E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৫ আগস্ট, ২০২২ / ১৯ শ্রাবণ, ১৪২৯

স্বাধীনতার ৭৫: ভারতের কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন

সায়নদীপ মিত্র


স্বাধীনতার ৭৫। এক গর্বময় ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে সর্বস্তরের ভারতবাসী। ‘কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা’ এই ইতিহাস দু’শো বছরের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে মুক্তি এনেছিল। কিন্তু আত্মত্যাগের এই ইতিহাসের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা ৭৫ বছর অতিক্রম করে দেশের সমাজ-অর্থনীতি-নাগরিক জীবনে কতটা পূর্ণতা প্রদান করল, তা অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

পৃথিবীর যে কোনো দেশের সামাজিক সুস্থতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম সূচক, সেই দেশের শ্রমশক্তির কত বৃহৎ অংশ কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত সেই মাপকাঠি দ্বারা নির্ধারিত হয়। একইভাবে এর বিপরীতে শ্রমশক্তির বিপুলঅংশ যদি কর্মহীন থাকে তাহলে সেই দেশের অর্থনীতি আবশ্যিকভাবে সংকটাপন্ন। প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমশক্তির বেশিরভাগ অংশ কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত থাকলে স্বাভাবিকভাবে সেই সমাজে এবং নাগরিক জীবনে সমৃদ্ধি আসতে বাধ্য এবং প্রতিটি পরিবার নিজেদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে সক্ষম হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নিশ্চিতভাবে দাবি করা যায় যে, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের হার।

৭৫ বছরের স্বাধীনোত্তর ভারতে এক্ষেত্রে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির পাল্লা অনেক বেশি ভারি। সারা পৃথিবীর মতোই আমাদের দেশে যুব জনসংখ্যা সাম্প্রতিক অতীতের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি। কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিঘাত এই প্রজন্মকে প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই সামগ্রিকতার মধ্যেও আবার যুবতী, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক জনজাতি অংশের মানুষের বিপন্নতা তুলনামূলকভাবে বেশি। ‘অক্সফ্যাম’-এর একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর ৬২ জন ধনী ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ পৃথিবীর অর্ধেকের থেকে বেশি গরিব মানুষের সম্পদের সমতুল্য। অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই ভয়াবহ চেহারা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। নয়া উদার অর্থনীতির বেপরোয়া আগ্রাসন এবং পুঁজির লাগামহীন কেন্দ্রীভবন এই বৈষম্য সৃষ্টির অবশ্যম্ভাবী ফল। এই প্রবণতার অপর একটি ক্ষতিকর দিক হলো, অবিশ্বাস্য গতিতে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি। যৌবনের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর আমাদের দেশকে যে চ্যালেঞ্জের মুখে প্রতিদিন পড়তে হচ্ছে। ৭৫ বছরের স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তুতি যখন মহাসমারোহে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে তার মধ্যেই সাম্প্রতিক সময়ের বেকারির সব রেকর্ড ভেঙে, দেশ কর্মসংস্থানহীন উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলেছে।

২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, ভারতের কর্মক্ষম শ্রমশক্তির মাত্র ৪১ শতাংশ কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত। ২০২২ সালের মার্চ মাসে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৪০ শতাংশে। পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে ৫৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৪৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ৪৬ শতাংশ থেকেও আমাদের চিত্র করুণ। ২ কোটি ২০ লক্ষ ভারতীয় বিগত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মহীন হয়েছে। অথচ এর বিপরীতে ভয়াবহ ছবিটা হলো, নতুন করে বিভিন্ন বয়সের ১২ কোটি ১০ লক্ষ কর্মক্ষম যুব নতুন করে শ্রমশক্তিতে যুক্ত হয়েছে। পরিসংখ্যানের এই ফারাকই আমাদের দেশে বেকারির অভিশাপ বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। এই পরিণতির অন্যতম কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সস্তায় শ্রম কেনার স্বার্থে সমাজ-অর্থনীতিতে বেকার সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়। পুঁজিবাদের এই অমানবিক বুনিয়াদি পদ্ধতির সাথে যুক্ত হয়েছে উৎপাদন ক্ষেত্রকে লঘু করে ফাটকা ব্যবসার প্রতি পুঁজির কেন্দ্রীকরণ। ফলে এই ফাটকা পুঁজির বিশ্বায়নের পরিণতিতে বিশ্বের সাথে আমাদের দেশেও বেকারির হার ঊর্ধ্বমুখী এবং কর্মসংস্থানের হার নিম্নমুখী। নয়া উদারনীতির এই ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের দেশের যুবসমাজ। ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতের তরুণ প্রজন্মের সাথে এ এক নির্মম প্রতারণা।

