E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন

মহান অক্টোবর বিপ্লবের রূপকার

অর্ণব ভট্টাচার্য


লেনিন এবং তাঁর স্ত্রী নাদেঝ্‌দা ক্রুপস্কায়া।

১৮৮৭ সাল। রাশিয়ায় নিহত হলেন জার তৃতীয় আলেকজান্ডার। আর এই হত্যার পরিকল্পনা করার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো সিমবির্স্ক শহরের স্কুল ইন্সপেক্টর ইলিয়া নিকোলায়েভিচ উলিয়ানভের জ্যেষ্ঠ সন্তান আলেকজান্ডারকে। টালমাটাল হয়ে গেল উলিয়ানভ পরিবার। কিন্তু এই ঘটনার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ল আলেকজান্ডারের ভাই ভোলোদিয়া ওরফে ভ্লাদিমিরের ওপর। বড়ো ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে ভ্লাদিমির সমকালীন রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসনে জনতার দুর্দশার প্রতি আরও তীক্ষ্ণ মনোনিবেশ করা শুরু করলেন। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জীবনীকার ক্রিস্টোফার হিলের ভাষায়, ‘‘এই সময় থেকেই ভোলোদিয়ার হৃদয়ে লেনিনের অবয়ব গড়ে উঠতে শুরু করল’’। বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাদের পরিবার রাজরোষে পড়ায় লেনিনকে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাঁকে কাজান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে কারারুদ্ধ করা হয়। নির্বাসনে থাকতে হয় এক বছর। তা সত্ত্বেও তিনি সাফল্যের সাথে আইন পরীক্ষায় স্বর্ণপদক পেয়ে পাশ করেন। তারপর সামান্য কিছুকাল আইন ব্যবসা। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আইন পেশা নয়, রাশিয়ার বুকে সমাজ পরিবর্তন করার সংগ্রামে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করবেন। তবে হ্যাঁ, তাঁর দাদা যে পথ অবলম্বন করেছিলেন সেই নৈরাজ্যবাদী ও ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের পথে নয়।

নির্বাসনে থাকাকালীন রুশ প্রগতিশীল সাহিত্যিক চেরনিশেভস্কির রচনা লেনিনের ওপর সর্বোচ্চ প্রভাব ফেলেছিল। এরপর কাজান এলাকার গোপন বিপ্লবী পাঠচক্রে তিনি মার্কস-এঙ্গেলস-প্লেখানভের লেখার সাথে পরিচিত হন এবং অতিদ্রুত অনুভব করেন যে, মার্কসবাদই সেই মতাদর্শগত হাতিয়ার যার সৃষ্টিশীল প্রয়োগের মাধ্যমে জার সাম্রাজ্যের শোষণ-বঞ্চনার বেড়াজাল থেকে মেহনতি মানুষ নিজেদের মুক্তি ছিনিয়ে আনতে পারবে। ১৮৯২ সালে সামারা এলাকায় লেনিন প্রথম মার্কসবাদী পাঠচক্র গড়ে তোলেন।

এই সময় রাশিয়ায় মার্কসবাদ বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল নারোদনিকরা। এরা শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করত এবং কৃষকদের মূল বিপ্লবী শক্তি মনে করত। ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিতেও বিশ্বাসী ছিল নারোদনিকরা। পরবর্তীকালে এই নারোদনিকরা উদারপন্থী ও আপসকামীতে পরিণত হয়। রাশিয়ার শ্রমজীবী মানুষের সামনে নারোদনিকদের চরিত্র উন্মোচন করেন লেনিন। এর পাশাপাশি তিনি খুব দ্রুত একথা অনুধাবন করেন যে, শ্রমিকশ্রেণিকে ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করতে হলে তার নিজস্ব বিপ্লবী পার্টি দরকার এবং সেই জন্য রাশিয়ায় ১৮৯৫ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গের মার্কসবাদী শ্রমিক চক্রগুলিকে একত্রিত করে লেনিন একটি দল তৈরি করেন যার নাম ছিল ‘‘শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রাম সংঘ’’। এই সংগ্রাম সংঘ স্থাপন রাশিয়ায় বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টি গঠনের প্রথম ধাপ। লেনিনের নেতৃত্বে মুক্তি সংগ্রাম সংঘ ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচারকার্য শুরু করে এবং শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত করে। ক্রমবর্ধমান শ্রমিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৭ সালে লেনিনকে তিন বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। ১৮৯৮ সালে রাশিয়ার বুকে একটি ঐক্যবদ্ধ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি গড়ে তোলার জন্য মিন্সক্ শহরে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির প্রথম কংগ্রেস ডাকা হয়। নির্বাসনে থাকার দরুন লেনিন এই কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু এই কংগ্রেস তাৎপর্যপূর্ণ কেননা তা জারের স্বৈরাচার এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করার কথা সোচ্চার ঘোষণা করে। তবে এই সময় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মতাদর্শগত বিচ্যুতি নানাভাবে প্রকাশিত হয়। বিশেষত ‘অর্থনীতিবাদ’-এর সুবিধাবাদী প্রবণতায় আক্রান্ত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক নেতৃত্বের একাংশ শ্রমিকদের কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে প্ররোচনা দেয় এবং রাজনৈতিক অধিকার দখলের লড়াই থেকে তাদের দূরে রাখার চেষ্টা করে। লেনিন অর্থনীতিবাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রামে লিপ্ত হন, তাদের ভ্রান্ত ও শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী মতবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেন এবং রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের প্রকৃত কর্তব্য স্থির করেন।

