E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯

দেশভাগ, ছিন্নমূল মানুষের লড়াই ও বামপন্থীরা

অর্ণব ভট্টাচার্য


ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আনন্দের সাথেই মিশে ছিল দেশভাগের হাহাকার। ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য একদিকে যখন দেশের মানুষ মরণপণ লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন তখন অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক ও স্বার্থান্বেষী শক্তি দেশকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসক এবং দেশীয় কায়েমি স্বার্থের যোগসাজশে ভারতবর্ষের বুকে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে ওঠে, যেগুলি দেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষের বীজ বপন করে। ১৯৩০-এর দশকেই হিন্দুত্ববাদী নেতা সাভারকর হিন্দু ও মুসলমানকে পরস্পরবিরোধী জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরপর ১৯৪০ সালে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে সওয়াল করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ভারতবর্ষকে ভাগ করে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।

চল্লিশের দশকে একদিকে যেমন পাকিস্তান প্রস্তাবের স্বপক্ষে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলি। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে যখন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল, তখন ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ জনগণ পথে নেমে বিদেশি রাজশক্তিকে মোকাবিলা করতে শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে মুম্বাইয়ে নৌসেনাদের বিদ্রোহ সমর্থন করতে এগিয়ে আসে আমজনতা। ধর্মীয় ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে তেরঙ্গা, চাঁদ-তারা ও কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা তিনটি ঝান্ডা নিয়ে পথে নামে মানুষ। ওই বছরই আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানী ক্যাপ্টেন রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই ডাক ও তার বিভাগের কর্মচারীদের দাবির সমর্থনে সাধারণ ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে জনগণের ঐক্য ও দৃঢ় মনোভাব ব্রিটিশ শাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে দেশের অভ্যন্তরে বিভেদকামী শক্তি। দেশের মানুষের মধ্যে এই বিকাশমান ঐক্যকে চুরমার করে দিতে পথে নামে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলি।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে’র ডাক মৌলবাদী শক্তির সামনে সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। ওই দিন থেকে কলকাতায় যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা শুরু হয় সেই দাঙ্গায় মহানগরীর কয়েক হাজার মানুষ নিহত হন। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে বিহার ও নোয়াখালিতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা ঘটে। নিহত ও ঘরছাড়া হন বহু মানুষ। অন্যদিকে পাঞ্জাবেও সাম্প্রদায়িক রক্তস্নান শুরু হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে গোটা ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে যেকোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ রাখবার প্রচেষ্টা না করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসক, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ দেশভাগের প্রস্তাবে একমত হয়ে যায়। শুরু হয় কালনেমির লঙ্কাভাগের প্রক্রিয়া। দেশভাগের এই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত বাংলা ও পাঞ্জাবের মানচিত্রের কেবল পরিবর্তন ঘটিয়েছে তা নয়, লক্ষ লক্ষ মানুষকে এক লহমায় ‘নিজভূমে পরবাসী’তে পরিণত করে এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন করে দেয়।

দেশভাগের সময় জাতীয় নেতৃবৃন্দ পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নানাভাবে আশ্বস্ত করেন যে, তাদের যদি পূর্ব পাকিস্তানে কোনো রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাহলে তারা ভারতবর্ষে স্বাগত। পরবর্তীকালে এ প্রতিশ্রুতির কী পরিণতি হয়েছিল ইতিহাস তার সাক্ষী।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে, তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের একই মানদণ্ডে বিচার করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার প্রশংসনীয় তৎপরতা দেখালেও পূর্ব সীমান্ত পেরোনো বাঙালি উদ্বাস্তুরা সীমাহীন ঔদাসীন্য ও অবহেলার শিকার হয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৭.৪০ লক্ষ আর পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুর সংখ্যা সরকারি মতে ৫৮ লক্ষ, কিন্তু বেসরকারি হিসেবে ১ কোটি ২০লক্ষ। শুধু পুনর্বাসন সাহায্য বাবদ পশ্চিম পাকিস্তানি শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করা হয়েছিল ৪৫৬ কোটি টাকা, আর পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে পুনর্বাসন খাতে মঞ্জুর হয়েছিল মাত্র ৮৫ কোটি টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য ১ লক্ষ ৬৬ হাজার বাসস্থান, ১৯টি সম্পূর্ণ উপনগরী ও ৩৬টি স্বয়ংসম্পূর্ণ কলোনি নির্মাণ করা হয়। অন্যদিকে পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য মাত্র ১১ হাজার গৃহ নির্মিত হয়েছে সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, কিন্তু সেগুলি পাঞ্জাবের সঙ্গে কোনো দিক থেকেই তুলনার যোগ্য নয়। কংগ্রেস পরিচালিত তৎকালীন রাজ্য সরকার এই অবহেলার কোনো প্রতিকার করবার বদলে উদ্বাস্তুদের প্রতি বৈরিতামূলক আচরণ করে। পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তু জীবনের সংকট বৃদ্ধি পায় এই অমানবিক ও বৈষম্যমূলক নীতির সুবাদে।

পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের পর উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে পাঠানো হতো। ক্যাম্পে স্বল্প পরিসরে অসংখ্য পরিবার একসাথে থাকত যাদের না জুটত সঠিক খাবার, চিকিৎসার সুযোগ এবং ন্যূনতম পরিষেবা। এই দুর্বিসহ পরিস্থিতির অবসানের জন্য উদ্বাস্তু জনতা আন্দোলনে শামিল হলে নেমে আসত পুলিশি নিপীড়ন। অপরিচিত পরিবেশে জীবনসংগ্রামে নেমে এদেশের সরকারের মতিগতি বুঝতে তাই দেরি হয়নি ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষের। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অমানবিক আচরণের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ করতে এবং নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে পশ্চিমবঙ্গের বাস্তুহারারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সংকল্প গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন বামপন্থীরা। ১৯৫০ সালে কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ১২ আগস্ট ৪৩টি উদ্বাস্তু সংগঠন ও বিভিন্ন কলোনির জনপ্রতিনিধিরা একত্রে বাস্তুহারাদের কেন্দ্রীয় সংগঠন ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল (ইউসিআরসি) বা সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ গড়ে তোলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী, প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী, সত্যপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর মুখার্জি, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, গোপাল ব্যানার্জি, অনিল সিংহ-র মতো অনেক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। উদ্বাস্তু জনতার আন্দোলন ইউসিআরসি’র নেতৃত্বে ক্রমশ সংগঠিত ও তীব্রতর আকার ধারণ করে। ১৯৫১সালের মধ্যেই নৈহাটি থেকে যাদবপুর পর্যন্ত ১৪৯টি জবরদখল কলোনি তৈরি হয়ে যায়। জল- জঙ্গলে পূর্ণ, পতিত জমিকে বাসযোগ্য করে তুলে নিজস্ব উদ্যোগে বাসস্থান নির্মাণ ও জীবন জীবিকা নির্বাহ করার যে উদ্যোগ দেখিয়েছিলেন উদ্বাস্তুরা, যেভাবে প্রশাসনের দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে, পুলিশ আর জমিদারের লেঠেলদের জোর-জুলুমকে প্রতিহত করে নিজেদের বাসভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়েছিলেন তা প্রমাণ করে যে, উদ্বাস্তু জনগণ আর সরকারের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে রাজি ছিলেন না। ‘‘আমরা কারা বাস্তুহারা, আমাদের দাবি মানতে হবে’’ - স্লোগানে পশ্চিমবাংলার পথঘাট মুখরিত হয়ে ওঠে। এ রাজ্যের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার প্রথম থেকেই উদ্বাস্তু আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করে। হাজার হাজার বাস্তুহারা মানুষকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয় এবং পুলিশের গুলিচালনাতে অনেক উদ্বাস্তু নরনারী শহিদের মৃত্যুবরণ করেন।

সরকারের চোখে উদ্বাস্তুরা ছিলেন অবাঞ্ছিত ও বিপজ্জনক। তাই জবর দখল কলোনি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেগুলি আইনসিদ্ধ করবার দাবিকে অগ্রাহ্য করে ১৯৫১ সালে বিধান চন্দ্র রায় সরকার এই সমস্ত কলোনির বাসিন্দাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করবার উদ্দেশ্যে বিধানসভায় বিল আনে। এই বিলের বিরোধিতায় ইউসিআরসি’র নেতৃত্বে ও বামদলগুলির সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে যে প্রবল আন্দোলন হয় তাতে বিচলিত ও নতজানু হয় সরকার। বিলটির নাম সংশোধন করে পুনর্বাসন শব্দটি যুক্ত করা হয় এবং সংশোধিত আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয় যে, ‘জীবিকার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না’। এর পরেও নানা ছলে বাস্তুহারাদের নতুন করে গৃহহীন করার সরকারি উদ্যোগ চলতে থাকলেও উদ্বাস্তু জনগণকে তাদের বহুকষ্টে অর্জিত বাসভূমি থেকে সরকার বা জমিদারের ভাড়াটে গুন্ডার দল বিতাড়িত করতে পারেনি। ১৯৫৭ সালে আবার উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করার জন্য বিধান সভায় পুনরায় বিল পেশ হলে বামপন্থীরা বিধান সভার ভেতরে ও বাইরে তীব্র বিরোধিতায় শামিল হন। বিধান সভায় বিরোধী দলের নেতা জ্যোতি বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, ‘আপনাদের কাছে মানুষের চেয়ে বড়োলোকের সম্পত্তির কদর বেশি... আইনের চোখে তারা অন্যায় করতে পারে, কিন্তু মানবতার কাছে তারা তো অন্যায় করেনি... এই আইন বাস্তুহারারা মানবে না, আমরাও মানব না’। উত্তাল গণ-আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে তৎকালীন রাজ্য সরকার।

উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের মূল বক্তব্য ছিল যে, এরাজ্যে কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে, পতিত জমি উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা সর্বোচ্চ পর্যায়ে করতে হবে। সেসব না করে বলপূর্বক বাঙালি উদ্বাস্তুদের ভিন রাজ্যে পাঠানোর অপচেষ্টার বিরোধিতা করেন উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।

উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের দায় অস্বীকার করবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ষাটের দশকের শুরুতেই তৎকালীন রাজ্য সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় ঘোষণা করে যে, উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। যা বাকি আছে তা এখন ‘অবশিষ্ট সমস্যা’। এই তত্ত্বের ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের পুনর্বাসন দপ্তর গুটিয়ে আনা হয় এবং সমগ্র সমস্যাটি মেটানোর জন্য মাত্র ২১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়।

১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস দল পরাস্ত হলে যুক্তফ্রন্ট সরকার রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকার দু’দফায় অতি স্বল্প মেয়াদের মধ্যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবার চেষ্টা করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ২৫০ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা পাঠানো হয়। কলোনি কমিটিগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি কলোনির বাসিন্দাদের জমির অধিকার দিতে ‘যোগ্যতাপত্র’ প্রদান করা হয়। ১৯৭২ সালে চরম সন্ত্রাস চালিয়ে কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর উদ্বাস্তু পুর্নবাসনের কাজ পুনরায় অবহেলিত হয়।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর পশ্চিমবঙ্গের কলোনিগুলির উন্নয়নের যে কাজ বন্ধ ছিল সেই কাজ আবার চালু করা হয় এবং কেন্দ্রের কাছে দাবিদাওয়া জানানো হয়। ১৯৮১ সালে কেন্দ্রের ইন্দিরা গান্ধী সরকারের কাছে সাড়ে সাতশ কোটি টাকার দাবি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পেশ করা হয়। এরপরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রের কাছে ১৭২৬.৫০ কোটি টাকার পরিকল্পনা পেশ করা হয়। বামফ্রন্ট সরকারের দৃঢ় মনোভাবের ফলে ১৯৮৭ সালে ৬০৭টি জবরদখল কলোনিকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। এই কলোনিগুলি সহ পূর্বতন ১৪৯ ও ১৭৫ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত জবরদখল কলোনির জমি অধিগ্রহণ বাবদ ৮৪ কোটি টাকা মঞ্জুর করে কেন্দ্রীয় সরকার। কলোনিগুলির উন্নয়ন খাতেও ৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস না থাকলে এই সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না।

১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার বাস্তুহারাদের স্বার্থে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বরানগরের নেতাজি কলোনিতে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রথম নিঃশর্ত দলিল অর্পণ করেন। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত কলোনিতেই নিঃশর্ত দলিলের অধিকার মেনে নিতে বাধ্য হয়। সীমিত আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যেও বামফ্রন্ট সরকার কলোনির উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে এবং উদ্বাস্তুদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বামফ্রন্ট সরকার ২০১১ সাল পর্যন্ত ২লক্ষ ৫৮ হাজার ২৭৩টি দলিল প্রদান ও পর্চা নথিভুক্ত করার কাজ করে। ২০০৪ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন উদ্বাস্তু কলোনির উন্নয়ন ও বাস্তুহারাদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০১০.৬০কোটি টাকার প্যাকেজ প্রস্তাব পেশ করা হয়। বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, যার সুফল পেয়েছিল রাজ্যের লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবার। অন্যদিকে বাংলার বুকে উদ্বাস্তুরা যে জীবনীশক্তি এবং উদ্যমের পরিচয় রেখেছেন তার তুলনা মেলা ভার। বামপন্থীরা চিরকাল তাদের এই জীবনযুদ্ধে সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করেছেন।

