E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিঃ নতুনভাবে বেঁচে থাকার কথা

ঈশিতা মুখার্জি


‘Our unity is undestroyable!’ (সোভিয়েত পোস্টার)

১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুনভাবে বেঁচে থাকার পথ খুলে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে অর্থনীতি চালনা করা এবং মানুষের বেঁচে থাকার উৎকর্ষ উপাদান যে তৈরি করা সম্ভব, তা বাস্তবে চাক্ষুষ করা গিয়েছিল ১৯১৭ সালের পর। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক অর্থনীতি যে উৎকর্ষ অর্থনীতির জন্ম দিতে পারে, তা সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির অভিজ্ঞতা না থাকলে অনুধাবন করা সম্ভব ছিল না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা চালনা করেছিল গোটা দেশকে। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক অর্থনীতির ভিত্তি কী? কীভাবে তা পুঁজিবাদী অর্থনীতির চেয়ে আলাদা? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আলোচনা করা প্রয়োজন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদনের ধরন এবং উৎপাদন সম্পর্কের ভিন্নতা প্রসঙ্গে। তাহলেই বোঝা সম্ভব যে কেন সমাজতন্ত্র বেঁচে থাকার একটি উন্নত ব্যবস্থা।

পরিকল্পনার কথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বা আমাদের দেশের মতো মিশ্র অর্থনীতিতে শোনা গেলেও পরিপূর্ণভাবে পরিকল্পনার ভিত্তিতে উৎপাদন, বণ্টন ও শ্রম নিয়োগ সম্ভব হয় না যদি না সেটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদনের উপাদানের মালিক পুঁজিপতিরা। সেই ব্যবস্থায় উৎপাদনের একমাত্র কারণ মুনাফা অর্জন।শ্রমকে সেই ব্যবস্থায় দেখা হয় পণ্য হিসেবে এবং শ্রমশক্তির দাম হিসেবে মজুরি দেওয়া হয়। এই ভাবে শোষণের ভিত্তিতে মুনাফা বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা তখনই ক্রমাগত বাড়ানো সম্ভব যখন বেকারি থাকে। ঠিক এই কারণেই কোনো পুঁজিবাদী দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে বেকারি নেই। শ্রমিককে কাজ হারানোর সম্ভাবনার মুখে সবসময়ে রেখে দিলে তাহলেই মজুরি ক্রমাগত কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি বেকারি ও দারিদ্র্য।বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানগুলি খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদি জোটানো কঠিন হয়ে পড়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। ১৯১৭ সালের বিপ্লব গোটা বিশ্বকে নতুনভাবে বেঁচে থাকার নিদর্শন তৈরি করে দিয়েছিল।

প্রথমত, উৎপাদনের উপাদানের অধিকার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে যা শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপত্তি হয় না। এই উদ্বৃত্ত মূল্যই মুনাফার জন্ম দেয় এবং শোষণের কারণ। সমাজতন্ত্র সামাজিক উৎপাদন সম্পর্ক, পরিকল্পনা ভিত্তিক উৎপাদন, মজুরির কথা বলে। শ্রমের উৎপাদনক্ষমতা এই ব্যবস্থায় বাড়ানো সম্ভব হয় শোষণ ছাড়া। পণ্য উৎপাদন যেহেতু সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় হয়,মার্কসীয় অর্থনীতির নিয়মে সেই পণ্যের মূল্য থাকে। মূল্য থাকে কিন্তু উদ্বৃত্ত মূল্য থাকে না। মূল্য আর দামে ফারাক থাকে।মূল্যের ব্যবহারিক মূল্য থাকে, বিনিময় যোগ্যতাও থাকে, কিন্তু বাজার দাম স্থির করে না। পণ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ দিয়েই একমাত্র অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় না। পণ্যের বাজারের উপর মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে না। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রাষ্ট্র বণ্টন এবং সরবরাহ করে। পণ্য-সর্বস্ব অর্থনীতি নয় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। এটি উন্নত জীবনের খোঁজ দেয় কারণ সমাজতান্ত্রিক দেশে খাওয়া-পরা-থাকা জোগাড় করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেই দেশের মানুষের একমাত্র কাজ হয় না শুধুমাত্র বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করা। সেই কাজ রাষ্ট্রের। আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি তো পণ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পণ্যের সরবরাহ, কেনাবেচা সর্বস্ব এক অর্থনীতি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পণ্য এই ভাবে বেঁচে থাকা নিয়ন্ত্রণ করে না। পুঁজিবাদীদের ছাড়াই পণ্য উৎপাদন হয় এবং সরবরাহ করা হয়।সমাজতন্ত্রে পণ্যের ভূমিকা মুখ্য নয়। এই ব্যবস্থাতেও মুদ্রা আছে, টাকা আছে, ঋণের ব্যবস্থা আছে; ব্যবসা বাণিজ্য আছে কিন্তু সবকিছুই আছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়মে বাঁধা। এক নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা, এক নতুন উৎপাদন সম্পর্ক স্থাপন করা হয় সমাজতন্ত্রে। নতুন এই কারণে যে তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে।পুঁজিবাদী দুনিয়ায় পণ্য উৎপাদন পুঁজির স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত, যা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয় এবং গোটা উৎপাদন ব্যবস্থাই সংকটে জর্জরিত হয়ে যায়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের স্বার্থে উৎপাদন এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হয়।এর জন্য পুঁজিবাদী সরবরাহ ব্যবস্থা যা উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা কেন্দ্রিক হয়, তার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে।

