৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভারতের অর্থনীতি
প্রভাত পট্টনায়েক
স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্রের সামনে দুটি প্রাথমিক কর্তব্য উপস্থিত হয়েছিল। তার একটি ছিল মেট্রোপলিসের (মেট্রোপলিটন) পুঁজির আধিপত্য কাটিয়ে ওঠা, যাতে করে উন্নয়নের এক বিকল্প, তুলনামূলকভাবে স্বাধীন কৌশল অবলম্বন করা যায়। দ্বিতীয়টি ছিল জমিদারতন্ত্রের নাগপাশ থেকে কৃষিজীবী জনগণকে মুক্ত করা এবং ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বেগবান শিল্পায়নের ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে জমিদারি ব্যবস্থার উপর তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনা। দুটি কাজই একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল। যতক্ষণ না জমিদারতন্ত্রকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ঘটানো যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীন উন্নয়নমুখী কৌশলের সাথে সম্পৃক্ত মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ এবং পরিশোধের হিসাব (Balance of Payments)-এর চাপের ফলে সামগ্রিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে থাকবে। এবং এর ফলে উদ্ভূত সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির চাপের ফলে রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে।
কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে জমিদারতন্ত্রের ওপর আক্রমণ অত্যন্ত ক্ষীণ ছিল। ফলে তা শুধুমাত্র প্রবাসী জমিদারদের হাত থেকে মুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছিল। অন্য সমস্ত জমিদার কালক্রমে কৃষিভিত্তিক ধনিক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়ে থেকে যান এবং এযাবৎকাল ‘খুদকস্ত’ হিসেবে ভোগ করা জমি নিজেদের দখলে রেখে দিতে সমর্থ হন। অন্যদিকে জমিদারশ্রেণির হাত থেকে যেটুকু জমি রাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করে তার প্রায় পুরোটাই উপরের স্তরের প্রজাদের মালিকানায় তুলে দেওয়া হয়। ফলে উপরের দিকের ১৫ শতাংশ জমিদারের মালিকানায় যে জমি কেন্দ্রীভূত ছিল তার পরিমাণগত বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধুমাত্র উপরের ১৫ শতাংশ জমির ভূস্বামীদের গঠনে সামান্য পরিবর্তন সাধিত হয় বলা যায়। কারণ প্রবাসী জমিদারদের (Absentee Landlords) প্রতিস্থাপন করে উপরের স্তরের প্রজারা ভূস্বামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলত গ্রামাঞ্চলে পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থার ক্ষেত্র প্রস্তুত ও প্রসারিত হয়। একই সময়ে উন্নততর কৃষি পদ্ধতির বিকাশ ও বিস্তারের জন্য সেচে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো হয়।
মেট্রোপলিসের পুঁজির আধিপত্য কাটিয়ে ওঠার জন্য কতকগুলি কৌশল অবলম্বন করা হয় যেমন, দেশীয় অর্থনীতিকে ব্যাপক সুরক্ষা প্রদান; বাণিজ্য, বিশেষত কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ; কৃষিভিত্তিক ব্যবসাকে যত দূর সম্ভব দূরে রাখা (এমনকী ভারতীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিকে কৃষকদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত রাখা); আন্তঃসীমান্ত পুঁজি প্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা; অর্থ সংস্থান সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জাতীয়করণ (যদিও ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হয় বেশ কিছু বছর পর); এবং এই ধরনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিকাশ ও বিস্তার। এই আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে গঠন করা হয় একটি বিনিয়োগ নীতি এবং একটি বিদেশি মুদ্রা-লাইসেন্সিং ব্যবস্থা। বিদেশি পুঁজির সাথে সহযোগিতার চুক্তিগুলির বিষয়ও এই লাইসেন্সিং ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ফলে ঔপনিবেশিক যুগের ভয়াবহ অবস্থার থেকে অনেকটাই পরিবর্তিত হয় দেশের অর্থনীতি। জিডিপি এবং কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হারে উল্লেখযোগ্য গতি আসে। একটি চমকপ্রদ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় মাথাপিছু খাদ্যশস্যের জোগানের ক্ষেত্রে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ব্রিটিশ শাসনকালে মাথাপিছু বার্ষিক খাদ্যশস্যের জোগান ছিল ২০০ কেজি। ১৯৪৬-৪৭-এ তা ভয়ঙ্করভাবে নেমে দাঁড়ায় ১৩৬.৮ কেজিতে। এই তীব্র অধোগতি থেকে স্বাধীন ভারত ঘুরে দাঁড়ায়। ৮০-র দশকের শেষের দিকে বার্ষিক মাথাপিছু খাদ্যের জোগান বেড়ে হয় ১৮০ কেজি।
কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগের তুলনায় খাদ্যের জোগানের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার বেশি হলেও সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ১৯৭৩-৭৪ সালেও গ্রামীণ ভারতের ৫৬ শতাংশ দৈনিক ২২০০ ক্যালোরির সংজ্ঞায়িত দারিদ্র্যসীমার নিচেই পড়েছিলেন। শহরের ৬০ শতাংশ মানুষ ২১০০ ক্যালোরির জোগান থেকে বঞ্চিত ছিলেন। একইভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ২ শতাংশে। দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের সাথে সমানুপাতিক হলেও এই বৃদ্ধির হার বিপুল বেকারত্বের ঔপনিবেশিক দায় থেকে দেশকে মুক্তি দিতে পারেনি। ফলে যুবসম্প্রদায়ের একটা বড়ো অংশ বঞ্চিত হতে থাকে। অন্যদিকে দেশের বৃহৎ বুর্জোয়ার যে অংশটি স্বায়ত্তশাসিত পুঁজিবাদের সমর্থন করছিল এবং এর ফলে কলেবরে বেড়ে আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছিল, তাদের কাছেও অর্থনীতির এই বৃদ্ধির হার ক্রমশ ‘হতাশাব্যঞ্জক’ হিসেবে প্রতিপন্ন হচ্ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের কোষাগার ঘাটতি ক্রমশ বেড়ে চলার ফলে আর্থিক বৃদ্ধির এই হারও ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল।
এই প্রেক্ষাপটেই দেশের বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণির পক্ষ থেকে আর্থিক নীতির আমূল পরিবর্তন অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থেকে নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার দিকে রাষ্ট্রীয় অবস্থান পরিবর্তনের দাবি উঠে আসে। সত্তরের দশকের তেলের দামের ধাক্কার পর আধিপত্যবাদী উপাদান হিসাবে আর্বিভূত হওয়া আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে মিশে গিয়ে আরও বেশি মুনাফার সন্ধান পেয়ে যায় তারা। মধ্যবিত্তও এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। নয়া উদারবাদের প্রলোভনের শিকার হয়ে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, অর্থব্যবস্থার এই পরিবর্তনের ফলে মেট্রোপলিসের (মেট্রোপলিটনের) পুঁজির কল্যাণে আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হবে। অন্যদিকে শ্রমজীবী জনগণ, যাদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার সপক্ষে দাঁড়ানোর আশা করা হয়েছিল, তারাও তাকে রক্ষার জন্য সেইভাবে এগিয়ে আসেননি। কারণ, ইতিমধ্যেই এই অর্থব্যবস্থা তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। তাই ১৯৮৫ থেকে শুরু করে, এবং বিশেষত ১৯৯১-এর পর থেকে ভারত একটি নয়া উদারবাদী অর্থনীতির কবলে চলে যায় - যার অর্থ হলো পণ্য ও পরিষেবা এবং মূলধনের অবাধ আন্তঃসীমান্ত প্রবাহ, তৎসহ লাইসেন্সিং প্রথার বিলুপ্তি।
এই পরিবর্তন কিন্তু অর্থব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং বলা যায় ঔপনিবেশিক আমলের মেট্রোপলিসের পুঁজির আধিপত্যের পুনরুত্থান সূচিত করে। একদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মেট্রোপলিসের পুঁজির সাথে মিলে যায় দেশের বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণি, অন্যদিকে দেখা যায় উচ্চমধ্যবিত্তের একাংশের এই পরিবর্তনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন। স্বাধীনোত্তর ভারতের নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনীতির পেছনে ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সমাজের দ্বন্দ্ব এবং তজ্জনিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিভিন্ন শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। কিন্তু নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় সেই দেশই আজ দ্বিধাবিভক্ত। সাম্রাজ্যবাদ ও জাতির মধ্যের বিভাজিকা রেখা স্থান পরিবর্তন করে আজ জাতির অভ্যন্তরে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। আজকের দ্বন্দ্ব বা বিভাজনের রেখার একদিকে রয়েছে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি এবং অভ্যন্তরীণ বৃহৎ বুর্জোয়া, অন্যদিকে রয়েছে সমগ্র শ্রমিকশ্রেণি।
