৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭
আমরা অপেক্ষায়
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকিনা। / যে যা করে দেখি ভাই / সুবিধেটা নিয়ে যাই / দুম করে প্রকাশ্যে আসি না / দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকিনা।’ ঘোষেদের নিয়ে ঘষাঘষি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও সেটাই হয়ে যাচ্ছে। কোন্ ঘোষ যে কখন গোরুর দুধে সোনা খুঁজে পান আর কোন্ ঘোষ ‘সাতে পাঁচে থাকিনা’ ‘রাজনীতি দলাদলি, কিংবা সে কোলাকুলি, যে যা খুশি হয়ে যাক, দুনিয়া চুলোয় যাক,’ বলে ‘টুঁ শব্দটি’ না করে নিঃশব্দে দিল্লি উড়ে যান মাথায় ঢোকে না। গত কয়েক মাসে এ যে কী মুশকিল হয়েছে! মাঝে মাঝে নিজেকে বেশ ‘ফিলিং বিস্মিত’ লাগে। দিনকাল হঠাৎ করেই কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই এরকমটা হয়েছে! হয়তো বা দীর্ঘ লকডাউনে মানসিক স্থিতির ওপর চাপ পড়েছে। তাই বড়োভাই যখন আত্মনির্ভর হবার নাম করে একের পর এক জমিদারির সম্পত্তি বেচে ‘পেয়ারে দেশবাসিয়ো’কে দেউলিয়া হবার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তখনও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। আর কেউ কেউ ‘সাতে পাঁচে থাকি না’ বলেও ঘাপটি মেরে বারোর ঘরে। অন্যের পোয়াবারো দেখতে দেখতে বাসের পেছন ছাড়া কিছু মনে পড়ছে না। ‘হিংসা কোরো না, তোমারও হবে’।
গত আট-দশ মাসে দেশে আমার মতো চুনোপুঁটিরা কতটা বিপদে পড়েছে ‘সেটা বড়ো কথা নয়’। কিন্তু একজন মহান মানুষ যেভাবে মহা বিপদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তা অবশ্যই চিন্তার। একে তো তাঁর এতদিনের সাধের দাড়ির পেটেন্ট নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। তিনি বেজায় ভয়ে ভয়ে আছেন। লোকজন যেভাবে গণহারে দাড়ি রাখতে শুরু করেছে, কোনদিন না আত্মনির্ভর হতে গিয়ে তাঁর সাধের দাড়িটারও স্ট্র্যাটেজিক সেল হয়ে যায়। সাধে কী আর নজরুল ‘দাড়ি-বিলাপ’ কবিতায় লিখেছিলেন - “বোকেন্দ্র-গন্ধিত ছাগ সেও দাড়ি রাখে, / শিম্পাঞ্জি, গরিলা - হায়, বাদ দিই কাকে! / এমন যে বটবৃক্ষ তারও নামে ঝুরি, / ঝুরি নয় ও যে দাড়ি করিয়াছে চুরি।” অবশ্য এ বছরের জন্য দাড়িটা হয়তো রক্ষা পেয়েছে। কারণ বাজেটে আর সবই মোটামুটি বিক্রি করার কথা বলা হলেও দাড়ি বিক্রির কথা কোথাও নেই। তবে এপ্রিল-মে-র পর কী হবে কিছুই বলা যায়না। আর তারপর আছে বই, কবিতা নিয়ে টানাটানি। ২০১৯-এর মে মাস থেকে এখনও পর্যন্ত তিনি বুঝে উঠতে পারেননি সহজপাঠ বেরোনোর বহু বছর আগে মরে গিয়েও বিদ্যাসাগর কবে তাঁর লেখা সহজপাঠ বইটা নিজের নামে ছেপে দিলেন। ১১ জুন ২০২০-র পর থেকে বুড়োদাদু প্রায় প্রতিদিন রাতে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝেই চমকে চমকে ওঠেন। আট মাস কেটে গেলেও তিনি কবে ‘চোলায় চোলায় বাজবে জোয়ের বেরি…’টা লিখেছিলেন সেটাও আজ পর্যন্ত তাঁর মনে পড়েনি। আর এবছরের ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী কেন যে ‘দুঃসময়’ কবিতা থেকেই আবৃত্তি করলেন সেটাও মাথায় ঢোকেনি। দেশের যে সত্যিই দুঃসময় সেটা তো সবাই বেশ এমনি এমনিই বুঝতে পারছে। তারজন্য কবিতা আওড়াতে হবে!
