E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৫ সংখ্যা / ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ২২ মাঘ, ১৪২৭

বিজ্ঞান আলোচনা


মুক্তবিজ্ঞানের ধারণা ও গালগপ্প

তপন মিশ্র



আলেক্সজান্দ্রার এলবাকয়ান

গত ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের তিনটি তাবড় গবেষণাপত্র প্রকাশনা সংস্থা এলসিভিয়ার (Elsevier), উইলি (Wiley) এবং আমেরিকান কেমিক্যাল সোস্যাইটি (American Chemical Society) দিল্লি হাইকোর্টে সাই-হাব (Sci-Hub) এবং লিবজেন (Libgen-Library Genesis)-এর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। পরের দুই সংস্থার বিরুদ্ধে এই বড়ো প্রকাশনা সংস্থাগুলির অভিযোগ হলোঃ তারা গবেষকদের জন্য ‘free academic material’ অর্থাৎ বিনাখরচে গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই সব পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণাপত্র পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। এর অর্থ হলো সাই-হাব এবং লিবজেন আম গবেষকদের জন্য ত্রাতা হিসাবে কাজ করে। মামলায় অভিযোগ হলোঃ সাই-হাব এবং লিবজেন কপিরাইটর আইন উলঙ্ঘন (copyright infringement) করছে। যেকোনো দেশের এবং যেকোনো গবেষকের একটি গবেষণাপত্র সামান্য হলেও জ্ঞানভাণ্ডারে কিছু না কিছু যুক্ত করে। কম বেশি করে পর পর যুক্ত হওয়া এই বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডারের প্রায় ৫০ শতাংশ ধীরে ধীরে এলসেভিয়ার, স্পিঞ্জার, উইলি, আমেরিকান কেমিক্যাল সোস্যাইটি এবং সেজের মতো গবেষণা পত্রিকা প্রকাশনাসংস্থার কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের জ্ঞান, যা সর্বজনীন হওয়া উচিত তা এদের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। একজন গবেষককে এককভাবে বা তিনি যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত তার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাঁর চাহিদামতো গবেষণাপত্র কিনতে হয়।

প্রশ্ন হতে পারে যে এটা আবার নতুন কী? যিনি বই লেখেন তাঁর বই তো প্রকাশক বিক্রি করে। এই বিক্রির কিছু অংশ লেখক পান। তবে এখানে ঘাটতি কিসের। এখানে যা হয় তা’হলো গবেষণাপত্রের লেখক, যিনি গবেষকও বটে তিনি তো তাঁর পরিশ্রমের মূল্য পান না, এমনকি প্রকাশিত বই বা গবেষণাপত্রের কোনো অনুলিপিও তাঁকে দেওয়া হয়না। যা দেওয়া হয় তা হলো তাঁর লেখার একটি সফট কপি। ছাপানোর আগে লেখকের থেকে ৪/৫ পাতার একটি চুক্তিপত্রে সই করিয়ে নেওয়া হয় যেখানে এমনই অনেককিছুই লেখা থাকে। এই চুক্তিপত্রে সই না করলে আপনার গবেষণার বিষয়বস্তু অপ্রকাশিত থেকে যাবে বা নিম্নমানের কোনো পত্রিকায় প্রকাশ করতে বাধ্য হবেন যা অধিকাংশ গবেষকের চোখ এড়িয়ে যাবে।

বিশ্বজুড়ে ‘ওপেন সায়েন্স’ (‘Open Science’) আন্দোলনের স্বর বড়ো থেকে ছোটো সমস্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় শুনতে পাওয়া যাবে। ইদানীংকালে কেবল বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নয় সমস্ত ধরনের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই বাধা সামনে আসছে। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, ‘কপিরাইট’ নামে জ্ঞান কুক্ষিগতকরণ। কোনো কোনো সিএসআইআর গবেষণাগারে এখন তুঘলকি আইন হলো, আপনি নিজের গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থ দিয়ে নিজের গবেষণাপত্র ইমপ্যাক্ট ফাক্টর-৪ (Impact factor-4 - গবেষণা পত্রের মান নির্ধারক মাপকাঠি যা ১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদি সংখ্যা দ্বারা নির্ধারিত হয়)-এর নিচে কোনো জার্নালে প্রকাশ করতে পারবেন না। অর্থাৎ আপনাকে বহুজাতিকদের দ্বারস্থ হতেই হবে।