২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই সরকার মাত্র ১৩ হাজার দলিল প্রদান করেছে এবং ২৫টি কলোনি অনুমোদন দিয়েছে। পরবর্তীকালে আন্দোলনের চাপে ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে ২৪৪টি কলোনির অনুমোদন দেওয়া হয়। এরমধ্যে ১৩১টি কলোনিতে সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূতভাবে জমি হস্তান্তর না করেই দখলি স্বত্বের দলিল প্রদান করা হচ্ছে। পর্চা রেকর্ড ভুক্তির ৬০ শতাংশ কাজ বাকি আছে। কলোনিগুলির উন্নয়নের প্রশ্নে সরকার শুধু নীরব নয়, বাকি কলোনির স্বীকৃতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোনো দাবি পর্যন্ত এই রাজ্য সরকার করেনি। বর্তমান সরকারের আমলে উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরকে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজগুলি এর ফলে অবহেলিত হচ্ছে।

আমাদের দেশে উদ্বাস্তু জনগণ নতুন করে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি হয়েছে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পর। বাজপেয়ী সরকারের আমলে পাশ হওয়া এই আইনের মাধ্যমে গরিব মানুষ বিশেষত উদ্বাস্তু মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বিজেপি। এই সর্বনাশা সংশোধনীর মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের ‘‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’’ বলে দাগিয়ে দেওয়া এবং এনআরসি চালু করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উদ্বাস্তু এবং উদ্বাস্তু নন এমন অনেক গরিব মানুষের পক্ষে পূর্বপুরুষের জন্ম সংক্রান্ত বা অন্যান্য বৈধ কাগজপত্র নানা কারণে সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব নয়। ২০০৩ সালের আইনের মাধ্যমে এই সমস্ত মানুষকে রাষ্ট্রহীন, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আসামে এনআরসি-র পর ১৯ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে গেছে। ইউসিআরসি দৃঢ়ভাবে এই মত পোষণ করেছে যে, ভারতের মাটিতে উদ্বাস্তু হিসেবে যারা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের কাউকে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে কোনো অজুহাতেই বঞ্চিত করা যাবে না। ২০১২ সালে সিপিআই(এম)’র কোঝিকোড কংগ্রেসে বাঙালি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দানের দাবি জানিয়ে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘এই পার্টি কংগ্রেস বাংলাদেশ থেকে আগত সংখ্যালঘু উদ্বাস্তুদের যথাযথ নাগরিকত্ব দেবার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট আইনের ২এর(১-এর খ) ধারার প্রয়োজনীয় সংশোধনের দাবি জানাচ্ছে।’’

এরই মধ্যে ২০১৯ সালে প্রবর্তিত হয়েছে বিতর্কিত সিএএ, যার মূল উদ্দেশ্য উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদান নয় বরং তাদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি করে দেশে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি করা। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর সিএএ-এনআরসি ক্রোনোলজি সংক্রান্ত কুখ্যাত বক্তব্যের মাধ্যমে এই আইনের মূল উদ্দেশ্য যে সংখ্যালঘু বিতাড়ন তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রসংঘ ইতিমধ্যেই এই আইনকে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং মানবতাবিরোধী বলে চিহ্নিত করেছে। আমাদের দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমদর্শিতার মৌলিক বোঝাপড়ার বিপরীতে গিয়ে এই যে আইন প্রণীত হয়েছে তার তীব্র বিরোধিতা করেছে বামপন্থীরা সহ দেশের সমস্ত প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক শক্তি।

ছিন্নমূল মানুষের মর্মযন্ত্রণার অবসান এখনো হয়নি। নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে জটিলতা রয়ে গিয়েছে, পুনর্বাসনের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। সরকারি অনুমোদনহীন কলোনিতে, রেললাইনের ধারে টালির ঘরে কিংবা ঝুপড়িতে অসংখ্য বাস্তুহারা মানুষ দিনযাপন করছেন। এই সমস্ত বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা তা দেশের শাসকশ্রেণির নেই। এই অবহেলিত, প্রতারিত মানুষকে সংঘবদ্ধ করে দাবি অর্জনের লড়াইয়ের পথে পরিচালিত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব অতীতের মতো বামপন্থীদেরই পালন করতে হবে।