‘ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের নামটা বলতে কেন যে লজ্জা করেনা বুঝতে পারিনা।’ ‘এত ক্ষমতালোভী একটা মানুষ আমি দেখিনি’। ‘খুব ভালো ছকবাজ একটি মানুষ’। ‘একটা আহাম্মক’ ‘ধর্মান্ধ’ ‘ক্ষমতালোভী’। ‘মানুষ কথাটার তালিকা এই মানুষটার নামে নেই’। কথাগুলো ২০১৪ সালে বলা। যিনি বলেছিলেন, তিনি আপাতত নীলমণি ঘোষ থেকে নাম বদল করে রামমণি ঘোষ হয়েছেন। ছেলেবেলায় যদিও তাঁর নাম ছিলো লালমণি ঘোষ। আপাতত অন্য অনেকের মতো তিনিও দলে থেকে কাজ না করতে পেরে পালটি মেরেছেন। অবশ্য যারা সাতে পাঁচে থাকেন না তাঁদের ক্ষেত্রে এরকম হতেই পারে। কখন পাঁচ সাত্তে পঁইত্রিশ হয়ে যায় ধরতে পারা যায় না।
মানুষের উপকার করার আকাঙ্ক্ষা, মানুষের জন্য কাজ করার আকাঙ্ক্ষা যুগ যুগ ধরে বুকে নিয়ে কিছু মানুষ বেঁচে থাকে। এদের মধ্যেই কেউ কেউ লকডাউনের সময় শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালায়, সস্তার বাজার চালায়, সর্বশক্তি দিয়ে মানুষের পাশে থাকতে চেষ্টা করে। আর কেউ কেউ মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়ে দলবদল করে। ‘দলে থেকে কাজ করতে পারছি না’ বলে অন্যদলে যায়। এখন অবশ্য কার্তিক পূর্ণিমা নয়, আর শোনপুরের হাটের বিবরণ দিতেও আমি বসিনি। তবে এই প্রসঙ্গে একখান কথা বলা যেতেই পারে। অভয় দেন তো বলেই ফেলি…
সাধারণ মানুষ কনফিউসড হয়ে পড়লেও দলবদল খুব ভালো কথা এ নিয়ে সন্দেহ নেই। একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে মাঝে দলবদল শরীর ও পকেট - দু’য়ের পক্ষেই ভালো। মানুষের জন্য আরও বেশি কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়। বলা যেতে পারে এক মহান উদ্দেশ্য নিয়েই জনগণের সেবার্থে দলবদল করা বা করানো হয়। শুধু যে কাকু বা দাদাকে লাল বা নীল দেখে রাতে মানুষ ঘুমোতে যায় সকালে যখন সেই কাকু বা দাদা গেরুয়া বা সবুজে রূপান্তরিত হয়ে নবরূপে আবির্ভূত হন তখন ঘুমের ঘোর কাটতে একটু সময় লাগে। মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছেয় দলবদল, দলে থেকে কাজ করতে পারছি না বলে দলবদল, কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই সরকার থাকলে কাজ করতে সুবিধে হবে বলে দলবদল - যুক্তিগুলো যে ধোপে টেকে না সেটা অবশ্য বদলুরা বুঝতে পারেন না।
সারসংক্ষেপ না লিখে একটু বরং ব্যাখ্যা লেখা যাক। যদি হয় যে ‘মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছেয় দলবদল’ সেক্ষেত্রে কোনো জনপ্রতিনিধির এই কথা বলার অর্থ - তিনি এতদিন মানুষের জন্য কাজ করেননি। এতদিন কেন সেকথা বলেননি, কেন মানুষের জন্য কাজ করেননি সে প্রশ্ন তাঁকে পাল্টা করা যেতেই পারে। তিনি হাজারো অসুবিধের কথা শোনাতে পারেন। কিন্তু তাতে দায়িত্ব অস্বীকার করা যাবে না বা শুকনো কথায় চিঁড়ে বোধহয় খুব বেশি ভিজবে না।
