৬০ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৪ নভেম্বর, ২০২২ / ১৭ কার্ত্তিক, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (সাত)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
দ্বন্দ্বতত্ত্ব হলো বিকাশের তত্ত্ব অর্থাৎ সমস্ত ঘটনাকে এবং তার বিকাশকে পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যে না দেখলে তা হবে গুরুতর ভ্রান্তি। আবার দ্বন্দ্বতত্ত্ব হলো সার্বিক সম্পর্কের তত্ত্ব।
দ্বন্দ্বতত্ত্ব - সার্বিক সম্পর্কের তত্ত্ব
● সমস্ত বস্তু ও প্রক্রিয়া পরস্পর সম্পর্কিত এবং পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কিছু বস্তু ও ঘটনাকে বিচার করলে ভুল হবে। কোনো ব্যক্তি মানুষকে তার পরিবার, তার চারপাশের সমাজ তথা সমসাময়িক আর্থিক-সামাজিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে বিচার না করা হলে তা হবে অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত মূল্যায়ন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধুলিকণা ও গ্যাসীয় মেঘ যান্ত্রিক গতির ফলে নিকটবর্তী হলো। জমাটবদ্ধ হওয়ার ফলে তাপ ও চাপের উদ্ভব ঘটল। এটা হলো পদার্থিক গতি (Physical Motion)। এটা বলা যেতেই পারে যে, যান্ত্রিক গতির ফলেই পদার্থিক গতির উদ্ভব ঘটল। শুধুমাত্র পদার্থিক গতিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে তার উৎস ও বিকাশকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা যাবে না। পৃথিবীর উদ্ভব হলো পদার্থিক গতির মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর মধ্যে জলমণ্ডল ও আবহমণ্ডল গড়ে উঠল। জলের মধ্যে জড় পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া (reactions) শুরু হলো। সৃষ্টি হলো নানা ধরনের যৌগিক ও জটিল পদার্থ। বিবেচনায় রাখতে হবে যে পদার্থিক গতিকে অবলম্বন করেই রাসায়নিক গতির উদ্ভব ঘটল। এই রাসায়নিক গতির ফলেই প্রাণের সৃষ্টি হলো। বস্তুর রাসায়নিক গতিকে অবলম্বন করেই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটল। প্রাণ সৃষ্টির পর তার বিবর্তন ধারা শুরু হলো। কয়েক শত কোটি বছরের বিবর্তন ধারার মধ্য দিয়েই মানুষের আবির্ভাব ঘটল। অর্থাৎ প্রাণের জৈবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক মানুষ অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্সের (Homo sapiens sapiens) উদ্ভব ঘটল। আবার পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর গড়ে উঠল মানব সমাজ। প্রথম সমাজের রূপ ছিল আদিম সাম্যবাদী সমাজ। মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির ধারায় ক্রমান্বয়ে মানব সমাজের কালের পরিবর্তন ঘটল। আদিম সাম্যবাদী সমাজ → দাস সমাজ → সামন্ততান্ত্রিক সমাজ → পুঁজিবাদী সমাজ → সমাজতান্ত্রিক সমাজ → সাম্যবাদী সমাজ → সমাজের এই গতিকে বলে সামাজিক গতি। জৈবিক গতিকে বাদ দিয়ে সামাজিক গতি সম্ভব হয় নি। যান্ত্রিক গতিকে নির্ভর করে পদার্থিক গতি, পদার্থিক গতিকে অবলম্বন করে রাসায়নিক গতি, রাসায়নিক গতিকে নির্ভর করে জৈবিক গতি, আবার জৈবিক গতিকে নির্ভর করে সামাজিক গতি। অর্থাৎ পূর্বের গতির ওপর পরবর্তী গতি নির্ভরশীল।
● মানুষের জীবন যদি লক্ষ করা যায়, তাহলে দেখা যায় শৈশবকে অবলম্বন করে কৈশোর, কৈশোরকে অবলম্বন করে যৌবন, যৌবনকে অবলম্বন করেই প্রৌঢ়ত্ব, আবার প্রৌঢ়ত্বকে অবলম্বন করে বার্ধক্য। কোনো কিছুকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার চেষ্টা হলে তা হবে ভ্রান্তি।
