৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯
নভেম্বর বিপ্লবঃ জ্ঞানচর্চা, তত্ত্বচর্চা
শুভময়
অগ্রহায়ণ ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে, ইংরেজি সাল অনুযায়ী ১৯৩৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার বিবিধ প্রসঙ্গ বিভাগে একই সুতোয় গাঁথা চারটি টুকরো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম টুকরোটির শিরোনাম ‘লেনিনের পাণ্ডিত্য’। লেখাটি শুরু হয় এমনভাবেঃ ‘নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল পাব্লিশারদের দ্বারা প্রকাশিত লেনিনের জীবনচরিত থেকে জানা যায়...।’ বিশ শতকের সেই তিনের দশকেই আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের এই জীবনীটির নাম বা তার লেখকের নাম উল্লেখ করা হয় না ওই লেখাগুলির কোথাও, যদিও পাদটীকায় বইটি থেকে একাধিক বাক্য উদ্ধৃত করা হয় ইংরেজি ভাষাতেই। লেখাটি এগিয়ে যায় লেনিনের পারিবারিক পরিচিতির মধ্য দিয়ে, বলা হয় লেনিন পরিবারের চার ভাইবোনের কথা, এবং লেখা হয় ‘তাঁহারা সকলেই গভীরভাবে অধ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং সকলেই বিপ্লবী ছিলেন।’
আমরা বলেছি, চারটি টুকরো লেখাই একটি সুতোয় গাঁথা। শেষ দুটি টুকরোর শিরোনাম ‘মার্কসের পাণ্ডিত্য’ এবং ‘পাণ্ডিত্য ও বিপ্লবিতা’। অভিন্ন সূত্রটি হলো এইঃ জ্ঞানচর্চার সঙ্গে মার্কসবাদী বিপ্লবীদের জীবনের কোনও বিরোধ তো নেই-ই, বিপরীতে জ্ঞানচর্চা ছাড়া মার্কসবাদী বিপ্লবীদের জীবন বলে কিছু হতেই পারে না। এবং এই সূত্রটি উত্থাপন করছে, স্বীকার করছে কোনও বামপন্থী পত্রপত্রিকা নয়, বিশ শতকের বহুমান্য সাংস্কৃতিক সাময়িকপত্র ‘প্রবাসী’ যার প্রধান লেখক ছিলেন অন্য কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
।। এক ।।
‘প্রবাসী’-র বিবিধ প্রসঙ্গ বিভাগে প্রকাশিত চারটি খণ্ড লিখনকে গাঁথতে উপরের ওই অভিন্ন সূত্রটিকে আমরা ধরতাই হিসাবে ব্যবহার করলাম মূলত এই কথাটি ফিরে তাকিয়ে বুঝে নিতে - আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শ্রম ও উদ্ভাবনী রণনীতি ও রণকৌশলের সঙ্গে নিবিড় ও একাগ্র জ্ঞানচর্চা ও তত্ত্বচর্চার ফলেই নভেম্বরের সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল। এই চর্চা শুধু মহামতি লেনিনের একক জীবনের আয়াস ও অর্জন নয়, জ্ঞান ও তত্ত্বচর্চায় তিনি প্রাণিত করতে পেরেছিলেন ও নিরন্তর প্রাণিত করতে চেয়েছিলেন সংগঠনের শেষতম ধাপের অগণিত কর্মী দরদি এবং শ্রমজীবী মানুষকেও, প্রয়োজনে সাংগঠনিক কঠোরতা ব্যবহার করেও।
আমরা ‘প্রবাসী’-র লেখাগুলিতে ফেরত যাব, দ্বিতীয় লেখাটিতে যার শিরোনাম ছিল ‘জ্ঞান অৰ্জন সম্বন্ধে লেনিনের মত’। এখনো পর্যন্ত আমরা মার্কসবাদী বা বামপন্থী সাহিত্য বা সমাজবিজ্ঞান থেকে কোনো অংশ উপস্থাপন বা উল্লেখ না করে কেবলমাত্র ‘প্রবাসী’ থেকে উল্লেখ করে যাচ্ছি এই কারণে, বিশ শতকের প্রথমার্ধের অবিসংবাদী সাংস্কৃতিক পত্রিকায় মার্কসবাদীদের জ্ঞানচর্চা নিয়ে এই লিখনের অর্থ হলো রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালের বঙ্গসমাজের অগ্রসর অংশ, জীবনানন্দ তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃজন-বিকাশকালের বঙ্গসমাজের সচেতন অংশ কী গভীর আগ্রহ নিয়ে সারা দুনিয়ার সঙ্গে এদেশের মার্কসবাদীদের জ্ঞানচর্চার বিকাশের দিকে তাকিয়েছিল, মার্কসবাদীদের জ্ঞানচর্চা ও তত্ত্বচর্চার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। ‘প্রবাসী’-র বিবিধ প্রসঙ্গ-এর লেখক বিশ শতকের তিনের দশকের সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশ ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছেনঃ
