৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯
কাকাবাবু এবং আমাদের ‘দেশহিতৈষী’
শংকর মুখার্জি
এবছরের ৫ আগস্ট কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ, কাকাবাবুর ১৩৪তম জন্মদিবস। অন্যদিক দিয়ে দেখলে পার্টির উদ্যোগে কাকাবাবুর জন্মদিবস পালনে এ বছরই ষাট বছর। ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরি হলে পার্টির উদ্যোগে কাকাবাবুর জন্মদিবস পালনের সূচনা হয়। যদিও এরকমভাবে পার্টির উদ্যোগে জন্মদিবস পালনে কাকাবাবুর বিস্তর আপত্তি ছিল। ওই রামমোহন লাইব্রেরি হলের সভায় আরেকটি ঘোষণা করা হয়। ঘোষণাটি ছিলঃ কয়েকদিন পর আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে থেকে সাপ্তাহিক ‘দেশহিতৈষী’ প্রকাশ হবে। সেই দেশহিতৈষী পত্রিকাও আর কয়েকদিন পর ষাট বছরে পা দেবে। কর্পোরেটপোষিত গণমাধ্যমের দুনিয়ায় একটি কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা হিসেবে ষাট বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ষাট বছর আগে ওই দুটি ঘটনা রাজ্যের কমিউনিস্ট আন্দোলনে মাইলস্টোন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
ইংরেজির ১৮৮৯ সালের আগস্ট মাসে এবং বাংলার ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসে কোনো এক সোমবার কাকাবাবু জন্মগ্রহণ করেন। কাকাবাবুর কথায়ঃ “খুব দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় আমার কখনও জন্মবার্ষিকী পালিত হয়নি। তাই আমার জন্মের সঠিক তারিখ আমার জানা নেই। মায়ের মুখে শুনে যতটা মনে আছে ততটাই শুধু আমি এখানে লিখলাম।”... শ্রাবণ মাসের ওই সোমবারের হিসেবে “আমি স্থির করেছি, ১৮৮৯ সালের ৫ আগস্টকে আমি আমার জন্মদিন বলব।” কাকাবাবুর জন্মস্থান ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি জেলার সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রাম। নোয়াখালির জেলা স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর হুগলির মোহসিন কলেজে আইএ ক্লাসে ভরতি হন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে স্থানান্তরিত হন।তবে তাঁর কলেজের পড়া অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
।। দুই ।।
সেসময়ে দেশ এবং বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরের এবং দেশের রাজনৈতিক ঘটনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় না পেলে পরিস্থিতির গভীরতা বোঝা শক্ত হবে। দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে গত শতকের ষাটের দশক এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়। প্রথমে সংশোধনবাদ এবং পরে সংকীর্ণতাবাদের পাকচক্রে পড়ে দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি, সোভিয়েত পার্টি ও চীনের পার্টির মধ্যে মতাদর্শগতবিরোধ দেখা দেয়। একে কেন্দ্র করে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরের আবির্ভাব ঘটে। মূলত স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লাইন গৃহীত হয়। চীনের পার্টি এই রাজনৈতিক লাইনকে সংশোধনবাদী বলে আখ্যায়িত করে। চীনের পার্টিকে সংকীর্ণতাবাদী বলে নিন্দা করে সোভিয়েত পার্টি। এই মতাদর্শগত বিরোধের সরাসরি প্রভাব পড়ে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটা বড়ো অংশ সোভিয়েত পার্টির লাইনকে অনুসরণ করে। এই লাইন অনুসরণ করার বাস্তবক্ষেত্রে মূল প্রায়োগিক দিকটা ছিল কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট পার্টির স্থায়ী মিত্র মনে করা। শ্রেণিসমঝোতার এই সংশোধনবাদী লাইনকে নিয়েই পার্টিতে তীব্র হয় মতাদর্শগতবিরোধ। পার্টির মধ্যে এই মতাদর্শগতবিরোধ যখন চরমে তখনই ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ঘটল চীন-ভারত সীমান্তবিরোধ। দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে দুর্বল করতে একে দারুণভাবে ব্যবহার করল কংগ্রেস দল।
কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে দেশজুড়ে শুরু হলো চীনবিরোধী উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রচার। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যাঁরা সোভিয়েত লাইনের অনুসরণ করছিল তারা কেন্দ্রীয় সরকারের চীনবিরোধী প্রচারে শামিল হলো। এই শ্রেণি আপসকামীদের বক্তব্য ছিলঃ পার্টির উচিত ভারত সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করা। আর পার্টির মধ্যে প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অংশ যাঁরা পার্টিতে শ্রেণিসংগ্রামের লাইনের পক্ষে ছিলেন তাঁরা এই চীনবিরোধী প্রচারে শামিল হতে অস্বীকার করলেন। তাঁরা জনগণের সামনে এই বক্তব্যই হাজির করলেন যে, চীনের সঙ্গে সীমান্তবিরোধ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া উচিত। কংগ্রেসের সুরে গলা মিলিয়ে পার্টির মধ্যে শ্রেণিসহযোগীরা একে চীনের সাথে আঁতাত বলল। তৎকালীন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্ট পার্টির ওই নেতৃত্বকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বেশিরভাগকেই গ্রেপ্তার করেন। পালঘাট পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে যে নীতিগত বিরোধ স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে তা পার্টিকে দুভাগে বিভক্ত করে ফেলল। ১৯৬২ সালের ২১ নভেম্বর চীন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার পরও সরকার সারা দেশে হাজারের বেশি পার্টিকর্মী ও নেতাকে ভারত রক্ষা বিধি অনুসারে আটক করে রাখল কিংবা নতুন করে গ্রেপ্তার করল। কাকাবাবুকে ওই ২১ নভেম্বরই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জেলে তখন কমরেড জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, নিরঞ্জন সেন, সরোজ মুখার্জি সহ আরও অনেক নেতৃত্ব। জেলেই নেতৃবৃন্দ ঠিক করেন যে, এই মতাদর্শগত লড়াইয়ে পার্টিকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে কাকাবাবুর জন্মদিন পালন করা হবে। কাকাবাবু প্রথমে রাজি ছিলেন না। পরে নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নেন। রামমোহন লাইব্রেরি হলে ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট জন্মদিবস পালনের সময় কাকাবাবু জেলেই। বন্দি অবস্থায় প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড অপারেশনের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল হাসপাতালে ভরতি করা হয়। অপারেশনের আগেই ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।
এই মতাদর্শগত লড়াইয়ে ১৯৬৩ সালের ১৬ আগস্ট দেশহিতৈষী প্রকাশের ঘোষণা ছিল এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা ইতিমধ্যেই সংশোধনবাদীরা পার্টির দৈনিক মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’ দখল করে নেয়। যাঁরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার জন্য পার্টির অভ্যন্তরে লড়াই চালাচ্ছিলেন তাঁদের বক্তব্য সাধারণ পার্টিকর্মী এবং নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া খুবই জরুরি ছিল। ভীষণ প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল একটা মুখপত্রের। সেইসময়ে ১৯৬৩ সালে হাওড়া জেলার পার্টির নেতা মদন দাস, জয়কেশ মুখার্জি এবং নরেশ দাশগুপ্তের উৎসাহে কয়েকজন কমরেড ‘হাওড়া হিতৈষী’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। প্রকাশক ছিল নির্দলীয় পরিষদ। তখন পার্টিনেতাদের মধ্যে সমর মুখার্জি জেলের বাইরে আত্মগোপনে রয়েছেন। নরেশ দাশগুপ্তের মধ্যস্ততায় ওই কমরেডরা ‘হাওড়া হিতৈষী'র রেজিস্ট্রেশন এবং ডিক্লারেশন সমর মুখার্জির হাতে তুলে দেন। সেই ‘হাওড়া হিতৈষী’ পরবর্তী সময় ‘দেশহিতৈষী’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
কাকাবাবু জেলে থাকা অবস্থায় পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের ১৬ আগস্ট আট পাতার দেশহিতৈষী’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয়। প্রথম সংখ্যাতেই দাবি তোলা হয়ঃ “সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি চাই”। প্রথম পৃষ্ঠায় কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ, কমরেড জ্যোতি বসু এবং কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর ছবি ছাপিয়ে “আজও বন্দী” শিরোনামে বলা হয়ঃ “...ভারত রক্ষা আইনে পশ্চিমবঙ্গের প্রিয় জননেতারা কারাপ্রাচীরের অন্তরালে বন্দী।”
