৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭
দশ বছর অপেক্ষা করেও সুরাহা মেলেনি পার্শ্বশিক্ষকদের
প্রতিবাদে নবান্ন অভিযান
অবিলম্বে আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে, প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স জারি করেও পূর্ণশিক্ষক হিসেবে মর্যাদা দান, পূর্ণাঙ্গ বেতন কাঠামো এবং স্থায়ীকরণের দাবিতে পাঁচ ফেব্রুয়ারি নবান্ন অভিযান করলেন এ রাজ্যের বঞ্চিত পার্শ্বশিক্ষকরা। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর অপেক্ষার পরেও সুরাহা মেলেনি পার্শ্বশিক্ষকদের। ২০১১ সালেই মুখ্যমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ বেতন কাঠামো এবং স্থায়ীকরণের মধ্য দিয়ে পূর্ণ শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পার্শ্বশিক্ষকদের। ২০১৯ সালের দীর্ঘ অনশন কর্মসূচির পর জনমানসে সরকারের সহানুভূতিহীনতায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টের সমকাজে সমবেতনের নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে এই প্রচার তুঙ্গে ওঠে। তখন তড়িঘড়ি পরিস্থিতি সামলাতে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি পার্শ্বশিক্ষকদের ডেকে পাঠান আলোচনার জন্য। কিন্তু তিনি তখন তাদের পাশে থাকার, দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখন সরে গিয়ে উল্টো সুর গাইছেন। এর মধ্যেই দাবি সনদ নিয়ে আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সময় চেয়ে পাঠানো হয়েছিল পার্শ্বশিক্ষকদের ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে। মমতা ব্যানার্জি সময় দেন নি। এরপর বিধানসভা অভিযানের মধ্য দিয়ে সরকারের কাছে তাদের ন্যায্য চাহিদার কথা পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছিলেন এই অসহায় শিক্ষকরা, কিন্তু সরকার পুলিশ দিয়ে লাঠি চালিয়ে সমাজ গড়ার অন্যতম কারিগরদের দমন করেছে। সরকারের এহেন অমানবিকতা, নেতিবাচক মানসিকতার জেরে দীর্ঘ টালবাহানার পর এবার আর অপেক্ষা করতে রাজি নন তারা। তাই পার্শ্বশিক্ষকরা দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ দিন বিধাননগরে বিকাশ ভবনের কাছে অবস্থান-বিক্ষোভের পর দাবি আদায়ের জন্য নবান্ন অভিযানের মধ্য দিয়ে তাদের অনিশ্চিত জীবিকার কথা তুলে ধরে প্রতিকারের জন্য যে কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত হয়েছেন।
২০০৯ সাল থেকেই রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী প্রধান বিরোধী নেত্রী হিসেবে লোকসভা ভোটের আগে রাজ্যের পার্শ্বশিক্ষকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন পূর্ণ শিক্ষক হিসেবে তাঁদের নিয়োগ করা হবে, মেনে নেওয়া হবে তাদের দাবিদাওয়া। কিন্তু ১২ বছর অতিক্রান্ত। রাজ্য সরকার পার্শ্বশিক্ষকদের পূর্ণ শিক্ষকের মর্যাদা দেয় নি। শুধু ২০০৯ সালেই নয়, ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তার নবগঠিত মন্ত্রীসভা প্রথম বৈঠকে পার্শ্বশিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বেতন কাঠামো এবং তাদের পূর্ণ শিক্ষকের মর্যাদা দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একথা মহাকরণের জানালায় দাঁড়িয়ে ৩ জুন ২০১১ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণাও করেন। সে কথা শুনেছিল গোটা রাজ্যের মানুষ। পার্শ্বশিক্ষকরা সে কথা শুনে ভেবেছিলেন, তাদের দাবি দাওয়ার সুরাহা হল। কিন্তু এখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ২০০৯ সালের প্রতিশ্রুতি এবং ২০১১ সালের মন্ত্রীসভাস্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পার্শ্বশিক্ষকরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন এখনও।
মহাকরণের জানালায় দাঁড়িয়ে পার্শ্বশিক্ষকদের স্থায়ী নিয়োগের যে সিদ্ধান্তের কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সেটা অবশ্য তিনি সামান্য বদলে ফেলেছিলেন কয়েকদিন পরেই। সিদ্ধান্ত নেবার দু’একদিন পরেই তিনি জানিয়েছিলেন যে, ট্রেনিং প্রাপ্ত পার্শ্ব শিক্ষকদের নিয়োগ করা হবে। এর পাশাপাশি আরো একটি মানদণ্ডের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। বলা হয়, পার্শ্বশিক্ষকদের উচ্চ মাধ্যমিকস্তরে ৫০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। পার্শ্বশিক্ষকরা ইতিমধ্যেই সেই যোগ্যতামান অর্জন করেছেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
