৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯
বিপন্ন সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য
আভাস রায়চৌধুরী
প্রায় দুই শতাব্দী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক সংগ্রামের পথ বেয়ে পঁচাত্তর বছর আগে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার উষাকালে ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও দাঙ্গায় দীর্ণ হয়েছিল আমাদের স্বদেশ। আধুনিক ভারতের সমাজ-সভ্যতার ইতিহাসে এ এক বিপর্যয়কর অধ্যায়। এই অধ্যায়ের শিকড় অনেক গভীরে এবং আধুনিক স্বাধীন ভারত নির্মাণে তার টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু সে সময় নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক বাধাকে আমরা অতিক্রম করতে পেরেছিলাম। সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতীয় রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতিতে জায়গা দখল করতে পারেনি।
পিছুটানকে অতিক্রম করে প্রগতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার উৎস ও শক্তি এসেছিল জনগণের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম এবং ক্রমশ পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে, বিশেষত রুশ বিপ্লবের পর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, তা থেকে। আজ পরিস্থিতিতে আবার নেতিবাচক ও পশ্চাৎমুখী পিছুটান। অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও আধুনিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন ভারত নির্মাণে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৭’র ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে গণপরিষদে পণ্ডিত নেহরুর ঐতিহাসিক ভাষণটি আজও স্মরণযোগ্য। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য গঠিত গণপরিষদের গঠনগত সীমাবদ্ধতা ছিল, ছিল অসংখ্য বিতর্ক। কিন্তু সব কিছুর পরেও আধুনিক ভারত নির্মাণের পথকে প্রসারিত করে স্বাধীন ভারতের সংবিধান ‘আমরা’ গ্রহণ করেছিলাম।
গণপরিষদে বিতর্ক, সমাজের বিভিন্ন অংশের স্বার্থ-দ্বন্দ্ব, শাসকশ্রেণির লক্ষ্য, সমকালীন পৃথিবীতে পরিবর্তনের অভিমুখ, সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি সমাজের প্রত্যাশা - এসবের প্রতিফলন আছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান, ভারতের সংবিধানে। ভারতীয় শাসকশ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে শ্রমজীবী সাধারণ ভারতবাসীর অবস্থান থেকে বিচার করলে আমাদের সংবিধানে অনেক খুঁতই খুঁজে পাওয়া যায়। এই সীমাবদ্ধতাগুলিকে অতিক্রম করার জন্য শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম জারি আছে এবং থাকবে। কিন্তু পুঁজিবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক ভারতের সমাজ ও রাষ্ট্রে ভারতবাসী সংগ্রামের ধারায় যে গণতান্ত্রিক পরিসর ও অধিকার অর্জন করেছে, আজ পঁচাত্তর বছর পরে তা বিপর্যয়ের সামনে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একফোঁটা সম্পর্ক না থাকা আরএসএস-ভারতীয় জনতা পার্টিকে সামনে রেখে এখন ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামোয় জাঁকিয়ে বসেছে।
সংবিধান পরিষদের বিতর্ক এবং আজকের বিপদের উৎস ও চরিত্রকে বুঝতে গেলে সংক্ষেপে হলেও ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। সাধারণভাবে বলা হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনটি ধারা - সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারা, গান্ধীবাদী অহিংস ধারা এবং শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষক সমাজের সংগ্রাম। সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারা বহুমাত্রিকতা এবং বহুপর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনের শ্রেণিগত যে সীমাবদ্ধতাই থাকুক, তা ছিল ভারতের সর্ববৃহৎ গণআন্দোলন। শ্রমিক ও কৃষক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী মতাদর্শ প্রসারিত হয়েছে। বিশেষত শেষ তিন দশকে। সমাজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ ছাত্রসমাজ এই প্রধান তিন ধারার সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আসমুদ্র হিমাচলের প্রথম লড়াই ১৮৫৭’র সিপাহি মহাসংগ্রাম। ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ যাকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু অনেকসময় আমাদের নজর এড়িয়ে যায় সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার প্রতিরোধের মতো অসংখ্য ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই। এগুলি শুধুমাত্র ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ ও লড়াই ছিল না, তৎকালীন জমিদারি ও মহাজনি শোষণের বিরুদ্ধেও সম্মিলিত বিদ্রোহ ছিল। অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তব, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে নতুন অগ্রগামী শ্রেণির যে বিকাশ ঘটছিল, সেই বিকাশমান ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি ও তাদের বুদ্ধিজীবীকুল, অন্ত্যজ জনঅংশের এই সংগ্রামগুলিকে মান্যতা দেয়নি বরং আড়ালে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। এই শ্রেণি সীমাবদ্ধতার পথ ধরেই ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় সিপাহি মহাসংগ্রামের পরেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধারা কখনোই সমগ্র ভারতীয় জনগণের ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম হয়ে ওঠেনি, উঠতে চায়ওনি। ১৯২৩-এ সাভারকরের হাতধরে হিন্দুজাতীয়তাবাদের সংহত রূপ ‘হিন্দুত্ব’র জন্ম। যারা এখন ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামোর শীর্ষ থেকে জনসমাজের তৃণমূল স্তরে প্রসারিত হয়ে গেছে। সমাজ রাজনীতি সংস্কৃতি ‘হিন্দুত্ব’র অ্যাজেন্ডাকে প্রসারিত করতে বেপরোয়াভাবে তৎপর। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে সংকীর্ণ ও বিকৃত করে বহুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জায়গায় হিন্দু জাতীয়তাবাদকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতভাবনার জায়গায় ‘হিন্দুত্ব’র মাধ্যমে বহুসংখ্যকবাদকে নির্মাণ করতে তৎপর। ফলে আজ আধুনিক ভারত রাষ্ট্র ও সংবিধান ফ্যাসিস্তসুলভ আক্রমণের সামনে।
যখন স্বাধীন সংবিধান গৃহীত হলো, ভারত যখন স্বাধীন হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর বিশ্ব তখন সমাজতন্ত্র অভিমুখী। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পালা চলছে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ভরকেন্দ্র ইয়োরোপ থেকে মার্কিন দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের পরিবেশে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিকশিত হচ্ছে। বিশ্বের জনমানসে এমনকী ধনবাদী দেশগুলিতেও উদারবাদের পরিবর্তে রাষ্ট্রপরিচালিত পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রতি জনসম্মতি বাড়ছে। এই ইতিবাচক ঘটনাগুলির প্রভাবে সীমাবদ্ধতা নিয়েও দেশীয় শাসকশ্রেণির দ্বারা সমঝোতার মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীন ভারতেও প্রতিবেশীদের তুলনায় আমরা অনেকবেশি প্রগতিশীল সংবিধান ও আধুনিক ভারত নির্মাণে অগ্রসর হয়েছিলাম। রুশ বিপ্লবের পরে পৃথিবীর প্রতিটি উপনিবেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গুণগত পরিবর্তন ঘটেছিল। উপনিবেশের জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রকৃত অর্থেই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনার পথ গ্রহণ করতে চেয়েছিল। শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, সমাজতন্ত্রের মতাদর্শগত প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভারতছাড়া পৃথিবীতে সম্ভবত আর কোনো নজির নেই যেখানে অগ্রসরমান বুর্জোয়ারা পশ্চাৎপদ জমিদারদের সঙ্গে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলেছে। ফলে স্বাধীন ভারতের সমাজে গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে গেল। এতদসত্ত্বেও স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ তিন দশকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের উত্তাপ এবং প্রগতিশীল মতাদর্শের প্রভাবে যুগ যুগ ধরে ভারতীয় সমাজের পশ্চাৎমুখীনতা আধুনিক ভারত নির্মাণ ও সংবিধান রচনায় দখল নিতে পারেনি। আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতীয় সমাজের সামন্ততান্ত্রিক-পুরুষতান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ‘ছাইচাপা আগুনের’ মতো বৈশিষ্ট্যগুলি সামনে চলে এসে আধুনিক ভারত ও তার স্বপ্নপূরণের ভাবনাকে পুড়িয়ে দিতে চাইছে।
