৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিলাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা
মিনতি ঘোষ
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নবজাগরণের আলোকে শুধু পুরুষ নন, নারী বোধহয় বেশি মাত্রায় আলোকিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন। আর সেই আলোই ছড়িয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
এক্ষেত্রে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা চিরস্মরণীয়। ১৮২৯ সালে সতী নিবারণ আইন, ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত আইন, বহু বিবাহ রদ করা, ১৯১৯ সালে দশ বছরের নিচে বালিকাদের সহবাস সংক্রান্ত আইন অর্থাৎ বাল্য বিবাহ রদ আইন নারীর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। এর প্রভাব সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য এর বিরোধিতাও কম হয়নি। বিশেষত, করুণার সাগর বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টা সমাজের মান্যগণ্যদের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন অন্ধকার থেকে আলোয় পৌঁছে দিয়েছে মেয়েদের। এক্ষেত্রে ইংরেজ বেথুন সাহেবের নাম উল্লেখ করতেই হয়। অন্তঃপুরবাসিনী নারীর বাইরের জগতে পা রাখার সুযোগ ঘটলো। কূপমণ্ডুকতা আর হীনম্মন্যতা থেকে অনেকটাই মুক্তি পেয়েছেন তাঁরা।
এই শতকের শেষ ভাগ থেকেই মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস গঠনের পর সেখানে মহিলারা প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন।
কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে পণ্ডিতা রমাবাই, লেডি বিদ্যাগৌরী নীলকণ্ঠ, রমাবাই রানাডে, শ্রীমতী নিকুম্ভ, শ্রীমতী কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্ণকুমারীদেবী অংশগ্রহণ করেন। সবাই ছিলেন অভিজাত ঘরের আলোকপ্রাপ্ত মহিলা।
দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মত ও পথ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে নানা মতপার্থক্য দেখা যায়। সুভাষচন্দ্র বসু আন্দোলনের শ্লথগতির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। আর একদিকে বাম-মনস্ক নেতৃত্বও ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় প্রথম বিপ্লবের অভ্যুদ্বয় ঘটেছে। এই একই সময়ে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ রদ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ জাগ্রত হতে শুরু করে। দলে দলে মহিলারা ব্রত পালন করেছেন, অরন্ধন করে প্রতীকী প্রতিবাদ থেকে রাখি উৎসবের মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছেন। এই উৎসবে রবীন্দ্রনাথের ছিল অসামান্য ভূমিকা। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মহিলারা যুক্ত হয়েছেন। গান্ধীজি সরে এসেছেন আন্দোলনের রাস্তা থেকে।
ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালের ৭-১৭ই নভেম্বর কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের অবসান হলো। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া গঠনে মহিলারা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন।
এদিকে ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে বিদেশি দ্রব্য বর্জনের ডাক দেওয়া হলো। তাঁরই নির্দেশে মেয়েরা চরকায় খাদির বস্ত্র তৈরি করে নিজেরা পরিধান করেছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাদি বস্ত্র বিক্রি করেছেন। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পরে নোয়াখালিতে কংগ্রেস নেত্রী জ্যোতি চক্রবর্তী, তাঁর বন্ধু সুশীলা মিত্র যথাক্রমে একমাস এবং ছয়মাস জেল খেটেছেন। জেল থেকে বেড়িয়ে এসে সুশীলা মিত্র’র সাথে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে পরবর্তীতে জ্যোতি চক্রবর্তী নেতৃত্বে উপনীত হয়েছেন।
১৯২০ সালেই সোভিয়েত রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছে। কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামী, দেশপ্রেমিক অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন।