এই মুহূর্তে প্রায় ৪৮ হাজার পার্শ্বশিক্ষক রয়েছেন রাজ্যে। এর পাশাপাশি এসএসকে এবং এমএসকে ভুক্ত শিক্ষক যারা অবসর গ্রহণের সময়সীমা ৬০ বছর মেনে অপশন গ্রহণ করেছিলেন তারাও প্যারাটিচার পর্যায় উন্নীত হয়েছেন। অর্থাৎ সবমিলিয়ে ৬২ হাজার পার্শ্বশিক্ষক এই মুহূর্তে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা চূড়ান্ত অসহায় বোধ করছেন। তাদের অসহায় বোধ করার কারণও রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী কোনো অস্থায়ী শিক্ষক আগামীদিনে থাকবেন না। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ বেতন কাঠামো ছাড়াই সর্বমোট যে টাকা (কনসোলিডেটেড অ্যামাউন্ট) এই পার্শ্বশিক্ষকদের দেওয়া হয় তা পদ্ধতিগতভাবে যথাযথ নয়। এই তৃণমূল সরকারের সময়ে পার্শ্বশিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়ে যা হয়েছে তা চূড়ান্ত ন্যক্কারজনক। ২০০৪ সাল থেকে পার্শ্বশিক্ষকরা কর্মরত রাজ্যে। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর শিক্ষা দপ্তর সে সম্পর্কে অবহিত প্রথম থেকেই। কিন্তু প্রভিডেন্ট ফান্ডের দেয় অর্থের ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের কার্যকাল ২০১৫ সাল ধরে রাজ্য সরকার তা কার্যকর করেছে। পার্শ্বশিক্ষকদের অভিযোগ, প্রায় ১১ বছরের প্রভিডেন্ট ফান্ড কার্যত এই সরকার মেরে দিয়েছে।
২০১৯ সালে উপায়ান্তর না দেখে পার্শ্বশিক্ষকরা সল্টলেকে বিকাশ ভবনের অদূরে তাঁদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য অবস্থান ধর্মঘটে বসেন। প্রথমদিকে প্রবল পুলিশি অত্যাচারের শিকার হন তাঁরা। তারপর হাইকোর্টের নির্দেশে প্রশাসন তাঁদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান মেনে নিতে বাধ্য হয়। সে সময় প্রায় ৩২ দিন তাঁরা খোলা আকাশের নিচে আন্দোলনরত অবস্থায় রাজ্য সরকারের ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। এই শিক্ষকদের অনশন আন্দোলনের জেরে রাজ্যের সর্বত্র ধিক্কৃত হয় মমতা ব্যানার্জির সরকার। মুখ রক্ষার তাগিদে তাঁদের শিক্ষামন্ত্রী ডেকে পাঠান। এই পরিস্থিতিতে ১২ ডিসেম্বর পার্শ্বশিক্ষকরা তাঁদের আন্দোলন স্থগিত রাখেন। তাঁরা ঠিক করেন রাজ্য সরকারের দাবিগুলির প্রতি সদিচ্ছার মানসিকতা দেখে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন। শিক্ষামন্ত্রীর ডাকে তাঁরা মন্ত্রীর দপ্তরে হাজির হয়ে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনায় বসেন। কিন্তু মন্ত্রী বন্ধ দরজার ভেতরে যে প্রতিশ্রুতি পার্শ্বশিক্ষকদের নেতৃত্বকে দিয়েছিলেন সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ্যে সেই বক্তব্য থেকে পিছিয়ে আসেন। পার্শ্বশিক্ষকরা বিস্মিত হলেও সরকারের ওপর তাঁদের আস্থা ছিল। আস্থা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর উপরেও। তাঁরা ভেবেছিলেন তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পূর্ণ শিক্ষকের মর্যাদা পাবেন। তাঁরা সরকারকে কিছুদিন সময় দিতে চান নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে।
এরমধ্যে ২০২০ সালে এসে পড়ে কোভিডজনিত মহামারীর পরিস্থিতি। সমস্ত ব্যবস্থাটাই থিতিয়ে যায়। ওইসময় পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর হাতে কোভিড পরিস্থিতির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়। পার্শ্বশিক্ষকরা বলছেন ওই সময় তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মহামারীজনিত কারণে শিক্ষামন্ত্রী কথাবার্তা বলতে চাননি। সার্বিক পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদে পার্শ্বশিক্ষকদের সংগঠন পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকাশ্য আন্দোলন-অবস্থান থেকে বিরত থাকেন। তাঁদের অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে গত ১১ ডিসেম্বর (২০১৯) আলোচনার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে মূল সংগঠকদের নিয়ে এক বৈঠক আয়োজিত হয়। সেখানে দেখা যায় শিক্ষামন্ত্রী তাঁর অবস্থান বদলে ফেলেছেন, সুর বদলে ফেলেছেন। তিনি রাজ্য সরকারের নানা অসুবিধার কথা তুলে পার্শ্বশিক্ষকদের ডিপার্টমেন্টাল টেট পরীক্ষা দিতে হবে এই নতুন যোগ্যতামানের কথা বলেন। পার্শ্বশিক্ষকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হয় যে, এলিমেন্টারি এডুকেশনের ক্ষেত্রে টেট বাধ্যতামূলক নয়।২০১৫ সাল থেকে যাঁরা ঢুকেছেন তাঁরা টেট পাস করেছেন। কিন্তু টেট পাশ করেও তাঁরা বসে আছেন, তাঁদের চাকরি হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী কার্যত উল্টো সুর ধরেন ওই বৈঠকে। এরপরই পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আবার অবস্থান-বিক্ষোভে বসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পর্বে তাঁরা ৫০ দিন অতিক্রম করেছেন। তাঁরা ঠিক করেছেন শেষ দেখে ছাড়বেন এবার। ন্যায্য দাবি আদায়ই তাঁদের লক্ষ্য।