৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭
জেলায় জেলায় সভা-সমাবেশ-দুর্বার মিছিলে দিনবদলের রক্তিম আহ্বান
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ এ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক বিজেপি যখন অনৈতিকভাবে নিজেদের মধ্যে দলবদলের কদর্য নজির তৈরি করে চলেছে, তখন সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী ও সহযোগী দল মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচির মধ্যদিয়ে জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলি তুলে ধরছে। বিভিন্নস্থানে এই সমস্ত কর্মসূচিতে কংগ্রেস দলও অংশগ্রহণ করছে। রাজ্যজুড়েই এই সমস্ত কর্মসূচিতে লালপতাকার প্লাবন বইছে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জনজোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে।
দীর্ঘ অপশাসন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতার কারণে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং রাজ্য সরকারের ওপর মানুষের ক্ষোভ দিনেদিনে বাড়ছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে এদের পরাজয় একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী। এটা আঁচ করেই রাজ্যজুড়ে শাসকদলের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতা নিজেদের গা বাঁচাতে ভিড় জমাচ্ছে কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় থাকা বিজেপি-র মতো হিংস্র সাম্প্রদায়িক দলের অন্দরে। অন্যদিকে বিজেপি’র মতো হিংস্র ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক দল কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্যে ক্রমান্বয়ে জনসমর্থন হারিয়ে এখন বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করতে অনৈতিক পথ অবলম্বন করছে। তারা নানা কৌশলে, প্রলোভন দেখিয়ে তৃণমূলের কলঙ্কিত নেতাদেরও দলে টেনে নিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের নেশায় মত্ত হয়েছে।
রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসকদলের অনৈতিক ও নীতি-আদর্শহীন কার্যকলাপের পরিণতিতে বিস্তর দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছেন গরিব-সাধারণ মানুষ। এদিকে কেন্দ্রের জনবিরোধী আর্থিক নীতির পরিণতিতে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের কোথাও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা নেই। শিল্পায়ন হচ্ছে না। উল্টে কর্মসংকোচনের ফলে বেকারত্বের সীমা ক্রমশ উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। কৃষকেরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে গরিব সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার মাত্রা ক্রমেই সীমা ছাড়াচ্ছে। তাই রাজ্যের এই বিপুল অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযন্ত্রণা লাঘব করতে জনজীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে জেলায় জেলায় এই সময়ে বামপন্থীদের অসংখ্য মিছিল-সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা নতুন সম্ভাবনার দিককেই তুলে ধরছে।
বর্ধমানের সমাবেশ
২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান শহরে সিপিআই(এম) পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির ডাকে জনপ্লাবিত সমাবেশ তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ‘ফেরাতে হাল, ধরো লাল’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে টাউন হল ময়দানে এদিনের এই সমাবেশে বাঁধভাঙা জনস্রোত জমায়েতের লক্ষ্য পূরণ করে প্রত্যাশা ছাপিয়ে যায়। এই সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য এবং ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার তৃণমূল-বিজেপি’র নকল যুদ্ধ ও ভাঁওতায় বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তৃণমূলের একটাই লক্ষ্য বিজেপি’র হাতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে দেওয়া। বিজেপি ত্রিপুরা সহ গোটা দেশের সর্বনাশ করেছে, এখন পশ্চিমবঙ্গকে শ্মশানে পরিণত করতে চাইছে। তিনি এদিন বলেন, বিষ খেলে যা হয়, বিজেপি’কে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়তে দিলে তাই হবে। ওরা যে বঙ্গজয়ের স্বপ্ন দেখছে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তা ব্যর্থ করে দিতে হবে।