‘We are for peace!’ (সোভিয়েত পোস্টার, ১৯৪৭)

এইভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন হয় যা নিঃসন্দেহে উন্নত জীবনযাত্রা নিয়ে আসে। এই সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন বণ্টন রাষ্ট্রের অর্থাৎ সামাজিক। উৎপাদনের উপাদানের মালিক সমাজ, কোনো ব্যক্তি নয়। কোনো ব্যক্তি উৎপাদন বা বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে না। ১৯৫৪ সালে রচিত ‘অ্যান্টি ডুরিং’-এ ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস এই উন্নত সমাজের বিবরণ দিয়েছেন। এঙ্গেলসের ভাষায়... “... এই ব্যবস্থায় মানুষ প্রয়োজনের দুনিয়া থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার দুনিয়াতে চলে যায় ...” মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মানুষের এই স্বাধীন হওয়ার কথাই বলে। মানুষকে প্রকৃত অর্থেই শৃঙ্খল মুক্ত করা যায় এই ব্যবস্থায়। উৎপাদন আর ভোগের মধ্যে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যে দ্বন্দ্ব থাকে সেই দ্বন্দ্বের অবলুপ্তি ঘটে সমাজতন্ত্রে।তাই এই ব্যবস্থায় মানুষের ভোগ, ক্রয়ক্ষমতা এবং উৎপাদন একইসাথে বৃদ্ধি করা সম্ভব।উৎপাদন বাড়ছে কিন্তু মানুষের কেনার ক্ষমতা নেই এই সংকট ঘটে থাকে পুঁজিবাদী দুনিয়ায়। সমাজতন্ত্রে এই সমস্যা ঘটে না ; বরং সমাজতান্ত্রিক সমাজে মানুষের নতুন নতুন চাহিদার সৃষ্টি হয় ; সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিকাশ লক্ষ করা যায় এবং এই সব চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হয়।মানুষের প্রয়োজনে উৎপাদনের নানা দিকে বিকাশ ঘটে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার কথা আমরা শুনি পুঁজিবাদী সমাজে।সমাজতান্ত্রিক সমাজে শুনি ভালভাবে বেঁচে থাকার কথা।সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা এক্ষেত্রে সম্ভব। ধরা যাক, শিল্পোৎপাদনের কথা। কত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ যাবে ভারি শিল্পে; কতটাই বা যাবে অন্যান্য শিল্পে এ সব কিছুই সমাজের প্রয়োজন অনুযায়ী করা সম্ভব। এর জন্যই প্রয়োজন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা।

