৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯
ভারতীয় সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র রক্ষার চ্যালেঞ্জ বামপন্থীদের গ্রহণ করতে হবে
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি এবছর অর্থাৎ ২০২২ সাল। বহু রক্তক্ষয় ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত ভারতের স্বাধীনতা। ভারতের জনগণ যেমন এই ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আবার রাজনৈতিক দলগুলিও তাদের মতো করে স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনের পরিকল্পনা করছেন। শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-ও এই ঐতিহাসিকক্ষণকে স্মরণে রেখে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে সমগ্র দেশ জুড়ে স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইয়ের তিনটি ধারার সম্পর্কে আমরা পরিচিত। তিনটি ধারা ছিল ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের প্রতিনিধি। প্রথম ধারাটি ছিল - ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতের লক্ষ্যে - এই ধারাটির নেতৃত্বে ছিল জাতীয় কংগ্রেস। দ্বিতীয় ধারাটি ছিল - ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক ভারত - এই ধারাটির নেতৃত্বে ছিল বামপন্থী ও কমিউনিস্টরা। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের সাথে সাথে জনগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও শোষণমুক্ত জীবন না হলে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জিত হয় না। তৃতীয় ধারাটি ছিল ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদী ভারত স্থাপনের লক্ষ্যে। হিন্দু মহাসভা ও পরবর্তীকালে আরএসএস এবং মুসলিম লিগ ছিল তৃতীয় ধারাটির নেতৃত্বে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটল দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা অর্জিত হলেও দেশ দুইটি ভাগে বিভক্ত হলো। ভারত ও পাকিস্তান। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব ভারতের শাসনভার গ্রহণ করল। পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করল মুললিম লিগ।
স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ভারতবাসীর গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম চিরস্মরণীয়। এই গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামে শ্রমিক-কৃষকসহ দেশের মেহনতি জনগণের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আপসহীনভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পুরোভাগে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ভারতীয় জনগণের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, সামন্ততন্ত্র বিরোধী আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই জাগরণের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। [১.৭ ধারা-সিপিআই(এম)-র কর্মসূচি]
ভারতের সংবিধান প্রণীত হলো ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি দ্বারা এই সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানের মর্মবস্তু প্রকৃত অর্থে তার ভিত্তি রচিত হয় ১৯৩১ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে।
জাতীয় কংগ্রেসের করাচি অধিবেশন
এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয় কংগ্রেসের করাচি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে গান্ধী - আরউইন চুক্তির মধ্য দিয়ে গণআইন অমান্য আন্দোলন স্থগিত করা হয়। মহাত্মা গান্ধী জেল থেকে মুক্তি পেলেন এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভগৎ সিং ও তাঁর দুই সহকর্মীর ফাঁসির সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। ভগৎ সিং এবং তাঁর দুই সহকর্মী রাজগুরু ও সুখদেবের মৃত্যুতে ভারতবাসীর শোকের প্রতিফলন লক্ষিত হয়েছিল করাচি অধিবেশনের সময়ে সমগ্র শহরে। ভগৎ সিং-এর প্রশ্নে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকার বিরুদ্ধে করাচিবাসীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
এই করাচি অধিবেশনে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ণ স্বরাজ অর্থাৎ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হলো। প্রস্তাবে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র যে সমস্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে গুরুত্ব দেবে তারও উল্লেখ করা হলো। সাথে সাথে মৌলিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা যা ভারত রাষ্ট্রে রক্ষিত হবে তারও উল্লেখ বলিষ্ঠভাবে করা হলো। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত ভারতবাসীর সমান অধিকারের কথা বলা হলো উক্ত প্রস্তাবে।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করার কথা এই প্রস্তাবে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলো। রাষ্ট্রের আচরণে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হলো। করাচি প্রস্তাবে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হলো। করাচি অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব ভারতের সংবিধানের ভিত্তি প্রস্তুত করল।
