E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি

মহম্মদ সেলিম


শহিদ ক্ষুদিরাম

‘কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর
‘বাঙালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!’

(কাণ্ডারী হুঁশিয়ার - নজরুল ইসলাম)

স্বাধীনতার ইতিহাসকে কেন স্মরণ করতে হয়? কারণ, যে জাতি ইতিহাসকে মনে রাখেনা সে কখনো নতুন ইতিহাস গড়ে তুলতে পারে না। তাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়। ইতিহাস বড়ো নির্মম, সে কাউকে ক্ষমা করেনা। আজকে আমাদের এই স্বাধীন দেশ ভারত, তার পেছনে একটা দীর্ঘ ২০০ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস আছে। যেমন স্বাধীনতা বিসর্জনের ক্ষেত্রে রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের খুব বিশাল বাহিনী ছিল না। তবু রবার্ট ক্লাইভরা সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে যায় ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফরের পাশাপাশি রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠদের বিশ্বাসঘাতকতায়। কোনো দেশকে হারাতে হলে প্রথমে তার জাতির নৈতিকতা-বিবেক ধ্বংস করতে হয়। তাহলেই উমিচাঁদ মীরজাফররা তৈরি হয়। তৈরি হয় আরও কিছু উমেদার, তালেবর গোছের লোক।

সেসময় যারা যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করে, তাদের উৎকোচ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্লাইভ। বলা হয়েছিল, যুদ্ধে জয়লাভ করলে এই ষড়যন্ত্রীদের লুটের বখরা হিসেবে পাঁচ শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে। সেই বখরার পাশাপাশি ইংরেজ যখন কলকাতা শহর গড়ছিল তখন তারা মুর্শিদাবাদ থেকে চলে এলে আলিপুরে, নতুন বসতি এলাকায় তাদের উৎকৃষ্ট জমিও দেওয়া হয় হেস্টিংস হাউসের চারপাশে। এভাবেই আদি গঙ্গার পাড় ধরে গড়ে ওঠে আলিপুর। ওখানে গভর্নরের বাড়ি হেস্টিংস হাউস-এর চারপাশে প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ রাজকর্মচারী, পরে লাট-বেলাটদের জন্য বাংলো তৈরি করা হয়েছিল। আর তার চারপাশে জায়গা পায় ওই ষড়যন্ত্রী পরিবারগুলি। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, গভর্নর জেনারেল যেখানে থাকবেন তার আশেপাশে একটা ঘেরাটোপ থাকবে যেখানে চট করে কোনো বিদ্রোহ ইত্যাদির আঁচ লাগবে না। খালের ওধারে ব্রিটিশ সেনা থাকবে পাহারায়। যদিও পরবর্তীতে এসব জমির হস্তান্তর ঘটেছে এযুগের ধনকুবেরদের কাছে।

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে! আজকে বলা হচ্ছে স্বাধীনতা বিপন্ন। স্বাধীনতা তখনই বিপন্ন হয় যখন কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। প্রতিপত্তিশালী, বিত্তশালী, ক্ষমতালোভীদের চাটুকারিতা, বিশ্বাসভঙ্গ, স্বজনপোষণ, দেশ ও দেশের সর্বস্তরের মানুষকে বিপদের দিকে ঠেলে দিলে সবচেয়ে বেশি বিপদ ঘনিয়ে আসে সাধারণ গরিব প্রান্তিক মানুষের দিকেই। বিপদ এলেই গরিব প্রান্তিক ও সর্বহারা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো অন্যায়ের সোচ্চার বিরোধিতা করা। প্রতিবাদ শুরুও করেন তাঁরা। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষ যে কোনও ইস্যুতে তার ব্যক্তিগত লাভ বা লোকসান আছে কিনা, হলে কতটা, সেটা আগে ভাবেন! কিন্তু বস্তি ও গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষ এসব হিসেব কশেন না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুরুতেই তারা সোচ্চার হন। পরাধীন দেশে আদিবাসী, ফকির, দরবেশ, সন্ন্যাসী, কৃষক সহ প্রান্তিক মানুষেরা ইংরেজের বিরুদ্ধে অসংগঠিত, বিক্ষিপ্ত, মাঝেমধ্যে জোরালো শক্তিশালী প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। বিভিন্ন ধারার এইসব প্রতিবাদ আন্দোলন আসলে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত কারণ সে কাজে বাংলার একটা ভূমিকা ছিল। নির্মমভাবে, নির্দয়ভাবে সেই সমস্ত বিক্ষোভগুলিকে বিদ্রোহগুলিকে, আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলপ্রয়োগ করে দমন করার চেষ্টা করেছিল। এটা পৃথিবীর সব দেশে সব যুগে হয়। যারা ক্ষমতাসীন ক্ষমতার দম্ভে তারা মনে করে সেনাবাহিনী, পুলিশ, জেল, লাঠি, গুলি, বন্দুক, কামান দিয়ে মানুষের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন সেখানে থামেনি। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত সেখান থেকেই। সেই লড়াইকেই পরে সমৃদ্ধ রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