‘‘রাশিয়াতে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে কম্যুনিষ্ট যুবজনের তৃতীয় কংগ্রেসকে সম্বোধন করিয়া লেনিন যে বক্তৃতা করেন, তাহাতে তিনি বলেন যে, মানবের জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকারী না হইয়া কম্যুনিষ্ট হওয়া যায় মনে করিলে গুরুতর ভ্রম হইবে; কতকগুলি কম্যুনিষ্ট গত আওড়াইয়া,কতকগুলি কম্যুনিষ্ট বুলি কপচাইয়া, জ্ঞানের সমুদয় শাখার অধিকারী না হইয়া, কম্যুনিষ্ট হওয়া যায় মনে করা ভুল। উত্তরাধিকারসূত্রে মানবজাতি বর্ত্তমানে যত জ্ঞান পাইয়াছে, তাহা অবলম্বন ক্রিয়া চিন্তার দ্বারা যদি কেহ কম্যুনিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার কম্যুনিজম একটা ফাঁকা কথা এবং সে নিজে ধাপ্পাবাজ।’’
‘বুলি কপচাইয়া’, ‘ফাঁকা কথা’, ‘ধাপ্পাবাজ’-এর মতো কঠোর ও খর শব্দবন্ধগুলি যে নেহাত ‘প্রবাসী’-র লেখকের প্রয়োগ নয়, সেগুলি যে খোদ লেনিনেরই, সেটি প্রমাণ করতেই বোধহয় তিনি পাদটীকায় উদ্ধৃত করেন লেনিনের বক্তৃতার সেই অংশ যেখানে ইংরেজি ভাষায় পাওয়া যায় ‘এম্পটি ফ্রেজ’, ‘মেয়ার ফ্যাসেড’, কিংবা ‘ব্লাফার’-এর মতো তীব্র শব্দগুলি।
অধ্যয়নের প্রশ্নে পার্টির অভ্যন্তরে, পার্টি নেতৃত্ব বা কর্মীদের সঙ্গে যখনই কথা বলেন লেনিন, এমনই কঠোর তিনি। শুধু মুখের কথায় নয়, লিখিত ভাষাতেও নিখাদ কঠোর তিনি। বিন্দুমাত্র শিথিলতাকেও জায়গা দিতে রাজি নন। ঠিক উলটো দিকে, শ্রমিক ও খেটে-খাওয়া মানুষদের নিয়ে যখনই তিনি কথা বলেন, তাদের জানবার আগ্রহ, পার্টির প্রতি দরদ, গ্রহণ করার ক্ষমতা, আশ্চর্য উদার, উচ্ছ্বসিত ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। বুদ্ধিজীবীদের নস্যাৎ করে তাঁর অবিচল ভরসার জায়গা শ্রমিক-জনতা। আমার মাস্টারমশাই অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য তাঁর ‘রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতি’ (দ্বিতীয় খণ্ড ) গ্রন্থে লেনিংক-কে লেখা একটি চিঠির অনুবাদ রেখেছেন। ১৯০৩ সালে লেখা এই চিঠির খানিকটা দীর্ঘ অংশই আমরা উদ্ধৃত করব কমরেড লেনিনের প্রবণতার ওই তিনটি স্পন্দন অনুভব করতেঃ ১. সংগঠনের অভ্যন্তরে থাকা ছদ্ম বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তাঁর শ্লেষ, ২. শ্রমিকের প্রতি অপার ভরসা এবং ৩. পড়া ও পড়ানোর প্রশ্নে নেতৃত্ব ও কর্মীদের প্রতি কঠোরতা। চিঠির বিভিন্ন অংশঃ
যে-সব বইপত্র শত শত কপি আপনাদের জন্যে চালান দেওয়া হয়েছে, আপনাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, আপনাদের মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কি আপনারা কাজে লাগাতে পেরেছেন? না আপনারা তা পারেননি। এই ছোট্ট ব্যাপারটাতে জনসাধারণের সঙ্গে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সংযোগ সাধন করতে আপনারা সক্ষম হননি।...