এর অভিঘাতে রাষ্ট্রের অবস্থানেও এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। শ্রেণির ঊর্ধ্বে দাঁড়ানো, আপাত নিরপেক্ষ সত্তা বজায় রাখার বদলে ভারতীয় রাষ্ট্র এখন সম্পূর্ণরূপে বৃহৎ বুর্জোয়াঊ, জমির মালিক ও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থবাহী হয়ে উঠেছে। এই পরিবর্তনের একটি বহিঃপ্রকাশ হলো কৃষি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উৎপাদন অবধি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রত্যাহার করা এবং এই ক্ষেত্রগুলিতে আন্তর্জাতিক কৃষি ব্যবসা এবং অভ্যন্তরীণ দেশীয় বৃহৎ বুর্জোয়ার আগ্রাসী অনুপ্রবেশের রাস্তা খুলে দেওয়া। এমনি কিছু সহায়তা প্রত্যাহার, যেমন অর্থকরী ফসলের ওপর থেকে সহায়কমূল্য প্রত্যাহার (সম্প্রতি এক বছর ব্যাপী কৃষক বিক্ষোভের ফলে খাদ্যশস্যের ওপর থেকে সহায়ক মূল্য প্রত্যাহারের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়) এবং ঋণ সহ বিভিন্ন রকম ভরতুকি প্রত্যাহারের মতো নীতির ফলে চাষে লাভজন আয় ব্যাপক ভাবে হ্রাস পায়। এই সংকটের ফলেই একদিকে দেশ জুড়ে কৃষিজীবী মানুষের আত্মহত্যা আর মৃত্যুমিছিল, অন্যদিকে অস্তিত্বহীন রুজির খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে কৃষিজীবী জনতার গণস্থানান্তর যার দরুন শিল্পের সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায়, নয়া উদারবাদ একটা মিথ্যের ঝুড়ি। নয়া উদারবাদী জিডিপি’র বৃদ্ধির হার নিঃসন্দেহে অনেকটা ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু অতীতের তুলনায় এই সময়কালে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার অর্ধেক হয়ে গেছে, অর্থাৎ বার্ষিক প্রায় ১ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উচ্চ হার যা শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটানোর পরিবর্তে শিল্পের শ্রম-নির্ভরশীলতা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। শ্রম-উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, দেশীয় উৎপাদকদের (শুধুমাত্র রপ্তানিকারকদের নয়, এমনকী যারা দেশীয় বাজারের জন্য উৎপাদন করেন তাঁদেরও) সমস্ত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে বিদেশি উৎপাদকদের সাথে অসম প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেওয়ার ভ্রান্ত নীতি। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, শিল্পের সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনীর আকার বৃদ্ধির বহিঃপ্রকাশ সবক্ষেত্রে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি হিসেবে দেখা দেয় না। পক্ষান্তরে, নির্দিষ্ট মজুরির বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার কাজ আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার কৌশলও অনেক সময় অবলম্বন করে শাসকশ্রেণি। কিন্তু এই বৃদ্ধি অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির সাথে সাথে সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরও দরকষাকষির ক্ষমতা কমিয়ে মজুরি কমিয়ে আনে।
কৃষক ও ক্ষুদ্র উৎপাদকদের চূড়ান্ত শোষণের মাধ্যমে এবং সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা কমিয়ে এনে নয়া-উদারবাদী শাসন সারা দেশের শ্রমিকদের প্রকৃত গড় মাথপিছু আয় ব্যাপক হারে কমাতে সমর্থ হয়েছে। ফলে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার যতই ঊর্ধ্বমুখী হোক না কেন, দারিদ্র্যের আনুপাতিক হারও ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮০-র দশকের শেষভাগ অবধি মাথাপিছু খাদ্যশস্যের জোগান যেটুকু বৃদ্ধি পেয়েছিল নয়া উদারবাদী জমানায় এসে তা থমকে দাঁড়ায়। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (National Sample Survey)-র প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৩-৯৪ সালে দৈনিক ২২০০ ক্যালোরির কম খাদ্য গ্রহণ করতে সমর্থ হন গ্রামীণ ভারতে ৫৮ শতাংশ মানুষ। ২০১১-১২-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে। এনএসএস-এর পরবর্তী (২০১৭-১৮)-তে পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। তথ্যে প্রকাশ, ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সময়কালে গ্রামীণ ভারতের জনগণের মাথাপিছু প্রকৃত ব্যয় ৯ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এই পরিসংখ্যান প্রকাশের ফলে দেশের অর্থনীতির নিদারুণ অবস্থা প্রকট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রতিবেদনটি চেপে দেয় এবং এনএসএস-র চিরাচরিত কাজে ধাঁচ বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই হলো গ্রামীণ ভারতের চিত্র। কিন্তু দেশের নগরের অধিবাসীদের পরিস্থিতিও এক ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরে। ১৯৯৩-৯৪ ও ২০১১-১২-র মধ্যবর্তী সময়কালে ভারতের শহরবাসী মানুষের মধ্যে ২১০০ ক্যালোরির কম খাদ্য গ্রহণ করা মানুষের সংখ্যা ৫৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশে।
নয়া উদারবাদী ‘‘চুঁইয়ে পড়া’’ (Trickle down)-র তত্ত্বের অন্তঃসারশূন্য অবস্থা অনাবৃত হয় যখন আমরা দেখি এমনকী এই শাসনব্যবস্থার চরম বিকাশের কালেও শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ক্রমবর্ধমান। এই দুর্দশা আরও প্রকট করে নয়া-উদারবাদ আজ এক গভীর সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত এবং সেখান থেকে উত্তরণের কোনো পথ তার সামনে খোলা নেই। কিন্তু এই সংকট কোনোভাবেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। আমরা আগেই দেখেছি, কিভাবে নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় শ্রম-উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি সত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষের মাথাপিছু প্রকৃত গড়পড়তা আয় হ্রাস পায় এবং কীভাবে এই প্রবণতার ফলে উৎপাদনে আর্থিক উদ্বৃত্তের অংশটি ঊর্ধ্বমুখী হয় (প্রকৃত অর্থে এটি একটি বিশ্বজনীন প্রবণতা)। নয়া উদারবাদী শাসনাধীন ভারতের এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশে আয় বৈষম্যের চূড়ান্ত বৃদ্ধির এটিই প্রধান কারণ।
যেহেতু উদ্বৃত্ত একজন উপার্জনকারীর হাতের এক টাকা একজন শ্রমজীবী মানুষের হাতে থাকা এক টাকার চেয়ে কম ব্যয়ের অবকাশ রাখে, তাই আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি অতিরিক্ত উৎপাদনের প্রবণতার জন্ম দেয়। সম্পদ মূল্যের বুদবুদ (Asset Price Bubbles) সৃষ্টির ফলে সম্পদ ভোগকারীদের মধ্যে নিজেকে ধনী মনে হওয়ার এক অলীক ধারণা তৈরি করে বাজারে এক কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রবণতা অনেকটাই প্রচলিত এবং সম্পদ-মূল্যের এই বুদবুদগুলির জন্যই অতিরিক্ত উৎপাদনের প্রক্রিয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল। ২০০৮ সালের মার্কিন আবাস বুদবুদ (American Housing Bubble)-এর পতনের সময় এই কৃত্রিম অতিরিক্ত চাহিদা নির্ভর উৎপাদন কৌশলের রূপটি আরেকবার জনসমক্ষে উন্মুক্ত হয়ে যায়। তারপর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতি কমবেশি স্থবির অবস্থায় রয়েছে এবং ভারতীয় অর্থনীতিও এই স্থবিরতার আবর্তে জড়িয়ে পড়েছে যা দেশকে আরও ঘোরতর বেকারত্বের সংকট এবং আরও তীব্র দুর্দশার মধ্যে দেশের জনগণকে নিক্ষিপ্ত করে চলেছে। এই নিদারুণ পরিস্থিতিকে আরও দুঃসহ করে তুলেছে নোটবন্দি এবং জিএসটি-র (যদিও এর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের আমলে) মতো অশুভ পদক্ষেপগুলি। নয়া উদারবাদী শাসনের অধীনে থেকে এই সংকট থেকে মুক্তির কোনও পথ নেই। এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র সম্ভাব্য প্রক্রিয়া হলো অধিকতর রাষ্ট্রীয় ব্যয়, এবং তা তখনই সম্ভব হবে যখন এই ব্যয়ের অর্থায়ন হবে হয় রাজস্ব ঘাটতির মধ্য দিয়ে নতুবা উদ্বৃত্ত উপার্জনকারীদের ওপর কর আরোপ করে। যদি এই অর্থায়ন হয় শ্রমজীবী মানুষের ওপর কর চাপিয়ে (এমনিতেই যারা প্রায় সম্পূর্ণ আয় ব্যয় করে ফেলেন) তাহলে শুধুমাত্র একধরনের চাহিদাকে আরেক ধরনের চাহিদার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। ফলে মোট চাহিদার কোনও বৃদ্ধি ঘটবে না। কিন্তু রাজস্ব ঘাটতি এবং বড়োলোকের ওপর কর চাপানো দুটির কোনোটিই আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে নয়া উদারবাদী শাসনে এই দুটির কোনও একটি পদক্ষেপও যদি করা হয়, সেক্ষেত্রে মূলধন দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে গিয়ে দেশকে একটি তীব্র আর্থিক সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।