আমাদের দেশে সংগঠিতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন প্রথম শুরু হয় ১৮৫৭ সালে। ইংরেজের শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ করে। ফারসি শব্দ ‘গদর’ হলো বিদ্রোহের প্রতিশব্দ। যে সংগ্রামকে ইংরেজ দেগে দিয়েছিল ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলে। এই প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ভিত ছিল সিপাই এবং গ্রামীণ কৃষকরা। আসলে সিপাইরা আসেন কৃষক পরিবার থেকেই। আজকে যখন সেনাবাহিনীতে অগ্নিবীর-অগ্নিপথ ইত্যাদি গালভরা নাম দিয়ে স্বল্প মেয়াদের ঠিকাসেনা তৈরির চেষ্টা করছে বিজেপি-আরএসএস, তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে দাবানলের মতো তোলপাড় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলন শুরুতেই দ্রুত রাস্তার দখল নিল, সেই প্রতিবাদের অন্যতম মুখ কৃষক পরিবারের কর্মহীন সন্তানেরা। তীব্র দুর্দশার সম্মুখীন তাঁরা দেখলেন তাদের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা হচ্ছে। যেমন কৃষিতে সংকট - যার জেরে স্বতঃস্ফূর্ত ঐতিহাসিক কিষান আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তেমনই এটা ঘটল অনিবার্যভাবে। স্বাধীনতাকামী মানুষ যদি প্রবলের বিরুদ্ধে লড়াই করে তখন সেখানে জাত পাত ধর্ম বর্ণের বিভেদ থাকে না। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের এটা হচ্ছে শিক্ষা। যেখানে কৃষক এবং ‘বিদ্রোহী সিপাহি’ এককাট্টা হয়ে যায়। অধিকাংশ সিপাহি কৃষক পরিবারের সন্তান। সেজন্যই ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের এতটা ব্যাপ্তি হয়েছিল।