লেনিন অনুভব করেছিলেন যে রাশিয়ার জন্য এমন একটি সংবাদপত্রের প্রয়োজন যা সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য যথার্থ প্রচারক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করবে। এই তাগিদ থেকেই ১৯০০ সালে জন্ম নিল মার্কসবাদী পত্রিকা ‘ইসক্রা’ অর্থাৎ স্ফুলিঙ্গ। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে রাশিয়ায় শ্রমিকদের পাশাপাশি কৃষক এবং ছাত্ররাও জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বড়ো সংখ্যায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। বাস্তব পরিস্থিতিকে বিপ্লবের লক্ষ্য পূরণের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য লেনিন লিখলেন ‘কি করিতে হইবে?’ লেনিন অনুধাবন করেছিলেন যে, রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হলে এমন এক বিপ্লবী পার্টি চাই যা কিনা মার্কসবাদের বিপ্লবী তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত এবং যেকোনো রকম প্রতিকূল অবস্থায় মধ্যে লড়াই করার যোগ্য ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। লেনিন বললেন যে, পার্টিতে থাকবে দুটি অংশ। একটি অংশ পেশাদার বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত, যাঁরা বিপ্লবের জন্য পুরোপুরি আত্মোৎসর্গ করেছে। অন্যটি হলো স্থানীয় পার্টি সংগঠনগুলির সুবিস্তৃত জাল ও বহু সংখ্যক পার্টি সভ্য যারা মেহনতি মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থনপুষ্ট। কৃষকদের কাছে পার্টির কর্মসূচি ব্যাখ্যা করার জন্য ১৯০৩ সালের বসন্তে লেনিন লিখলেন ‘গ্রামের গরিবদের প্রতি’। এখানে তিনি সাবলীল ভাষায় শ্রমিকশ্রেণির পার্টি গঠনের তাৎপর্য এবং শ্রমিকদের সাথে গরিব কৃষকের ঐক্য স্থাপন করবার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন।

১৯০৩ সালে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পার্টির নিয়মাবলির প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা যায়। লেনিন চেয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী পার্টি গড়তে, যেখানে পার্টি সভ্য তাঁরাই হবেন, যাঁরা পার্টি কর্মসূচি মেনে চলেন, পার্টিকে অর্থ সাহায্য করেন এবং কোনো একটি পার্টি সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গণসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সুবিধাবাদী মার্তভের বক্তব্য ছিল যে, পার্টিকে অর্থ সাহায্য করাই পার্টি সভ্যপদ লাভ করার জন্য যথেষ্ট। অল্প ভোটাধিক্যে প্রথমে মার্তভের এই প্রস্তাব গৃহীত হলেও পরবর্তীতে লেনিনের মতাবলম্বীরা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ইসক্রা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী নির্বাচনের সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পান। লেনিনের পক্ষ অবলম্বনকারীদেরকে পরবর্তীকালে বলশেভিক বলা হয় যার অর্থ সংখ্যাগুরু। আর মার্তভপন্থীদের বলা হয় মেনশেভিক যার অর্থ সংখ্যালঘু।