● গুণগতভাবে উন্নতমানের পার্টি সদস্য শাখার মান উন্নত করে, উন্নত শাখার মান সংশ্লিষ্ট এরিয়া কমিটিকে শক্তিশালী করে, শক্তিশালী এরিয়া কমিটি জেলা কমিটির শক্তি বৃদ্ধি করে। একটির ওপর আরেকটি নির্ভরশীল।
● বিকাশই বস্তুজগতের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। সমগ্র বস্তুজগৎ পরস্পর সম্পর্কিত একটি অখণ্ড সমগ্রও বটে। একটি বস্তু ও ঘটনার বিকাশ বিচ্ছিন্নভাবে অর্থাৎ এককভাবে হয় না। প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার বিকাশ অন্য বস্তু ও ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। বস্তু ও ঘটনাকে তাদের সার্বজনীন সম্পর্কের ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। দ্বন্দ্বতত্ত্ব বস্তুজগৎকে অখণ্ড সমগ্র হিসাবে বিচার করে।
● বস্তুজগতে বহুরূপের বস্তু ও ঘটনা বিচার করছে। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক হলো বহুমুখী। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সমস্ত রকমের সম্পর্কের বিচার না করে কেবলমাত্র সাধারণ সম্পর্কগুলি যেগুলি সমস্ত বস্তু ও ঘটনার মধ্যে বিরাজমান, সেগুলিরই বিচার করে। এই পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জগতের নিয়মাবলি জানতে সাহায্য করে। মানুষের ব্যবহারিক জীবনের কার্যকলাপের জন্য এই নিয়মগুলি সম্পর্কে জ্ঞান অপরিহার্য।
● বস্তু ও ঘটনাসমূহের মধ্যে সার্বজনীন সম্পর্কের বহুবিধ আকার ও রূপ (categories) রয়েছে। পারস্পরিক সম্পর্কের বহুবিধ আকার ও রূপের দ্বন্দ্বতত্ত্ব বস্তুজগতের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিরাজ করে তা পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যে বিকাশ এবং মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূল নীতিগুলি সম্পর্কে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে আমাদের সাহায্য করে।
● এবারে আমরা সার্বজনীন সম্পর্কের বহুবিধ রূপ সম্পর্কে আলোচনায় প্রবেশ করব -
বিশেষ ও সার্বজনীন [Individual and universal]
● প্রতিটি বস্তু বা ঘটনা কিছু বিশেষ ধর্ম (property) বা বৈশিষ্ট্য বহন করে। এই বৈশিষ্ট্যই তাকে অন্যান্য বস্তু বা ঘটনা থেকে পৃথকভাবে বুঝতে সাহায্য করে। বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করার সাথে সাথে অন্যান্য বস্তু বা ঘটনার সাধারণ বৈশিষ্ট্যও বহন করে। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হলো সার্বজনীন। সুতরাং এভাবেই তাহলে বলা যেতে পারে যে, বিশেষ বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও প্রতিটি বস্তু ও ঘটনাই অন্যান্য বস্তু ও ঘটনার সঙ্গে সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যের দ্বারা সম্পর্কিত। ধরা যাক দুই ব্যক্তি, অমল ও ইসমাইল। অমলের শিক্ষা, চালচলন, জীবন আচরণের যেমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আবার ইসমাইলেরও শিক্ষা, চালচলন, জীবন আচরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। তবে অমল ও ইসমাইল দুইজনই সার্বজনীন মানব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আবার সেই ব্যক্তি মানুষ সার্বজনীন মানব সমাজের অঙ্গ ও তার সাথে সম্পর্কিত।