এই উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সামন্তবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, স্বৈরতন্ত্রবিরোধী, জনপ্রিয় স্লোগানগুলি মূলত হিন্দোস্তানি ভাষায়। তার কারণ, প্রবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের সংগঠিত দ্রোহকাল ১৮৫৭। সেখান থেকেই সিপাহি সহ অন্যান্যদের মধ্য থেকে এইসব স্লোগান উঠে এসেছে। সিপাহি বিদ্রোহে যারা অংশ নিয়েছিলেন সেই এলাকাগুলির দিকে তাকালে বিষয়টা পরিষ্কার হবে - যেখানে রয়েছে মিরাট, কানপুর, লক্ষ্ণৌ থেকে দিল্লির আশেপাশের অংশ এবং বাংলায় বারাকপুর সেনা ছাউনি সংলগ্ন এলাকা। হিন্দি এবং উর্দুর মিশ্রণে স্লোগান উঠে এসেছিল। এমনকী প্রতিবাদী কবিতাও এ দেশে তখন থেকেই লেখা হতে শুরু করল। তার আগে লেখা হতো রোম্যান্টিক কবিতা। লেখা হলো, ‘বাগিও মে জব তলক বু রহেগী ইমান কি/তখতে লন্ডন তক চলেগি তেগ হিন্দুস্তান কি’...। অর্থাৎ, প্রয়োজনে তরবারি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সিংহাসন পর্যন্ত গিয়ে আক্রমণ করতে পারে, কিন্তু বিদ্রোহীদের সৎ থাকতে হবে।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর প্রতিবাদী কবিতা এবং স্লোগানের যেমন জন্ম হলো, তেমনি তারপর প্রায় সিকি শতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিখ্যাত সব মানুষের জন্ম হলো যারা বেড়ে উঠলেন ওই পর্বে। ১৮৫৭-পরবর্তী ১০০ বছর এদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরা প্রায় সবাই জন্মেছেন ওই কালপর্বে। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা, রাজনীতি, সমাজ সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বিরোধী সংগ্রাম-আন্দোলন তীব্র হয় সেই উন্মেষকালে।

তীব্র আন্দোলন হলে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, সমাজে তৈরি হয় এক নতুন মূল্যবোধ। ১৮৫৭ সালের সংগ্রামের পথ বেয়েই দেশে শুরু হলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলন সংগঠিত রূপ পেতে লাগলো। কিন্তু তা শুধুমাত্র আবেদন-নিবেদন, পিটিশন বা চিঠি চাপাটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হলো। সীমাবদ্ধ রাখা হলো মূলত উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবর্গীয় মানুষের দাবিদাওয়া ও অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে। অন্যদিকে মহারাষ্ট্র থেকে পাঞ্জাব, সংযুক্ত প্রদেশ, দক্ষিণ ভারত ও সর্বোপরি বাংলা বা যুক্ত বঙ্গপ্রদেশে উদ্বেলিত যৌবন বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে নানান কায়দায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে লাগল। তাঁরা এগিয়ে এসে বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করলেন নানা ধরনের বিপ্লবী সমিতি।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত মুক্তি আন্দোলনে মানুষ যাতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে না পারে, তার জন্য পরিকল্পিত উপায়ে ১৮৫৭’র পরে পরেই বিভাজনের নীতি নিয়ে এগোতে থাকল। তারা প্রথমে মূলত উত্তর ভারতে যেখানে যেখানে ১৮৫৭’র স্বাধীনতা আন্দোলনের পদচিহ্ন ছড়িয়ে ছিল সেই এলাকাগুলিকে লক্ষ্য করে এগোলো। অনেক ভেবেচিন্তে এদেশীয় কিছু এজেন্ট এবং প্রভাবশালী যারা জনমানসকে প্রভাবিত করতে পারে এমন ব্যক্তি, ধর্মগুরু ও সংগঠনকে ব্রিটিশ রাজশক্তি কাজে লাগায়। আজকে গোটা দেশে বিভাজনের, যে হিংসা ও ঘৃণার রাজনীতি, মৃত্যুর রাজনীতি প্রতিদিন চলছে বা যেসব কারণে স্বাধীনতার প্রাককালে আমরা দেশভাগের শিকার হলাম, তার বীজ বপন হয় উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে মূলত কয়েকটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসে।

সেগুলি হলো, ১) উত্তর ভারতের সাধারণের ভাষা হিন্দোস্তানির লিপি কী হবে, দেবনাগরী অথবা উর্দু সেই বিতর্ক উসকে দেওয়া, ২) গোহত্যা নিবারণ ৩) ধর্মীয় মিছিল ৪) সাধারণ উপাসনাস্থলকে দ্বন্দ্বের উপকরণে পরিণত করা ইত্যাদি।