অন্যদিকে সংকট মোকাবিলায় নয়া উদারবাদের নিজস্ব টোটকা হলো, পুঁজিপতিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার আশায় তাদেরকে কর ছাড় দেওয়া। কিন্তু এরফলে আসলে সংকট তীব্রতর হবে, কারণ পুঁজিপতিরা একটি টাকাও বিনিয়োগ না করে ট্যাক্স ছাড়ের টাকা পকেটস্থ করবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, পুঁজিপতি তখনই বিনিয়োগ করবে যখন সে দেখবে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্যাক্স ছাড়ের নীতিতে সংকট তীব্রতর কারণ, ট্যাক্স ছাড়ের জন্য সরকারি ব্যয়ের যে সংকোচন ঘটে তার ফলে চাহিদা প্রকৃতপক্ষে কমে, বাড়ে না।
নয়া উদারবাদের এই সংকট সাম্প্রতিক অতিমারী শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছে (যদিও অতিমারী সাময়িকভাবে সংকটের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে) এর থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ হলো নয়া-উদারবাদের প্রত্যাখ্যান। কিন্তু এমন কোনো সম্ভাবনাকে আগেভাগেই বানচাল করতে, তার বিরুদ্ধে শাণিত হয়ে ওঠা ভাষ্যের (Discourse) সূচিমুখ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নয়াউদারবাদ হাত মিলিয়েছে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার সাথে। কর্পোরেট ও হিন্দুত্বের এই জোটের লক্ষ্য হলো নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা মানবজীবনের বস্তুগত সমস্যার বিরুদ্ধে উচ্চারিত ভাষ্যের অভিমুখটি সরিয়ে দিয়ে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত অতীত বা বর্তমানের তথাকথিত ‘নৃশংসতার’ দিকে সংখ্যাগুরুর ছবি ঘুরিয়ে দেওয়া। যে সময়ে আন্তর্জাতিক পুঁজি এবং দেশীয় ধনিক শ্রেণি এই তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্যেও তাদের সম্পদ বাড়িয়ে চলে, কাঁচামাল আহরণ ও উত্তোলনের অধিকার হস্তগত করে, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র এবং ক্ষুদ্র উৎপাদন ক্ষেত্রের কাছ থেকে বিনিয়োগের সমস্ত সুযোগ হরণ করে নেয়, যে সময়ে মানুষ ক্রমবর্ধমান দুর্দশায় জর্জরিত - ঠিক সেই সময় তাদেরকে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার দিকে ঠেলে দেওয়াই এই জোটের উদ্দেশ্য।
বড়ো ব্যবসায়িক গোষ্ঠী উগ্রহিন্দুত্ববাদী দলকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে বিপুল অর্থের জোগান দেওয়ার পাশাপাশি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়ার মাধ্যমে দলের পক্ষে সমর্থন আদায় করে। এর বিনিময়ে তারা সম্পদের আদিম সংগ্রহের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়। নির্লজ্জ আধিপত্যবাদ, জনগণের মধ্যে অনৈক্য তৈরি এবং ভিন্নমতের মানুষদের বিরুদ্ধে এক শ্রেণির দুর্বৃত্তকে লেলিয়ে দিয়ে তারা এই লুটের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা যেকোনো বিরোধিতার দমনে উদ্যত হয়।
নয়া উদারবাদ, এমনকী তার চরম বিকাশের মুহূর্তেও, ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যেটুকু গণতান্ত্রিক উপাদান অবশিষ্ট থাকে তাকেও খারিজ করতে সচেষ্ট হয়, রাষ্ট্রের স্বাধীনসত্তাকে ধ্বংস করে। কিন্তু শত প্রচেষ্টার পরেও সে মন্দার জালে জড়িয়ে পড়ে, যেখান থেকে তার সামনে বেরোনোর কোনও পথ নেই। স্থবিরতার কানাগলিতে আটকে পড়ে সে দেশরক্ষার এক নয়া-ফ্যাসিবাদী শাসন চাপিয়ে দেয়। কিন্তু শুধুমাত্র সমস্ত গণতান্ত্রিক উপাদানগুলি একত্রিত হলেই এই অপশাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব নয় (যদিও সেটি লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান)। কিন্তু নয়া-ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রত্যাখ্যান ও তার থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন, যে পরিস্থিতির কারণে তার সৃষ্টি, সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় নয়া উদারবাদের দ্বারা সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থাকেই উৎখাত করা। কিন্তু এটি অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ এবং এই উত্তরণ একমাত্র শ্রমজীবী জনগণের ব্যাপক সংহতির মাধ্যমেই সম্পন্ন করা সম্ভব।
বঙ্গানুবাদঃ সুমন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়