স্বৈরাচারে জর্জরিত রাশিয়ার বুকে প্রকৃত বৈপ্লবিক পরিবর্তন করা কোনোরকম ঢিলেঢালা সংগঠনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অথচ সুবিধাবাদী মেনশেভিকরা সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির সংগঠনকে ঢিলেঢালা করার পক্ষপাতী হয়ে কার্যত প্রতিক্রিয়ার শক্তিকেই সহায়তা করছিল। রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের কাছে মেনশেভিকবাদের বিপদ তুলে ধরবার জন্য ১৯০৪ সালে লেনিন লিখলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘‘এক পা আগে, দু পা পিছে’’। এই বইতে লেনিন দেখালেন যে, শ্রমিকশ্রেণির পার্টি একটি সাধারণ বাহিনী নয়। পার্টি হলো অগ্রগামী বাহিনী, শ্রেণি চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাহিনী। এই বাহিনীকে হতে হবে সুসংহত, শৃঙ্খলাবদ্ধ। এই পার্টি পরিচালনার নীতি হবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা অর্থাৎ সংখ্যা গরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সংখ্যালঘিষ্ঠকে মেনে চলতে হবে। লেনিনের এই বক্তব্য পাটিকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তাঁরা এই নীতির তাৎপর্য অনুভব করতে পারেন।

১৯০৪ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় জারতন্ত্রের কঙ্কালসার চেহারাকে জনগণের সামনে উন্মোচিত করে দেয়। ১৯০৫ সালের ৯ জানুয়ারি সেন্ট পিটার্সবার্গে শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলের উপর সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণে ১০০০-এরও বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর শ্রমিকদের যে ব্যাপক বিক্ষোভ সংঘটিত হয় তার মধ্যে আগামীদিনের বিপ্লবের সূত্রপাত লক্ষ করেছিলেন লেনিন। ১৯০৫ সালের জুন মাসে কৃষ্ণ সাগরে নৌবাহিনীর পোটেমকিন যুদ্ধজাহাজের নাবিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। লেনিন রাশিয়ার এই ঘটমান বিপ্লবকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে গণ্য করেছিলেন। লন্ডনে আয়োজিত রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে লেনিনের সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, এই বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি ও নেতা হতে হবে শ্রমিক শ্রেণিকে যাদের সহযোগী হবে গরিব কৃষক। যথারীতি মেনশেভিকরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্ব ও শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীকে অস্বীকার করে। এর বিরুদ্ধে লেনিন রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল ডেমোক্রাসির দুই কর্মকৌশল’।

সংগ্রামের এই দিনগুলিতেই শ্রমিকদের প্রতিনিধি সংগঠন হিসেবে সোভিয়েতগুলি আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে কোনো দেশেই এরকম সংগঠন গড়ে ওঠেনি। সমস্ত কলকারখানা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে শ্রমিকদের যে সোভিয়েত গঠিত হয় তা ছিল জনগণের সৃজনী শক্তির নবতম বিপ্লবী রূপ। দেশে ফিরে এসে ১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে লেনিন সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। ডিসেম্বর মাসে মস্কোতে শ্রমিকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান হয়। জারের সেনা এই বিদ্রোহ দমন করলেও লেনিন একে দেখেছিলেন রুশ শ্রমিকদের অবিস্মরণীয় কীর্তি হিসেবে। যদিও এই বিপ্লবের সাংগঠনিক ত্রুটির দিকগুলি তার নজর এড়িয়ে যায়নি। সেগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন সংগ্রামে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানান লেনিন।

১৯০৫ সালে লেনিন রাশিয়ার প্রতিনিধি সভা ডুমা বয়কট করার ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯০৫ সালের বৈপ্লবিক প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর প্রতিনিধি সভার মঞ্চকে বিপ্লবের প্রচার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ১৯০৬ সালে ডুমাতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অবশ্য ১৯০৭ সালে ডুমা ভেঙে দেয় জার সরকার এবং মন্ত্রী স্তলিপিনের নেতৃত্বে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী বৈপ্লবিক শক্তির ওপর ভয়ংকর নির্যাতন নামিয়ে আনা হয়। লেনিনকে হত্যা করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে জার প্রশাসন। ফলে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়।

এই সময় লেনিন একদিকে সংগঠন গোপনে চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলশেভিকদের পরামর্শ দিয়েছেন অন্যদিকে সময়োপযোগী রণনীতি অবলম্বন করে প্রতিদিনের সাদামাটা কর্মকাণ্ড চালিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। মেনশেভিকরা এই সময় গোপন সংগঠন তুলে দেওয়ার ডাক দেয়। পার্টির অভ্যন্তরে এই লুপ্তিপন্থী বা লিকুইডেটারদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম করতে হয় লেনিনকে। আবার বলশেভিকদের একাংশ বৈধ শ্রমিক সংগঠনের কাজ থেকেও নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে চাইছিলেন। এই প্রত্যাহারপন্থীদের প্রবণতাও ছিল সর্বনাশা, কারণ এতে পার্টি কেবলমাত্র রুদ্ধদ্বার জনবিচ্ছিন্ন সংগঠনে পরিণত হতো। এই ধ্বংসাত্মক ঝোঁকের বিরুদ্ধেও লেনিন সংগ্রাম করেন।