উত্তর ভারতে হিন্দি এবং উর্দু সংক্রান্ত বিভাজনের হাতিয়ার কাজে দিলেও সে দ্বন্দ্ব যুক্তবঙ্গে তা অচল। কারণ এখানে হিন্দু এবং মুসলিম দুই সম্প্রদায়েরই ভাষা বাংলা। তাই এখানে ভৌগোলিক সীমাকে বিবাদের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা হলো। যার পরিণতি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। বাংলার বুকে জোরালো স্বদেশি আন্দোলন এবং নবজাগরণের উত্তরাধিকার হিসেবে মুক্ত চিন্তা ও সংস্কার বিরোধী মনোভাব সাময়িকভাবে হলেও বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবকে রদ করল। কিন্তু উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারতে এই বিভাজনের রাজনীতি জাঁকিয়ে বসলো।

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মানুষ তখন কোন পথে মুক্তি তা খোঁজার জন্য পথ হাতড়াচ্ছেন। তখন বিভিন্ন দেশে দেশে যেসব মুক্তি আন্দোলন চলেছে যেমন আইরিশ বিপ্লবের পথ বা রুশ বিপ্লবের পথ, তা নিয়ে পড়াশোনা চলছে, মতবিনিময় হচ্ছে মানুষের মধ্যে, হচ্ছে চীনের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কী চাইছেন তা নিয়েও। বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে আসল পথ কোনটা, কোন পথে গেলে পাওয়া যাবে প্রকৃত স্বাধীনতা। রাজনীতির সঙ্গে বিদ্যাচর্চার একটা সংযোগ তৈরি হয় তখন থেকেই। অহিংস পথ না সহিংস পথে, ব্যক্তিহত্যার মধ্য দিয়ে না সংগঠিত বিদ্রোহের পথে এগোনো হবে এসব নিয়ে চলছে অবিরাম আলোচনা। তখন রুশ বিপ্লবের সাফল্য সেই প্রজন্মের বিপ্লবী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে এক নতুন চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটালো। এই চর্চার পথ ধরেই ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠা হলো কমিউনিস্ট পার্টির। পার্টির প্রায় জন্ম লগ্নেই কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলল কমিউনিস্টরা। তার আগে আজাদি বা পূর্ণ স্বরাজ এ কথাটা ব্রিটিশ জমানায় কেউ লেখার, বলার সাহস করেনি। কংগ্রেস তখন সে দাবি মানল না।

বিশের দশকে ভারতে অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলন ছিল হিন্দু মুসলমানের প্রথম মিলিত আন্দোলন। চৌরিচৌরার ঘটনার প্রেক্ষিতে গান্ধীজির আন্দোলন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত দেশের যুব মননে হতাশা তৈরি করল। পুলিশ ফাঁড়ির পাশাপাশি জমিদারের কাছারি আক্রমণ করার ঘটনাও তিনি মেনে নিলেন না।

চৌরিচৌরার পর ১৯২০ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে সশস্ত্র বিপ্লবীরা আবার সংগঠিত হলেন। ওই বিশের দশকেই বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের মতো রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকুল্লা খান প্রমুখ বিপ্লবীরা যুক্তপ্রদেশের শাহজাহান পুরে তৈরি করলেন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি বা এইচআরএ, যা পরে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি (এইচএসআরএ)-তে পরিণত হয়। আমাদের এখানে সংঘটিত হলো চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ। ভগৎ সিং-এর নেতৃত্বে ভারত নওজোয়ান সভা তৈরি হলো। এসবই ঘটলো ১৯২০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হবার পর।