খুদে খুদে অপদার্থ ইন্টেলেকচুয়ালরা, লেখাপড়া জানা বাবুরা, ইস্ক্রা সম্বন্ধে বলে থাকেন,’ইস্ক্রা অত্যন্ত ইন্টেলেকচুয়াল ধরনের পত্রিকা, পণ্ডিতদের জন্য লেখা।’ [শ্রমিক-সাধারণ ইস্ক্রা পড়ে বুঝবে না]। কিন্তু মস্কো শহরের চারপাশের জেলাগুলোর শিল্পাঞ্চলে, যেখানে শ্রমিকরা অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ও অশিক্ষিত, সেখানে সেই শ্রমিকদের সাধারণ জনতার সঙ্গেই এই ইস্ক্রার সংযোগ ঘটানো গেছে। আমি সেই শ্রমিকদের নিজে জানি, যাঁরা ওই অঞ্চলে নিজেরা ইস্ক্রা বিলি করেছেন; তাঁরা শুধু বলেছিলেন, ‘ইস্ক্রার কপি বড়ো কম সংখ্যায় পাওয়া যাচ্ছে, আরও বেশি সংখ্যায় পাওয়া দরকার।’ ওই অঞ্চল থেকে এখানে এসেছেন এমন একজন শ্রমিকের মুখে, যাঁকে বলা চলে ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগত একজন সৈনিক’ তাঁর মুখে আমি শুনেছি মধ্য এশিয়ার এক কোনে পড়ে থাকা এক ফ্যাক্টরি এলাকায় কীভাবে শ্রমিকদের অনেকগুলো সার্কেলে একত্র বসে ইস্ক্রা পড়া হয়,দশ থেকে পনেরো জন করে লোক এক-একটা সার্কেলে থাকে; পার্টি-কমিটির লোকেরা নিজেরা প্রত্যেকটি সংখ্যা আগে পড়ে নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে, কীভাবে প্রত্যেকটা প্রবন্ধকে কথাবার্তার সময় কাজে লাগান যাবে তার পরিকল্পনা করে।...
আসুন তো, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো দেখি, ইস্ক্রার যে কপিগুলি আপনাদের হাতে পৌঁছেছে, সেগুলোর প্রত্যেকটাকে কি আপনারা কাজে লাগাচ্ছেন,যেভাবে এই শ্রমিকরা কাজে লাগিয়েছে? আপনারা চুপ করে আছেন তো?
পার্টি পত্রপত্রিকা পাঠ, মার্কসবাদী সাহিত্যপাঠকে এমনভাবে শ্রমজীবী জনতার স্তরে নামিয়ে আনা গিয়েছিল বলেই দু-বছরের মধ্যেই রাশিয়া সংঘটিত করতে পেরেছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যে দুরন্ত সংগ্রাম ১৯০৫ সালে। ব্যর্থ হয়েছিল ১৯০৫ সালের বিপ্লব, কিন্তু এ-কথা তো আজ আর নতুন করে বলে দেওয়ার নয় যে, ১৯০৫-এর ব্যর্থতাই রচনা করে রেখেছিল ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের বনিয়াদ।
।। দুই ।।
১৯০৫ সালের বিপ্লবে পরাভবের পর জ্ঞানচর্চা ও মার্কসবাদ চর্চায় আরও একাগ্র হয়েছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। ‘প্রবাসী’-র সেই টুকরো লেখাগুলির একটি বাক্য, একটি নির্দ্বিধ নিখাদ বাক্য কখন আমরা আনমনে ফেলে এসেছি, ‘লেনিনের চেয়ে বড়ো বিপ্লবী এ পর্যন্ত কেহ জন্মগ্রহণ করে নাই।’ সব থেকে বড়ো বিপ্লবী বলেই হয়তো তিনি সমাজ-বদলের যাত্রীদের মধ্যে কার্ল মার্কস-ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস উত্তরকালের সবথেকে বড়ো পাঠক।
বিপ্লবকে শুধুমাত্র ধারণায় না রেখে পার্টি কর্মসূচির মধ্যে নিয়ে আসার লক্ষ্যে কী পড়লেন নির্বাসিত লেনিন?