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে ৩২ জন জাতীয় পরিষদের সদস্য জাতীয় পরিষদের সভা ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে কাকাবাবু ছিলেন। এঁরাই ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে অন্ধপ্রদেশের তেনালিতে কনভেনশন ডাকেন। সেখানেই ঠিক হয়, ওই বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর কলকাতায় পার্টির সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে।
বোঝাই যাচ্ছে, দেশহিতৈষী যখন প্রকাশ হলো তখন আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টি বিভক্ত হয়নি। তাই পার্টির নামে দেশহিতৈষী প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। দেশহিতৈষী’র প্রকাশক হিসেবে নির্দলীয় পরিষদের নামই থাকল। কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী পার্টি কর্মী-নেতারা প্রথম সংখ্যা থেকেই দেশহিতৈষী’কে পার্টির মুখপত্র হিসেবেই গ্রহণ করলেন।
এরাজ্যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ১৯৬৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল এক স্মরণীয় দিন। যাঁরা পার্টির জাতীয় পরিষদের সভা ত্যাগ করে এসেছিলেন তাঁরা তৎকালীন মনুমেন্ট ময়দানে সমাবেশের ডাক দেন। তখন কাকাবাবু জেল থেকে মুক্তি পেলেও, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাননি। হাসপাতালের বিছানা থেকেই সমাবেশকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে বার্তা পাঠালেন দেশহিতৈষী’তে।
সেই বার্তায় কাকাবাবু লিখেছিলেনঃ “আমি একান্তভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, কলকাতার ও আশেপাশের জিলাগুলির মানুষ হাজারে হাজারে ২৮ শে সেপ্টেম্বর সমাবেশে যোগদান করুন। ওখানেই হবে কাজের শুরু। এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজপত্রে’ যে একটি কবিতা লিখেছিলেন তার দুটি পঙক্তি আজ আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি।”
“আমরা চলি সমুখপানে
কে আমাদের বাঁধবে।
রইল যারা পেছুর টানে
কাঁদবে তারা কাঁদবে ৷৷”
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আর্দশে অটল থেকে সেদিন সমুখপানে চলারই নির্দেশ দিয়েছিলেন কাকাবাবু। আর সমাবেশ থেকে কাকাবাবুর কথা মতো “কাজের শুরু” হলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে নতুন পার্টি গড়ার।
সপ্তম কংগ্রেস শুরুর আগের দিন ১৯৬৪ সালের ৩০ অক্টোবর কাকাবাবুকে ফের গ্রেপ্তার করল কংগ্রেস সরকার। কংগ্রেসে উপস্থিত থাকতে পারলেন না কাকাবাবু। সপ্তম কংগ্রেসে যে রিপোর্টটি পেশ করা হয়েছিল তার শিরোনামও ছিল ‘সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে’। জেলে থাকাকালীন অবস্থাতেই কাকাবাবু সপ্তম কংগ্রেসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেলেন ১৯৬৬ সালের ৬ মে। কাকাবাবু এই পর্বে জেলে ছিলেন ১৮ মাস। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে সিপিআই(এম) গঠন এবং পার্টি কংগ্রেসে পার্টি কর্মসূচি গৃহীত হবার মধ্য দিয়ে মতাদর্শগত লড়াইয়ের একটা পর্যায় শেষ হয়। তবে সপ্তম কংগ্রেসের রিপোর্টেই খুব স্পষ্টভাবেই বলা ছিল যে, সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবার সাথে সাথেই পার্টিকে সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
।। তিন ।।
সপ্তম কংগ্রেসের পর থেকেই পার্টিতে কিছু সংকীর্ণতাবাদী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় পার্টির রাজ্য সম্মেলনে দেশহিতৈষী’কে পার্টির রাজ্য কমিটির মুখপত্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। তখনই সংকীর্ণতাবাদী গোষ্ঠীর নেতারা ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।