কমিউনিস্ট পার্টি তৈরির প্রথম কয়েক বছরেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বুঝেছিল তাদের ‘শিরে সংক্রান্তি’। তাই পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা এরকম অসংখ্য ষড়যন্ত্র মামলা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কমিউনিস্ট নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করল ব্রিটিশ হুকুমত। নেমে এলো ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন। শুরু হলো পত্র-পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, গান কবিতা বাজেয়াপ্ত করার মতো পদক্ষেপ। তৈরি হলো চরম দমনমূলক রাজদ্রোহ আইন সহ বেশ কিছু আইন-কানুন। আগে যেখানে মধ্যবিত্ত মানুষের ইস্যুগুলি তুলে ধরা হতো আন্দোলনের ময়দানে, সেখানে কমিউনিস্টদের আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণের ফলে উঠে এলো শ্রেণি ইস্যুগুলি। শুধু স্বাধীনতার দাবি নয়- কৃষকের দাবি, শ্রমিকের দাবি, মজুরির দাবি উঠে এলো প্রকাশ্যে। কৃষক শ্রমিকদের দাবিসমূহ সামনে আসায় তাঁরা যোগ দিলেন। গড়ে উঠতে আরম্ভ করল শ্রমিক-কৃষকদের সংগঠনগুলি - ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষকসভা। একই সঙ্গে গাড়োয়ান, মেথর সহ বিভিন্ন প্রান্তিক মানুষেরাও সংগঠিত হলেন অংশ নিলেন আন্দোলন ধর্মঘটে।

তখন শ্রমজীবী সহ প্রান্তিক মানুষদের সংগঠিত করার প্রয়োজন থেকেই প্রকাশিত হতে লাগল বাংলায় লাঙল পত্রিকা। লাহোর থেকে উর্দুতে প্রথম ম্যাগাজিন বেরুলো অবিভক্ত ভারতের প্রথম কমিউনিস্ট পত্রিকা ইনকিলাব। কলকাতা থেকে ইংরেজিতে বেরুলো সাপ্তাহিক পত্রিকা কমরেড। একদিকে শুরু হলো শ্রেণিকে সংগঠিত করার কাজ, অন্যদিকে একই প্রয়োজনে বৌদ্ধিক চর্চা। দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-যুবরা এবং সমাজের শিক্ষিত অংশ যুক্ত হলো পার্টির বিভিন্ন ফ্রন্টে। যুক্ত হলেন মহিলারা। স্বাধীনতা মানে শুধু ইংরেজ শাসনের অবসান নয়, ইংরেজ বিতাড়ন নয়-স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের ব্যবস্থাপনা কী হবে সেই ব্যাপারেও একটা সম্যক ধারণা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হলো। গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, শ্রমের অধিকার, পরিকল্পিত উন্নয়ন সংক্রান্ত সমাজতান্ত্রিক ভাবনা-চর্চা শুরু হলো।

অন্যদিকে বিভেদের রাজনীতি ও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হিন্দু এবং মুসলমান বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনও ওই সময় যুবদের লড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গজিয়ে উঠলো। ইংরেজ প্রথম ধর্ম সংসদ করল। বেআইনি ঘোষণা করা হলো কমিউনিস্ট পার্টিকে।

এত মুঘল পেইন্টিং দেখা যায়, রাজস্থানের পেইন্টিং দেখা যায়, কিন্তু সেখানে কোনো মহরমের ছবি দেখা যায় না। কারণ এখন রামনবমি বা মহরমের যে মিছিল দেখা যাচ্ছে রাজপথে তা ২০০ বা ৩০০ বছর আগে ছিল না। কারণ, এটা বিভাজনের লক্ষ্যে শুরু করা ব্রিটিশের চাল। আগে প্রজাদের সঙ্গে জনসংযোগের লক্ষ্যে জাঁকজমক সহকারে ধর্মীয় মিছিল করা হতো রাজ পরিবারের তরফে। যাতে ধর্মের প্রতি, দেব-দেবীর প্রতি যে আস্থা সেটা স্থানান্তরিত হয় সিংহাসনের প্রতি। এই জন্যই এখন কার্নিভাল করতে হয় দুর্গাপুজোয়! মন্দিরের সামনে দিয়ে মহরমের মিছিল গেলে পুজোয় ব্যাঘাত হবে আর মসজিদের সামনে দিয়ে বিসর্জনের মিছিল গেলেও ধর্মের ব্যাঘাত হবে সেই উসকানি দেওয়াটাই তখন ছিল লক্ষ্য। ধর্মীয় মিছিলের জেরে কানপুরে প্রথম দাঙ্গা হলো। কানপুর থেকে আমাদের হাওড়া, হুগ‍‌লি, উত্তর চব্বিশ পরগনা এলাকায় দাঙ্গা শুরু হল। ব্রিটিশের দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রয়োগ সফল হলো।