প্রশ্নটা অবশ্য উলটো দিক থেকেও করা যেতে পারে, কী পড়লেন না লেনিন?
সেই পড়ার পথে তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল মার্কসবাদের বৈপ্লবিক তত্ত্বে সংশোধনবাদের পথে বিচ্যুতি আনার যে কোনো প্রয়াসকে রুখে দেওয়া। প্রবল পরাজয়ের পর এই বৈপ্লবিক একাগ্রতায় সমগ্র শক্তিকে সংহত রাখা বড়ো কঠিন কাজ। ইদানীন্তনকালেও আমরা তো দেখি যে কোনো সমূহ পরাজয়ের পরেই কৌশলে সমাজবদলের তাত্ত্বিক ভিত্তিতেই অবিশ্বাসের কাঁপন হেনে দেওয়া হয়। সেদিনের রাশিয়ায় লেনিন নির্ণয় করে নিলেনঃ ‘আজ যখন দেশের মানুষ হৃদয়ঙ্গম করছে প্রত্যক্ষ বৈপ্লবিক সংগ্রামের অভূতপূর্ব সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা, তখন বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে তাত্ত্বিক সংগ্রাম, বৈপ্লবিক মার্কসবাদের জন্যে তাত্ত্বিক সংগ্রামই পাখির চোখ।’
অস্ট্রিয়ার দার্শনিক ও ভৌতবিজ্ঞানী আর্নস্ট মাখ (১৮৩৮-১৯১৬)-কে অবলম্বন করে রাশিয়ার বিশিষ্ট কয়েকজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী যখন মার্কসবাদের মৌলিক দর্শনে ভাববাদ-ঘেঁষা অভিজ্ঞতাবাদের সঞ্চার ঘটাতে চাইছিলেন সবার আগে রুখে দাঁড়ালেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। নির্দয় সমালোচনায় বিদ্ধ করলেন মাখপন্থীদের। স্মরণ করে নেব মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ থেকে বিচ্যুত এই রুশ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন খোদ গোর্কির মতো শ্রদ্ধেয়জন। কী কঠোর সমালোচনায় প্রিয় বন্ধু গোর্কিকে তিরস্কার করেছেন ভ্লাদিমির ইলিচ, বন্ধুকে পরিত্যাগ না করেই। সেদিনের কথা স্মরণ করে লেনিন-প্রয়াণের পর গোর্কি লিখেছিলেন, ‘তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক, কঠোরতম শিক্ষক।’ মার্কসবাদী দর্শনকে গুলিয়ে দেওয়া, অপরিছন্ন করার এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে লেনিন লিখলেন ‘বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমালোচনা’। এ-বই লিখতে বসে মার্কস- এঙ্গেলসকে আরও নিবিড় করে বারংবার পড়লেন লেনিন, সেইসঙ্গে পড়লেন দিদেরো, ফয়েরবাখ, চেরনিশ্যেভিস্ক এমনকী বস্তুবাদের জঙ্গি বিরোধী আইরিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলে (১৬৮৫-১৭৫৩)।
লক্ষ্য এক এবং অদ্বিতীয়, মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে একাগ্র থেকে বিপ্লবকে বাস্তব কর্মসূচিতে সজীব রাখা।
‘বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমালোচনা’-কে আরও প্রসারিত করতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনাপর্বে লেনিন মনোনিবেশ করলেন তাঁর’দার্শনিক নোটবই’-এ। এবার মার্কস-এঙ্গেলস-এর বনিয়াদে অবিচল থেকে লেনিন হেঁটে গেলেন আরও আরও দূরযানী পূর্বপথে। তিনি জানতেন গ্রহণ-বর্জনের দ্বান্দ্বিকতায় কীভাবে হেগেলকে পরিগ্রহণ করেছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস, কীভাবে হেগেল গ্রহণ করেছিলেন আরিস্ততলকে, আরিস্ততল প্লাতোকে...। লেনিন নিবিড় পথ নিলেন আরিস্ততল থেকে, এমনকী সোক্রাতেস-পূর্ব হেরাক্লিটাস থেকেও।
