E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭

সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান


● মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রচার-আন্দোলন জোরদার করো
● পশ্চাদমুখী তিন কৃষি আইনের প্রত্যাহার চাই
● কৃষক আন্দোলনকারীদের উপর ঘৃণ্য দমন-পীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করো

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সভা গত ৩০-৩১ জানুয়ারি অনলাইনে হয়েছে। সভা‍‌ শেষে প্রচারিত এক বিবৃতিতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বিবৃত করা হয়। সভায় কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেঃ ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় অর্ধে দেশজুড়ে পার্টির সমস্ত শাখা একপক্ষকাল ধরে প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করবে। মোদী সরকার কর্তৃক সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণ করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সংবিধানের কাঠামো ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস, জাতীয় সম্পদের লুট, বিরাটাকারে বেসরকারিকরণ, মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমআইনের অবলুপ্তি, লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা বেকারত্ব প্রভৃতি ইস্যুগুলি এই প্রচার আন্দোলনে তুলে ধরা হবে। দিল্লির সীমান্তে চলতে থাকা কৃষক সংগ্রামের প্রতি সংহতিকে দৃঢ় করা এবং বিজেপি-আরএসএস’র মিথ্যা প্রচারকে উন্মোচিত করে দেওয়া হবে এই প্রচার কর্মসূচিতে। শ্রমিকশ্রেণি, কৃষক এবং আমাদের জনগণের অন্য সমস্ত অংশের সংগ্রামগুলি ও সংহতিমূলক কর্মসূচিগুলিতে জনগণের বৃহত্তর অংশকে সমবেত করার কাজ করে যাবে পার্টি।

কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেঃ এই সময়ে পার্টির সমস্ত কার্যক্রমের মূল লক্ষ্যই হবে - আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে বিজেপি’কে পরাজিত করা; কেরালায় সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন এলডিএফ সরকারের ফিরে আসা সুনিশ্চিত করা; পশ্চিমবঙ্গে বাম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিকল্পের জন্য কাজ করা; তামিলনাডুতে বিজেপি-এআইএডিএম জোটকে পরাজিত করে ডিএমকে নেতৃত্বাধীন জোটের জয়কে সুনিশ্চিত করা এবং আসাম বিধানসভায় পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি করা। সিপিআই(এম)’র ২৩তম কংগ্রেস হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে। অতিমারী/ লকডাউন এবং কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু ও আসামের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য পার্টি কংগ্রেস পিছিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি। বিবৃতিতে বলা হয়েছেঃ কেন্দ্রীয় কমিটির লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করার।

এই বিস্তৃত অন্তঃপার্টি অনুশীলন - সম্মেলনের প্রক্রিয়া শাখা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে পার্টি কংগ্রেস সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে। কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেঃ দেশজুড়ে শাখা সম্মেলনের কাজ শুরু হবে ২০২১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে।

দিল্লির সীমান্তে যে দুর্বার কৃষক সংগ্রাম চলছে তাকে অভিবাদন জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি। সভা থেকে ফের একবার এই পশ্চাদমুখী তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি করা হয়েছে। দেশের সমস্ত কৃষকের সবধরনের ফসলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়ার আইনি অধিকার দিতে আইন প্রণয়নেরও দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম)।

কৃষক আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে সেই পুরনো কায়দায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ দমনপীড়ন চালাচ্ছে। কৃষকদের দাবি নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন এরকম ৩০শেরও বেশি কৃষকনেতার বিরুদ্ধে ২৫টি এফআইআর করেছে দিল্লি পুলিশ। বিজেপি সরকার এবং দিল্লি পুলিশের এই দমনপীড়নের নিন্দা করেছে সিপিআই(এম)। পার্টি দাবি করেছে, কৃষকনেতাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক।

গত ২৮ জানুয়ারি ৯ ভারতীয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। যাঁরা কৃষক আন্দোলন নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহ-সহ অন্যান্য মিথ্যা অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, কর্নাটক ও দিল্লি পুলিশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এইসব আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। কেন্দ্রীয় কমিটি এর তীব্র নিন্দা করেছে এবং অবিলম্বে এই এফআইআর’গুলি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টির সমস্ত শাখার কাছে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতির অবশিষ্ট অংশ নিচে দেওয়া হলোঃ

কৃষক সংগ্রাম

সাধারণতন্ত্র দিবসের দিনে এক লক্ষ ট্রাক্টরে কয়েক লক্ষ কৃষক বিশাল প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন এবং নির্ধারিত পথ ধরেই তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়েছেন। দেশের সমস্ত রাজ্যে এই ধরনের প্যারেড ও অন্যান্য কর্মসূচি পালিত হয়েছে বড় আকারে।

ওই দিন বিক্ষিপ্ত কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে কিন্তু তা কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি থেকে নজর ঘোরাতে পারে না। প্ররোচনাকারী দালালরা ওই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের কয়েকজনের বিজেপি’র সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। সমগ্র কৃষক আন্দোলন এবং দেশ ওই ঘটনার নিন্দা করেছে।