ভগৎ সিং বটুকেশ্বর দত্তরা বোমা ছোড়ার পর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ছিলেন, পালাননি। স্লোগান দিচ্ছিলেন ইনকিলাব জিন্দাবাদ। ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লিফলেট। তাদের যখন আদালতে জিজ্ঞেস করা হলো তারা কেন করলেন, তখন তারা বললেন, ব্রিটিশ সরকার কানে কালা তাই দেশের মানুষের অভাব অভিযোগের কথা তাদের শোনানোর জন্য এটা করা হয়েছে। আমরা কাউকে প্রাণে মারতে চাইনি। তার জন্য যদি ফাঁসি দিতে চাও ফাঁসি দিতে পারো! তাদের বোমায় একটাও পেরেক ছিল না যে পেরেক থেকে মানুষের আঘাত লাগতে পারে। পুলিশ তাদের দায় অস্বীকার করতে বললে ভগৎ সিং বলেছিলেন, ‘জীবন্ত ভগৎ সিং-এর চেয়ে শহিদ ভগৎ সিং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অনেক বেশি কাজ করবে তাই আমাকে মৃত্যুদণ্ড নিতে হবে’।

আর আজ যারা বলেন ‘হিন্দু হিতমে কাম করেগা, গোলামি কা নিশান মিটায়েগা’, বাবরি মসজিদ ভাঙার পর তাঁদের কারো হিম্মত হলো না লিবেরহান কমিশনের সামনে গিয়ে ‘গর্বে’র সঙ্গে বলার যে আমি হিন্দু, আমি ভেঙেছি। আদবানি, প্রবীণ তোগাড়িয়া, মুরলী মনোহর যোশি, থেকে সুষমা স্বরাজ - কারও সাহস হলো না। উলটে বলল কি করে হলো আমরা জানি না।

এখন নাথুরামের সন্তানেরা দেশপ্রেম শেখাচ্ছে ক্ষুদিরামের সন্তানদের! গণতন্ত্র যখন বিপন্ন হয় তার আগে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে বিপন্ন করে তোলা হয়, এটাই সংকট। দেশপ্রেমের মানে কী? দেশ একটা ম্যাপ নয়, দেশ শুধু একটা ভাষা নয়, দেশ একটা জাতি নয়, দেশ শুধু একটা ধর্ম নয়। দেশের কিছু মানুষকে বাদ দেওয়া কখনো দেশপ্রেম হতে পারে না। কিন্তু এখন নতুন দেশপ্রেম শেখানো হচ্ছে, একটা মানুষকে অপর একজন মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা-হিংসা, একটা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আর একটা জনগোষ্ঠীকে পরস্পর লড়িয়ে দিয়ে। দেশপ্রেম হলো দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সংগঠিত করা সঙ্ঘবদ্ধ করা। দেশপ্রেমের চিহ্ন হচ্ছে কে দেশের মানুষকে ভালবাসে এবং একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করে, তাকে উন্নয়নের একটা ধাপ থেকে আর একটা ধাপে উত্তরণ ঘটায় সেই দিকগুলি। এই উত্তরণ মানে উল্লম্ব উত্তরণ। মানে অন্নহীন বস্ত্রহীন কর্মহীন মানুষকে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া।