প্রায় দেড় বছর ধরে সংবিধান পরিষদে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলেছিল। ভারতীয় শাসকশ্রেণির স্বার্থ ও সমকালীন জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রবাহের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ছিল ওই বিতর্কসমূহ। ভারতের সংবিধানে অলিখিত ব্রিটিশ সংবিধান ও লিখিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রভাব সব থেকে বেশি। আবার সমকালীন পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ আস্থার প্রতিফলনেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানের অনুকরণ আছে নির্দেশমূলক নীতিসমূহে। যদিও মৌলিক অধিকার অধ্যায় পুরোদস্তুর বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছাঁচে ফেলা।
১৯৫৬-তে পণ্ডিত নেহরুর সমাজতান্ত্রিক ধাঁচার প্রস্তাব, কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ৪২তম সংবিধান সংশোধন করে প্রস্তাবনার ভারতকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ', 'সমাজতান্ত্রিক’ বলে উল্লেখ করা হলেও ভারতের সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র কোনো অর্থেই সমাজতন্ত্র নয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ধারায় অথচ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পরিবেশে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়েছে। ফলে সীমাবদ্ধতা নিয়েই এই সংবিধানের মধ্যে ভারতের শ্রমজীবী সাধারণ জনগণের জন্য বেশ খানিকটা পরিসর ছিলো। ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে শ্রমজীবী জনগণ বিভিন্ন অধিকারের সাংবিধানিক ও আইনি স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, বিশ্ব রাজনীতিতে দোদুল্যমানতা নিয়েও সাধারণভাবে জোট নিরপেক্ষ আহ্বান, কখনো কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার ফলে সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারত ক্রমশ সার্বভৌমত্বের অবস্থানকে দৃঢ় করতে পেরেছিল। ‘জনগণ’ অথবা ‘জনকল্যাণ’র নামে তৎকালীন ভারতীয় শাসকশ্রেণির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল ভারতের সংবিধানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে সদ্যস্বাধীন দেশ হিসেবে এটা ছিল ইতিবাচক দিকে অগ্রগতি। আমাদের মনে রাখা দরকার, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এদেশের শ্রমিকশ্রেণি-কৃষক সমাজ সহ সাধারণ মানুষের বিপুল অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্ব রয়ে গিয়েছিল ভারতীয় বুর্জোয়া ও জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সাধারণ মঞ্চ, বলা ভালো গণমঞ্চ। দক্ষিণপন্থী, অতি দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী, সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট সমস্ত মতাদর্শের মানুষের অংশগ্রহণ ও প্রভাব নিয়েই বিভিন্ন পর্যায়ে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে জাতীয় কংগ্রেস। ১৯৪৭-এ ভারত ১৯৪৯’র নয়া চীন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি অথবা পরপর ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভিয়েতনামের মতো এগোতে পারেনি ভারতের জনগণের সংগ্রাম। শাসকশ্রেণির স্বার্থ, সীমাবদ্ধতা, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির আসমান-জমিন ফারাক সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতের সংবিধান আধুনিক ও সহনশীল ভারত নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছিল।