এদিন সমাবেশে আসা মানুষের দখলে ছিল বর্ধমান স্টেশন থেকে পারবীরহাটা পর্যন্ত জিটি রোডের বিশাল অংশ। এই সমাবেশকে কেন্দ্রকরে গোটা বর্ধমান শহর সেজে উঠেছিল লাল পতাকায়। এই গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসা অগণিত মানুষের ঢল তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে বিকল্প সরকার গড়ার স্বপ্নকে উসকে দিয়েছে। ধামসা-মাদল নিয়ে আদিবাসী শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণ বুঝিয়ে দিয়েছে - তাঁদেরই একান্ত আপন লাল পতাকা - একান্ত আপন কমিউনিস্ট পার্টি।
এদিনের সমাবেশে মানিক সরকার তৃণমূল-বিজেপি’র হিংসাত্মক ও অনৈতিক কার্যকলাপ, দুর্নীতি, জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)’র লাগাতার লড়াই-আন্দোলনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, এসবের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলারা যখন আন্দোলন করছেন, তখন বর্ণ, ধর্ম, জাতের নামে মানুষকে ভাগ করে মানুষকে শোষণ ও শাসনের নীতি নিয়ে চলেছে বিজেপি। কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন ও শ্রম আইনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, কর্পোরেটদের স্বার্থেই এই সরকার চলছে। আন্দোলন যত বিকশিত হচ্ছে, তত গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। তাই তৃণমূল-বিজেপি আঁতাত করেই বাংলায় বামপন্থীদের আটকানোর ষড়যন্ত্র করছে। যত আক্রমণ ও প্রতিকূলতা তৈরি হোক না কেন, মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের কথা ধৈর্য্যধরে শুনতে হবে বামপন্থীদের। মানুষের হাতে হাত ধরে নতুন বাংলা গড়তে হবে বামপন্থীদেরই।
এদিনের সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্টির পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক, পার্টি নেতা অমল হালদার, আভাস রায়চৌধুরী, সৈয়দ হোসেন প্রমুখ।
এছাড়াও গত ১ ফেব্রুয়ারি পার্টির টালিগঞ্জ ২ এরিয়া কমিটির উদ্যোগে নারকেলবাগান এলাকায় ‘বামপন্থাই বিকল্প’ শীর্ষক পার্টির প্রয়াত নেতা কমরেড প্রশান্ত শূর স্মারক বক্তৃতা করেন মানিক সরকার।
আরামবাগে মিছিল ও সমাবেশ
দেশব্যাপী দুর্বার কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগাতার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশ সফল করতে সিপিআই(এম) হুগলি জেলা কমিটির আহ্বানে দৃপ্ত মহামিছিলে উত্তাল হলো আরামবাগ। দীর্ঘ সময়ে তৃণমূলের সন্ত্রাসে অবরুদ্ধ এই অঞ্চলে এদিন পার্টির ডাকে মহামিছিলে আক্ষরিক অর্থেই যেন জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এই মহামিছিল শুরু হয় কালীপুর বাজার থেকে। এই মিছিল দ্বারকেশ্বর নদীর ওপর রামকৃষ্ণ সেতু অতিক্রম করে পল্লিশ্রী, বাসস্ট্যান্ড, নেতাজি স্কোয়ার, বসন্তপুর, গৌরহাটি মোড় হয়ে বাসুদেবপুরে শেষ হয়। তৃণমূলের সন্ত্রাস ও অত্যাচারের হাতথেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং নব্য বিজেপি বাহিনীর দাপট থেকে মুক্তি পেতে স্বস্তির আবহ তৈরি হয় এদিনের বিশাল মিছিল ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে।
এদিন গোঘাট, খানাকুল, পুরশুড়া ও আরামবাগের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে লালঝান্ডা নিয়ে বাস, ট্রেকার, লরিতে, ট্রেনে এবং মিছিল করে হাজার হাজার মানুষ মহামিছিলে অংশনেন। এদিনের মহামিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ-সহ মোজাম্মেল হোসেন, ভাস্কর রায়, অসিত মুখার্জি, জ্যোতিকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, শ্রুতিনাথ প্রহরাজ, তীর্থঙ্কর রায়, আবদুল হাই প্রমুখ।