বামপন্থা মানে খাদ্যের অধিকার। মানুষ খেতে পাচ্ছে কিনা সেটা দেখা, তার ঘরে খাবার আছে কিনা সেটা দেখা। আর দক্ষিণপন্থার মানে হচ্ছে কে কী খাচ্ছে তাই নিয়ে তাদের লড়িয়ে দেওয়া। এর মানে হলো আসলে সে খাবার দিতে পারে না। ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই! তাই সে নজরটাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। প্রতিবেশীকে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে, কৃষককে কৃষকের বিরুদ্ধে, শ্রমিককে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিচ্ছে। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যায় নাইজেরিয়াকে টপকে ভারত এগিয়ে গেল এখন। কেন কর্মহীন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ভারতে বাস করে এই প্রশ্ন যাতে কেউ না করেন তাই এই কায়দা।

কবি নজরুল লিখেছেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ/ চায় দুটো ভাত, একটু নুন’। তার মানে হচ্ছে খাদ্যের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, উন্নয়নের অধিকার সেই সবার সমান অধিকার চাওয়া। যারা সেটা চায় না তারা তামিল তেলুগু আসামি বিহারি রাজবংশী এভাবে ভাগ করতে চায়। তারাই ভাগাভাগির রাজনীতি তখনও করেছে এখনও করছে।

কমিউনিস্টরা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়া মানে সেখানে সব অংশের মানুষকে নিয়ে যোগ দেওয়া। তার পরিণতিতে তখন আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর বিচার হলো তখন গোটা দেশে ধর্মঘট আর কলকাতায় আইএনএ সেনাদের মুক্তির দাবিতে মিছিল সংগঠিত করা হলো। মিছিলে শাহাদত হলো রামেশ্বর ব্যানার্জি, আব্দুস সালামের। দেশ জুড়ে স্লোগান উঠল ‘লালকিলে সে আই আওয়াজ, সায়গল-ধিলোঁ-শাহনওয়াজ’। আজকে যারা বলছে হিন্দু, মুসলিম, শিখ আলাদা, তাঁরা সেদিনও তাই বলেছিল। যখন ভারতীয় সেনারা নৌবিদ্রোহ করল তখন জিন্না নেহরু তা সমর্থন করলেন না। নৌবিদ্রোহীদের সমর্থনে সুতাকল শ্রমিকরা, বন্দরের শ্রমিকরা পথে নেমে এলেন। জাহাজ দখলের পর ব্রিটিশ ঝান্ডা নামিয়ে দিয়ে একটা কংগ্রেসের পতাকা একটা মুসলিম লিগের পতাকা আর একটা কমিউনিস্টদের পতাকা তুললেন নাবিকরা - একসাথে। কমিউনিস্টরা এটাই করে। কমিউনিস্টরা মানুষকে এককাট্টা করে।

আমাদেরকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস অমিত শাহ শেখাবে না। স্বাধীনতা মানে গণতন্ত্র। মানুষের অংশগ্রহণের অধিকার। বিজেপি সংবিধান মানে না কারণ আমাদের সংবিধানে বৈচিত্রের সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা বলি না আমাদের সংবিধান সবকিছু ঠিক আছে, কিন্তু সংবিধান শুরু হয়েছে ‘উই দ্য পিপল’ বলে। সেখানে কেউ রাজা নেই। আর এখন কেউ কেউ বলছে আমি সম্রাট, আমি সম্রাজ্ঞী।

আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হবে। মানুষকে তার অধিকার ফিরে পেতে হলে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামশীল হতে হবে। না হলে সে অধিকার ফিরে পাবে না। জরুরি অবস্থার সময় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আক্রান্ত হয়েছিল মানুষ তা সামলে নিয়েছিল। তারপর ১৯৭৭ সাল এসেছে।

এখন সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ভেঙে ফেলা হচ্ছে ইলেকটোরাল বন্ড, অর্থের জোরে, অস্ত্র, সেনার জোরে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যকে দেওয়া অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র না থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবেনা আবার ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে গণতান্ত্রিক দেশ থাকবে না। কথা বলার, প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এখন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাকে দেখে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কারণ মানুষকে মনুষ্যত্ব দিয়ে চেনা যায় দেশকে দেশপ্রেম দিয়ে ভালবাসতে হয় ধর্ম দিয়ে নয় - এটাই আজকের শপথ।