এই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতির চরম বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল ১৯৬৭-৬৮ সালে। দেশহিতৈষী’র ওপর হামলা দিয়েই তথাকথিত নকশালদের এই হঠকারী রাজনীতি শুরু হয়েছিল। তারা দেশহিতৈষী দপ্তরে হামলা চালায় ১৯৬৭ সালের ২৮ জুন। নকশালপন্থীদের দেশহিতৈষী দপ্তরে হামলা চালানো মূল কারণ ছিল ‘সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সংকীর্ণতাবাদী ঝোঁক’ নামে দেশহিতৈষী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধটি অশোক মুখার্জি ছদ্মনামে লিখেছিলেন কমরেড সমর মুখার্জি।
দেশহিতৈষী’র ওপর নকশালপন্থীদের এই আক্রমণে কলম ধরলেন কাকাবাবু। ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই গণশক্তিতে নিজ নামে স্বাক্ষরিত এক সম্পাদকীয় লিখলেন। ওই সম্পাদকীয়তে তিনি লেখেনঃ
“...কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে হঠকারী উপদলের অভ্যুদয় হয়েছে। এই উপদলের লোকেরা যদি আত্ম-সমালোচনার ভিতর দিয়ে নিজেদের বিচ্যুতির হাত হতে না বাঁচান, তবে কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁদের স্থান নেই। ইতোমধ্যে তাঁদের অনেকেই পার্টি হতে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ (কাকাবাবু)
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এই হঠকারী উপদলের লোকেরা কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ “দেশহিতৈষীকে” নিয়ে পালাবার চক্রান্ত করে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশহিতৈষীর পাঠক, গ্রাহক, অনুগ্রাহক - এক কথায়, সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে পালাতে না পারলে শুধু একখানি কাগজ নিয়ে পালিয়ে গেলে কি লাভ? তাঁরা কি মনে করেছিলেন যে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের পিছনে ধাওয়া করবে?
...অতীতে আমরা হঠকারিতার জন্যে অনেক মূল্য দিয়েছি। আর সেই পথে নয়। যত দুঃখ হোক, যত কষ্ট হোক, যত কাঁটা বিছানোই হোক না কেন আমাদের পথ - আমরা বিপ্লবের পথ ধরেই চলব। হঠকারীরা আর যাই কিছু হোন না কেন, তাঁরা বিপ্লব-বিরোধী।
আমাদের ভিতরে হঠকারীদের স্থান নেই। তাঁদের ভিতরে আমাদের পার্টির অনেকেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা থাকতে পারেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও ভুললে চলবে না যে, বন্ধুর চেয়ে পার্টি বড়।”
গণশক্তিতে লেখা এই সম্পাদকীয়র কয়েকদিন পর দেশহিতৈষী’র পরবর্তী সংখ্যায় কাকাবাবু আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন। যার শিরোনাম ছিলঃ ‘ হঠকারীদের হঠাতে হবে’। ওই প্রবন্ধে তিনি লিখলেনঃ
“ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে যাঁরা শোধনবাদের পথ ইখতিয়ার ক'রে পার্টিকে একটি নিরীহ ও নিরামিষ সংগঠনে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতায় পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের ঘোষণার দ্বারা আমরা তাঁদের বর্জন করেছি। আমরা ঘোষণা করেছি যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতবাদ আমাদের মতবাদ; আর মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সংগ্রামী পথ আমাদের পথ। কিন্তু বুঝতে হবে যে, এই সংগ্রামী পথ হঠকারিতার পথ কিছুতেই নয়।”
ঠিক এইভাবেই সংশোধনবাদ এবং সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শিক্ষা আজীবন দিয়ে গেছেন কাকাবাবু।
।। চার ।।
জীবনে পেশা কী হবে তা নিয়ে কৈশোরে কাকবাবুর নিজের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। কাকাবাবু লিখছেনঃ “ আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল তাতে শেষপর্যন্ত জয় হলো রাজনীতির।... ১৯২০ সালের শুরুতে আমি স্থির করে ফেললাম যে রাজনীতিই হবে আমার জীবনের পেশা।” যদিও ১৯১৬ সাল থেকেই তিনি সভা-সমিতি মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেছিলেন। গত শতকের বিশের দশকের শুরু থেকেই দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলায় কাকাবাবু নিজেকে নিয়োজিত করলেন। গড়ে তুললেন শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলন এবং সংগঠন। কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে কানপুর ষড়যন্ত্র এবং মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় পাঁচ বছর জেলে পুরে রাখল ভারত সরকার। কিন্তু সরকার তাদের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলো। জেল থেকে বেরিয়ে আরও শ্রমিক, কৃষক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পার্টির মধ্যে নিয়ে আসতে সফল হলেন, বাংলার প্রায় সমস্ত জায়গায় পার্টিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজও করা গেল।