E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯

ভারতবাসীর জীবন-জীবিকার উপর সর্বাত্মক আক্রমণের বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বর মাসে দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দিল সিপিআই(এম)


কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার দেশের মানুষের জীবন জীবিকার ওপর চরম আঘাত নামিয়ে এনেছে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, চরম বেকারত্বের জেরে জর্জরিত দেশের মানুষ। এরই বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বর মাসে ১০ দিন ব্যাপী দেশ জুড়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন সংগঠিত করার ডাক দিয়েছে সিপিআই(এম)। ওই মাসের ১৪ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করবে পার্টির রাজ্য কমিটিগুলি। জুলাই মাসের ৩০-৩১ তারিখ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১ আগস্ট, সোমবার এক বিবৃতিতে এরই পাশাপাশি চলতি মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৫ আগস্ট পার্টির প্রতিটি দপ্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং সংবিধানের প্রস্তাবনার অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে বলে জানানো হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সিপিআই(এম)-র ২৩তম কংগ্রেসের পরবর্তী চার মাস ফ্যাসিবাদী আরএসএস আরও আগ্রাসীভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি নামিয়ে এনেছে দেশে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নয়া উদারবাদী সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, ধান্দার পুঁজিবাদকে আরও শক্তিশালী করে তোলা। এই সাম্প্রাদায়িক-কর্পোরেট আঁতাত ভারতীয় অর্থনীতিকে আরও ধসিয়ে দিচ্ছে এবং এরই জেরে দেশবাসীর ঘাড়ে চাপছে নজিরবিহীন বোঝা।

মুদ্রাস্ফীতির বৃদ্ধি

অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, পাইকারি মূল্যসূচক এবং ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচকের রেকর্ড বৃদ্ধিতে মানুষের জীবন জীবিকা ধ্বংস হচ্ছে, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং এরই জেরে অর্থনীতিতে চাহিদার স্তরও নিম্নমুখী। অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় উৎপাদনমুখী কার্যকলাপও কমে এসেছে। এর জেরে অর্থনীতির আরও অধোগতি ঘটছে এবং কাজ হারাচ্ছেন মানুষ।

খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জেরে মুদ্রাস্ফীতি এবং একই সঙ্গে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়ছে। সাম্প্রতিক জিএসটি বৃদ্ধির জেরে প্রতিদিনের ব্যবহারের পণ্যের দামও বেড়ে গেল আরও। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি জিএসটি বৃদ্ধি এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের সেস/সারচার্জ প্রত্যাহারের দাবি আবার জানাচ্ছে।

গরিবদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপানোর বদলে রাজস্ব বাড়াতে অতি-ধনীদের ওপর আরও কর চাপানোর দাবি জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।

রেকর্ড বেকারত্ব

দেশের ২০-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪২ শতাংশ। এর অতিরিক্ত দেশের কর্মক্ষম ৯০ কোটি জনসংখ্যার ৬১.২ শতাংশ কাজ পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছে। শ্রমিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ মহিলারা, ৩৮.৮ শতাংশ। মোদি সরকারের ৮ বছরে চাকরির আবেদনের মাত্র ০.৩৩ শতাংশের সরকারি দপ্তরে নিয়োগ হয়েছে। অথচ ১০ লক্ষেরও বেশি শূন্যপদ রয়েছে।

কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, শূন্যপদে এখনই নিয়োগ করতে হবে এবং একই সঙ্গে বাড়াতে হবে রেগায় বরাদ্দ। বন্ধ করতে হবে যুবদের মধ্যে এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিভাজন।

আদিবাসীদের অধিকারে আক্রমণ

বনাঞ্চল সংরক্ষণ সংশোধনী আইনের ভিত্তিতে জারি নির্দেশিকা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। গ্রামসভা, আদিবাসী সমাজ সহ বনাঞ্চলের চিরকালীন বসবাসকারী অধিবাসীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে ওই নির্দেশিকায়। এঁদের আগাম সম্মতি ছাড়াই বনাঞ্চলকে মুনাফালোভী কর্পোরেটদের সুবিধার জন্য তুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই নির্দেশিকা। এরফলে বনাঞ্চল যেমন ধ্বংস হবে তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়বে।

চূড়ান্ত আধিপত্যবাদ

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিরোধী সরকারগুলি ভাঙতে ও বিরোধী নেতাদের হেনস্তার লক্ষ্যেই ইডি এবং সিবিআই-কে আরও বেশিভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে মোদি সরকার। সুপ্রিম কোর্টের এক বেঞ্চের সাম্প্রতিক রায়ে অর্থ নয়ছয় সংক্রান্ত আইনের ২০১৯ সালের সমস্ত সংশোধনীকেই বজায় রাখা হয়েছে। এর ফলে ইডি’র হাত আরও শক্ত হয়েছে। যে বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই রায় দিয়েছে সেই বিচারপতি এই রায়দানের পরেই অবসর নিয়েছেন। এই ধরনের রায় গণতন্ত্রের ওপর গুরুতর আঘাত।