বেকারি গত আড়াই দশক ধরে আমাদের দেশে কার্যত মহামারীর চেহারা ধারণ করলেও করোনা অতিমারী- পরবর্তী ভারতে এই সংকট হিমশৈলের আকার ধারণ করেছে। কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করা সমীক্ষক সংস্থা সিএনআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি)-র প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতে বেকারের সংখ্যা ৫ কোটি ৩০ লক্ষে পৌঁছে গেছে। আর এই সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী বেকারত্বের হার ২০২২ সালের মে মাসে ৭.১ শতাংশ থেকে বেড়ে জুন মাসে ৭.৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই সংখ্যাতত্ত্বের মধ্যে গ্রাম ও শহরের মধ্যেও তারতম্য আছে। গ্রামে এই হার ৮ শতাংশ এবং শহরে ৭.৩ শতাংশ। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে ২০২২-র জুন মাসে কাজ হারিয়েছে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। সমগ্র ঘটনায় আরও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে ২৫ লক্ষ বেতনভুক্ত কর্মচারীর ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার ঘটনা। কর্মসংস্থানের হার হ্রাস পেতে পেতে ২০২২ সালের জুন মাসে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৮ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এই হার সবচেয়ে কম। এই প্রসঙ্গে শিউরে ওঠার মতো পরিসংখ্যানও আছে। বর্তমান ভারতের ৫৮.৩ শতাংশ স্নাতক উত্তীর্ণ এবং ৬২.৪ শতাংশ স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ শিক্ষিত যুব সম্পূর্ণ বেকার। আবার কর্মরতদের মধ্যে ৪৬.৬ শতাংশ নিজেরা স্বনির্ভর। অর্থাৎ প্রথাগত কর্মসংস্থানের আওতার বাইরে রয়ে গেছে এই বিপুল অংশ। গ্রামাঞ্চলে এই আত্মকর্মসংস্থানের পরিমাণ সাধারণ গড়ের থেকে বেশ কিছুটা বেশি। প্রায় ৫৫ শতাংশ। বেকারির সমস্যার ক্ষেত্রে বয়সের বিন্যাসের দিকেও যদি চোখ রাখা যায় তাহলে দেখা যাবে ১৫-৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে কর্মহীনতার সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। ১৫-৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে শহরে বেকারত্বের হার ৮.৬ শতাংশ এবং গ্রামে ১১.৭ শতাংশ। অথচ এই প্রজন্ম মোট শ্রমশক্তির ৪৮.৭ শতাংশ স্থান দখল করে আছে। এই ছবি স্পষ্ট করে দেয় দেশের স্বাধীনতা অনেকগুলি বছর অতিক্রম করে ফেলল, কিন্তু নতুন প্রজন্মের প্রাপ্তি শূন্য।

তবে শুধু বেকারত্বের এই মর্মান্তিক ছবিই যথেষ্ট নয়। কর্মসংস্থানের সামাজিক নিরাপত্তার চেহারাও আমাদের দেশে ভয়াবহ। নয়া উদারনীতির দাপট আমাদের দেশে শুরু হওয়ার আগে মূলত ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি। কিন্তু ক্রমশ উদারনীতির সাথে অসম যুদ্ধে এই ক্ষেত্রগুলি দুর্বল হতে শুরু করে। কাজের জায়গার চরিত্র ক্রমশ পরিবর্তিত হয়। বর্তমানে শহরাঞ্চলে ৬০ শতাংশ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হলো পরিষেবা ক্ষেত্র এবং উৎপাদন ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত ৩৫ শতাংশ। এছাড়াও পাইকারি ও খুচরো ব্যবসা এবং নির্মাণ শিল্পের সাথেও এক অংশ যুক্ত। এই সকল কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রায় ৭০ শতাংশ কাজের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা নেই। প্রায় ৮২ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো লিখিত কাজের চুক্তি নেই। কর্মরতদের মধ্যে ৯০ শতাংশ কার্যত কোনো সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ পায় না। এই পরিসংখ্যানগুলি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কর্মসংস্থানের চরিত্রই আজকে আমাদের দেশে অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক।

