৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭
কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২১-২২
সঙ্কট-জর্জরিত মানুষের সাথে বেইমানি
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ অতিমারী, লকডাউন দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ১৫ কোটি মানুষ বিভিন্নভাবে জীবিকা হারিয়েছেন। বহু মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে। বহু কলকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। চলতি আর্থিক বছরে এর সামগ্রিক প্রভাবে দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে প্রায় ৭.৭ শতাংশ। তাই আশা করা গিয়েছিল, এসবের মোকাবিলায় ২০২১- ২২-এর বাজেটে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু ১ ফেব্রয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে এসব বিষয়ে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। বরঞ্চ যেসব ঘোষণা করা হয়েছে তাতে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। বেকারত্ব হ্রাস, মূল্যবৃদ্ধি হ্রাস কিংবা নতুন কাজ সৃষ্টি এবং মানুষের হাতে নগদ জোগান বাড়ানোর কোনো দিশা দেখাতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। এর পরিবর্তে পাইকারিহারে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বেসরকারিকরণের পথে হেঁটেছে এই বাজেট।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এই বাজেট প্রসঙ্গে বলেছে, মহামারী এবং মন্দার দ্বৈত সঙ্কটে জর্জরিত মানুষের সঙ্গে বেইমানি করা হলো কেন্দ্রীয় বাজেটে। শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণা ও দুর্দশাকে বাড়িয়ে তোলার বিনিময়ে মুষ্টিমেয় কিছু বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করার ব্যাপারেই যে কেন্দ্রীয় সরকার বেশি আগ্রহী তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই বাজেট । সিআইটিইউ এই বাজেটকে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর নির্দয় আচরণ বলে বর্ণনা করেছে।
২০২১-২২ বাজেট প্রস্তাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা গতবারের থেকে সামান্য কমিয়ে রাখা হয়েছে ১ লক্ষ্য ৭৫ হাজার কোটি টাকা। গতবারে ছিল ২ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এই বিলগ্নিকরণের মধ্যে আছে জীবন বিমা করপোরেশন, দুটি ব্যাঙ্ক এবং একটি সাধারণ বিমা কোম্পানি। জীবন বীমা কর্পোরেশনের আইপিও বাজারে ছাড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধনী পেশ করা হবে এই বাজেট অধিবেশনেই। বিমা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সীমা ৪৯ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৭৪ শতাংশ করা হয়েছে। বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে যে, চার স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের হাতেগোনা কয়েকটি সংস্হা ছাড়া সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হারই বেসরকারিকরণ করবে কেন্দ্রীয় সরকার। যেগুলির সম্ভব হবে না সেগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে।বাজেট বক্তৃতায় সীতারামন বলেছেন, ২০২১-২২অর্থবর্ষের মধ্যে বিপিসিএল, এয়ার ইন্ডিয়া, শিপিং করপোরেশন, কনটেনার করপোরেশন, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক, বিইএমএল, পবন হংস, নীলাচল ইস্পাত নিগমের বিলগ্নিকরণ সম্পন্ন করা হবে। পিপিপি’র মধ্য দিয়ে বন্দরেরও বেসরকারিকরণ করা হবে। এজন্য আগামী অর্থবর্ষে ২ হাজার কোটি টাকার সাতটি প্রকল্প নেওয়া হবে। যেসব রাজ্য সরকার তাদের অধিগৃহীত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণে অগ্রাধিকার দেবে অর্থ বরাদ্দে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বিশেষ সুবিধা দেবে। বাজেটে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, সরকারি মন্ত্রক ও দপ্তরের পড়ে থাকা জমিও বিক্রি করে দেওয়া হবে। এই কাজের জন্য বিশেষ সংস্থা গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে বাজেটে।