অসহযোগ আন্দোলনের বছরেই মৌলানা হসরত মোহানি পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলে অধিবেশন কক্ষে একটি লিফলেট বিতরণ করেন। সমর্থক ছিলেন কুমারানন্দ স্বামী।
বিপ্লবী ধারায় অনুপ্রাণিত মহিলারা নানা ধারায় আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে বিপ্লবী মানসিকতার পরিচয় বহন করে অসীম কষ্ট লাঞ্ছনা ভোগ করতেও দ্বিধা করেননি।
১৯৩০-এর আইন অমান্য, ডান্ডি অভিযানে গ্রামের হাজার হাজার গৃহবধূ বেড়িয়ে এসেছেন। যে কোনো আন্দোলনের মধ্যেই জন্ম নেয় সঙ্গীত, নাটক, কবিতা। ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পরো না। আবেগে, উন্মাদনায় তাঁরা সে পথেই অগ্রসর হয়েছেন। স্বাধীনতার অধিকার মানুষের জন্মগত। পুলিশের লাঠি-গুলির ভয় নেই, জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে নিজ নিজ বিশ্বাসে তাঁরা এগিয়ে গিয়েছেন।
বিংশ শতাব্দী থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিপ্লবী পার্টিও গড়ে উঠেছিল কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সময়ে বা তার কিছু পরে। লেবার পার্টি, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি, এম এন রায়ের দল। তার কিছু পরে গড়ে ওঠে ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় বার্মায় পালিয়ে গিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেন। রানি লক্ষ্মীবাই নামে নারী বাহিনীর নেত্রী ছিলেন ডাঃ লক্ষ্মী সেহগল। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছেন।
এই সময়েই বিভিন্ন বিপ্লবী সহিংস আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, শ্রী সঙ্ঘ, পাঞ্জাব গদর পার্টি, ভারতীয় বিপ্লবী দলের সদস্য-সদস্যারা গোপনে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, কুস্তি, ব্যায়াম চর্চার সাথে রিভলবার চালানো শিখেছেন। ইংরেজ নিধনই তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল।
১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানে ব্রিটিশের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পর তাঁরা ব্যর্থ হলেন। বিপ্লবী বাহিনীতে ছিলেন কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। অনেকেই পালিয়ে গেলেও কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলেন। জেলের অভ্যন্তরে অসীম লাঞ্ছনা ভোগ করে প্রমাণাভাবে দীর্ঘদিন পর ছাড়া পেয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন কল্পনা দত্ত। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট নেতা পি সি যোশীর সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।
এই সময়ে বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তিসুধা ঘোষ, সুহাসিনী গাঙ্গুলি, লতিকা সেন, কমলা দাশগুপ্ত, কমলা চ্যাটার্জি প্রমুখ অসংখ্য নারী নেত্রী। এছাড়া জানা-অজানা কত যে মহিলা বিপ্লবী ছড়িয়ে আছেন তাঁদের বীরগাথা আমাদের অজানা। সেই সময়ে বীরাঙ্গনা নারীরা সামাজিক লজ্জা, বাঁধন এড়িয়ে পুরুষ সহযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রাণের ঝুঁকি নিতেও তাঁরা দ্বিধাবোধ করেননি।
অপরদিকে কৌশলী ইংরেজ শাসক কমিউনিস্টদের ধরপাকড় করেছে অবিরত। তাঁরা বুঝেছিল এরাই ব্রিটিশদের প্রকৃত শত্রু।
‘কাকাবাবু’ মুজফ্ফর আহ্মদকে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদিন কারান্তরালে রেখেছেন। অনেকেই আত্মগোপনে থেকে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই উত্তাল সময়ে সমাজের বিভিন্ন বর্গের মানুষ আলোড়িত হয়েছেন।
জেলাস্তরেও অসংখ্য কর্মী গড়ে উঠেছিল সমাজতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে বুকে নিয়ে। তিরিশের দশকের এই আন্দোলনের ঢেউয়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গণসংগঠন। ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষকসভা, নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন, প্রগতি লেখক সংঘ - ১৯২০-১৯৩৬ এর মধ্যে।
১৯২৬ সালে গড়ে ওঠে নিখিল ভারত মহিলা সংগঠন। ১৯২৭ সালে গায়কোয়াডের মহারানী চিমনভাই, মার্গারেট কাজিনস, রেনুকা রায়, মোহিনী দেবী, সরোজিনী নাইডু, অমৃত কাউর, রামেশ্বরী নেহরু, বেগম হামিদাবানু সংগঠনের পুরোভাগে ছিলেন। তাঁদের মূল কাজই ছিল সমাজ সেবামূলক।
