৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭
কৃষক আন্দোলন স্তব্ধ করতে মোদী সরকারের বেনজির দমন নীতি
দিল্লি সীমান্ত ঘিরে অস্বাভাবিক সামরিক ব্যারিকেড
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কৃষি ও কৃষক স্বার্থবিরোধী কেন্দ্রের সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লি সীমান্তের কৃষকেরা যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাচ্ছেন, তা স্তব্ধ করে দিতে একপ্রকার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে কেন্দ্রের সরকার। আন্দোলনরত কৃষকদের বিরুদ্ধে সামরিক ধাঁচে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। লোহার রড দিয়ে কাঠামো বানিয়ে কংক্রিটের ঢালাই করে রাস্তাজুড়ে ব্যারিকেড তৈরির পাশাপাশি রাস্তায় লোহার তীক্ষ্ণ শিক পুঁতে দেওয়া হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রাজধানীর ভেতর থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন যানবাহন বিশেষ করে ট্রাক্টরের যাতায়াত রুখতে গ্রামের রাস্তা আগেই খুঁড়ে রেখেছে প্রশাসন। এর পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের খাবার, পানীয় জল, শৌচালয় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুরমুখী রাস্তাগুলিকে এভাবেই বন্ধ করা হয়েছে যাতে সেখানে কৃষকেরা আসতে না পারেন, অথবা কেউ সাহায্য নিয়ে আসতে না পারে। দিল্লি জলবোর্ডের জলের ট্যাঙ্কারকে দিল্লি পুলিশ প্রতিবাদস্থলে যেতে দিচ্ছে না। যদিও দিল্লি জলবোর্ড রাজ্য সরকারের অধীন কর্পোরেশন। গুরু তেগবাহাদুর স্মারকে শৌচালয়ের যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা শক্তি প্রয়োগ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচিত দিল্লি সরকারকেও কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ইন্টারনেট বন্ধ রাখার পর তা আপাতত দিল্লির দিকে খুলে দেওয়া হলেও হরিয়ানায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদস্থলে কোনো সংবাদমাধ্যমকেও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। দিল্লি সীমান্তবর্তী অঞ্চল ঘিরে যেভাবে কয়েক হাজার পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, তাতে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যেন সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।
এভাবে কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্রের রোখার চেষ্টা সত্ত্বেও আন্দোলন এতটুকু শিথিল হয়নি। বরং আন্দোলনের গতিবেগ আরও বেড়ে চলেছে।
৩ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী, অমানবিক অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করে বলেছে, তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন, বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালাচ্ছেন কৃষকেরা। তাঁদের ন্যায্য দাবি মানতে সরকার যেমন অস্বীকার করছে, তেমনি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন দিল্লি পুলিশ খেতে না দেবার মতো অমানবিক পথ নিয়েছে। তারা ভাবছে এইভাবে কৃষকদের প্রতিবাদকে বিপর্যস্ত করা যাবে, সরিয়ে দেওয়া যাবে। কৃষক আন্দোলন ঘোষণা করেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণ প্রতিবাদকারীদের দুর্বল করতে পারবে না। তাদের প্রত্যয় আরও বেড়েছে, দৃঢ়তা আরও বেড়েছে, নতুন নতুন কৃষক এসে সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে সমবেত হচ্ছেন।
পলিট ব্যুরো দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের এইসব দানবীয় মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। জল, খাদ্য, নিকাশির সুযোগ, অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ দিল্লি পুলিশ বন্ধ করতে পারে না। এই অমানবিক অবরোধ তুলে নিতে অবিলম্বে দিল্লি পুলিশকে নির্দেশ দিতে হবে।
কেন্দ্রের এই স্বৈরাচারী পদক্ষেপ সত্ত্বেও প্রতিবাদ আরও তীব্র হচ্ছে। ৩ ফেব্রুয়ারি দিল্লির মান্ডি হাউস থেকে ছাত্র, যুব, মহিলা ও শ্রমিক সংগঠনগুলির একটি মিছিল বেরোয়। এই মিছিল যন্তরমন্তরের দিকে যাবার পথে পুলিশ আটকে দেয়।
