৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯
প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিকের চোখে নভেম্বর বিপ্লব
পল্লব সেনগুপ্ত
জন রীড
১৯১৮ সালের জুলাই সংখ্যা ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ঃ ‘অ্যাট দ্য ক্রস রোডস’। ওই নিবন্ধে মাত্র কয়েকমাস আগে ঘটে-যাওয়া নভেম্বর বিপ্লব সম্পর্কে তিনি লিখছেনঃ “We know very little of the history of the present revolution in Russia we cannot be certain if she in her tribulations is giving expression to man's indomitable soul against the prosperity built upon moral nihilism.’’ রুশ বিপ্লবের সাফল্যের মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কবি তাঁর সত্য রূপটিকে চিনেছিলেন এবং তাকে উৎসুকভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন; যদিও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চোখ এড়িয়ে সেই মহান বিপ্লবের সমস্ত সংবাদ এদেশে এসে তখনও পৌঁছায়নি। এদেশের মানুষ তার সামগ্রিক পরিচয়টাকে জানতে পেরেছিল আরও কিছুদিন পরে।
কিন্তু শুধু এদেশের মানুষরাই বা বলছি কেন! রুশ বিপ্লবের সঠিক সংবাদ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও খুব সুলভ্য ছিল না। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির পরিচালকরা এবং তাদের সহযোগী গণমাধ্যমগুলি রাশিয়ার বিপ্লবের সেই যুগান্তকারী পালাবদলের প্রকৃত সমাচার প্রায় প্রচার করতই না, যেটুকু খবর তাদের বজ্রমুষ্টি এড়িয়ে মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছাতো, তাও ছিল ব্যাপকভাবে মিথ্যায় ভরা অথবা বিকৃত। এই আঁধিকে ঘুচিয়ে নভেম্বর বিপ্লবের প্রত্যক্ষদ্রষ্টা এক মার্কিন সাংবাদিক - জন রীড - যে দশটি দিন ব্যাপ্ত করে বিপ্লবের প্রথম বিস্ফোরণ থেকে তার বিজয়ের নিশ্চিতির ঘটনাগুলো ঘটেছিল, সেই সবকিছুর বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন ১৯১৮ সালে; যা পরের বছর প্রকাশিত হয় একটি বইতেঃ ‘টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’ - বহু বাধা এবং বিপর্যয়কে এড়িয়ে যেটি মানুষের হাতে পৌঁছায়। এবং রুশ বিপ্লব সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ সেই প্রথম যথাযথভাবে জানতে পারল।
।। দুই ।।
এই বইয়ের রুশ সংস্করণের ভূমিকায় লেনিনের জীবনসঙ্গিনী এবং তাঁর সংগ্রামের সহযোদ্ধা নাদেজদা ক্রুপস্কায়া একে অভিহিত করেছিলেন ‘‘এক ধরনের মহাকাব্য’’ বলে। কথাটা খুব খাঁটি। গল্প বলা এবং রোজনামচা লেখার মিশ্রভঙ্গিতে রচিত এই ইতিহাসের দলিলটিতে বাস্তবিকই একটা মহাকাব্যসুলভ ব্যাপ্তি আছে। সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যচর্চা - দুটোই ছিল জন সাইলাস রীডের নেশা এবং পেশা। তাই এই বই নিছক ইতিহাসের তথ্যভাণ্ডার কিংবা ব্যক্তিগত ভাবনার সংকলন নয়। একটা মুমূর্ষুপ্রায় দেশের মানুষ কীভাবে যুগান্তকারী মহাসংগ্রামের উত্তাপে সঞ্জীবিত হয়ে উঠছে, কেমন করে তারা যুগসঞ্চিত দুঃখ-বেদনার গ্লানিকে মুছে ফেলে আত্মবিশ্বাসে সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে - সেই বিশাল ঘটনার দিগন্তপ্রসারী ব্যাপ্তি তো সত্যিই মহাকাব্যিক! ক্রুপস্কায়া তো ঠিকই বলেছেন! এই রাজনৈতিক মহাকাব্যের রচয়িতা অপক্ষপাতী বা নিরাসক্ত ছিলেন না অবশ্যই। কিন্তু আদর্শগতভাবে সমাজতন্ত্রী এক তীক্ষ্ণধী বুদ্ধিজীবীর পক্ষে তা থাকা কি আদৌ সম্ভব ছিল?... নিশ্চয়ই উত্তর হবে - না, কিন্তু ওই বিপ্লবের সহমর্মী হওয়া সত্ত্বেও রীড কোথাও ইতিহাসের বদলে নিজের পছন্দসই