● সামন্তবাদী সমাজ বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করত। আবার পুঁজিবাদী সমাজেরও রয়েছে বহু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তবে এই দুই ধরনের সমাজই মানব সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বহন করে। পুঁজিবাদ একটি নির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থা। উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন ও তাকে আত্মসাৎ করা হলো পুঁজিবাদের সার্বজনীন রূপ। লগ্নিপুঁজি হলো পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। এর সার্বজনীন বহিঃপ্রকাশ হলো সাম্রাজ্যবাদ। বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজি (Globalised Finance Capital) পুঁজির নির্দিষ্ট রূপ। বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির আগ্রাসন বর্তমান পৃথিবীতে সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে।
● বিশেষ ও সার্বজনীনের পারস্পরিক সম্পর্কের দ্বন্দ্বতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানই বাস্তব জগতের বহুবিধ প্রক্রিয়ার গোলক ধাঁধার মধ্যে আমাদের সঠিক দিশা তথা পথের সন্ধান দেয়। বিকাশের নিয়মকে বুঝতে ও তাকে প্রয়োগ করতে সাহায্যও করে।
● প্রতিটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য বহন করে। আবার প্রতিটি সার্বজনীনতার প্রকাশ ঘটে বিশেষকে নির্ভর করে অথবা বিশেষের মধ্যে।
আধার ও আধেয় (Form and Content)
● বস্তু ও ঘটনার সমগ্র উপাদান ও প্রক্রিয়াই সেই বস্তু ও ঘটনা বা প্রক্রিয়ার আধেয়। বস্তু বা ঘটনার অন্তর্বস্তুই হলো আধেয়। আধেয়র কাঠামো বা সংগঠনকে আধার বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ মৌলিক কণাসমূহ এবং তাদের অবস্থান পরিবর্তনের পদ্ধতি পরমাণুর আধেয়। মৌলিক কণার গঠনপ্রণালী পরমাণুর আধার। উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন ও পুঁজিপতি কর্তৃক তার আত্মসাৎকরণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আধেয়। বেকারি, বৈষম্য, দারিদ্র্য এগুলি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আধার।
● আধার ও আধেয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আধেয় ছাড়া আধার সম্ভব নয়। আবার আধার ব্যতিরেকে আধেয় সম্ভব নয়। বস্তু বা ঘটনামাত্রই হলো আধার ও আধেয়র ঐক্য। শোষণহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে বহুবিধ কার্যধারা তথা প্রক্রিয়া এটাই হলো সমাজ রূপান্তর প্রক্রিয়ার আধেয় (content)। শান্তিপূর্ণ না অশান্তিপূর্ণ পথ সেটাই হলো আধার।
● অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের জন্য আধেয়র মধ্যে ধারাবাহিক পরিবর্তন ঘটে, বিকাশ ঘটে। পুঁজিবাদী কথা যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে দেখি পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব হলো পুঁজিবাদী সমাজের আধেয়। পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলে। আধার অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজ আধেয় অপেক্ষা স্থায়ী। আধেয়র প্রতিটি পরিবর্তনের সাথে সাথে আধারের পরিবর্তন হয় না। আধেয়র ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনের ফলে নতুন আধেয়র উদ্ভব ঘটে। এই নতুন আধেয়র (content) সাথে পুরাতন অধারের (Form) দ্বন্দ্ব শুরু হয়, ক্রমান্বয়ে দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত নতুন আধেয়র সাথে সঙ্গতি রেখে নতুন আধারের উদ্ভব হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদিকা শক্তি ও ব্যক্তিগত পুঁজিবাদী মালিকানার মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। উৎপাদনের চরিত্র সামাজিক। সামাজিক উৎপাদনের অগ্রগতির ধারায় পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। আধেয়র পরিবর্তনের ফলেই আধারের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। আধেয় আধারের নিয়ন্ত্রক। নতুন আধারের আবির্ভাব নতুনভাবে আধেয়র বিকাশের সুযোগ করে দেয়।
(ক্রমশ)