমাজের দিশাহারা ভাব, অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক পথের সন্ধানে আকুলতা - হবিবুল্লাহর গল্প পরাধীন ভারতের ইতিহাসের এই যে মোড়টির সন্ধান দেয় তার থেকেই তো জন্ম নেন মুজফ্ফর আহ্মদ নিজেও। এমন তরুণদের চিন্তাচেতনায় বলশেভিকদের প্রভাব নিয়ে ইংরেজদের পুলিশ কেন এতটা মাথা ঘামাচ্ছিল আসলে তার আভাসই এই গল্পটি দিচ্ছে। ‘ইংরেজ গভর্নমেন্টের চিরন্তন জুজু’ রুশদের নিয়ে প্রচারের কথা রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তেও রয়েছে। সেখানে যখন ১৯১৭-তে জারের জমানা ঘুচিয়ে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ সরকার কায়েম হলো, আবার অচিরেই বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে এক নতুন সমাজের গোড়াপত্তন করলো, তখন ঔপনিবেশিক পুলিশ-প্রশাসন ও প্রচারযন্ত্র তাতে বিপদ দেখবে এটাই স্বাভাবিক।
যেটা আসল প্রশ্ন তা হলো দূরত্বের বাধা, পুলিশি বাধা, ভাষার বাধা, প্রযুক্তির বাধা সবকিছু পেরিয়ে মুজফ্ফর বা পুলিশ রিপোর্টের হবিবুল্লাহ বা ভারতের কিছুটা লিখতে পড়তে জানা একটি প্রজন্মের কাছে নভেম্বর বিপ্লবের চিন্তাভাবনা কী করে পৌঁছে গেল? এ যেন মাটি প্রস্তুত ছিল, তাই বহুদূর থেকে বীজ উড়ে এসে তাতে নতুন জীবনের সঞ্চার করল। ইংরেজ জমানায় তাদের বিচারে বিপজ্জনক বইপুস্তক পাওয়া ছিল খুবই কঠিন। তাসত্ত্বেও নভেম্বর বিপ্লবের প্রায় পাঁচ দশক আগেই তো কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কথা কলকাতায় পৌঁছেছিল। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের বছরে প্রথম আন্তর্জাতিকের দপ্তরে অজ্ঞাতনামা কোনো কলকাতাবাসীর আবেদন পৌঁছেছিল কলকাতায় একটি শাখা খোলার জন্য। ১৮৭৪ সালে শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভারত শ্রমজীবী’ পত্রিকা, যেখানে মানবসভ্যতার বিকাশে শ্রমিকের আগুয়ান ভূমিকা ছিল প্রতিপাদ্য। ১৮৭৬ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর একটি বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয় বলে জানা গেছে।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে রুশ বিপ্লবেরও আগে ‘নিহিলিস্ট রহস্যে’র মতো বইপড়ার কথা বলেছেন নজরুল ও মুজফ্ফরের বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। বলেছেন টলস্টয় দস্টয়েভস্কির পাশাপাশি গোর্কির লেখা পড়ে শ্রেণিসংঘাতের বিষয়টি আরও ভালো করে বুঝতে পারার কথা।মুজফ্ফর আহ্মদ ও আবদুল হালিম ১৯২১-২২ সালে লেনিনের Leftwing Communism: an Infantile Disorder এবং How Will Bolsheviks Retain Power? এই দুটি বইয়ের সন্ধান পেয়েছিলেন, যদিও মুজফ্ফর জানান এক বলশেভিক- বিরোধীর লেখা ‘দাস ক্যাপিটালে’র সংক্ষিপ্তসার ছাড়া মার্কস-এর কোনো রচনাই তিনি জোগাড় করতে পারেননি।
হালিম বলেছেন ক্রোপোটকিন, বাকুনিন, লাফার্গ ও বেবেলের লেখার মাধ্যমে অস্পষ্টভাবে হলেও শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণি-রাজনীতির সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ের কথা। এঙ্গেলস-এর Origin of Family, Private Property and the State-এর নামও এ তালিকায় ছিল। সাধারণ্যে লভ্য না হলেও আগ্রহীর হাত থেকে ব্রিটিশ সরকার এসবকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। ক্রমে ক্রমে কোনো কোনো বই বাংলাতেও অনুবাদ হয়েছে। সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকায় ১৯২৫ সালে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে গোর্কির ‘মা’ প্রকাশ পেতে শুরু করে; ১৯২৫-৩৮-এর মধ্যে এই বইটির চারটি অনুবাদ হয়েছিল বলে জানা যায়।