প্রসঙ্গত, একইভাবে স্বাধীনতার পর দেশের শাসক কংগ্রেস দলও তাদের শত্রুকে চিনতে ভুল করেনি। ১৯৪৮, ১৯৬২ এবং ১৯৬৪ সালে মোট তিন বার স্বাধীন ভারতে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ গ্রেপ্তার হন। স্বাধীন ভারতে তাঁর জেলজীবন পাঁচ বছরেরও বেশি।
পার্টি পত্রপত্রিকা প্রকাশের কাজকে তিনি সবসময়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। ১৯৪৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ প্রকাশ হয়। স্বাধীন ভারতে পার্টি বেআইনি হলে স্বাধীনতা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। আবার নবপর্যায়ে স্বাধীনতা প্রকাশ শুরু হয় ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। বিভিন্ন সময় স্বাধীনতা প্রকাশের জন্য তহবিল সংগ্রহ, নিজস্ব ছাপাখানা তৈরি করে সেখান থেকে স্বাধীনতা ছাপানো, ছাপাখানার আধুনিকীকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাকাবাবু যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা এ রাজ্যের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
।। পাঁচ ।।
দেশহিতৈষী’র যখন প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হচ্ছে তখন কাকাবাবু জেলে তা আমরা আগেই জেনেছি। তিনি তখন কোনো শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতে পারেননি। একমাস পর যখন তিনি অপারেশনের জন্য কলকাতা মেডিক্যাল হাসপাতালে ভরতি তখন তিনি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। কাকাবাবু পাঠিয়েছিলেন শুভেচ্ছাবার্তা, কিন্তু দেশহিতৈষী এটাকে নির্দেশ হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। মাত্র ২৫ শব্দের সেই বার্তা দেশহিতৈষী’র ষাট বছরের পথ চলায় সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ এবং দেশহিতৈষী যতদিন প্রকাশ হবে ততদিন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। কাকাবাবুর বার্তা ছিলঃ “একটি কথা আমি শুধু বলবো। ‘দেশহিতৈষী’ যেন সত্যই মেহনতি মানুষের মুখপত্র হয় এবং ধনিক-বণিক-জমিদারি সরকারের লেজুড় না হয়, সেদিকে আপনারা সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন।”
কাকাবাবুর এই নির্দেশকে পত্রিকা প্রকাশের প্রতিটা ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে প্রয়োগ করেই আমরা এতটা পথ পেরিয়েছি। আগামীদিনেও মেহনতি শোষিত মানুষের বলিষ্ঠ মুখপত্র হিসেবে দেশহিতৈষী দায়িত্ব পালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
একটি সংক্ষিপ্ত বিষয়ের উল্লেখ করে এই প্রবন্ধের ইতি টানবো। দেশহিতৈষী’র প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘সংকল্প ও শপথ’। তার এক জায়গায় লেখা হয়েছিলঃ “গণতন্ত্র আজ উপেক্ষিত। জনগণের প্রিয় নেতৃবৃন্দ কারান্তরালে বন্দি। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কুক্ষিগত হওয়ায় স্বাধীন সংবাদপত্রের কণ্ঠ আজ রুদ্ধ। রামমোহন-হরিশ্চন্দ্র-সত্যেন্দ্রনাথের সাংবাদিকতার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ধূলায় লুণ্ঠিত। এতদসত্ত্বেও জনসাধারণের জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম রুদ্ধ হয় নাই।”
তখন ছিল রাজ্যে-কেন্দ্রে কংগ্রেস শাসন। এখন কেন্দ্রে বিজেপি'র শাসন। সময়ের ব্যবধান ষাট বছর, কিন্তু পরিস্থিতির মধ্যে কি অদ্ভুত সাযুজ্য। কার্ল মার্কসের সেই বিখ্যাত উক্তিটা - “History repeats itself, first as tragedy, second as farce.”।
জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম আজও রুদ্ধ হয়নি। শাসকশ্রেণির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশহিতৈষী কাকাবাবুর নির্দেশিত পথেই মেহনতি মানুষের সংগ্রামে সংগঠকের ভূমিকা পালন করে যাবে।