দ্বিতীয়ত - যেসব জনপ্রতিনিধি বলছেন - দলে থেকে কাজ করতে পারছি না বলে দলবদল - তাঁদের ক্ষেত্রে সবথেকে বড়ো প্রশ্ন - কথাটা ভোটের ঠিক মুখে মুখেই মনে হল? এতদিন কী করছিলেন? সকলেই তো চেয়ার আলো করে বসেছিলেন। কেউ মন্ত্রী, কেউ সান্ত্রি, কেউ মেয়র, কেউ কাউন্সিলর। এক দু’জন ছাড়া কেউই তো পদ ছাড়েননি। মৌচাকের আশেপাশেই তো সকলের অবস্থান ছিল। আমার কাছে যেহেতু কোনো প্রমাণ নেই তাই আমি কাউকেই অবশ্য নারদ ঘুষখোর, তোলাবাজ, চিটফান্ড দুর্নীতিতে যুক্ত এসব বলতে পারবো না। তবে দল ছেড়ে যাবার পর কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছেন না। কেউ বলছেন ‘ভাইপো তোলাবাজ’, আর কেউ বলছেন ‘বন সহায়ক পদ নিয়ে কারসাজি করা হয়েছে। চুরি করে বিজেপি-তে চলে গেছে, তদন্ত হবে।’ আর কেউ জনসভায় ফাইল হাতে নিয়ে হিসেব দিচ্ছেন কে কত কোটি টাকা ঘুষ খেয়েছে। ঘুঁটেতে ভরে যাচ্ছে পাঁচিল। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায় দেখ। কিন্তু বিলম্বিত বোধোদয় তো এটাকে বলা যাবে না। আর হঠাৎ এই বোধোদয় কেন তার কারণ খুঁজতে ব্যোমকেশ বক্সীকে ডাকারও দরকার নেই। সাদা চোখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে।
এবার আসি তৃতীয় পয়েন্টে। জনৈক দলত্যাগী বলেছেন - কেন্দ্র এবং রাজ্যে একই সরকার থাকলে উন্নয়নের কাজ করতে সুবিধে হয়। এমনিতেই রাজ্যে গত ১০ বছর, কেন্দ্রে গত ৬ বছরের উন্নয়ন ও অনুপ্রেরণা এবং বিকাশের ঠেলায় দেশবাসী-রাজ্যবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছে। এরপরেও কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই সরকার থাকলে কতটা বেশি উন্নয়ন হয় তার প্রমাণ তো উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, আসাম, কর্ণাটক সহ একাধিক রাজ্যে আছেই। আর হাতে গরম উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ত্রিপুরার নাম। ‘হীরের ত্রিপুরা’ যবে থেকে গড়ে উঠেছে তখনই তো ত্রিপুরায় এবং কেন্দ্রে একই দলের সরকার। ত্রিপুরার প্রতি চৌমোহনীতে কী পরিমাণ হীরে প্রতিদিন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তার সাক্ষী সে রাজ্যের মানুষ। ১০৩২৩ শিক্ষকের স্থায়ী চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হীরক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এখন প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। উল্টে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর গত সপ্তাহেই জলকামান থেকে লাঠিচার্জ - সব ঘটনাই ঘটেছে। রাজ্যের উন্নয়নের থেকে বিরোধীদের দমন পীড়নই এখন হীরক রাজ্যের মূল কাজ।
সারা দেশে বিকাশ সম্পূর্ণ হওয়া এবং আচ্ছে দিন এসে যাবার পর আপাতত ডেস্টিনেশান বাংলা। সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি। সেই সোনার বাংলা - যেখানে বিদ্যাসাগর সহজপাঠ লেখেন, গোরুর দুধে সোনা খুঁজে পাওয়া যায়। এতদিন যাঁদের দিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ ‘তোলাবাজ’ বলে আঙুল তোলা হতো, দলবদলের পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে হঠাৎ দেবদূতে পরিণত হওয়া সেইসব ‘সফেদ’ নেতা-নেত্রীরাই কর্তা মন্ত্রী হয়ে যাবেন। ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গিয়ে নবরূপে সোনার বাঙলা দেখতে দেখতে সাধ মিটবে বাঙালির।