দমনপীড়ন

জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অশান্তি তৈরির লক্ষ্যে আরএসএস-বিজেপি একই কায়দা অবলম্বন করেছে যা তারা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়েও করেছিল। দিল্লি সীমান্তে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসে থাকা কৃষকদের ওপরে আক্রমণ করতে দিল্লি পূলিশের পাহারায় সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে কৃষক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রোধ সঞ্চারিত হয়েছে এবং আরও বেশি সংখ্যায় তাঁরা এসে প্রতিবাদে সমবেত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশের প্রচলিত কায়দায় এই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, আক্রান্তদেরই বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন এমন ৩০ জন কৃষক নেতার বিরুদ্ধে ২৫টি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। দাঙ্গা বাধানো, অপরাদমূলক ষড়যন্ত্র, হত্যার চেষ্টা, ডাকাতির ধারাও যুক্ত করা হয়েছে। বিজেপি সরকার ও দিল্লি পুলিশের এই দমনমূলক ব্যবস্থার নিন্দা করে এইসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পরিসংখ্যানের কারিকুরি করে মহামারী এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে জনতাকে রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা চালানো হয়েছে। আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তব্য, সরকারি ব্যয় এবং বিনিয়োগে ব্যাপক বৃদ্ধি প্রয়োজন হলেও সরকার সেই পথে চলবে না।

সাংবাদিকদের লক্ষ্য করা হচ্ছে

উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, হরিয়ানা, কর্ণাটকের বিজেপি সরকারগুলি এবং দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন পুলিশকে দিয়ে তীব্র করা হচ্ছে আক্রমণ। সেই সাংবাদিকরাই আক্রমণের লক্ষ্য যাঁরা কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছেন। বেশ কিছুদিন ধরেই সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া এবং ভয় দেখানো চলছে। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নয়জন ভারতীয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের সঙ্গে আইনের আরও নয়টি ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা, ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত, জাতীয় সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর বক্তব্য প্রচারের অভিযোগ। পরিচিত বরিষ্ঠ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে সোশ্যাপল মিডিয়ায় তাঁদের ব্যক্তিগত টুইটের জন্য।

এই পদক্ষেপ নিন্দনীয়। সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা, দাবিয়ে রাখা এবং হেনস্তার উদ্দেশ্যেই নেওয়া হচ্ছে এমন পদক্ষেপ। কড়া নিন্দার পাশাপাশি সিপিআই(এম)’র দাবি, অবিলম্বে এফআইআর প্রত্যাহার করতে হবে। নিপীড়নের প্রতিবাদের পাশাপাশি সিপিআই(এম) ফের দাবি তুলেছে যে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারই করতে হবে কেন্দ্রকে।

সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনেই তা করতে হবে। বাতিলের পর কৃষি সংস্কার নিয়ে কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট অন্য অংশগুলির সঙ্গে বসে নতুন প্রস্তাব আনতে পারে সরকার। সংসদে সেই প্রস্তাব পেশ করে বিশদে আলোচনার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুসরণ করতে পারে সরকার। সংসদে এই তিন আইন বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে পার্টি সাংসদদের।

জনগণের ক্রমবর্ধমান দুর্দশা

সিএমআইই’র রক্ষণশীল হিসাবও জানাচ্ছে কেবল সংগঠিত ক্ষেত্রেই ১৫০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছেন প্রায় একশো লক্ষ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। অসংগঠিত ক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে কোটি কোটি মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত।

অর্থনৈতিক মন্দা এবং লাফিয়ে বাড়তে থাকা বেকারির মধ্যেই মানুষের যন্ত্রণা বেড়েছে মূল্যবৃদ্ধিতে। মারাত্মক বাড়ছে সব জিনিসপত্রের দাম, বিশেষত পেট্রোল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের। নিয়ম করে নির্বিচারে বেড়ে চলেছে জ্বালানির দাম। বিশ্বের মধ্যে পেট্রোপণ্যে করের হার ভারতে সর্বোচ্চ।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা

মহামারী অথবা বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ব্যর্থতা আড়াল করা হয়েছে পরিসংখ্যানের কারিকুরি করে। সরকার পরিচালনায় গুরুতর ব্যর্থতে নির্বোধের মতো প্রশংসা করা হয়েছে ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন’ বলে। জনগণের জীবিকার ওপর সরকারি নীতির ভয়ঙ্কর প্রভাব ঝাপসা করে দেখাতে এটি প্রচারে একটি কৌশল।

প্রথম ত্রৈমাসিকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ হারে উৎপাদন কমেছে ২৩.৯ শতাংশ। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ৭.৫ শতাংশ হ্রাস হয়েছে। এরপরও বলা হয়েছে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো পুনরুজ্জীবন হবে! পুনরুজ্জীবন আদৌ হলে তা হবে ‘কে’ অক্ষরের মতো। বড়লোক আরও বড়লোক হবে এবং গরিব আরও গরিব, অক্সফামের রিপোর্টে যা ধরা পড়েছে। বচেয়ে ধনী বিলিওনিয়ারদের সম্পদ ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন গরিবরা কাজ খুইয়েছেন, ক্ষুধা, অপুষ্টি এবং বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বছরভর। সরকারের ‘সংস্কারের’ এই আসল চেহারাই আড়াল করা হয়েছে অর্থনৈতিক সমীক্ষায়।

আসন্ন বাজেট

সব অংশই একমত যে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন একমাত্র সম্ভব সরকারি ব্যয়ে বিপুল বৃদ্ধির মাধ্যমে। যে কোনও সংবেদনশীল সরকার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন নিশ্চিত করতে এবং জনকল্যাণে বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বিপুল বাড়াবে। তার ফলে প্রচুর কাজ সৃষ্টি হতে পারে। যুবরা তাঁদের আয় খরচ করতে শুরু করলে অভ্যন্তরীণ চাহিদায় দ্রুত বৃদ্ধির মাধ্যমে পুনরুজ্জীবন শুরু হতে পারত। মানুষও তা চাইছেন। কিন্তু এই বিজেপি সরকার কেবল ভারতের জাতীয় সম্পদের নির্বিচার লুট এবং ধান্দাবাজ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলির সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ব্যস্ত।