সাধারণভাবে নারীর আইনগত অধিকার, নারীর ভোটাধিকার, স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে সংগঠন প্রগতিশীল ভূমিকা নিয়েছে। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস মহিলা সঙ্ঘের জন্ম। মহিলাদের সংগঠিত করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুব, মহিলা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। উল্লেখযোগ্য অংশের মহিলা কর্মীরাও শেকল ভাঙার লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। তাঁদের ত্যাগ তিতিক্ষা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ত্রিশের দশকে ভারতের ছাত্র ফেডারেশনে যুক্ত হলেন কনক দাশগুপ্ত, শান্তি সরকার বসু, কল্যাণী মুখার্জি (কুমার মঙ্গলম), চিনু ঘোষ, রায়বাদী পার্টির শোভা মজুমদার - এঁদের নেতৃত্বে গঠিত হয় গার্লস স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, যার প্রথম সম্পাদিকা কনক দাশগুপ্ত। এরপর সম্পাদিকা হন গীতা মুখার্জি। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কমিউনিস্ট নেতা সরোজ মুখার্জির সাথে বিবাহের পর তিনি পরিচিত হলেন কনক মুখার্জি নামে। পরবর্তীকালে যাঁদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে উন্নীত হয়েছেন। কেউ বা সাংস্কৃতিক জগতে পা রেখেছেন যেমন প্রীতি ব্যানার্জি।
প্রত্যেকেই অসংখ্য পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কনক দাশগুপ্ত কমরেড কানাই রায়ের স্ত্রী সেজে দিল্লিতে পৌঁছেছেন। দু’বছর তিনি সেখানে থাকতে বাধ্য হয়েছেন।
বারবার কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়েছে আর নেতা-নেত্রীদের হয় জেল নয় আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। অপরদিকে শুরু হলো ’৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন। দলে দলে গৃহবধূরা বেড়িয়ে এসেছেন সব ছেড়ে। একটা তীব্র অধৈর্য্য আর অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠল। মেদিনীপুরে শহিদ হলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে অকুতোভয়ে বলেছিলেন পেছাবনি। গুলিতে দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেলেও মুষ্টিবদ্ধ হাতে তেরঙ্গা পতাকা ধরাই ছিল। আসামে শহিদ হয়েছিলেন কনকলতা বড়ুয়া।
১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মাঝেই ১৩ এপ্রিল কলকাতায় কমিউনিস্ট নেত্রীদের উদ্যোগে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে গঠিত হলো ‘কলকাতা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’। সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রগতিশীল মহিলারা, কংগ্রেসের মহিলা নেতৃত্ব যুক্ত হয়ে প্রস্তাব পেশ করলেন - যার সারমর্ম স্বাধীনতা আন্দোলনে সমস্ত মানুষকে শামিল করতে হবে। এই সম্মেলনে সম্পাদিকা হলেন এলা রিড। কার্যকরী কমিটির সদস্যাবৃন্দ - জ্যোর্তিময়ী গাঙ্গুলী, সাকিলা বেগম, রেণু চক্রবর্তী, সুধা রায়, মনিকুন্তলা সেন, নাজিমুন্নেসা আহমেদ, রিয়াস্ট্রিস স্টেবান, অপর্ণা সেন, ফুলরেণু গুহ।
প্রত্যেক বক্তাই বলেছেন চীন ও সোভিয়েত রাশিয়ার নারীদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই তাঁদের উজ্জীবিত করেছে। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে।
১৯৪৩-এর মন্বন্তরে খাদ্য সংকট, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে নারীর জীবনে এসেছে নানা সংকট। মহিলারা রিলিফের কাজ থেকে শুরু করে নারীর সুরক্ষা, অসহায় মেয়েদের সাক্ষরতার কাজ, সেলাই শিক্ষা থেকে শুরু করে গ্রামে গ্রামে তাঁদের সংগঠিত করতে শুরু করলেন, মূলত কৃষক রমনীদের।