সামাজিক বিন্যাসের আলোতেও যদি বেকারির চিত্র বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে সেক্ষেত্রেও বৈষম্যের ছবি ফুটে উঠবে। বিগত দশ বছরে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পরিসংখ্যান বলছে, গ্রামে ১৫-৪০ বছর বয়সী মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার ৩৪ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। শহরে এই কমার হার তুলনামূলক কম। ২০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৮ শতাংশ। কিন্তু উদ্বেগের আসল চিত্র হলো এই তরুণ অংশের কর্মক্ষম মহিলাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই, প্রায় ৫১ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র গৃহকর্মের সাথেই যুক্ত। এই বিপুল শ্রমশক্তিকে কোনো ধরনের উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সাথে যুক্তই করা হয় না। আবার কর্মরত মহিলাদের একটা বড়ো অংশ নানা ধরনের ‘প্রকল্প ভিত্তিক’ কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এই ধরনের কাজের সাথে প্রথাগত কর্মসংস্থানের ধারণা খাপ খায় না। এই সমস্ত কর্মসংস্থান আসলে নয়া উদারনীতির ফসল। এই ধরনের কাজে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো নিয়োগচুক্তি থাকে না এবং কোনো সামাজিক সুরক্ষার বালাই নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আধাসামন্তবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও মহিলাদের সাথে তুমুল বৈষম্য স্পষ্ট। বিভিন্ন জনজাতিগত সামাজিক বিন্যাসের ক্ষেত্রেও এই অসাম্যের চেহারাটা কার্যত একইরকম। আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী, তপশিলি এবং অন্যান্য অংশের পিছিয়েপড়া শ্রেণির মানুষের মধ্যে অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক কাজের সংখ্যাই বেশি। শহরাঞ্চলে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো হলেও গ্রামে এই অংশের কর্মসংস্থানের চেহারা তথৈবচ। কিন্তু বেকারত্বের সংখ্যায় গ্রামের থেকে শহর বেশ কিছুটা এগিয়ে। শুধুমাত্র তপশিলি অংশের যুবদের মধ্যে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ১২.২ শতাংশ এবং গ্রামে ৮.৭ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে শ্রেণি বিভক্ত এই সমাজে আদিবাসী, দলিত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বেসরকারি ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে মুসলিমদের ক্ষেত্রে শিক্ষিত যুব অংশের মধ্যে বেকারির হার সবচেয়ে বেশি। প্রায় ২৬.৮ শতাংশ। নিয়মিত বেতন বা মজুরি পাওয়া কর্মরতদের সংখ্যাও এই অংশের মধ্যে সবচেয়ে কম। অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক কাজের সাথেই এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের যুব যুক্ত। স্থায়ী কাজের সংখ্যা সেখানে নগণ্য। হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক দর্শন কাজের জায়গাতেও উচ্চ বর্ণের আধিপত্য কায়েম করতে চাইছে এবং সামাজিকভাবে পিছিয়েপড়া মানুষ এক্ষেত্রেও ব্রাত্য। আজও সামাজিক বৈষম্যের এই অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি স্বাধীন ভারত।