মতাদর্শের জগতে এই সময় সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে নস্যাৎ করার প্রয়াস। শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতির ভিত্তিমূলে আঘাত হানবার এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের বিরুদ্ধে, বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠিত করবার স্বার্থে লেনিন এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার ‘মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ বইটিতে তিনি বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের যাথার্থ্য প্রমাণ করেন এবং শ্রেণি রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তিকে দৃঢ়তর করেন।

ইতিমধ্যে পার্টির অভ্যন্তরে মেনশেভিকদের সাথে বলশেভিকদের মতাদর্শগত সংগ্রাম তীব্রতর হয়ে ওঠে। শ্রমিকশ্রেণির শক্তিকে একত্রিত করে বিপ্লবের পথে নতুনভাবে অগ্রসর হওয়ার জন্য দরকার পড়েছিল বলশেভিকদের স্বতন্ত্র পার্টি। ১৯১২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রাগ সম্মেলন থেকে স্বতন্ত্র রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (বলশেভিক) আত্মপ্রকাশ করে। সেই বছরই প্রকাশিত হয় তাদের বৈধ সংবাদপত্র ‘‘প্রাভদা’’। লেনিন এই সময় পোল্যান্ডের ক্রাকভে চলে এসে প্রাভদার দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বলশেভিকদের সময়োপযোগী রণকৌশল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন লেনিন। ১৯১২ সালের ডুমা নির্বাচনে অংশগ্রহণকে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে তিনি বিবেচনা করেন। বলশেভিকদের নির্বাচনী স্লোগান শ্রমিকদের আকৃষ্ট করায় গোটা রাশিয়ার ছটি প্রধান শিল্পপ্রদেশে বলশেভিকরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম ইয়োরোপের সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতারা যুদ্ধের সময় নিজ নিজ দেশে শাসক শ্রেণিকে সহায়তা করার নীতি গ্রহণ করলেন এবং দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে শ্রমজীবী জনগণকে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানালেন। এই সময়ে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেন লেনিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে তিনি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেন এবং এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণিকে অবস্থান গ্রহণ করার সপক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। বলশেভিকরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং শান্তির সপক্ষে ও জারতন্ত্রের উচ্ছেদের ডাক দেয়। লেনিন শ্রমজীবী মানুষকে নিজ দেশের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরতে বলেন। ১৯১৬ সালে রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’। এই গ্রন্থে লেনিন পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আগ্রাসী রূপের সামগ্রিক বিশ্লেষণ হাজির করেন এবং সাম্রাজ্যবাদকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কাল বলে চিহ্নিত করেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের কাজে লাগাতে সক্ষম হয় রাশিয়ার বলশেভিকরা। ১৯১৭ সালের ৯ জানুয়ারি শ্রমজীবীদের যে বিক্ষোভ সংঘটিত হয় তা ফেব্রুয়ারি মাসে তীব্রতর হয়ে ওঠে। জার সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু লেনিন সহ বলশেভিক নেতৃত্বের সিংহভাগ নির্বাসনে কিংবা কারান্তরালে থাকায় শ্রমিক ও সৈনিকদের যে সোভিয়েতগুলি গঠিত হয়েছিল তা দখল করে নেয় মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারিরা। রাশিয়ার মেহনতি জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছিল তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারিরা। তারা বুর্জোয়াদের সাথে আপস করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাশিয়ায় যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হলো তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেন বলশেভিকরা। অস্থায়ী সরকারকে সরিয়ে সোভিয়েত সরকার স্থাপন না করলে শান্তি বা বিপ্লবী দাবিগুলো কখনোই যে পূরণ হতে পারে না তা লেনিন তুলে ধরেন। ১০ বছর ফেরারি থাকার পর ১৯১৭ সালের ৩ এপ্রিল রাতে লেনিন পেট্রোগ্রাডে পৌঁছালেন। ৪ এপ্রিল তিনি বলশেভিকদের সভায় যে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন তা ‘‘এপ্রিল থিসিস’’ নামে খ্যাত। জমিদার ও পুঁজিপতিদের স্বার্থবাহী এই অস্থায়ী সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সোভিয়েতগুলির হাতে ক্ষমতা স্থানান্তরিত করার জন্য আহ্বান জানালেন লেনিন। অবশ্য এখনই তিনি বলপূর্বক উচ্ছেদের পক্ষপাতি ছিলেন না। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের প্রধান কেরেনস্কি ও বুর্জোয়া শাসনযন্ত্র শ্রমিক ও সৈনিকদের ওপর দমনপীড়নের পথ বেছে নেয়। ৩ জুলাই পেট্রোগ্রাডের রাস্তায় রক্ত ঝরে। লেনিনকে গ্রেপ্তার করে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হওয়ায় আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন লেনিন।

