৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭
দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসর সম্প্রদায় এবং লোকশিল্পীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে কলকাতায় প্রত্যয়ী সমাবেশ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মনুস্মৃতি অনুযায়ী দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা চালু করতে চায় বিজেপি-আরএসএস। তাই একের পর এক দলিত আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ-বিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। শুধু তাই নয়, সাধারণ অর্থনৈতিক আক্রমণের পাশাপাশি এখন তফশিলি জাতি, আদিবাসী, অন্যান্য পশ্চাৎপদ জাতিভুক্ত মানুষ দেশজুড়ে পরিকল্পিতভাবে ধারাবাহিক সামাজিক নিপীড়নের শিকার। বেশিরভাগ আর্থ-সামাজিক সূচকে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর তুলনায় এঁরা পিছিয়ে রয়েছেন। আর নির্বাচনের মুখে দলিত আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের দরজায় ভিড় জমাচ্ছেন তৃণমূল বিজেপি’র নেতারা। দেওয়া হচ্ছে ভুরিভুরি প্রতিশ্রুতি। ঘোষণা করা হচ্ছে নানা প্রকল্প। ভোট মিটে গেলে এগুলোর কোনো হদিশ থাকবেনা। দলিত, আদিবাসী পিছিয়ে পড়া বর্গ ও লোকশিল্পীদের অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে বামপন্থীরাই লড়াই করেন এবং লড়াই করেই লুণ্ঠিত অধিকার আদায় করতে হবে। ২৮ জানুয়ারি কলকাতার ওয়াই চ্যানেলে পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী লোকশিল্পী সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের সমাবেশে একথা বলেন সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন সাংসদ ও দলিত শোষণ মুক্তি মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক ডা: রাম চন্দ্র ডোম, পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক অলকেশ দাস, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক শংকর মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন মন্ত্রী দেবলীনা হেমব্রম, জলধর কর্মকার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক প্রাক্তন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রাক্তন মন্ত্রী অধ্যাপক দেবেশ দাস।
সমাবেশে ডাঃ রামচন্দ্র ডোম বলেন, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে দাবি আদায়ের লড়াইকে জোরদার করতে হবে এই অংশের মানুষদের। ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই তৃনমূল বিজেপি’র অপচেষ্টা, অভিসন্ধিগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দলিত, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য একটা সুষ্ঠু জীবন-জীবিকার বন্দোবস্ত পুনরায় কায়েম করতে হবে।
দেবলীনা হেমব্রম বলেন, দলিত, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষ এবং লোকশিল্পীদের জন্য বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যে অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তৃণমূল ক্ষমতায় এসে তা কেড়ে নিচ্ছে। আদিবাসী মহিলাদের উপর ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। তৃণমূলের বিভিন্ন প্রকল্পের ঘোষণা এবং বিজ্ঞাপনের বহর থাকলেও, সে প্রকল্পের সুবিধা কতজন পেয়েছেন প্রশ্ন তুলেছেন দেবলীনা হেমব্রম। তিনি বলেন, আদিবাসীরা নির্বাচনের কাঠ পুতুল নয় যে তাদের কেবলমাত্র ভোট রাজনীতির ফায়দা তুলতে ব্যবহার করা হবে। এর বিরোধিতা করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারকে তপশিলি জাতি,আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতিভুক্ত মানুষের উপর বাড়তে থাকা নির্যাতন ও বঞ্চনা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, তপশিলি জাতি, আদিবাসী এবং ওবিসি ভুক্ত মানুষদের অর্জিত অধিকার হরণ করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরকারগুলিকে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ, এসসি, এসটি, ওবিসি শংসাপত্র প্রদানের প্রক্রিয়ার সরলীকরণ এবং হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ, সংরক্ষণের