ভারতীয় সংবিধান
ভারতের স্বাধীনতার প্রায় আড়াই বছর পর সংবিধান প্রবর্তিত হলো। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার দিনটিতে ভারত প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষিত হলো। সংবিধানই হলো ভারতের সর্বোচ্চ আইন সংক্রান্ত দলিল। জনগণের মৌলিক অধিকার, নির্দেশাত্মক নীতি, নাগরিকদের কর্তব্য - সমস্ত কিছুই এই সংবিধানে বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি ১৯৪৯-এর ২৬ নভেম্বর সংবিধান গ্রহণ করেছিল। দুই মাস পর তা কার্যকর হয়।
ভারতীয় সংবিধানে ভারতকে একটি সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি ১৯৭৫-৭৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারত রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য ন্যায়, সমতা এবং স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করবে। জনগণের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবে - একথাও সংবিধানে উল্লেখ করা হলো।
কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি তিন বছরের মধ্যে এই সংবিধান প্রস্তুত করেছিল। একথা বলা কোনো অত্যুক্তি নয়, বাবা সাহেব আম্বেদকর ছিলেন প্রকৃত অর্থেই সংবিধানের মূল রচয়িতা। নিঃসন্দেহে একথা বলা যায় যে, ভারতীয় সংবিধান এক অত্যন্ত উন্নতমানের দলিল।
বর্তমানে সংবিধানের মর্মবস্তু আক্রান্ত
২০১৪ সাল থেকে বিজেপি কেন্দ্রের সরকার পরিচালনা করছে। আরএসএস হলো বিজেপি-র মূল পরিচালক। অরএসএস-র হয়ে রাজনৈতিক কার্যধারা পরিচালনা করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। উগ্র হিন্দুত্ববাদই হলো আরএসএস-র মতাদর্শ। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করাই হলো এদের লক্ষ্য। ভারতের বহুত্ববাদী ইতিহাসকে তারা স্বীকার করে না। নানা ভাষা ও ধর্ম, নানা বর্ণ ও জাতি-উপজাতির সমন্বয়ে ভারতীয় বৈচিত্র্যকেও তারা স্বীকার করে না। ফ্যাসিবাদী সংগঠনের আদর্শ সামনে রেখে গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত আরএসএস স্বাধীনতার পর যে ভারত গড়ে উঠল, স্বাধীন ভারতের যে সংবিধান, কোনটাকেই তারা গ্রহণ করেনি। বিস্মৃত হলে চলবে না, গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গড্সে ছিলেন আরএসএস-র প্রচারক। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ স্থাপনই সংঘের একমাত্র লক্ষ্য।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের লক্ষ্যে আরএসএস-র কার্যধারা পরিচালিত হচ্ছে। কেন্দ্রের সরকারকে ব্যবহার করে ভারত রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি সম্পূর্ণ দখল করার অভিযান তারা পরিচালনা করে চলেছে। সমগ্র প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, সামরিক বাহিনীর সমস্ত শাখা, শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সংস্থা, পাঠ্যপুস্তক রচনার সংস্থা, সমগ্র সংস্কৃতি ক্ষেত্র, সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলি খুবই পরিকল্পিতভাবে আরএসএস তাদের অধিকারে এনেছে। বিচার ব্যবস্থার দিকেও তারা হাত বাড়িয়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র কর্মসূচিতে এই প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘‘...বিজেপি কোনো সাধারণ বুর্জোয়া দল নয়। কেননা ফ্যাসিস্ত ধাঁচের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাদের পরিচালনা করে, আধিপত্য করে। বিজেপি ক্ষমতায় আসায় রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সংস্থায় প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে আরএসএস। হিন্দুত্ব মতাদর্শ পুনরুত্থানবাদকে মদত দেয়, হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে।’’ (৭.৩৪ ধারা)
সিপিআই(এম)-র কর্মসূচিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ত ধাঁচের আরএসএস পরিচালিত জোটের শক্তিবৃদ্ধি ও কেন্দ্রে তাদের ক্ষমতা দখলের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির বিপদ গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যমের সাম্প্রদায়িকীকরণের পরিকল্পিত প্রয়াস চলছে।...’’ (৫.৭ ধারা)
ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত
ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতা বিগত ৮ বছর সময়কালে অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে গুরুতরভাবে আক্রান্ত। জাতীয় প্রচারমাধ্যমে অযোধ্যার মন্দির নির্মাণ শুরু এবং কাশী বিশ্বনাথ গঙ্গা রাস্তা (করিডোর) নির্মাণ শুরু প্রকল্পকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে দেখানো হয়েছে, বর্ণনা করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির বড়ো কথা হলো রাষ্ট্র যে কোনো ধরনের ধর্মীয় কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকবে - তাকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে নবনির্মীয়মাণ সংসদের শীর্ষে অশোক স্তম্ভ বসানোর অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিন্দু ধর্মীয় আচরণ করলেন। মোদি সরকার ভারতকে একটি হিন্দুত্ব রাষ্ট্রে পরিণত করতে ক্রমান্বয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমগ্র সঙ্ঘ বাহিনীর দ্বারা আক্রমণ উৎসাহিত হচ্ছে। ২০২০-তে দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ছিল পরিকল্পিত আক্রমণ। যারা আক্রমণ করল এবং কেন্দ্রীয় যে মন্ত্রী চরম প্ররোচনামূলক বক্তব্যে হিংসাকে ইন্ধন জোগান, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। ২০২১-এর তথাকথিত ধর্ম সংসদ ভয়ংকরভাবে সরাসরি মুসলিম হত্যার আহ্বান জানালো। কেন্দ্রের সরকার নির্বিকার। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গো হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, লাভ-জিহাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে দেশদ্রোহিতার আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।
জম্মু-কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০নং ধারা বাতিল দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর আক্রমণ। দেশের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫(ক) ধারা বাতিল দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর সরাসরি আক্রমণ। অসাংবিধানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে চরম অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে মোদির সরকার।
ক্রমবর্ধমান স্বৈরতন্ত্র
গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার যা ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তা আজ চরম আক্রান্ত। জাতীয় নিরাপত্তা আইন, দেশদ্রোহী আইন, ইউএপিএ - এগুলি নির্বিচারে জনগণের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে বিনা অপরাধে প্রতিবাদী মানুষদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। যে কোনো ধরনের বিরোধিতা মোদি সরকার জাতীয়তা বিরোধী আখ্যা দিচ্ছে। সিএএ অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব আইন যা আরএসএস-বিজেপি সরকার জারি করেছে তার যেকোনরকম বিরোধিতা দমন করতে দানবীয় আইন জারি করেছে। সাজানো ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় ১৬ জন বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীকে জেলে পুরে দেওয়া হয়েছে ইউএপিএ আইনে। এদের মধ্যে ফাদার স্ট্যান স্বামী জেলের অভ্যন্তরে মারা গেলেন। ২০১৫-র পর ইউএপিএ আইন প্রয়োগ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার ব্যাপারে সাংবিধানিক সুরক্ষা আজ মোদি সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণে ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত। জনগণের গোপনীয়তার অধিকারের কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এমনকী জনগণের ডিজিটাল তথ্যের ক্ষেত্রেও অনুপ্রবেশ করছে। ডিজিটাল নজরদারি পরিকাঠামোকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইজরায়েল সরকারের থেকে ‘পেগাসাস স্পাইওয়ার’ প্রযুক্তি কেন্দ্রের সরকার ক্রয় করেছে বিরোধীদের, সাংবাদিকদের এবং সমাজকর্মীদের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য।
আক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা
ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সাথে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। যা দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। আরএসএস-বিজেপি সরকার শিক্ষাগত, রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্ত দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপাল পদকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংবিধানের রাজ্য তালিকাভুক্ত এলাকাগুলিতে রাজ্য সরকারগুলির অধিকার হরণ করা হচ্ছে। শিক্ষা যা যৌথ তালিকায়, সেখানে রাজ্য সরকারগুলির অধিকার অস্বীকার করে কেন্দ্রের সরকার একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ এভাবে ঘোষণা করা হলো রাজ্য সরকারগুলিকে অন্ধকারে রেখে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির স্বাধিকার ভয়ংকরভাবে সংকুচিত। বিরোধী শাসিত রাজ্য সরকারগুলির অর্জিত অধিকার গুরুতরভাবে আক্রান্ত। ভারতীয় সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তা নরেন্দ্র মোদীর সরকারের শাসনে শুধু গুরুতরভাবে দুর্বলই হয়নি, ভয়ংকরভাবে আক্রান্তও বটে। স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্য তথা বহুত্ববাদের পীঠস্থান ভারতের মর্মবস্তুকে রক্ষা করতে হলে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হলো ভারতীয় সংবিধানের প্রাণভোমরা। হিন্দুত্ববাদী আরএসএস ভারত ধারণার মর্মবস্তুকে সম্পূর্ণ পালটে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে ভারতের মর্মবস্তু অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র রক্ষার শপথ নিতে হবে। ভারতীয় সংবিধান যখন চরমভাবে আক্রান্ত তখন দেশের সংবিধান ও সংবিধানের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ বামপন্থীদের গ্রহণ করতেই হবে।