মিছিল শেষে বাসুদেবপুর মোড়ে সভা হয়। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে এই সভা পরিণত হয় জনসভায়। এই সভায় মহম্মদ সেলিম বলেন, তৃণমূলী সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি আমরাই, এখন বিজেপি বলছে ওরা নাকি তৃণমূল ঠেকাবে! মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতাতেই বুঝছেন এই দুই দল আসলে কী! আম্বানির একহাত মোদীর হাতে, আরেক হাত মমতার সঙ্গে। আর আপনাদের এই জনজোয়ার বলছে মানুষের পক্ষে আমরাই। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি একমাত্র বিকল্প। বাম ও গণতান্ত্রিক সরকার গড়তে এই লড়াইকে তীব্র করতে হবে।
সমাবেশে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, বিজেপি’র চেহারা দেখছে মানুষ। আর তৃণমূলের বিরুদ্ধে এখন ঘৃণা জমছে মানুষের। রাজ্যে বাম ও গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে তুলতে হবে - এটাই সময়ের দাবি।
কামাখ্যাগুড়ির সমাবেশ
ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের আলিপুরদুয়ার জেলা তৃতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ১ ফেব্রুয়ারি কামাখ্যাগুড়ির হরিবাড়িতে বিশাল যুব সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে পার্টি নেতা সুশান্ত ঘোষ বলেন, দশ বছর ধরে গোটা রাজ্যে লুটপাট করছে তৃণমূল। সেই চোরেরা বাঁচার জন্য ডাকাতের দলে যাচ্ছে। এদেরকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
‘রক্ষা করো দেশের সংবিধান, ফিরিয়ে দাও কাজের অধিকার’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে যুব ফেডারেশনের জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন উপলক্ষে হরিবাড়িতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে মানিক সরকার ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি, রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র, জেলা সম্পাদক জীবন সরকার প্রমুখ।
এদিন উপচে পড়া জনস্রোতকে উদ্দেশ্য করে সুশান্ত ঘোষ বলেন, এরাজ্যে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। প্রথমে স্লোগান ছিল, বদলা নয়, বদল চাই। কিন্তু তা পরে পালটে বদলার রাজনীতিতে পরিণত হয়। তার শিকার হয়েছে বামপন্থীরাই। তিনি বিজেপি’র ঘৃণ্য বিভাজনের রাজনীতির নিন্দা করে বলেন, আগামীদিনে যুবদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। দুইদল মিডিয়ার পর্দায়। বামপন্থী ছাত্র-যুবরা মাঠে ময়দানে। এই মেজাজ নিয়েই আগামী নির্বাচনে লড়াই হবে দুই জনবিরোধী শক্তির সঙ্গে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির।
বাঁকুড়া ও তালডাংরায় কর্মীসভা
১ ফেব্রুয়ারি বাঁকুড়ার বড়জোড়া ও তালডাংরায় সিপিআই(এম)’র দু’টি কর্মীসভায় সূর্য মিশ্র বলেছেন, মানুষ এই সময়ের মধ্যে দেখেছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে লালঝান্ডার লড়াই, শ্রমজীবী ক্যান্টিন, ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তদানসহ বামপন্থীদের একাধিক কাজ। এখন একটাই স্লোগান - ‘যারা সরকারে আছে তারা দরকারে নেই, আর যারা সরকারে নেই তারা দরকারে আছে।’ যারা মানুষের দরকারে আছে তাদেরকেই নিয়ে আসতে হবে। আত্মবিশ্বাস নিয়েই কর্মীদের আগামী নির্বাচনী লড়াইয়ে বামগণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে মানুষকে লড়াইয়ে শামিল করতে হবে।
এদিনের দু’টি সভাতেই বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক অজিত পতি। তালডাংরার সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্টি নেতা মনোরঞ্জন পাত্র, বড়জোড়ায় যদুনাথ রায়।