১৯১৭ সালের জুলাই মাসে পেট্রোগ্রাডে অনুষ্ঠিত হলো পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস। বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ করে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে লেনিন রচনা করলেন ‘‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’’। পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে নেই। বিশ্বাসঘাতক কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনার কথা পত্রিকা মারফত ফাঁস করে দেওয়া সত্ত্বেও বিপ্লবের গতিকে প্রতিহত করতে পারেনি সামরিক সরকার। ২৪ অক্টোবর (নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৬ নভেম্বর) লেনিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্মোলনি ইনস্টিটিউটে এলেন এবং সরাসরি বিপ্লব পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন। ২৫ অক্টোবর (নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ নভেম্বর) সকালবেলাতেই অভ্যুত্থানী শ্রমিক, সৈনিক ও নাবিকদের দখলে চলে গেল টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও রেডিয়ো স্টেশন, নেভা নদীর উপর সমস্ত সেতু, সবক'টি রেল স্টেশন, রাজধানীর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সকালে পেট্রোগ্রাডের সামরিক বিপ্লবী কমিটি প্রকাশ করল লেনিনের লেখা বিবৃতি ‘‘রাশিয়ার নাগরিকদের প্রতি’’। এতে ঘোষিত হলো যে, সামরিক সরকারের পতন হয়েছে, ক্ষমতা গেছে সোভিয়েতগুলির হাতে।ওইদিন সন্ধ্যায় স্মোলনিতে অনুষ্ঠিত হলো সোভিয়েতগুলির কংগ্রেস। তৈরি হলো বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার যার প্রধান হলেন লেনিন। এই সরকার প্রথমেই জারি করলো শান্তি ও জমির ডিক্রি। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ থেকে সরে এলো সোভিয়েত রাশিয়া। জমিদারি উচ্ছেদ হলো বিনা ক্ষতিপূরণে। ১৫ কোটি হেক্টরেরও বেশি জমির মালিক হলো দেশের জনগণ। শোষণ থেকে মুক্তির আলোকোজ্জ্বল পথে হাঁটতে শুরু করল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

লেনিন কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলায় দিক্ নির্দেশক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাই নয়, বিপ্লবকে রক্ষা করবার জন্য তিনি অত্যন্ত বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একদিকে যেমন গৃহযুদ্ধের সময় শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের মেহনতি জনতা ও লালফৌজকে পূর্ণ বিজয়ের লক্ষ্যে পরিচালিত করেন, তেমনই পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে জার্মানির সাথে ব্রেস্ট-লিটভেস্কর শান্তি চুক্তি স্থাপন করে ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিউ ইকনমিক পলিসি প্রবর্তনের মাধ্যমে শিশু সোভিয়েত রাষ্ট্রকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভিত প্রস্তুত করে দেন। জার সাম্রাজ্য যা কিনা ‘জাতিসমূহের কারাগার’ বলে বিবেচিত হতো সেই সাম্রাজ্যের অধীনস্ত বিভিন্ন অবদমিত জাতিকে প্রকৃত মর্যাদায় উন্নীত করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিভিন্ন জাতিসমূহের স্বেচ্ছামূলক ঐক্যের ভিত্তিতে নির্মিত বহু ভাষা ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্রে পরিণত করায় লেনিনের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। শ্রমিক-কৃষকের আপনার জন কমরেড লেনিনের জীবন বিপ্লবী শিক্ষার এক অফুরান উৎস। সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বে ‘ধনগরিমার ইতরতা’ যত বেশি প্রকট হচ্ছে তত বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন কমরেড লেনিন।


তথ্যসূত্রঃ

১। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস - এন বি এ।
২। লেনিনঃ এই সময়ে - আর বি এন্টারপ্রাইজ।