অধিকার হরণ করার ষড়যন্ত্র বন্ধ করে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরিতে শূন্য সংরক্ষিত পদগুলি অবিলম্বে পূরণ করতে সংরক্ষণের নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ, বেসরকারি ক্ষেত্রে এসসি, এসটি এবং ওবিসি ভুক্ত মানুষদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতি কার্যকর, জল, জঙ্গল ও জমি সম্পর্কিত আদিবাসী জনগণের অধিকার রক্ষা এবং আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করা, তফশিলভুক্ত ও আদিবাসীদের জন্য স্পেশাল কম্পোনেন্ট প্ল্যান এবং ট্রাইবাল সাব প্ল্যান কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরে চালু করা, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল কেবলমাত্র এসসি, এসটি এবং ওবিসিভুক্ত মানুষের জন্য ব্যবহার, ইত্যাদি দাবি পূরণের জন্য সমাবেশে সোচ্চার হয়েছেন নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা মনে করি সিএএ, এনপিআর, এনআরসি প্রক্রিয়া এই দেশের নাগরিকত্ব নির্ধারণে ধর্মকে যুক্ত করে সংবিধানের মূল নীতি লঙ্ঘন করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত সিএএ প্রত্যাহার করা, এনপিআর প্রক্রিয়া বাতিল এবং এনআরসি-র পুরো পদ্ধতি বাতিল করা। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রসঙ্গ তুলে নেতৃবৃন্দ বলেন, এই অংশের ছাত্রছাত্রীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। তাদের ভাতা পাচ্ছেন না কেন এবং ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল সংক্রান্ত যাবতীয় সুবিধা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এসসিএসটি খাতের টাকা অন্যত্র খরচ করা চলবে না।
প্রাক্তন সাংসদ এবং পশ্চিমবঙ্গ সামাজিক ন্যায় মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক অলকেশ দাস বলেন, কর্মসংস্থান, খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা সহ তপশিলি আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের বঞ্চনার কথা। ভোটের ফায়দা তুলতে ভাঁওতা দেওয়ার প্রসঙ্গে এই অংশের মানুষদের সতর্ক থাকার আবেদন করেছেন তিনি।
আদিবাসী এবং লোকশিল্পীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনার বিষয়গুলি তুলে ধরেন পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক শংকর মুখোপাধ্যায়। তিনি শ্লেষের সুরে বলেন, অমিত শাহ আদিবাসীদের বাড়ি এসে পাত পেড়ে একদিন খাচ্ছেন কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলো তাদের খাবার আছে কিনা তাদের অধিকার রক্ষিত হচ্ছে কিনা এসব দেখার সময় নেই। লোকশিল্পী এবং লোকসংস্কৃতিকে রক্ষার দিকে এই সরকারগুলি নজর দিচ্ছে না। আদিবাসীদের বনাঞ্চলের আইন খর্ব করা হচ্ছে। আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক আইনগুলি স্থগিত নয়, বাতিল করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে।
রাজ্য সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বহু আদিবাসী লোকশিল্পী নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এই সময়। শাসকদলের প্রতি আনুগত্যে সামান্য সন্দেহ হলেই লোকশিল্পীদের পরিচয়পত্র বাতিল করা হচ্ছে। লোকশিল্পের ঐতিহ্যপূর্ণ আঙ্গিক রক্ষা করার কোনও তাগিদই নেই রাজ্য সরকারের।
প্রসঙ্গত, নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে উঠে আসে রাজ্য সরকারের বঞ্চনার প্রসঙ্গও। ১০ সেপ্টেম্বর একটি চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমফান এবং লকডাউন পরিস্থিতিতে আদিবাসী এবং লোকশিল্পীদের পরিবার পিছু সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। প্রকৃত লোকশিল্পীদের সরকারি তালিকা তৈরি করতে হবে। প্রবাদপ্রতিম লোকশিল্পীদের নামে যে সমস্ত পুরস্কার বামফ্রন্ট সরকারের সময় চালু ছিল তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এদিনের সমাবেশ থেকে দাবি তোলা হয় এগুলি পুনরায় চালু করতে হবে। সুধী প্রধানের পরিকল্পিত অনুষ্ঠান প্রসার প্রকল্প পুনরায় চালু করতে হবে। বন্ধ করতে হবে শিল্পীদের ওপর নজরদারি।