সংসদের ওপর আঘাত

বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির মতো জ্বলন্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে দিতে অস্বীকার করে সংসদের ওপর নজিরবিহীনভাবে আঘাত হানছে মোদি সরকার। চলতি অধিবেশনে ২৭ সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, যা স্বাধীনোত্তর ভারতে বিরল ঘটনা।

যেভাবে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করা সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার নিন্দা করেছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। এক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের রায়কে হাতিয়ার করা হয়েছে, যার রায় দিয়েছিলেন সেই বিচারপতি।

যেভাবে জুবেইর আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট, যাদের বিদ্বেষ ভাষণের জেরে সাম্প্রাদায়িক হিংসা ছড়াচ্ছে, তাদেরকেই সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত মোদি সরকার। উলটোদিকে, ওইসব বিদ্বেষ ভাষণ ফাঁস করে যাঁরা সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁদেরকেই গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে।

ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তরা দীর্ঘ তিন বছর ধরে জেলে রয়েছেন। এছাড়াও সাংবাদিক, ছাত্র সহ অনেককেই ইউএপিএ-তে আটক করে রাখা হয়েছে হাজতে।

পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অবিলম্বে তিস্তা শীতলবাদ, আর বি শ্রীকুমার সহ ভীমা কোরোগাঁও সহ অন্য বন্দিদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।

আরও ধারালো সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ

শাসকদলের মদতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দাপাদাপি আরও বাড়ছে। এর জেরে আক্রমণের লক্ষ্য করা হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এবং হিংসার ঘটনাও বাড়ছে। দিল্লি এবং বিজেপি শাসিত অন্য রাজ্যে ব্যাপক হারে বুলডোজার রাজনীতির ফলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও ধারালো আকার নিচ্ছে। বিদ্বেষের বিষ প্রচার ও আতঙ্ক তৈরি করে মেরুকরণ এবং হিংসা ছড়াচ্ছে বিজেপি-আরএসএস। এর মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী ভাবাবেগকে একীকরণের চেষ্টা চলছে। যার মূল লক্ষ্য আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র ভেঙে দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করা।

ভারতের সাধারণতন্ত্রের ওপর আঘাতের আরও বড়ো ঘটনা সম্প্রতি প্রত্যক্ষ করা গেল নতুন সংসদ ভবনের ওপরে জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদির হিন্দু আচার মেনে পূজার্চ্চনার মধ্যে। ভারত রাষ্ট্র এবং সরকার যে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে এবং মোটেই ভারতের সংবিধানের পক্ষে নয়, তা আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।

দেশের নাগরিকদের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করা, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র এবং ভারতীয় সংবিধান রক্ষায় সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন মানুষ ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি।

কেরালা

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে অপব্যবহার করে কেরালার এলডিএফ সরকারকে ফেলার ছক কষছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেরালার কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিক্ষোভ দেখিয়ে যাচ্ছে। যেন বিজেপি’র সঙ্গে সমঝোতা করেই এলডিএফ-কে আক্রমণ শানাচ্ছে।

কেরালার বৈধ রাজস্বের অধিকারকেও বৈষম্যমূলকভাবে অস্বীকার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্পদের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করছে। এই সমস্ত ঘটনার তীব্র ভাষায় নিন্দা করছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। একই সঙ্গে কেরালার এলডিএফ সরকারকে রক্ষা এবং জনমুখী বিকল্প নীতির সপক্ষে দেশ জুড়ে প্রচার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি।

ত্রিপুরা

রাজ্য সরকারকে ব্যবহার করে ত্রিপুরাবাসী এবং সিপিআই(এম) নেতা-কর্মীদের ওপর ফ্যাসিস্ত কায়দায় আক্রমণ চালাচ্ছে বিজেপি। নির্বাচনের আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বদল করলো বিজেপি। জনগণ যাতে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নিতে না পারে সেজন্য হিংসা এবং ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। বিজেপি সরকারের এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি এবং হিংসার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিআই(এম)।

কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান

চলতি মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী পালন করবে সিপিআই(এম)। সোমবার সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিতে একথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই কর্মসূচি চূড়ান্ত রূপ নেবে ১৫ আগস্ট পার্টির প্রতিটি দপ্তরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার অঙ্গীকার গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এই সময়কালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, গণতন্ত্র রক্ষা, গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রচার চালাতে হবে। এরই সঙ্গে ভারতবাসীর জীবন জীবিকার ওপর যে আঘাত ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, তার বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বরের ১৪ থেকে ২৪ তারিখ, ১০ দিন ধরে প্রচার চালানো হবে। প্রতিটি রাজ্যকে এই প্রচার চালাতে গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আর সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করবে প্রতিটি রাজ্য কমিটি। আর এই কর্মসূচি চূড়ান্ত আকার নেবে প্রতিটি রাজ্যের রাজধানী শহরে কেন্দ্রীয় প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে, কেরালার এলডিএফ সরকারকে ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই প্রচারে এলডিএফ সরকারের জনমুখী বিকল্প কর্মসূচির কথা তুলে ধরতে হবে।