আরিস্ততলকে পরিগ্রহণ করে তিনি মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার পথে আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলেন, জানিয়ে দিলেন দর্শনের সেই আদত কথা - তাকে অনুশীলনে নিয়ে আসাই জরুরি। দুনিয়ায় কোনও কিছুই অনড় নয়, পরস্পরের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট। এই দ্বন্দ্বের পথেই সহসা উল্লমফেন, ধারাবাহিকতার সহসা ভাঙনে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
আসলে প্রথম মহাযুদ্ধের সেই দুর্যোগের দিনকালেই লেনিন দেখছিলেন বিপ্লবের সম্ভাবনায় হিরণ্যগর্ভা হয়ে আছে সময়।
।। তিন ।।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর যখন দেশে ফিরেছেন লেনিন, উপস্থাপন করা হয়েছে তাঁর এপ্রিল থিসিস, শ্রমিক শ্রণির মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে বলশেভিকদের গণভিত্তি, তখনই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লেনিন-বিরোধী কুৎসা। লেনিন জার্মান গুপ্তচর। লেনিন জার্মান সোনার বিনিময়ে ঘুষ দিয়ে শ্রমিক সমর্থন কিনছেন। লেনিন বিরোধী প্রচার হিংস্র হয়ে উঠছে ক্রমশ। কনস্তান্তিনোভা ক্রুপস্কায়া স্মরণ করেছেন সেই ভয়ানক দিনগুলি, পিটার্সবার্গের রাস্তায় হাঁটলে শোনা যাচ্ছে,সাধারণ গৃহবধূ কয়েকজন গল্প করছে, ভয়ানক ঠাট্টার ধারালো হাসিতে বলে উঠছে,’আচ্ছা, এই লেনিন লোকটাকে ধরা পড়লে কি করতে হবে বলো তো! কুয়োয় চুবিয়ে মারা হবে নাকি অন্য কোনওভাবে...!
ক্রুপস্কায়া আক্ষেপ করেছেন, এসব কুৎসা বুর্জোয়াদের মুখ থেকে শোনা এক কথা, কিন্তু সাধারণ মানুষের মুখ থেকে শুনলে কষ্ট হয়।
লেনিন তখনও পড়ছেন। তুমুল সাংগঠনিক ব্যস্ততার মধ্যে, যুদ্ধোন্মাদ লেনিন-বিরোধী হিংস্রতার মধ্যেও পড়ছেন। পড়ছেন প্যারি কমিউনের ইতিহাস, এঙ্গেলস-এর লেখা থেকে সমরবিজ্ঞান, মার্কস থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতি, রাষ্ট্রব্যাখ্যান, এমনকী রুশ সোশ্যাল রেভলিউশনারিদের পত্রপত্রিকা থেকে ভূমিসম্পর্ক।
এই তুমুল সাংগঠনিক শ্রম ও অধ্যয়নের শ্রমের জমিন থেকেই কদিন পরেই ফুটবে নভেম্বরের রক্তিম পুষ্পগুচ্ছ।
।। চার ।।
আমরা শুরুতে যেকথা বলেছিলাম, একা পড়েননি লেনিন। পড়েছেন, পড়তে প্রাণিত করেছেন সহ-নেতৃত্বকে - কোলোনতাই, স্তালিন, স্লিয়াপনিকভ, সেরদেলভ, কামেনেভ, জিনোভিয়েভ...। এবং বলশেভিক কর্মীদের শেষতম স্তর অবধি।
দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রধান মুখ অবশ্যই ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। নবজাত বৈপ্লবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার তিনিই প্রাণনেতা। তাঁর মতো প্রাজ্ঞজন এই রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেনএবং সেখান থেকেই বিজ্ঞান শিল্প সংস্কৃতি শিক্ষা জনস্বাস্থ্য খেলাধুলায় সোভিয়েতের সমূহ বিকাশের সূচনা।
সোভিয়েতের সমালোচকরা যদি একবার আজকের দেশ ও এরাজ্যের কথা ভাবেন, ভাবুন মেধাহীন অধ্যয়নহীন নেতৃত্বের অনুসরণে কীভাবে ধূর্ত অশিক্ষিতের লোভ দুর্নীতি ও প্রবঞ্চনার জাল বুনে যায়।