৫৮ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৫ মার্চ, ২০২১ / ২০ ফাল্গুন, ১৪২৭
নিপীড়িত শ্রেণি, সামাজিক অংশের মেলবন্ধনের লক্ষ্যেই সংযুক্ত মোর্চা
সূর্য মিশ্র
এরাজ্যের সংযুক্ত মোর্চাকে কেবল নির্বাচনী সংগ্রামের মধ্যে সীমিত করে না রেখে মানুষের জীবন-জীবিকা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণের মোকাবিলায় সুদূরপ্রসারী হাতিয়ার করতে চাইছেন বামপন্থী নেতৃবৃন্দ। মোর্চায় আইএসএফ’কে যুক্ত করা নিয়ে অপপ্রচারের বিরোধিতা করে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, নিপীড়িত বঞ্চিত সব শ্রেণি ও সামাজিক শক্তিগুলির মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে লড়াইয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটাই আগামীদিনে বিপদকে রোখার পথ।
ব্রিগেডে সংযুক্ত মোর্চার বিশাল সমাবেশ দেখে সব হিসাব গণ্ডগোল হয়ে গেছে তৃণমূল এবং বিজেপি’র। রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তারা নানারকমের অপপ্রচার শুরু করেছে। ভোটে জেতার জন্য বামপন্থীরা হাত মিলিয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে, এমন কথাও প্রচার করা হচ্ছে সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্রকে এই সম্পর্কে প্রশ্ন করায় বুধবার তিনি বলেছেন, ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি নয়। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির থেকে ভিন্ন। ওদের ঘোষণাপত্রে আদিবাসী, তফশিলি জাতি, অন্যান্য অনগ্রসর অংশ, সংখ্যালঘু এবং বর্ণহিন্দু সহ সবার কথা রয়েছে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সুফি ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধনের কথা বলেছে তারা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ তো ধর্মাচরণের বিরোধিতা নয়, যে যার বিশ্বাস মতো ধর্মাচরণের অধিকার সংবিধান দিয়েছে, তাকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
বামপন্থীরা তাঁদের আদর্শের থেকে বিচ্যুত হয়েছে এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মিশ্র দাবি করেছেন যে, বামপন্থীরা এরাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছে সংযুক্ত মোর্চা গঠনের মাধ্যমে। কেন্দ্রে বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূল সরকার গঠিত হওয়ার পরে বাংলায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিপদের মোকাবিলা করে মানুষের ঐক্যগঠনের ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের তাগিদের কথা বলেছেন তিনি।
মিশ্রের কথায়, যখনই সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার বিপদ বাড়ে তখনই সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার বিপদকেও ডেকে আনে। আজকে দেশের সংখ্যালঘুরা যে বিপদের মধ্যে রয়েছেন স্বাধীনতার পরে কখনো এমন অবস্থা হয়নি। বামপন্থীরা দুই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেই অবিরাম সংগ্রামে ছিল এবং আছে। সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে যে কোনো দেশেই সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা বেশি বিপজ্জনক। যেমন ভারতে হিন্দুত্ববাদী এবং বাংলাদেশে ইসলামিক সাম্প্রদায়িক শক্তি। কিন্তু এই দু’য়ের মধ্যে যোগসূত্রও থাকে, যেমন স্বাধীনতার আগে মুসলিম লিগ এবং হিন্দু মহাসভার মধ্যে ছিল। তারা একসঙ্গে বাংলা সহ কিছু প্রদেশে মন্ত্রীসভাও চালিয়েছিল, একসঙ্গে দেশভাগও চেয়েছিল। এখন আবার এই দুই সাম্প্রদায়িক শক্তির মেরুকরণের বিপদ দেখা যাচ্ছে, এই মেরুকরণ না হলে বিহারের নির্বাচনে আরও অনেক ভালো ফলাফল হতে পারত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যদি এমন মেরুকরণ সফল হয় তাহলে আমাদের প্রাকস্বাধীনতা যুগের দেশভাগ ও দাঙ্গার পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে হবে। অন্ধকার ফিরে আসবে। তাই আমরা বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধী সব ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।