সমাজতন্ত্রের সাথে অবিচ্ছেদ্য এই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অর্থনীতি। বিভিন্ন শিল্পের উৎপাদনের মধ্যে পারস্পরিক অনুপাত কী হবে তা তো নির্ধারণ করে নিতে হবে এই সমাজে। তাই প্রয়োজন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার। উৎপাদন করতে হবে মানুষের চাহিদা মেটাতে, মানুষের প্রয়োজন মেটাতে; তাই স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে অগ্রাধিকারের প্রশ্নটি। এই অগ্রাধিকারই পরিকল্পনা ভিত্তিক অর্থনীতির মূল কথা। মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকা প্রাধান্য পেলে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী অগ্রাধিকার স্থির হয়। নিঃসন্দেহে এই ব্যবস্থা মানুষের বাঁচার বিকল্প উন্নত ব্যবস্থা।এই উন্নত ব্যবস্থা কোনভাবেই পুঁজিবাদী সমাজে লাভ করা যায় না, কারণ সেখানে উৎপাদনের অভিমুখ মানুষের প্রয়োজন মেটানো নয়; পুঁজির মুনাফা মেটানোর জন্য। সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের উপাদানের মালিক যেহেতু রাষ্ট্র, তাই স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থনীতিতে ভারি শিল্পের প্রতি অতিরিক্ত জোর দেওয়া হয়। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ এই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বৃহৎ শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছিল ৫৫২শতাংশ। এখান থেকেই বোঝা যায় যে এই নতুন সমাজ কোন দিকে চালিত হয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র এমন এক সমাজ সৃষ্টি করতে পেরেছিল যেখানে শ্রমিক ও কৃষকের মজুরি বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল কয়েকগুণ। ১৯১৩ সালের তুলনায় অর্থাৎ বিপ্লবের আগের সময়ের সাথে তুলনা করলে ১৯৫৪ সালে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি ৬ গুণ বেড়ে গিয়েছিল এবং কৃষকের প্রকৃত মজুরি ৬.৫ গুণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। কমরেড লেনিনের কথায় এই ব্যবস্থায় মানুষের বুদ্ধি-মেধাকে আর বাইরের শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। শ্রমিকের মজুরি তার পণ্যরূপে দেখা শ্রম শক্তির বাজারি দাম নয় বরং সামাজিক উৎপাদনে তাঁর শ্রমের অংশ অনুযায়ী হয় তাঁর মজুরি।

‘Stay for the protection of the USSR...’ (সোভিয়েত পোস্টার)

১৯১৭ সালের বিপ্লবের সময়ে এই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কমরেড লেনিন মার্কসের তত্ত্ব থেকে এই ব্যবস্থার বাস্তব রূপ প্রতিষ্ঠা করেছেন ইতিহাসের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে। এই পরীক্ষা নিরীক্ষার পথ সহজ ছিল না।সমাজতন্ত্রের বুর্জোয়া সমালোচকেরা বলে থাকে, এই ব্যবস্থায় গণতন্ত্র লোপ পায়। তা পুরোপুরি সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি বিকৃত ধারণা। কমরেড লেনিন ১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসের বক্তৃতায় বলেন যে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রে মানুষের অধিকারের কথা বললেও বেশ কিছু প্রান্তিক ও অন্যান্য মানুষের গোষ্ঠী থাকবে যাদের এই অধিকার থাকবে না। একমাত্র সমাজতন্ত্রই সেই ব্যবস্থা সামনে আনতে পারে যেখানে মানুষের গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব। তিনি মনে করতেন সমাজতন্ত্র যেহেতু এক উন্নত সমাজব্যবস্থা তা পুঁজিবাদী সমাজকে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হবে সারা পৃথিবীতে।

পুঁজিবাদী সমাজে মানবাধিকারের যে ধারণা আমরা পাই তার জন্ম নয়া উদারীকরণের প্রথম ধাপের পর। যখন দেশে দেশে নয়া উদারীকরণ অধিকার লঙ্ঘনের নজির সৃষ্টি করল, তখনই এই ধারণা চালু হলো। মানবাধিকার যে পুঁজিবাদী সমাজে থাকে না এ কথা তো সমাজতন্ত্রের ধারণা দেওয়ার সময়ে কমরেড লেনিন বলেছিলেন। মানবাধিকার তো সেই খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, ইত্যাদির অধিকারের কথাই বলে থাকে, যা সমাজতান্ত্রিক সমাজে স্বাভাবিকভাবেই রক্ষিত। আজ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ধ্বংসের যেমন ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত; আবার পুঁজিবাদের আগ্রাসী রূপ নয়া উদারীকরণেরও ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত।স্বাভাবিকভাবেই মানবাধিকারের প্রশ্নে কী উত্তর এই দুই ব্যবস্থা দিয়েছে, তা এই সময়ে সামনে আনার দিন। ১৯১৭ সালের বিপ্লব যে উন্নত সমাজের ধারণা সারা বিশ্বকে দিয়েছিল তাই তা আবার বিশ্বের নানা জায়গায় সামনে চলে এসেছে। বর্তমান পৃথিবীতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলি যে উন্নত সমাজ তৈরির কথা বলছে তা কিন্তু এই সমাজতন্ত্রের ধারণা নিয়েই। বলশেভিক বিপ্লব এই উন্নত সমাজের স্বপ্ন সারা পৃথিবীকে দিয়েছিল যা এক চিরন্তন সত্য।