কল্পিত কথা লেখেননি। সম্পূর্ণ ভিন্নভাষী এবং বহুলাংশেই ভিন্ন সংস্কৃতির একটি দেশে গিয়ে এটা করা খুব সহজ একটা ব্যাপার ছিল না রীডের পক্ষে। তবু প্রায় নিখুঁতভাবেই ওই অভিজ্ঞতাগুলিকে কলমবন্দি করতে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন এবং সামান্য দু-চারটে জায়গা ছাড়া তেমন ভুলভ্রান্তি কিছু ঘটেনি তাঁর লেখায়। তাই নভেম্বর বিপ্লবের প্রথম প্রামাণ্য এবং সুস্পষ্ট চিত্রায়ণ যে ঘটেছে এই ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ বইয়ের প্রায় সর্বত্রই সে কথা মানতেই হবে।
‘টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটির প্রথম রাশিয়ান সংস্করণের প্রচ্ছদ (বামদিক থেকে প্রথম) ও পরবর্তীতে প্রকাশিত ইংরাজি অনুবাদের কয়েকটি প্রচ্ছদ (ডানদিকেরগুলি)।
।। তিন ।।
এটাও অবশ্য ঠিক যে, ঠিক ‘‘দশটা দিনের মধ্যেই একটা অতবড়ো ঐতিহাসিক দিগ্নির্দেশী ঘটনা সহসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে স্থায়ীভাবে শিকড় গেড়ে বসেনি। রীডের দেওয়া গ্রন্থনাম কিছুটা ‘আলঙ্কারিক’ অর্থেই যে ব্যবহৃত, সেটা বুঝতে হবে। তবে ওই দশটা দিন এবং তার আগে-পিছের অনেক অনেক দিনের, মাসের, বছরের ঘটনা সোভিয়েত বিপ্লবকে দানা বাঁধতে এবং বিকশিত হতে সহায়তা করেছে। রীড এই দশটি দিনকে বিপ্লবের (নাটকের পরিভাষায়) ‘ক্লাইম্যাক্স’ বা ‘শীর্ষবিন্দু’ হিসাবে ধার্য করে এমন নাম দিয়েছিলেন যে, এমনটা মনে করতে হবে। সেই ক্লাইম্যাক্স-পর্বের আলোচনা তো করবই; তবে তার আগে ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রতিবেদক সঞ্জয়ের’ সঙ্গে তুলনীয় (হয়তো!) এই জন সাইলাস রীডের ব্যক্তি পরিচিতিটাও একটু দিতে হবে। (এই বইকেও তো রুশ বিপ্লবের ‘মহাকাব্য’ বলেই মনে করেছেন স্বয়ং ক্রুপস্কায়াই!)
জন সাইলাস রীড ওরফে ‘জ্যাক’ রীডের জন্ম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন রাজ্যের পোর্টল্যান্ড শহরে ১৮৮৭ সালে। মোটামুটি স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও বরাবরই শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মী ছিলেন। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। চিন্তাদর্শে সমাজতন্ত্রের অনুগামী এই যুবকটি সাংবাদিক হিসাবেও চক্ষুশূল ছিলেন রাষ্ট্রশক্তির। এই বাবদে তাঁকে অনেকবারই জেল খাটতেও হয়েছে। আমেরিকার কমিউনিস্ট লেবার পার্টির সদস্য হওয়ায় তাঁর চলাফেরা, লেখালেখি - সবই ছিল পুলিশি নজরে। ১৯১৩-তে মেক্সিকোর বিপ্লব চলাকালীন তিনি সেদেশে যান এবং প্রথম মহাযুদ্ধেরও যুদ্ধ-সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করেছেন রীড। তারই সূত্রে তাঁর রাশিয়ায় যাওয়া এবং সেখানে লেনিন প্রমুখ বিপ্লবের নির্মাতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া। এবং বিপ্লবের সূত্রপাতের প্রত্যক্ষদ্রষ্টা হওয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করার সময়ে ইয়োরোপের যুদ্ধবিব্রত বেশ কয়েকটি দেশে যাবার অভিজ্ঞতাও তাঁর ছিল। তবে বহু ক্ষেত্রেই তাঁকে শত্রুপক্ষের গুপ্তচর বলে সন্দেহ করা হয় - যার ফলে তাঁর পাঠানো খবরাখবরও হামেশাই সেন্সর করা হতো বা আটকানো হতো। রাশিয়ায় যাবার পর মার্কিন দূতাবাসও তাঁর বিপ্লবী বলশেভিকদের সঙ্গে মেলামেশাটা সম্পর্কে সন্ধিগ্ধ হয়ে ওঠে এবং তাই দেশে পাঠানো খবরাখবরও গোপন নির্দেশে ডাকঘরেই ‘গাপ’ করে দেওয়া হতো। এর মধ্যে অবশ্য বিপ্লবের কিছু আগে রীড স্বদেশে ফেরেন একবার। কিন্তু কর্তৃপক্ষের শ্যেনদৃষ্টি তাঁর ওপর সর্বদাই থাকে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে, রীড তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান লেখাপত্তরে। ফলে দেশের কাগজে তাঁর লেখাও হয় বন্ধ, নয় কাটা-ছেঁড়া হতো সেগুলো। রীড এরপরেই রাশিয়ায় ফেরেন এবং সরাসরি বলশেভিক নেতৃত্বের সাহচর্যে পৌঁছান। আর তখনই সূত্রপাত হয় আসন্ন বিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্য ও সত্য সংগ্রহ এবং সঞ্চয়ের কাজ। গড়ে উঠতে থাকে রুশ বিপ্লবের প্রথম প্রামাণ্য দলিল, যা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছায় - অবশ্য অনেক বাধা এবং বিঘ্নকে অতিক্রম করেই।
‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ বইটির বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে নানা সময়ে প্রকাশিত বাংলা সংস্করণের প্রচ্ছদ।
।। চার ।।
রীডের নিজের কথাতেইঃ ‘‘বইটি হলো ঘনীভূত ইতিহাসের একটা অনুচ্ছেদ - সে ইতিহাসকে আমি যেটুকু দেখেছি।’’ (ভূমিকা) রীড মূলত পেত্রোগ্রাদ (রাশিয়ার রাজধানী) শহরে বিপ্লবের ক্রমসঞ্চিত ঘূর্ণি কীভাবে ৭ নভেম্বর থেকে পরবর্তী দিন দশেকের মধ্যে আছড়ে পড়েছিল, তার বিবরণই দিয়েছেন। বলশেভিকদের নেতৃত্বের বিভিন্ন পর্যায়ের কমরেডদের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক এবং আদর্শগত ঘনিষ্ঠতা এই ব্যাপারে তাঁর আরদ্ধ কাজের সহায়ক হয়েছিল বিশেষভাবে। রীডের নিজের কথাতেইঃ ‘‘পেত্রোগ্রাদে যেটা হচ্ছিল, কম বা বেশি তেমনটাই ঘটেছিল রুশ দেশের অন্যসব অঞ্চলেও।’’ এই বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের মধ্যে রুশ বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং তার অন্তরালে ক্রমপুঞ্জিত কারণগুলির সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন রীড। কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে সেদেশের মানুষ অত্যাচারিত এবং শোষিত হয়েছেন ধনী, ভূস্বামী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক এবং অনুগত (একইসঙ্গে) রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে, কেমনভাবে বছরের পর বছর ধরে সেই অপহ্ণবের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে বহু জায়গায় মানুষ ফুঁসে উঠছে, রুখে দাঁড়িয়েছে, বিফল হয়েছে কিন্তু মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়নি - সেই বিশাল পরিপ্রেক্ষিতের সংক্ষিপ্ত অথচ ঋজু প্রতিবেদন করেছেন রীড।
তারপর থেকে শুরু হয়েছে বিস্তৃত বিবরণ। অজস্র নথিপত্র, ইস্তাহার, গোপন এবং প্রকাশ্য নির্দেশাবলী, মৌখিক ও লিখিত সংবাদ, আর সেইসবের সঙ্গে রীডের নিজস্ব প্রত্যক্ষদৃষ্ট অভিজ্ঞতা - এত সবকিছু মিলে জুগিয়েছে এই বইয়ের সমস্ত উপকরণ। সেগুলোর সমাহারে রীড লিখে গেছেন এক অনন্যপূর্ব ইতিহাস - যা বর্ণিত হয়েছে একেবারে গল্প বলে যাওয়ার ভঙ্গিতে। (নাকি ‘মহাকাব্যিক’ রীতিতে!)। বলশেভিকরা কীভাবে সংহত হতে শুরু করেছিলেন, কেমন করে পদে পদে তাঁদের বাধা পেতে হয়েছে, কোন্ আন্তরিক দক্ষতায় দেশের মানুষের বৃহদংশের কাছে তাঁরা আপনজন হয়ে উঠেছেন, ঘরের ও বাইরের শত্রুদের মোকাবিলা কেমন দৃঢ়তার সঙ্গে লেনিন ও অন্য সমস্ত অগ্রগণ্য নেতাদের কর্মকৌশলে করা সম্ভব হয়েছিল - ঋজু ভাষায় রীড তার প্রতিবেদন করেছেন। ১৮৯৪ সাল থেকে যে রুশ সম্রাট সেই দেশের সিংহাসনে বসে অপশাসন চালিয়ে গেছেন, সেই জার দ্বিতীয় নিকোলাস যখন সমস্ত রুশি জনতার স্ফুটমান বিক্ষোভ (যাঁরা গোর্কির ‘মাদার’ পড়েছেন, তাঁরা এটার সঙ্গে পরিচিত) আর সামলাতে পারেননি, তিনি সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেন তাঁর অন্যতম ক্ষমতাশালী মন্ত্রী