ভারতবর্ষ সম্পূর্ণভাবে ঔপনিবেশিক শাসনাধীন হওয়ার আগে বহু রাজ্য সাম্রাজ্যে বিভাজিত ছিল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আসমুদ্র হিমাচলের জনগণের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। ভিতরে অসংখ্য দেশীয় রাজ্য নিয়েই অখণ্ড ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র নির্ধারিত হয়েছিল। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির ব্রিটিশ ভারতে সকলের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের একটাই সাধারণ লক্ষ্য ছিল, স্বাধীনতা। পঁচাত্তর বছর আগে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এসেছিল অনাকাঙ্ক্ষিত দেশভাগের বিপর্যয়কে সাথে নিয়ে। ভারতের জাতীয়তাবাদ ইয়োরোপের ক্লাসিক ন্যাশনালিজমের ধারণার মতো প্রধানত একজাতিকেন্দ্রীক নয়। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’র প্রাণভোমরাকে লালন করে বহুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে। আজকের পরিচিতি সত্তার রাজনীতির যুগে সহজেই বোঝা যায় বহুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের ধারণা গড়ে ওঠা সহজ ছিল না। এই অসাধ্যসাধনের প্রধান কারণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়মুক্তি সংগ্রাম। ফলে বহুত্ববাদী আধুনিক ভারতের অস্তিত্বের প্রধান শর্ত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দৃঢ় অবস্থান। আজ এই জায়গাটায় ফাটল ধরেছে। আজকের পৃথিবীতে ‘ফিনান্স’ নেতৃত্বকারী আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সর্বব্যাপী আগ্রাসন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিপতিরা এই আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে বেশি বেশি করে সংলগ্ন হতে চাইছে। বিশ্বব্যাপী লুণ্ঠনের ধনতন্ত্রের দিনে এদেশেও জাতীয় সম্পদের লুঠ বিনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে আজ ভারতের সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। ভারতের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বভৌমত্বকে লঘু করার জন্য সংবিধানের ওপর আক্রমণ সংগঠিত করা হচ্ছে।
বহুত্ববাদী ভারতের সমাজ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। সংবিধান পরিষদের অন্যতম বিতর্কিত বিষয় ছিল, স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র কেমন হবে - এককেন্দ্রিক না যুক্তরাষ্ট্রীয়, বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণপন্থীরা সরব ছিলেন ভারতকে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হোক। প্রসঙ্গত, আরএসএস যে ভারতীয় সংবিধানকে মানে না তার অন্যতম কারণ ভারত ‘যুক্তরাষ্ট্র’। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণার উৎস ভারতীয় সমাজ, জাতি ধর্ম ভাষা সংস্কৃতি নির্বিশেষে ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ বহুমাত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস এবং মার্কিন সংবিধানের প্রভাব। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রদেশগুলি যে অধিকার ও স্বাধিকার ভোগ করে ভারতের রাজ্যগুলি তা করে না। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য প্রথম থেকেই কেন্দ্রপ্রবণ। আবার সময় যত এগিয়েছে, সত্তর দশক থেকে বিশ্বপুঁজিবাদের পুনঃসংকটে, ভারতে তার প্রভাব বেড়েছে, কেন্দ্রপ্রবণ যুক্তরাষ্ট্রে আরও কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য টিকে আছে, রাজ্যগুলির স্বাধিকারের লড়াইয়ের পরিসর অক্ষুণ্ণ ছিল। ১৯৭৫-এ অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা এবং তার বিরুদ্ধে দেশবাসীর সংগ্রাম, ১৯৭৭-এ সরকার পরিবর্তন ইত্যাদি অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে বলা যায়, সীমাবদ্ধতা ও অভ্যন্তরীণ বিপদ সত্ত্বেও ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরুদণ্ড বহুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের গণতান্ত্রিক মতাদর্শ ও রাজনীতি। আজ নয়াউদারবাদী অর্থনীতির বিপর্যয়কর পরিবেশে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থার রাজনীতি ক্রমবর্ধমান। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি নয়াউদারবাদী লুঠের সামনে যে কোনো ধরনের সম্ভাব্য প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধকে ধ্বংস করতে দেশে দেশে তীব্র দক্ষিণপন্থার ‘বাইনারি’ রাজনীতিকে প্রসারিত করতে চাইছে। ভারতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এখন আরএসএস-বিজেপি, যারা মতাদর্শগতভাবে বহুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক ভারত ভাবনাকে মানে না এবং ধ্বংস করতে তৎপর। ফলে ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম উজ্জ্বল সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আজ আক্রান্ত। এখনো প্রত্যক্ষ সংবিধান পরিবর্তন করতে পারেনি, কিন্তু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির অবনমন ঘটিয়ে, আইন বিভাগ ও প্রশাসনের ভিতরে প্রবেশ করে তাকে নিজেদের মতাদর্শ ও লক্ষ্যে ব্যবহার করছে আরএসএস। এই উদ্যোগের লক্ষ্য শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত নয়, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত।
বহুত্ববাদী ভারত ভাবনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং গণতান্ত্রিক ও আধুনিক পরিসর হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। এটা ঠিকই যে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইয়োরোপের রেনেসাঁর ফসল ‘সেকুলারিজম’র সঙ্গে একাকার করা যায় না, প্রয়োজনও নেই। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গা ও বাঁটোয়ারার পরিবেশে, যখন ভাগ হয়ে যাওয়া অংশটা ধর্মপরিচয়ের মধ্যে স্বাধীনতার পরিচয় খুঁজেছিল, তখন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে ওঠা কম কথা ছিল না। ১৯৫০ সালে কার্যকর হওয়া সংবিধানের কোথাও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র শব্দের ব্যবহার না থাকলেও আধুনিক ভারত নির্মাণের অন্যতম মানদণ্ড যে ধর্মনিরপেক্ষতা হবে একমাত্র সঙ্ঘ পরিবার কিংবা তাদের মতো পশ্চাৎমুখী ভাবনা ও সংগঠন বাকি সকলেই তা চেয়েছিলেন। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন, পারসি, খ্রিস্টানসহ সমস্ত ধর্মবিশ্বাস এবং নাস্তিক মানুষ অর্থাৎ সর্বস্তরের ভারতবাসীর সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ভারত নিজের মতো করে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা গড়ে নিয়েছিল - রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। এই উদার ও গণতান্ত্রিক পরিসরের প্রত্যাশায় কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম মানুষ ৩৭০ ধারাকে সামনে রেখে ভারতে যুক্ত হয়ে তাদের পরিচয় খুঁজেছিল। মোদি সরকার এক কলমের খোঁচায় ৩৭০ এবং ৩৫ক ধারাকে বাতিল করে নিমেষে একটা রাজ্য ও রাজ্যবাসীর অস্তিত্বকে ধ্বংস করছে তাই নয়, সংবিধানের মর্মবস্তুকে আঘাত করেছে। আজ সাভারকরের শিষ্যরা রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাই অনাধুনিক ‘হিন্দুত্ব’র আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা। ভারতের উদার সহনশীল বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করতে আরএসএস হাজির করেছে তথাকথিত হিন্দু পরিচয়ে ‘বহুসংখ্যকবাদ’কে। আজ বুর্জোয়া প্রগতিভাবনা ও আধুনিকতার বিপক্ষে বিশ্বব্যাপী উলটো হাওয়া। একদিন পুঁজিবাদী পৃথিবীতে পুঁজিবাদের শোষণ ও বুর্জোয়া মতাদর্শের বিপরীতে মানবমুক্তির সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর রাস্তা সমাজতন্ত্রের জন্য উলটো হাওয়ার দিন ছিল পৃথিবীতে। যেখানে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করে সমস্ত জাতি ও পরিচয়ের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পরিসর হিসেবে সমাজতন্ত্র বিবেচিত হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি যখন বিশ্বকে হাতের তালুতে নিয়ে ইচ্ছেমতো লুঠ চালাচ্ছে, তখন দেশে দেশে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বহুসংখ্যাবাদের সঙ্গে নির্মিত জঙ্গি জাতীয়তাবাদের ধারণা ও আবেগ যুক্ত করে দিতে চাইছে। এই জঙ্গি জাতীয়তাবাদে সংখ্যালঘুর কোনো স্থান নেই, ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা কিংবা মর্যাদার স্থান নেই। বলাবাহুল্য, তা গণতন্ত্র বিরোধী মতাদর্শ শুধু নয়, গণতন্ত্র ধ্বংসকারী হাতিয়ার। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী যখন রামমন্দিরের শিলান্যাস কিংবা নতুন সংসদ ভবনে বিকৃত অশোক স্তম্ভ প্রতিষ্ঠায় হিন্দু ধর্মের উপাচার তুলে ধরেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আরএসএস-বিজেপি’র মূল লক্ষ্য ভারতের সংবিধান এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। আরএসএস ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতকে ভেঙে দিয়ে হিন্দু ভারত নির্মাণ করতে চায়। হিন্দুরাষ্ট্র পরিচালিত হবে মনুবাদী ফরমুলায়। পশ্চাৎমুখী ধর্মীয় অনুশাসন-নির্ভর সমাজ রাষ্ট্রে পাঁচশো বছর আগে ফেলে আসা সামাজিক বিধি ও রীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। মনুস্মৃতি যেমন বলেছে দলিতদের স্থান হবে ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের পায়ের তলায়। সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কিছু বলার অবকাশ মনুস্মৃতিতে ছিল না, তবে বলার অপেক্ষা রাখে না তাদের স্থান হিন্দুরাষ্ট্রে নেই।
এই ভারত আমরা চাই না। কিন্তু আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে সংলগ্ন দেশীয় করপোরেট বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ভারতের পরিবর্তে ধর্মের নামে বহুসংখ্যাবাদী ফ্যাসিস্ত ভারত চায়। তাতে একই সঙ্গে লুঠ ও শ্রমজীবীদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন অত্যন্ত সহজ হয়ে যায়। এই কারণেই আজ ভারতে ‘করপোরেট হিন্দুত্ব’ নামক ভয়ংকর শব্দবন্ধের সৃষ্টি হয়েছে।
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে ‘হিন্দুত্ব’, ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নয়। এ হলো সব থেকে বড়ো যুক্তিবিনাশী আত্মহননের পথ। বর্তমান ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্র, সংবিধান প্রতিটি ভারতবাসীর কাছে ‘মুক্তি’র বার্তা বহন করতে পারেনি, পারার কথাও নয়। ১৯২০-তে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পরে পরেই ১৯২১-এ জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্টরাই প্রথম পূর্ণস্বরাজের দাবি তোলে। কমিউনিস্টদের কাছে স্বাধীনতার মানে শুধুমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্তি ছিল না, সব ধরনের শ্রেণি শোষণ ও সামাজিক নিপীড়নের অবসানই হলো প্রকৃত স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পঁচাত্তরে এসে আমরা বলতেই পারি ভারতবাসী, বিশেষত শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ সেই ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ থেকে এখনও বঞ্চিত। তার জন্যই শোষণ নিপীড়নের এই সমাজকে বদলের ডাক দিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। চড়াই-উৎরাই, এগনো-পিছনো সব নিয়ে সেই সংগ্রাম জারি আছে, জারি রাখতে হবে। কিন্তু ভারতে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধ পরিসরের মধ্যে যতটুকু এগোনো সম্ভব হয়েছে তা আজ লুঠ হতে চলেছে। ফিনান্স নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে এদেশে দেশি বিদেশি করপোরেটের লুঠকে অক্ষুণ্ণ রাখতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিকল্পহীন পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে। যার কেন্দ্রে রয়েছে আরএসএস, বিজেপি। আজ আরএসএস শুধু বিজেপি’র মাধ্যমে তার কর্মসূচি রূপায়ণ করছে না, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমগ্র জনসমাজের মধ্যে অনুপ্রবেশ কিংবা দখল করে তার হিন্দুত্বের কর্মসূচিকে রূপায়ণে উদ্যোগী ও মরিয়া। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতের বর্তমান সংবিধান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আরএসএস’র পথে বাধা। তাই সংবিধান ও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রের কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যকে ভেঙে ফেলতে মরিয়া এই অনাধুনিক হিন্দুত্ববাদী শক্তি। এই ভয়ঙ্কর প্রকল্পের আন্তর্জাতিক যোগসূত্রও রয়েছে। স্বাধীনতা ৭৫-এ তাই ভারতীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্র, সংবিধানের ওপর ফ্যাসিস্তধর্মী আক্রমণের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহত্তম ঐক্য ও সমাবেশ জরুরি। এই সংগ্রামের সাফল্য ও শক্তির ওপর ভবিষ্যৎ শ্রেণিসংগ্রামের গতিপথ অনেকটাই নির্ভরশীল।