দিল্লি সীমান্তে সামরিক ধাঁচে ব্যারিকেড করে ঘিরে ফেললেও হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, প্রভৃতি রাজ্যে একের পর এক জায়গায় হচ্ছে কৃষকদের ‘মহাপঞ্চায়েত’। এদিন হরিয়ানার জিন্দে এমনই এক বিশাল সমাবেশে ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, রাজা যখন ভয় পান, তখন দূর্গ নিরাপদ করেন। দিল্লিতে এখন তাই হচ্ছে। এখন পর্যন্ত শুধু ‘কানুন ওয়াপসি’-র দাবি তুলেছি, এইরকম চলতে থাকলে ‘গদি ওয়াপসি’-র স্লোগান উঠবে। তিনি আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কৃষক আন্দোলন কোন্ পথে এগোবে তা সংযুক্ত কৃষক মোর্চা ঠিক করবে।
এদিন সংযুক্ত কিষান মোর্চার তরফে বলা হয়েছে, কৃষক আন্দোলন দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে। উত্তর প্রদেশে কিষান মহাপঞ্চায়েতে বিপুল সমর্থন পাবার পর মধ্যপ্রদেশের দাবরা, হরিয়ানার জিন্দে মহাপঞ্চায়েত হয়েছে। শাহজাহানপুরের ধরনাস্থলে কৃষক রাজস্থান এবং পাঞ্জাব থেকে কৃষকেরা অবিরাম আসছেন। পালওয়াল ধরনা ভেঙে দেবার পর তা আবার শুরু হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান থেকে বিরাট সংখ্যায় কৃষকেরা পালওয়ালে আসছেন।
এদিকে ভারতের কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ট্যুইটে সরব হন আন্তর্জাতিক পপ তারকা রিহানা, পরিবেশ কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, মার্কিন অভিনেত্রী আমান্ডা সার্নি সহ মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের ভাইঝি মীনা হ্যারিস প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এদের এই সরব হওয়াকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক।
কৃষক আন্দোলনেরপ্রতি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরা যে সমর্থন জানাচ্ছেন তাকে স্বীকৃতি দিয়ে সংযুক্ত কিষান মোর্চা বলেছে, বিশ্বের বহু বিশিষ্ট মানুষ কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংবেদনশীল। কিন্তু ভারত সরকার কৃষকের যন্ত্রণা অনুভব করছে না। এমনকি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের সন্ত্রাসবাদী বলেও আখ্যা দিচ্ছে। সিঙ্ঘু সীমান্তে সাংবাদিকদের ঢুকতে না দেওয়ার নিন্দা করেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করছেন কৃষকেরা। প্রায় পাঁচশোটি কৃষক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্বে এই আন্দোলন চলছে। ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে কৃষক প্যারেডের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। ওই দিন লক্ষলক্ষ কৃষক শান্তিপূর্ণভাবে প্যারেড করেন দিল্লির রাস্তায়। একটি ছোটো অংশ মিছিলের মূল রাস্তা থেকে সরে গিয়ে লালকেল্লায় ঝামেলা তৈরি করে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিপীড়ন শুরু করে পুলিশ। কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়। ঘটনায় দেখা যায় পুলিশই ছক কষে একটা ছোট্ট অংশকে লালকেল্লায় ঢুকতে সাহায্য করে। এর মধ্যে থাকা বেশ কয়েকজন বিজেপি’র হয়ে কাজও করেছে। তখন থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর কেন্দ্রের দমনপীড়ন শুরু হয়।
এদিকে কৃষক আন্দোলনের ওপর কেন্দ্রের সরকার ও গোষ্ঠীর হামলা ও হয়রানি বন্ধ না হলে এবং আটক কৃষকদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কোনো ‘আনুষ্ঠানিক’ আলোচনা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। ২ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চ বলেছে, কৃষক আন্দোলনের ওপর নানা কায়দায় এই হামলা আসলে গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আক্রমণ। মনে হচ্ছে, প্রতিবাদী কৃষকদের প্রতি রাজ্যে রাজ্যে সমর্থনের বিপুল স্রোত দেখে সরকার ভয় পেয়েছে।