এই প্রসঙ্গে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি’কে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন ধাক্কা দিতে সফল হয়েছে তার উদাহরণ দিয়ে মিশ্র বলেছেন, সাম্প্রতিককালে শ্রমিক কৃষকদের ওপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ দেখিয়ে দিচ্ছে শ্রেণি ও সামাজিক শক্তিগুলোকে সংহত করা সম্ভব। সংযুক্ত কিষান মোর্চার আন্দোলন, ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘট আন্দোলন, এসবের ফলে বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে। বিহারের নির্বাচনে কিংবা বিভিন্ন রাজ্যের পঞ্চায়েত পৌরসভার নির্বাচনী ফলাফলই তার প্রমাণ।
পশ্চিমবঙ্গে শ্রেণি ও সামাজিক শক্তিগুলোর এই ঐক্যগঠনের প্রয়াস হিসাবেই তিনি সংযুক্ত মোর্চার উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদী সরকার তৈরি হওয়ার পরে মানুষের জীবন-জীবিকা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরে আক্রমণ ক্রমশ বেড়েছে। ২০১৬ সালে এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সময় বামপন্থীরা কংগ্রেসের সঙ্গে আসন বোঝাপড়া করলেও তার মধ্যে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি থাকায় সফল হয়নি। বিজেপি এবং তৃণমূল ভবানীপুর সহ বেশ কিছু আসনে পরস্পর ভোট ট্রান্সফার করেছিল। কিন্তু আমরা বামপন্থীরা নির্বাচনে সফল না হলেও বিজেপি’র বিপদকে অনেকাংশে প্রতিহত করতে পেরেছিলাম। না হলে বিজেপি তখনই রাজ্যে দ্বিতীয় শক্তি হয়ে যেত। তারপরে রাজ্য সরকারের ছত্রছায়ায় বিজেপি বেড়েছে, সঙ্ঘ পরিবার প্রসারিত হয়েছে। তৃণমূলের শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মানুষের মধ্যে মেরুকরণ হয়েছে। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিকল্প তুলে ধরা যায়নি। বিজেপি’র উত্থানে সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘুরা অনেকেই বাধ্য হয়ে তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন। আবার আদিবাসী, তফশিলি ও অন্যান্য অনগ্রসরদের একাংশ বিজেপি’র দিকে চলে গিয়েছিল।
মিশ্র বলেন, এটাই তো বিপদ। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ৫১ শতাংশই হলো আদিবাসী, তফশিলি, অন্যান্য অনগ্রসর এবং সংখ্যালঘু অংশের মানুষ। এরাই রাজ্যের দরিদ্র অংশের ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ এরাই মেহনতি অংশ। এই মেহনতি অংশের ঐক্যে ভাঙন ধরানোই তো বিপদ। বামপন্থীরা বরাবরই শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একসূত্রে বেঁধে লড়াই করেছে। এখনও জীবন-জীবিকা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরে আক্রমণের মোকাবিলায় শ্রেণি ও সামাজিক শক্তিগুলোর ঐক্য গড়ে তোলাই একমাত্র পথ। এটাই এই সময়ে বামপন্থীদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। পশ্চিমবঙ্গে সংযুক্ত মোর্চার কাজ কেবল নির্বাচনী সংগ্রামের মধ্যে সীমিত থাকবে না, তা সুদূরপ্রসারী হবে। শ্রেণি ও সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে।
কোনো কোনো মহলের তরফে বলা হচ্ছে আইএসএফ’কে সঙ্গে নেওয়ায় উলটোদিকে বিজেপি’র সুবিধা হতে পারে। সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়ে হিন্দুদের নিজেদের পক্ষে সংহত করতে সুবিধা হয়ে যাবে তাদের। এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে মিশ্র বলেছেন, ভুল ধারণা। শ্রেণি ও সামাজিক শক্তিগুলোর ঐক্য প্রয়াসে ওরা ইতিমধ্যেই সমস্যায় পড়েছে। সংযুক্ত মোর্চা যে সব দাবিতে লড়ছে সেগুলো তো হিন্দুদেরও দাবি, হিন্দুরাও তো মুসলিমদের মতোই সমানভাবে আক্রান্ত। তাঁদের জীবন-জীবিকাও বিপন্ন। পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ সব জায়গার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলির অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিচ্ছে সবাইকে যদি ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ করা যায় তাহলে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গেও সম্ভব।
মিশ্রের প্রত্যয়ী জবাব, মোদী-যোগী আগে গুজরাট উত্তর প্রদেশ সামলাক। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইতেই ওরা আটকে যাবে।