একশ দিনের কাজের প্রকল্প এম এন রেগা’য় অর্থ বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে সংশোধিত অর্থ বরাদ্দ ছিল ১,১১,৫০০ কোটি টাকা। এবারে এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৭৩,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ কমেছে ৩৪ শতাংশ। যুবক-যুবতীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ এই বাজেটে গত বছরের ৫,৩৭২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এবছরে করা হয়েছে ৩,৪৮২ কোটি টাকা। কমানো হয়েছে খাদ্যে ভরতুকিও। গতবছর খাদ্যে ভরতুকি দেওয়া হয়েছিল ৩,৪৪,০৭৭ কোটি টাকা, এবছর এই খাতে বরাদ্দ হ্রাস করে করা হয়েছে ২,০২,৬১৬ কোটি টাকা। বরাদ্দ কমেছে স্বাস্থ্য এবং কৃষিতেও। কৃষিতে গতবছর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১,৩৪,৩৪৯ কোটি টাকা, এবছরের ব্যয়ের প্রস্তাব ১,২২,৯৬১ কোটি টাকা। বরাদ্দ কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ।
সবাইয়ের ধারণা ছিল, এই অতমারীর আবহে জনস্বাস্থ্যে কোনো বিশেষ ঘোষণা থাকবে এই বাজেটে। তাতেও হতাশা ছাড়া অন্য কিছু মেলেনি।করোনার টিকা সবাইকে দেওয়ার জন্য ভরতুকি দেবে বলেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের বাজেটে তার কোনো প্রতিফলন ঘটে নি। গণটিকার জন্য প্রয়োজন ছিল ৮০,০০০ কোটি টাকা, বাজেট প্রস্তাবে রয়েছে মাত্র ৩৫,০০০ কোটি টাকা। গণটিকাকরণের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না হলেও সরকারের দাবি স্বাস্হ্যে নাকি এবার ১৩৭ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দের নথি থেকে দেখা যাচ্ছে,চলতি বর্ষে স্বাস্থ্যে যেখানে ৮২,৪৪৫ কোটি টাকা খরচ হতে চলছে সেখানে এবারে বরাদ্দ ৭৪,৬০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয় কমছে প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা।
২০২১-২২ বাজেট প্রস্তাবে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪.৮ লক্ষ কোটি টাকা, যা প্রায় ২০২০-২১ অর্থবর্ষের ব্যয়ের সমতুল। তাই বলা যায়, টাকার প্রকৃত মূল্যে ব্যয় বাড়েনি বরং কমেছে। বাজেট বিবৃতি অনুযায়ী বিদায়ী আর্থিক বর্ষে কোষাগারীয় ঘাটতি হয়েছে জিডিপি’র ৯.৫ শতাংশ। আয়কর এবং কোম্পানি করের হার অপরিবর্তিতই আছে।তবে এই দুই খাতে আগামী আর্থিক বছরে আদায় কম ধরা হয়েছে। ২০২০-২১-এ কোম্পানি কর ও আয়করে সংগ্রহ হয়েছিল যথাক্রমে ৬.৮১ লক্ষ কোটি এবং ৬.৩৮ লক্ষ কোটি টাকা। এবছরের বাজেটে এই দুই কর থেকে আদায়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে যথাক্রমে ৫.৪৭ লক্ষ কোটি এবং ৫.৬১ লক্ষ কোটি টাকা। মূলধনী খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩৪.৫ শতাংশ। পুরসভায় পরিশ্রুত জলবণ্টনে ২ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এতে মাত্র ২ কোটি ৮৬ লক্ষ বাড়িতে জল পৌঁছে দেওয়া যাবে।
শিক্ষাখাতেও গত বছরের তুলনায় প্রায় ৬.১৩ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। গতবছরে শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ৩১২ কোটি টাকা, শেষপর্যন্ত সংশোধিত বরাদ্দ হয় ৮৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। ২০২১-২২ বাজেট প্রস্তাবে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৯৩ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।
প্রতিরক্ষায় সামান্য বৃদ্ধি করে এবারে বরাদ্দ হয়েছে ৪ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। নতুন করে কৃষি সেস বসানো হয়েছে পেট্রোল ও ডিজেলে। পেট্রোলে সেসের পরিমাণ লিটার প্রতি ২ টাকা ৫০ পয়সা এবং ডিজেলে লিটার প্রতি ৪ টাকা। পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থে ৬৭৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হবে বলে অর্থমন্ত্রী সীতারামন বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন। কিন্তু এ রাস্তা কোথায় কিভাবে হবে সেব্যাপারে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি বাজেট বক্তৃতায়। অন্যদিকে রাজ্যের চা-শিল্পের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সেই অর্থে চা-শ্রমিকদের কল্যাণে কিছুই থাকছে না। অন্যদিকে রাজ্যের মেট্রোরেল প্রকল্পগুলিতেও কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি এই বাজেটে।
আগামী অর্থবর্ষে রেলের পরিকাঠামো খাতে বাজেট ধরা হয়েছে ২,১৫,০৫৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে কেন্দ্র সাহায্য করবে ১,০৭,৩০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা জোগাড়ের দায়িত্ব রেলের।