অপরদিকে ১৯৪৬ সালে শুরু হলো ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা। পরিকল্পিত এই দাঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশেও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা থেকেছেন। ১৯৪৬-৪৭ - স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল দুর্নিবার কৃষক আন্দোলন। জোতদার-জমিদার, সামন্ত প্রভুদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকসভার নেতৃত্বে শুরু হলো তেভাগার দাবিতে লড়াই। সে এক অসম যুদ্ধ। জমিদারদের নিজস্ব লেঠেল বাহিনী, ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে কৃষকের লড়াই স্বাধীনতা লাভের পথকে ত্বরান্বিত করেছে। কৃষক রমনীর সেই লড়াইয়ের ভূমিকা সেভাবে আলোচিত হয় না। অভিজাত ঘরের কংগ্রেস নেত্রী, মধ্যবিত্ত ঘরের নেতৃত্বের কথাই আমরা জানি। কিন্তু কত নাম না জানা কৃষক রমনীর আত্মত্যাগ কমই স্থান পায় আলোচনায়। বাংলার কৃষক আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি আদিবাসী নারী পুরুষের দাসশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন গোদাবরী পারুলেকর। তেলেঙ্গানার সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহে জঙ্গি নারীদের আন্দোলন, কেরলের লড়াই, ত্রিপুরার রিয়াং বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর বাংলায় রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, হাওড়া, হুগলি, ২৪ পরগনা, মেদিনীপুরসহ প্রায় ১৯টি জেলাতেই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কাকদ্বীপের গর্ভবতী অহল্যা দাসী, সূর্যমণি, দিনাজপুরের খাঁপুরে যশোদারানী সরকার, কৌশল্যা, চন্দনপিড়ি, ডুবিরভেড়ি, ডোঙ্গা জোড়ার কৃষক রমনী চন্দনপিড়ির উত্তমী দাসী, বাতাসী দাসী, সরোজিনী দাসী ও নাম না জানা একজন, হুগলি জেলার ডুবিরভেড়ির পুষ্পবালা দাসী, পাঁচুবালা ভৌমিক, দাসীবালা মাল, কালীবালা পাখিরা, মুক্তকেশী মাঝি, রাজকৃষ্ণের মা, আরও পাঁচজন, হাওড়া জেলার সাঁকরাইলের মাসীলা গ্রামে শহিদ হয়েছেন মনোরমা রায়, লক্ষ্মীমণি রায়, হিরন্ময়ী গাঙ্গুলী, ঘেটুরামের স্ত্রী, বাঁগরীর মা, পঞ্চুর বৌ, হাওড়া জেলার হাটালে শহিদ হয়েছেন যশোদাময়ী সাঁতরা, সুধাময়ী সাঁতরা, পারুলবালা ভৌমিক, মাখনবালা সাঁতরা, সত্যবালা দাসী, অষ্টবালা পণ্ডিত, ননীবালা পণ্ডিত, বালিকা পাত্র, সিন্ধুবালা দলুই, ভাবময়ী দাসীসহ আরও অনেকে। এভাবেই চলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর জোতদার, জমিদার, কংগ্রেসের নেতৃত্বে নারী কৃষক হত্যা। নাচোলের কৃষক আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রর উপর ব্রিটিশ পুলিশের বর্বর অত্যাচারের ঘটনা সর্বজনবিদিত।
ব্রিটিশ শাসকের প্রতিনিধি, কংগ্রেস, মুসলিম লিগের নেতৃত্ব গোল টেবিল বৈঠকে বসে দেশ ভাগ করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করল। ১৯৪৭ সালের মধ্যরজনীতে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়ল। পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান এই নামে। আমরা স্বাধীন হলাম। এই আন্দোলনে মহিলাদের বীর গাথার ভগ্নাংশ মাত্র তুলে ধরা গেল।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান ঘোষণা করেছে ভারত একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, প্রজাতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সবার জন্য খাদ্যের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার নারী পুরুষ উভয়েই ভোগ করবেন। বাস্তবে তার কতটা কার্যকর হয়েছে সে অন্য ইতিহাস। সমস্ত অধিকার আজ আক্রান্ত। মহিলাদের উপর মনুবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, শারীরিক মানসিক নিগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার আক্রান্ত। আইন ও বিচারব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা চলেছে। জীবন-জীবিকা আক্রান্ত, সংবিধানকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ফ্যাসিস্ত বিজেপি-আরএসএস হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ক্রমশ আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংসের মুখে। তার বিরুদ্ধে বাম-গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল শক্তি সর্বত্র প্রতিবাদ ধ্বনিত করছে। কি রাজ্যে কি কেন্দ্রে একই মানসিকতার সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। মহিলারাও সেই লড়াইয়ে শামিল রয়েছেন।
ঋণ স্বীকারঃ ‘নারী মুক্তি আন্দোলন ও আমরা’ - কনক মুখোপাধ্যায়