৫৮ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৫ মার্চ, ২০২১ / ২০ ফাল্গুন, ১৪২৭
জনকল্লোলিত ব্রিগেডে ঘোষিত হলো রাজ্যে নতুন দিন গড়ার দুরন্ত প্রত্যয়
জনতরঙ্গে উত্তাল ব্রিগেড ছড়িয়ে দিল প্রত্যয়ী বার্তা - সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং স্বৈরতন্ত্রী তৃণমূলকে পরাস্ত করে পরিবর্তন আনবে সংযুক্ত মোর্চা। তৃণমূলের শাসনের দুঃসহ কালযাপনের নিদারুণ অভিজ্ঞতাকে দূরে ঠেলে শান্তি-সমৃদ্ধির নতুন বাংলা গড়ার দুরন্ত শপথ বাঙ্ময় হলো ২৮ ফেব্রুয়ারির জনকল্লোলিত ব্রিগেডে। এদিন বাংলার প্রতিটি গ্রাম-শহর-মাঠ-পাথার-বন্দরের লাখো লাখো মানুষের দৃপ্ত উপস্থিতি জানান দিল,বাংলার রাজনীতিতে বিকোনো মিডিয়ার কল্পিত ভাষ্যে তৃণমূল-বিজেপি - কেবল এই দু’টি দলের দ্বৈরথ নয়, এই দুই দলকে পিছনে ফেলে স্পর্ধিত-দুর্বার শক্তি হিসেবে বিরাজ করবে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জোট সংযুক্ত মোর্চা। এই মোর্চাই বাংলার বুকে বিকল্প প্রতিষ্ঠা করবে। এদিন ব্রিগেড ময়দানের সবুজ প্রান্তরকে ঢেকে দিয়ে রক্ত পতাকার রঙিন উদ্ভাস, সেই সঙ্গে আরও রঙ-বেরঙের পতাকার রঙ মিলে মিশে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের চিরন্তন আবহ রচনা করেছিল। যা বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিকল্প গড়ার সম্ভাবনাকেই মূর্ত করেছে।
প্রায় মাস দুয়েক ধরে রাজ্য জুড়ে প্রচার চলেছে এই ব্রিগেড সমাবেশের। একদিকে কেন্দ্রের উগ্র সাম্প্রদায়িক-জনবিরোধী নীতি, অন্যদিকে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী নীতি, মানুষের অধিকার হরণ, সীমাহীন দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি এবং সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থের অপচয় করে গরিব সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার মতো নানা অপরাধ-অপকীর্তিকে তুলে ধরে নিবিড় প্রচার সংগঠিত করেছে সিপিআই (এম)সহ বামফ্রন্টের বিভিন্ন শরিক দল, সঙ্গে কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। সেই লক্ষ্য নিয়েই রাজ্যের নানা প্রান্তে অসংখ্য সভা-বৈঠক-সমাবেশ এবং যৌথ মিছিলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হচ্ছিল ২৮-এর জনকল্লোলিত ব্রিগেড রূপ নেবে এক অভূতপূর্ব সমাবেশের। ব্রিগেডের সেই কূলছাপানো দৃপ্ত রূপই এদিন প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্য তথা দেশের মানুষ।
ব্রিগেড অভিমুখী লড়াকু জনতার ঢল নেমেছিল আগের রাতেই। উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণবঙ্গের দূরবর্তী অঞ্চলের অগণিত মানুষ এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন ব্রিগেডের অস্থায়ী তাঁবুতে ও অন্যান্য জায়গায়। ২৮-এর সকাল থেকেই কলকাতা মহানগরীর রাজপথ দখল নিয়েছিল রক্তপতাকারঞ্জিত মিছিলে সহস্র-অজুত প্রত্যয়-দীপ্ত মানুষ। তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে কংগ্রেস ও সাদা-সবুজ-নীল পতাকা নিয়ে আইএসএফ’র বিপুল অংশের কর্মী-সমর্থকও এসেছিলেন নতুন বাংলা গড়ার অঙ্গীকারে।
সমাবেশ শুরুর সময় নির্দিষ্ট ছিল বেলা ১টা। তার অনেক আগে থেকেই ব্রিগেড প্রান্তর ঢাকা পড়েছিল উদ্বেলিত জনতার সমারোহে। তখন রক্তপতাকা সহ আরও নানা বর্ণের আন্দোলিত পতাকা,তারসাথে লক্ষ-অযুত কণ্ঠে দৃপ্ত স্লোগান মিলে রচনা করেছিল মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নতুন সূচনার। এদিন মানুষ এসেছিলেন ট্রেনে-বাসে নানা যানবাহনে। কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষ এসেছিলেন মিছিলে রাজপথ কাঁপিয়ে। মিছিলে দেখা গেছে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর সহ শ্রমজীবীরা, ছিলেন ছাত্র-যুব-মহিলা-কর্মচারী। তবে এদিন সব কিছু ছাপিয়ে মিছিলে-ব্রিগেডে যুব-ছাত্রদের উত্তাল তরঙ্গ স্পষ্ট করে দিয়েছে আগামী দিনের লড়াইয়ে, দিনবদলের অভিযানে অগ্রপথিক হবেন তারাই।
এদিনের এই নজিরবিহীন সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন মোর্চার বিভিন্ন শরিক দলের সর্বভারতীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব। সভাপতিত্ব করেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও সংসদে বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরী, আইএসএফ নেতা আব্বাস সিদ্দিকি, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম, সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি এবং রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সিপিআই (এম) রাজ্য কমিটির সদস্য দেবলীনা হেমব্রম। নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে উঠে এসেছে আগামী নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি-কে পরাস্ত করাই শুধু নয়, মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রাম, গণতন্ত্র রক্ষা ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম সর্বোপরি দেশ রক্ষার লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চা।
বর্তমানের এই কঠিনকাল উত্তরণে বামপন্থী সহ সহযোগী গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির যে লড়াই, তার প্রতি সংহতি জানাতে এদিন জলপ্লাবিত ব্রিগেডের অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হতে উপস্থিত হয়েছিলেন সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজনেরা। উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার,কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, নাট্যকার চন্দন সেন, সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র, কবি মন্দাক্রান্তা সেন, অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী, বাদশা মৈত্র, দেবদূত ঘোষ, চন্দন সেন, শ্রীলেখা মিত্র, বিমল চক্রবর্তী, অসিত বসু, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়, উষসী চক্রবর্তী, সীমা মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয় দত্ত, সৌরভ পালোধী, জয়রাজ ভট্টাচার্য প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী কাজী কামাল নাসের, গণনাট্য শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, গোপাল অধিকারী সহ ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোক সংস্কৃতি সঙ্ঘ, ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ ও জনবাদী লেখক সঙ্ঘের শিল্পীরা। শিল্পীদের কথায়-গানে-কবিতায়-নৃত্যের মধ্য দিয়েও এদিন বাঙ্ময় হয়েছে অপশক্তির দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন দিন গড়ার দুরন্ত প্রত্যয়। সব মিলিয়ে ২৮শের ব্রিগেড রচনা করেছে ইতিহাসের এক সমুজ্জ্বল অধ্যায়।