লিখতে গেলে আরও অনেক কথা লেখা যায়। গত দু’মাসের ওপর চলা কৃষক আন্দোলনের কথা লেখা যায়। কৃষকদের অনমনীয়তা, দৃঢ়তা, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের কথা লেখা যায়। সরকারের নিষ্ঠুরতার কথা লেখা যায়। প্রশাসনের কৃষক আন্দোলন ভাঙার চেষ্টার কথা লেখা যায়। আন্দোলনের চাপে ভীত হয়ে আন্দোলনস্থলের বিদ্যুৎ সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, জল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবার কথা লেখা যায়। কৃষকদের আন্দোলন ভাঙতে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, পেরেক, গজাল, তারের ফেন্সিং লাগানোর কথা লেখা যায়। সরকারের রক্তচক্ষু উড়িয়ে জেলায় জেলায়, রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের মহাপঞ্চায়েতের কথা লেখা যায়। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তারকাদের ট্যুইট যুদ্ধের কথা লেখা যায়। তার বিরোধিতায় রাতারাতি অক্ষয় কুমার থেকে শচীন তেন্ডুলকরের ঘুম ভাঙার কথা লেখা যায়। লড়াই লড়াই এবং শুধুমাত্র লড়াই-এর কথা লিখে ফেলা যায় এক নিঃশ্বাসে। লেখা যায় বাজেটের কথা। বীমা ক্ষেত্রে একধাক্কায় এফডিআই বাড়িয়ে দেবার কথা। একাধিক সংস্থা বিলগ্নীকরণের কথা, দুই ব্যাঙ্ক বিক্রির কথা। যে প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম বলেছেন - এই বাজেটকে মনে হচ্ছে সরকারের ওএলএক্স-এর বিজ্ঞাপন। রেল বেচবেন, ইন্সিওরেন্স বেচবেন, কারখানা বেচবেন, দু’টো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেচবেন। সবকিছুই বিক্রির জন্য। মোদী সরকার যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সেগুলো কোথায় গেল? যখন বিজেপি বিরোধী ছিল তখন এলআইসি-তে এফডিআই-এর বিরোধিতা করেছিলো। এবার সেটা ৭৪ শতাংশ করে দেওয়া হলো। এটা প্রাইভেটাইজেশন নয়, আদানিজাইজেশন হচ্ছে। আজ সরকারের যা করণীয় তা কর্পোরেট করছে। আর কর্পোরেটের যা করণীয় সেটা সরকার করছে।
তাই লড়াই চলছে। আন্দোলন চলছে। প্রতিরোধ চলছে। মানুষ প্রতিরোধের জন্য রাস্তাকেই বেছে নিচ্ছেন। সিঙ্ঘু থেকে টিকরি, গাজীপুর থেকে জিন্দ, মুজফফ্রনগর থেকে মথুরা, কলকাতা থেকে কাকদ্বীপ - একসুরে কথা বলছে। দেশের কৃষক আন্দোলন শক্তি জোগাচ্ছে বৃহত্তর আন্দোলনে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে জোট বাঁধতে। দেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তরে বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই সময় সকলেই যখন এত রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করছেন আমরাই বা করবো না কেন? আমরাও বরং তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে বলি - ‘বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ, / দেখে না যে বান ডেকেছে / জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।” “সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে, / শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে, সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে / লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়। / আয় প্রচণ্ড”…আমরা অপেক্ষায়।