আলেকজান্দার কেরেনস্কির হাতে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তিনিও ছিলেন মেনশেভিক। কায়েমি স্বার্থেরই পরিপোষিত ও অনুগত মানুষ। দেশের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও বিক্ষোভকে তাঁর পক্ষে সামলানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, জনসাধারণের বৃহত্তম অংশের আপনজন হয়ে উঠছিল। সেটা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ এই পালাবদলের সংকেত বিশ্বযুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত হওয়া পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক দেশগুলির পরিচালকদের চোখ এড়ায়নি। তারা বুঝেইছিল যে, জার্মানির সঙ্গে যত স্বার্থ সংঘাতই থাকুক না কেন, ধনতন্ত্রী অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপরে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলির সবচেয়ে বড়ো শত্রু হলো কমিউনিজম। তাই বলশেভিক বিপ্লব যদি সফল হয়, তাহলে কমিউনিস্ট রাশিয়াই হবে তাদের বৃহত্তম বিপদের কারণ। তাই বিপ্লবের সময় এবং তারপরেও সাম্যবাদী রাশিয়াকে বিপন্ন করতে তারা সদাই তৎপর হতো।
।। পাঁচ ।।
বলশেভিকদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মার্কিনি কমিউনিস্ট জন রীডের একটা সহমর্মিতা গড়ে উঠল। কীভাবে সেটা ঘটল, তার হদিশও আছে এই বইতে। আর সেই কমরেডশিপের সূত্রেই তিনি লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি এবং অন্যান্য নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পান এবং অভ্যুত্থানের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি সম্পর্কে অবহিত হতে থাকেন। প্রতিবিপ্লবী মেনশেভিকরা কেরেনেস্কির নেতৃত্বে কেমন করে বিপ্লবের হানিসাধন করতে সচেষ্ট ছিল এবং কীভাবে সেই দুষ্প্রয়াস ব্যর্থ করে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করতে পারল - তার জীবন্ত চিত্রায়ণ আছে এই বইতে।
বিপ্লবের বিজয়পর্বে যে ‘সমারোহ অধিবেশন’ অনুষ্ঠিত হয়, তার বর্ণনা দিয়ে রীড তাঁর বই শেষ করেছেন। সার্থক বিপ্লবের অনুপুঙ্খ রূপরেখাটি রাঙা-রঙিন করে চিত্রিত করার পর, সবশেষে রীড বইয়ের শেষ পঙ্ক্তিটিতে লিখেছেন এই কথাগুলিঃ ‘‘শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের এই সংহত শক্তি সব মেহনতি ও শোষিত মানুষদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হয়ে অর্জিত ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। অন্য সব দেশে ও শ্রমিকশ্রেণির কাছে যাতে ক্ষমতার চাবি গিয়ে পৌঁছায়, তার জন্য বৈপ্লবিক চিন্তাকে মূর্তিমন্ত করবে। আর শান্তি এবং সমাজতন্ত্রের চিরস্থায়ী জয়কে সুনিশ্চিত করবে। করবেই।’’
যেসব দলিল সংকলিত করে এই বই লেখা হয়, বিপ্লবের পর দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরেই মার্কিন-কর্তৃপক্ষ তা কেড়ে নেয়। বহু প্রয়াসে আইনের সাহায্যে রীড সেইসব নথি পুনরুদ্ধার করার পর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে বইটি লেখেন।... প্রকাশক পেতেও কম বাধা আসেনি। তবে শেষ পর্যন্ত বইটা বেরোয় ১৯১৯ সালে। বিশ্বের মানুষের হাতে নভেম্বর বিপ্লবের প্রামাণ্য বিবরণ এসে পৌঁছায়। আর তার পরের বছরই মস্কোতে টাইফাস রোগে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। ক্রেমলিনের প্রাচীরের ধারে তাঁর সমাধির ওপরে তাঁরই কমরেডরা এই কথাগুলি গ্রানাইট স্মৃতিফলকে খোদাই করে দেন। ‘জন রীড, তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিনিধি, ১৯২০।’ আর এটাই ছিল তাঁর অভীস্পিত আত্মপরিচয়ও।