জ্ঞানচর্চায়ও ফেলো কড়ি

এখন সারাবিশ্বে বিনাখরচে গবেষণাপত্র ছাপার জায়গা খুঁজে পাবেননা যদি না আপনি কোথাও আমন্ত্রিত লেখক হন। যদি আপনি এমন কোনো পত্রিকা খুঁজে পান যেখানে বিনাখরচে ছাপার কথা বলা আছে, তাহলে আপনার গবেষণাপত্র পাওয়ার কিছুদিন পর আপনি নিশ্চয়ই একটি মেল পাবেন। মেলটিতে লেখা থাকবেঃ “আপনার গবেষণাপত্র আমাদের জার্নালে ছাপার উপযুক্ত নয়। কিন্তু আপনি অমুক পত্রিকায় পাঠালে আপনার গবেষণাপত্র ছাপা যেতে পারে।” তারপর খবর নিয়ে জানতে পারবেন যে, সেই পত্রিকায় ছাপার খরচ অনেক বেশি। কারও মনে হতে পারে যে, আপনার গবেষণাপত্রের মান তত ভাল নয় তাই এই হেনস্তা। কোনো গবেষণাপত্র কত ভাল না মন্দ তার বিচার হয় জার্নালে ছাপা হওয়ার সময়। কারণ ছাপার আগে “পিয়াররিভিউ”(peerreview) বা সেইবিষয়ে যাঁরা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত গবেষক তাঁদের দ্বারা পরীক্ষিত হয়।

কাজাখস্তানের এক যুবতী আলেক্সজান্দ্রার এলবাকয়ান (Alexandra Elbakyan) সায়েন্স হাবের স্রষ্ট্রা। তাঁর সঙ্কল্প হলো, যেকোনো মূল্যে গবেষকদের কাছে বিনাখরচে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গৃহীত এবং প্রকাশিত গবেষণাপত্র পৌঁছে দেওয়া। অনেক বাধা সত্ত্বেও সেই কাজে তিনি অনেকটা সফল হন। ২০১১ সাল থেকে সায়েন্স হাব কাজ শুরু করে। ২০১৯ সালে সায়েন্স হাবের কর্তাদের মতে প্রতিদিন প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ ওঁদের এই ছায়া গ্রন্থাগারের সাহায্য নেয়। ২০২০ সাল নাগাদ কেবল সায়েন্স হাবের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার প্রায় ৮.৫ কোটি গবেষণাপত্র পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।শুধু তাই নয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনি যত ভালভাবে এবং তাড়াতাড়ি গবেষণাপত্র সংগ্রহ (Download) করতে পারবেন পত্রিকাগুলির মূল সাইট থেকে অর্থের বিনিময়ে তত তাড়াতাড়ি পাবেননা। গড়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য এই পত্রিকাগুলির সদস্য চাঁদা ৩১.৫ ডলার অর্থাৎ কমবেশি ২৬০০ টাকা। ২০১৬ সালের একটা হিসাব বলছে যে, কেবল ভারতে গবেষকরা সাই-হাব থেকে প্রায় ৭০ লক্ষ গবেষণাপত্র বিনামূল্যে সংগ্রহ করেছেন, যার জন্য প্রায় ২৫ কোটি ডলার (প্রায় ১৮২৫ কোটি টাকা) দিতে হতো। এটা সহজে বোঝা যায় যে, গবেষণার জন্য এ দেশে কোনো গবেষক এই বিপুল পরিমাণে অর্থ বহন করতে পারবেন না। যদিও কিছু বড়ো বড়ো গবেষণা সংস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে এই পত্রিকাগুলির সদস্যপদ নিয়ে নিজেদের গবেষকদের প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেশের আমগবেষকদের পক্ষে এই সুবিধা পাওয়া সম্ভব নয়।

নতুন বিজ্ঞান নীতি (STIP) এবং মুক্ত বিজ্ঞানের গল্প

ভারত সরকার গত ২০২০-র ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে একটি নতুন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী নীতি ঘোষণা করেছে। এই নীতির প্রথম অধ্যায়ের (Chapter 1: Open Science) একদম প্রথম ছত্রে (Priority Issues) মুক্ত বিজ্ঞানের ধারণা নিয়ে কিছু নতুন কথা বলা আছে।এখানে বলা হয়েছে - “To promote open science, the public will have the right to access all outputs from research funded by the central government or the state governments, either directly or through funding agencies, or institutions supported by the central government or the state governments (hereinafter referred to as “publicly funded research”). The right to access will include, but not be limited to, scholarly publications, research dataand resources such as research infrastructures, instruments, computing facilities, libraries, learning spaces, etc.”। অতীব সুন্দর এই ভাষ্য আমাদের এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়; কারণ ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে হতে বাধ্য যে, একজন গবেষক অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডারের মধ্যে বসে আছেন এবং সমস্তটাই তাঁর আহরণের জন্য। কিন্তু তাঁর জন্য কেবল কেন্দ্র বা রাজ্যসরকারের অনুদানপ্রাপ্ত গবেষণাগুলির ফল যা গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হবে সেগুলি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং সঙ্গে থাকবে গবেষণা পরিকাঠামো যেমন গবেষণাগার, কম্পিউটার, গ্রন্থাগার ইত্যাদি।

বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে এখানে কয়েকটি প্রশ্ন মনে আসে। আমাদের মতো আমজনতা যারা এদেশের গবেষণা পরিকাঠামো যেমন গবেষণাগার, কম্পিউটার, গ্রন্থাগার ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুটা অবগত তারা জানি যে,
- প্রথমত, সরকারি গবেষণা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সেই প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের চাহিদা পুরণ করতে সক্ষম নয়, সেখানে অন্যদের প্রবেশাধিকার কী করে সম্ভব? এখনও বেশ কিছু সরকারি গবেষণাগারে অনুমতিক্রমে এবং কোথাও অর্থের বিনিময়ে সেই প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো ব্যবহার করা যায়। এবার তা কী অনুমতির ঝকমারি ছাড়া বিনাপয়সায় পাওয়া যাবে? কিন্তু তাহলে যে চাপ গবেষণাগারগুলির উপর পড়বে তা সামলানো কখনই সম্ভব হবেনা। আমদের দেশে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এমন অনেক ছাত্র এবং শিক্ষক-গবেষক আছেন যাঁরা গবেষণা পরিকাঠামোর অভাবে পর-মুখাপেক্ষি হয়ে থাকেন।

- দ্বিতীয়ত, সরকারি উদ্যোগে এই দেশের গবেষকদের গবেষণাপত্র কোনো আন্তর্জাতিক পত্রিকায় (ধরে নিতে পারেন যে, ইদানীংকালে সমস্ত উন্নতমানের বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা উপরে উল্লেখিত কোনো না কোনো বহুজাতিকের সঙ্গে যুক্ত) ছাপা হলে সেই গবেষণাপত্র কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে সবার গোচরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর অর্থ হলো, সরকারি গবেষণাসংস্থাগুলিতে যাঁরা গবেষণা করেন হয় তাঁরা উন্নতমানের পত্রিকায় ছাপবেন না, না’হয় সরকারি উদ্যোগে এই পত্রিকাগুলির সদস্যপদ গ্রহণ করতে হবে। যেভাবে গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগ কমছে এবং নতুন এসটিআইপি নীতিতে কোথাও ব্যয়বৃদ্ধির কোনো উল্লেখ নেই তাই পরের সম্ভাবনার কোনো আশাও নেই।

২৪ ডিসেম্বরের শুনানিতে আদালত বিবাদী ওয়েবসাইটগুলি থেকে অভিযুক্তকারী লিঙ্কগুলি সরাতে অস্বীকার করে এবং বলে যে, যেহেতু ২০১১সাল থেকে এই লিঙ্কগুলি কাজ করছে তাই এখনই বন্ধ করার দরকার নেই। তবে সাথেসাথে এই আদেশ দিয়েছে যে, ‘‘কোনো নতুন নিবন্ধ বা প্রকাশনা, যেখানে বিবাদীদের কপিরাইট নেই, আপলোড করা যাবে না’’। একটি খবর এখানে পরিবেশন করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে এই সুবিধা বন্ধ করার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেমন আমেরিকায় দু’বার এই লিঙ্কগুলি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আরও কয়েকটি দেশেও তাই, কিন্তু সাই-হাব নতুন লিঙ্ক তৈরি করে পৃথিবীর জ্ঞানপিপাসু গবেষকদের পাশে দাঁড়িয়ে যায়।

১৯৪৮ সালে মানবাধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘোষণায় (Universal Declaration of Human Rights) জ্ঞানের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০২ সালে বুদাপেস্ট মুক্ত জ্ঞান ঘোষণায় (Budapest Open Access Declaration) সারা বিশ্বের গবেষকদের জন্য বিনা খরচে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গবেষণাপত্র পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার দাবি তোলা হয়। দুঃখের বিষয় হলো, পৃথিবীতে যত গবেষণাপত্র ছাপা হয় তার মাত্র ২০ শতাংশ বিনাখরচে (open access articles) গবেষকরা দেখতে পান।

ধরা যাক, কলকাতা শহর যেখানে নাই নাই করে ছোটো বড়ো ২০ টি নাচারাল সায়েন্স এবং সোশ্যাল সায়েন্স-এর বিভিন্ন ধারার কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ৫ শতাংশেরও কম গবেষক এই গবেষণাগারগুলিতে প্রবেশের সুযোগ পান। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নন এমন কোনো গবেষক বা বিজ্ঞান প্রচারের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি কলকাতার দূষণ নিয়ে কোনো কাজ করতে চায় তা’হলে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো গবেষণাগারের গবেষণা পরিকাঠামো ব্যবহারের কোনো সুযোগ তাদের নেই বললেই চলে। তাই বলি, গবেষণার সুযোগ তৈরি না’করে নতুন বিজ্ঞাননীতিতে “মুক্ত বিজ্ঞান”-এর প্রতিশ্রুতি শুধু ‘গপ্প’ নয় ‘গালগপ্প’। দেশের বিজ্ঞান আন্দোলন সংগঠনগুলির সর্ববৃহৎ নেটওয়ার্ক অল ইন্ডিয়া পিপলস সায়েন্স নেটওয়ার্ক (এআইপিএসএন) একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, যদি এদেশে সাই-হাব এবং লিবজেন-কে নিষিদ্ধ করা হয় তা’হলে ওদের যে ক্ষতি হবে তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হবে এদেশের গবেষকদের। তাই জ্ঞানের একচেটিয়া দখলদারি বন্ধ করতে হবে।