ভারতের গ্রামীণ কর্মসংস্থানের এখনো প্রধান ক্ষেত্র কৃষি এবং কৃষিনির্ভর বিভিন্ন কাজকর্ম। গ্রামে ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষির উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কৃষি নির্ভর কর্মরত মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। কৃষি অলাভজনক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জমির সাথে সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের পরিণতিতে কাজের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। বৃহৎ কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা সরাসরি জমির নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষিপণ্যের বাজার দখল করে নেওয়ার ফলে কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। দেশের সরকার কৃষককে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে কর্পোরেটের দাসত্ব করছে। কর্পোরেটমুখী কৃষি আইন বাতিল করতে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন নতুন দিক খুলে দিলেও সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস অব্যাহত এবং গ্রামে বেকারত্বের হার ঊর্দ্ধমুখী। রেগা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত বরাদ্দ কমাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বকেয়া থাকছে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের। বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে গ্রামীণ যুবদের এক বিরাট অংশ শহরে বা ভিন্‌ রাজ্যে কাজের সন্ধানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। করোনা অতিমারী পর্বে পরিযায়ী শ্রমিকদের স্রোত এবং লকডাউনের বিভীষিকা থেকে বাঁচার আর্তি এখনো আমাদের স্মৃতিতে সতেজ।

৯০’র দশক থেকে চালু হওয়া উদারনীতি এবং ২০১৪ সালের পর এর সাথে যুক্ত হওয়া হিন্দুত্বের রাজনীতির দর্শন, ভারতের সমাজজীবন ও অর্থনীতিতে গভীর সংকটের ছাপ ফেলেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতি এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি - উভয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে দেশের সমাজ এবং অর্থনীতি গুরুতর বিপদের মুখোমুখি। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা গণতন্ত্রের পক্ষেও আশঙ্কাজনক। সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বাড়বাড়ন্তে সমাজে এখন গভীর অসুখ। এই অসুখের প্রবণতায় অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এই অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব ফেলছে কাজের বাজারে। বেকারত্বের সমস্যায় আজকে লক্ষাধিক দেশবাসী জর্জরিত। তাদের বেশিরভাগ অংশই তরুণ প্রজন্মের। এই খারাপের মধ্যেও আরও খারাপ অবস্থা মহিলাসহ সমাজের অন্যান্য অংশের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর। বেশিরভাগ কাজের চরিত্রই অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক। সামাজিক নিরাপত্তার লেশমাত্র নেই। উৎপাদনমুখী শিল্পেও কর্মসংস্থানহীনতা গুরুতর সংকট সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাসহ কর্মসংস্থানমুখী শিল্প ধুঁকছে। কৃষিতে কার্যত বন্ধ্যা অবস্থা। শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের সামনে ঘন অন্ধকার। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের দপ্তরে ৬০ লক্ষ শূন্যপদ। কিন্তু নিয়োগে অন্তহীন নিষেধাজ্ঞা। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমে প্রমাণিত ধান্দার ধনতন্ত্রের প্রভাবে নিয়োগ দুর্নীতি এবং জালিয়াতির জাল কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সর্বত্র কাজের হাহাকার।

এই পঙ্গু অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে সমাজে অপরাধ প্রবণতার শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’ (Crime and Punishment) উপন্যাসটি এই ঘটনাক্রমের প্রামাণ্য দলিল। জার শাসিত রাশিয়ার দিশাহীন অর্থনীতির বিকারগ্রস্ত এবং বিকলাঙ্গ ফলন এই উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। অথবা ‘টমাস মান’-এর ‘ভেনিসে মৃত্যু’ কিংবা ‘ম্যাজিক মাউন্টেন’। দেউলিয়া অর্থনীতির দেশ জার্মানি কীভাবে একটি রোগগ্রস্ত সমাজ উপহার দিচ্ছে। বর্তমানে ভারতের একটা আদর্শ উদাহরণ হতে পারে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ। তরুণ প্রজন্মের এক অংশ কীভাবে নির্মম প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এই পশ্চিমবঙ্গের আলোকে সারা দেশের অর্থনীতির অন্ধকার দিকটা আন্দাজ করা যায়। অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলশ্রুতিতে নতুন করে ১৩ কোটি কর্মহীন হয়ে যাওয়া যুব সমাজের হতাশাকে সঙ্গী করেই আমাদের দেশ ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।


সূত্রঃ
● NSSO-PLFS (2019-2021)
● CMIE Report (2021, 2022)