কৃষক আন্দোলনের ওপর আরএসএস-বিজেপি এবং পুলিশের হামলার প্রতিবাদে সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় সমিতির ডাকে ৩ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি দেশের গ্রামে গ্রামে চলছে প্রচার অভিযান। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি ‘চাক্কা জ্যাম’ কর্মসূচি সর্বাত্মক করার ডাক দিয়েছে এআইকেএসসিসি। এছাড়া ৩ ফেব্রুয়ারি কৃষক সহ সমস্ত গ্রাহককে লুট এবং ভরতুকি তুলে দেবার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশের সমস্ত বিদ্যুৎ দপ্তরের সব অফিসের সামনে এআইকেএসসিসি’র আহ্বানে কৃষকেরা বিক্ষোভে অংশ নেন।
১ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত কিষান মোর্চার বৈঠকের পর প্রকাশিত বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, হয়রানি ও হামলা বন্ধ না হলে সরকারের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনায় না বসার সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। কৃষক নেতারা বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ও তাদের পুলিশ ও প্রশাসন কৃষকদের ওপর নানা কায়দায় আক্রমণ বাড়িয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনে বাধা তৈরি করতে কংক্রিট ব্যারিকেডের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তায় পেরেক পুঁতে রাখা হচ্ছে। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনস্থলে ঘন ঘন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ, পানীয় জল এবং ট্যুইটার বন্ধ করা হচ্ছে। এমনকি আরএসএস-বিজেপি কর্মীদের দিয়ে আন্দোলনস্থলে পরিকল্পিত হামলাও চালানো হচ্ছে। এসব বন্ধ না হলে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো মানেই হয় না।
শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলনে সঙ্ঘ পরিবার এবং মোদী সরকারের ক্রমবর্ধমান আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে সারা ভারত কৃষক সভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অশোক ধাওয়ালে এবং হান্নান মোল্লা বলেছেন, ৩১ জানুয়ারি গোয়ালিয়রে কৃষক ধরনায় আক্রমণ চালিয়ে অনেককে জখম করেছে সঙ্ঘীর গুণ্ডারা। ধরনাস্থলে বাবাসাহেব আম্বেদকর, শহিদ ভগৎ সিংয়ের ছবি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তারা। কুখ্যাত ইউএপিএ-সহ অন্যান্য ধারায় বহু কৃষক কর্মী এবং আন্দোলন সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে সরকার। সত্য বলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাংবাদিক মনদীপ পুনিয়াকে। এছাড়াও রাজদীপ সরদেশাই, মৃণাল পান্ডে এবং বিনোদ জোশের মতো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজানো হচ্ছে।
এদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি তুলে কৃষক সভার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অনুমতি দিলেও সরকার নানা কৌশলে আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে। জল, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট বন্ধ করে, ব্যারিকেড গড়ে, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী দিয়ে কৃষকদের ঘিরে ফেলা হয়েছে। আন্দোলনস্থলকে খোলা জেলখানায় পরিণত করে বর্বরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে বিজেপি সরকার। এখনই এসব বন্ধ না হলে দেশজুড়ে আরও বড়ো আন্দোলন হবে।
এদিকে কৃষক আন্দোলনে শহিদদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। উলটে লোকসভায় কৃষকদের ওপর লাঠিচার্জের পক্ষেই সওয়াল করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি। সংসদে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল শহিদ কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কিনা - লোকসভায় লিখিত উত্তরে কৃষি মন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে এবারে সরব হয়েছেন দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত চারশো’র বেশি শিক্ষাবিদ। কেন্দ্রের কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সংসদেও সোচ্চার হয়েছেন বিরোধীরা।