রুশ বিপ্লবের খবর বাংলায় অনেকটাই আসত পাশ্চাত্যের একপেশে মিডিয়ার হাতবদল হয়ে।ই পি স্টেবিং, রিজ উইলিয়ামস প্রমুখের বয়ানে বিপ্লবের ঘটনাবলির কিছুটা সহানুভূতিশীল বিবরণও কিন্তু বিপ্লবের পরের বছরগুলিতে বাংলা অনুবাদে লভ্য হয়। সরাসরি সংযোগের একটি সূত্র ছিল নজরুলের মতো যুদ্ধফেরত ফৌজিদের মধ্যে।১৯২০ সালে নজরুল দেশে ফেরার আগে ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’য় তৎকালীন বেলুচিস্তানের প্রেক্ষাপটে তাঁর ‘ব্যথার দান’ গল্পটি প্রকাশিত হবার সময়েই মুজফ্ফর খেয়াল করেছিলেন সেখানে নায়ক সয়ফুলমুল্কের ‘উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধরত ‘লালফৌজে’ যোগ দেবার উল্লেখ; পুলিশের নজরে পড়বে একারণে গল্পটি ছাপানোর সময়ে নজরুলকে জিজ্ঞাসা না করেই তিনি কথাটি বদল করে করেছিলেন ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’।
যাঁরা নজরুলের মতোই উনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গলি ব্যাটেলিয়নে ছিলেন এবং দেশে ফিরেছিলেন নানা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁদের মধ্যে মুজফ্ফর উল্লেখ করেছেন ‘লাঙলে’র সম্পাদক-হিসাবে যে মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম লেখা হতো তাঁর। নজরুলের আরো দুজন বন্ধু ছিলেন শম্ভু রায়, যিনি ওই ব্যাটেলিয়নে জমাদার-পদে ছিলেন, ছিলেন অর্গ্যানমাস্টার নিত্যানন্দ দে এবং বিউগল বাদক ‘গোপী’। করাচিতে তাঁদের ব্যারাকটির ওপর কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর ছিল। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘সেন্সর’-এর হাত এড়িয়ে রাওলাট কমিটির রিপোর্ট এবং রুশবিপ্লব-সংক্রান্ত কিছু নিষিদ্ধ দলিলপত্র সেখানে নজরুলের হাতে পৌঁছাত বলে জানিয়েছেন শম্ভু রায়। একবার লালফৌজের কোনো বিশেষ জয় উপলক্ষে নজরুলের ঘরে গোপনে একটি উৎসবেরও আয়োজনও হয়েছিল।
১৯২০ সালে নজরুল কলকাতায় এসে থিতু হবার পরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়ায় শুধু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে নয়, শ্রমিকপল্লির ভিতরেও। এসময়ে যেখানেই তিনি গেছেন কবিতা ও গানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার অভিব্যক্তি শত্রুর সংখ্যা ছাপিয়ে আন্দোলিত করেছে তাঁর অজস্র গুণমুগ্ধদের। এই খোলামেলা অভিব্যক্তিতে আবেগোচ্ছ্বাসের অংশ যতোই থাকুক, ছোটোবেলা থেকে যে কবির ভাষা, গায়কের কণ্ঠ, লোকরঞ্জনের দক্ষতা তিনি আয়ত্ত্ব করেছিলেন নিছক রাজনৈতিক আলোচনা বা বক্তৃতার চাইতে তার সহজ আকর্ষণীশক্তি ছিল অনেক বেশি। মুজফ্ফরের সঙ্গে তাঁর চারিত্রিক বৈপরীত্যসত্ত্বেও মুজফ্ফর তাঁর এই ক্ষমতার প্রকৃত জহুরি ছিলেন, কবির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের চাবিকাঠি ছিল এইখানেই।
‘নবযুগ’, ‘গণবাণী’ পত্রিকায় তাঁদের মণিকাঞ্চনযোগ পরাধীন ভারতের প্রেক্ষিতে শ্রমিকশ্রেণিকে নিয়ে বৈপ্লবিক চিন্তার বীজতলার প্রাথমিক কাজ যে করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। ‘লাঙল’ বা ‘ধূমকেতু’তেও নজরুলের সাংবাদিকতার দিশা ছিল এমনই। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের গুণগ্রাহী নজরুল রাজনৈতিক কবিতায় কতকাংশে সেই অগ্রজের পথ অনুসরণ করেছেন। কিন্তু ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর প্রলয় নতুন সৃজনবেদন’ এই অভিনব মাত্রা যখন তিনি যোগ করেন বা ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে যখন তিনি শুধু শ্রেণিসাম্য নয়, লিঙ্গসাম্যকেও প্রতিষ্ঠিত করেন ‘বারাঙ্গনা’র সন্তানের সমতার দাবিকেও তার অঙ্গীভূত করে, তখন কি তিনি নভেম্বর বিপ্লবের পরবর্তী সামাজিক পরীক্ষানিরীক্ষাগুলির কথাই ভাবছেন না? ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে আনসারের চরিত্রে বলশেভিক বিপ্লবীর ছায়া কি নেই? আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের বাংলায় প্রথম অনুবাদকও তো নজরুলই।
১৯১০ এবং ১৯২০র দশকেরও কিছুটা জুড়ে ভারতে শিল্প-শ্রমিকরা দৃশ্যমান হয়ে উঠছিলেন একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলনকে আশ্রয় করে। অসহযোগ-কর্মসূচি পরিত্যক্ত হবার পরেও শিল্পক্ষেত্রে শ্রেণিবিক্ষোভের ঢেউ বিকল্প পথের অস্পষ্ট নিশানা দেখাচ্ছিল, সোভিয়েত রাষ্ট্রে শ্রমিকশ্রেণির নিজস্ব জমানা গড়ে তোলার উদ্যোগকে তাই ভারতের তৎকালীন রাজনীতিতে অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। ১৯২৩ সালে ‘সংহতি’ পত্রিকায় সন্তোষকুমারী গুপ্তার ‘বাংলার চটকলের কথা’ শ্রমিকের চেতনা-উন্মেষের সেই আভাস দেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ইয়োরোপের আগ্রাসন-বিরোধী খিলাফতি প্যান-ইসলামবাদ, ইটালি, জার্মানি এবং জাপানের বিজয়পিপাসু কট্টর জাতীয়তাবাদও মুক্তির পথসন্ধানী ভারতীয় মানসে কম আলোড়ন তোলেনি। বলশেভিক বিপ্লবের বার্তাকে সেখানে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হয়েছিল আদর্শগত এইসব প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করেই।
শিপ্রা সরকার ও অনমিত্র দাশ-সংকলিত ‘বাঙালির সাম্যবাদচর্চা’ বইটিতে ১৯১৭-১৯৪৭এর মধ্যে বাংলা পত্রপত্রিকা ও পুস্তিকায় প্রকাশিত যে ধরনের লেখা পাওয়া যাচ্ছে তার একটি বড়ো অংশ একেবারে ১৯১৭ সাল থেকেই নভেম্বর বিপ্লব ও বলশেভিকবাদের ওপর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা, কোথাও আশাবাদ, কোথাও তথ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়নের চেষ্টা, কোথাও ত্রস্ত বিপদসংকেত।শুধু প্রান্তিক বামপন্থী প্রকাশনা নয়, এমন আলোচনা পাওয়া যাচ্ছে ‘প্রবাসী’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘নারায়ণ’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাতেও। ৩০ জানুয়ারি, ১৯২৪এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ‘মহামতি লেনিন, মানবমিত্র লেনিনে’র মৃত্যুতে ‘আদর্শের বহুল পার্থক্য’ সত্ত্বেও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছে।
‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’তে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়াতে সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকেই শুধু স্বাগত জানানো হয়নি, ‘নারায়ণ’-এ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘প্রবাসী’তে অমলচন্দ্র হোম পরবর্তী পর্বে শ্রমিকরাষ্ট্র সম্বন্ধে হাজার সংশয় রেখেও, ক্রনস্টাড অভ্যুত্থান ও লেনিনের নয়া কৃষকনীতি সম্বন্ধে বহু প্রশ্ন নিয়েও ‘নবোত্থিত গণশক্তি’র সম্ভাবনাকে অস্বীকার করেননি। আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের রিপোর্ট ১৯২১ সালে প্রকাশ করেছে ‘প্রবাসী’। অন্যত্র ‘রাশিয়ান সোভিয়েতসমূহে রীতিমতো শাসন ও বিচারের বন্দোবস্ত আছে.. অন্যান্য সভ্যদেশের অপেক্ষা রাশিয়াতেই গণতন্ত্রপ্রথা ও নির্বাচনপ্রথা সর্বাপেক্ষা পুষ্টি ও বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে’ - এ বিবৃতির পরে স্টালিন-আমলে তা কতটা অটুট আছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রাশিয়ার যৌননীতি, তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও আইনব্যবস্থা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সদ্যজাগ্রত রুশ জাতীয়তাবাদকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩০)এইসব পর্যালোচনাতে এক অমূল্য অধ্যায় যোগ করেছে।
বাঙালির সাম্যবাদচর্চায় নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবের আরও অনেক উদাহরণ উপরোক্ত সংকলনটি থেকেই দেওয়া যায়। আবুল হোসেনের ‘বাংলার বলশি’ (১৯২১) ভবিষ্যৎবাণী করে যে কৃষকের বঞ্চনা বাংলায় বলশেভিক চেতনার গোড়াপত্তন করবে। নলিনী গুপ্তের বলশেভিক দূষণের জবাব দেন শিবরাম চক্রবর্তী ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরি’তে (১৯২৯)। ১৯২৯এ ‘মাসিক বসুমতী’ ‘বলশেভিক বিভীষিকা’র অজুহাত তুলে এদেশে বিনাবিচারে কমিউনিস্টদের অপরাধী করার ব্রিটিশ তৎপরতার খোলাখুলি সমালোচনা করে। শ্রমিকবিক্ষোভ কেন তার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের পরামর্শ দেয়। নির্মলকুমার বসুর ত্রিশের দশকের দুটি প্রবন্ধে (১৯৩৫-৩৬) একদিকে তিনি ‘হিন্দু সোশ্যালিজমে’র তত্ত্বকে খারিজ করেন, অন্যদিকে গান্ধীবাদের সঙ্গে সাম্যবাদের পার্থক্য নির্ণয় করেন। প্রবন্ধ দুটি বিশেষভাবে কৌতূহলজনক, তিনি বলশেভিজমকে ‘শূদ্র-অধিকারের’ প্রতিষ্ঠার নীতি হিসাবে দেখছেন এই কারণে, কিন্তু নলিনী গুপ্তের মতো রক্ষণশীল বিচারধারা থেকে নয়।
‘গণবাণী’, ‘সংহতি’, ‘সর্বহারা’ পত্রিকার আলোচনার চাইতেও এইসব নিবন্ধকে এখানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি এই কারণে যে, পূর্বোক্তগুলির তো নির্দিষ্ট মতাদর্শগত একটি চরিত্র ছিলই যার জন্য তাদের ওপর পুলিশের নজর সর্বদাই থাকত, কিন্তু ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ বা ‘মাসিক বসুমতী’ ছিল সাধারণ ‘অরাজনৈতিক’ পাঠক সমাজের জন্য। সেখানে এধরনের লেখার উপস্থিতি এব্যাপারে তাদের আগ্রহেরও একটি পরিমাপ জোগায়। কুড়ির দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এক গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। অসহযোগ কর্মসূচি তাতে যে উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল হঠাৎ করেই তার প্রত্যাহারে মানুষের আশাভঙ্গের পর্বে রুশবিপ্লবের সমাজ-পালটানোর বার্তার ছিল বিশেষ তাৎপর্য। বিশেষত তৃতীয় আন্তর্জাতিক উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামকে যে সমর্থন জানিয়েছিল সেই সংগ্রামের পক্ষে তাও ছিল এক নতুন জিনিস।
পরবর্তী দুই দশকে বাংলার কথাসাহিত্য, কবিতা, চিত্রশিল্প, নাট্যকলা এবং যাবতীয় সৃজনশীলতার ক্ষেত্রকেও আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের সংবেদন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উর্বর করে তুলবে, সংস্কৃতিতে শ্রেণির বেড়াকে নাড়িয়ে দেবে। বাস্তববাদ এবং আধুনিকতার প্রেক্ষিতকে নতুনভাবে বিকশিত হতে সাহায্য করবে। সেই সঞ্জীবনী মন্ত্র আরও কয়েক দশক ধরে বাংলার সংস্কৃতিকে দেবে ভিন্ন মাত্রা। এখানে তার সূত্রপাতটুকুরই কিছু হদিশ দেবার প্রয়াস করা হলো।
সূত্রঃ
● মুজফ্ফর আহ্মদ / ‘কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’ (কলকাতা ১৯৮১)।
● পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় / ‘চলমান জীবন’ (কলকাতা, ১৯৯৪)।
● শিপ্রা সরকার ও অনমিত্র দাশ (সংকলিত) / ‘বাঙালির সাম্যবাদচর্চা’ (কলকাতা ১৯৯৮)।
● ‘An Essay on Rabindranath and Gorky’ by Rabin Pal. (https://www.parabaas.com/rabindranath/articles/pRabin_RT&Gorky.htm)
● ‘An Early Communist: Muzaffar Ahmad in Calcutta 1913-1929’, Suchetana Chattopadhyay, New Delhi, 2011.