৫৮ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৫ মার্চ, ২০২১ / ২০ ফাল্গুন, ১৪২৭
অহল্যা থেকে আনোয়ারাদের প্রতিস্পর্ধা
গীতশ্রী সরকার
আগের দিন রাতে গ্রাম থেকে বেরিয়েছেন সঙ্গে একটু মুড়ি, অসহ্য রোদে মঞ্চের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে থাকলেও আজও বছর সত্তরের বৃদ্ধার কানটা সজাগ হয়ে পড়ে আছে মঞ্চেই। ভোর ছ’টায় বাবা-মায়ের সাথে রওনা দেওয়া কলেজ ছাত্রী থেকে কোলে বাচ্চা নিয়ে দীর্ঘ পথ হেটে আসা মা - সকলের মিলনক্ষেত্র - ব্রিগেড প্যারেড ময়দান। রাজ্যজুড়ে ‘‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’’ পোস্টারে যখন ছেয়ে গেছে, তখন বাংলার সত্যিকারের মেয়েরা জবাব দিতে পা মেলালেন ব্রিগেডের প্রচার থেকে মিছিল, মঞ্চ থেকে সমাবেশের মাঠ। বাংলার এক মেয়েকে যখন ‘পোস্টার গার্ল’ হয়ে নিজের ‘বাংলার মেয়ে’-র পরিচয় দিতে হচ্ছে কোটি টাকা খরচ করে, তখন কী বলছে এই বাংলার মেয়েরা। সভ্যতার আদিম কাহিনি মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে কৃষিকাজের গুরত্বের কথা যেমন বলে, তেমনি বলে দিয়ে যায় তার পেছনে মেয়েদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথাও। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আমলে কৃষক আত্মহত্যা করলে তা ‘বাংলার মেয়ের’ চোখে ‘পার্সোনাল ম্যাটার’ বা ‘পেটি ম্যাটার্স’। অন্যদিকে প্রতিদিন মাটির সোঁদা গন্ধে অভিষিক্ত হওয়া মেয়ের কথায় উঠে এলো অঘ্রান মাসে ধান কাটা থেকে সাজানো ধান খেতে গর্তে ঢোকা ইঁদুরের কথাও। মাটির গন্ধ মাখা উদাহরণ ঝরে পড়ে ব্রিগেডে - ধান খাওয়া ইঁদুর আর তৃণমূল মিলে যায় অবলীলায়।
২০১১ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হওয়া, পরিবর্তন, বদল, গণতন্ত্রের মিথ্যে ফানুস ওড়ানো তৃণমূলের আসল চেহারাটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি মানুষের। নারীনির্যাতন, শ্লীলতাহানি সম্পর্কে সরকারের নির্লজ্জতার স্বরূপ প্রকাশ পেতে দেরি হয়নি। নারী নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের প্রতি নরম মনোভাব, ধর্ষিতার জন্য ভাতা, পুলিশের রিপোর্ট লিখতে অনীহা, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ধর্ষিতার প্রতি উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, মন্তব্য - যে দর্শনের, যে ভাবনার উপস্থাপনা করেছিল, তা বুঝিয়ে দিয়েছিল সরকার চলবে গুন্ডারাজের-নৈরাজ্যের পিঠে ভর করেই। এই নৈরাজ্য রাজ্যজুড়ে যে ভয়ের পরিবেশ নির্মাণ করেছে তা আঘাত হেনেছে আমাদের সংস্কৃতিতে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ষাটোর্ধ্ব মহিলা চম্পাদি ব্রিগেড আসছেন অনেক দিন ধরে। কতদিন হিসেব করে বলতেও পারলেন না। বাড়ির কলেজ পড়ুয়া নাতনিকে আনবার শখ ছিল, কিন্তু ভরসা করে আনতে পারেননি। কীসের ভয় এই ব্রিগেডে! অসহায় অভিভাবক বলেন, ‘‘ভয় তো রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে। আমি কী ওকে দেখে রাখতে পারবো? রাস্তা-ঘাটে ওরা নোংরা মন্তব্য করে, কিছু বললে শোনে না, পুলিশও কিছু করে না।’’ রাস্তা-ঘাট মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয় - এই কথা যেন অবিরত বেজে চলেছে আজ পশ্চিমবঙ্গের অভিভাবক, প্রতিটি মানুষের কথায়। গ্রামের সেই মহিলা তো এমনই দিন দেখতে চেয়েছেন যেদিন নাতনিকে নিয়ে রাস্তায় বেরোতে আর ভয় লাগবে না; পশ্চিমবাংলার মানুষ আজ মেয়েদের জন্য সুস্থ সমাজ দেখতে চাইছেন। এমন একটা প্রশাসন দেখতে চাইছে যে ধর্ষিতাকে ভাতা বা ভিক্ষে নয়, ধর্ষককে শাস্তি দেবে। এই সামাজিক অসুস্থতা থেকে বাঁচতে, সুস্থতার সংস্কৃতিকে বাঁচাতেই তো কোচবিহার থেকে নানুর, ঝাড়গ্রাম থেকে কসবা - সবাই ছুটে এসেছেন ব্রিগেডে। ভালোবাসার ব্রিগেডে। ভরসার সমাবেশে।
একজন দোকান খুলে বসে বিধায়ক, মন্ত্রী বিক্রি করছেন; আরেকদল দিল্লিতে দোকান খুলে কয়লা, বিমা, রেল, ব্যাঙ্ক, বিমান সবই বেচে দিচ্ছে। বিগত দশ বছর বিরোধীদের চুপ করে থাকতে বলা নেত্রীর কাছে কাজ চাইতে গিয়ে যখন খুন হয়ে যায় মইদুল, আজও যখন নিখোঁজ দীপক পাঁজা, তখন উত্তর খুঁজতে ব্রিগেডে আসা কমরেডের ঝাঁঝালো কথার তেজ হার মানায় প্রচণ্ড ঝাঁঝালো রোদকেও। বীরভূম থেকে আসা কমরেডের কথায় - ‘‘আমার ছেলেটাও তো মইদুল হতে পারত।’’ বাংলার ঘরের মায়েরা ছেলের খুনীদের শাস্তির দাবিতে আজও রাস্তায় নামতে ভয় পায় না। এলাকার সন্ত্রাস, তৃণমূলের অত্যাচারকে থমকে দেওয়ার জন্য ওদের রাগী চোখগুলোই তো যথেষ্ট। নিজের বাড়ির গ্র্যাজুয়েট মেয়ের হাত ধরে ব্রিগেডে আসা মা তাই বলেন - ‘‘আমার আর কী, মেয়েটার জন্য আমাদের সময়টার মতো একটা দিন এনে দিতে হবে তো!’’ চাকরি, কারখানার দাবিতে এসএসসি, টেট-এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে চেপে রাখা রাগগুলো ঝড়ে পড়ল বারবার। তবে এই রাগ একবার ঝেড়ে দিলেই শেষ হয়ে যায় না। প্রতিটি রাগ জমাট বাঁধছে, বিস্ফোরণের জন্য।
উত্তরবঙ্গের কলেজ ছাত্রী অনন্যা, দু’দিন বাদে অনলাইন পরীক্ষা, তাও ব্রিগেডে এসেছে। পরীক্ষা, পড়া নেই বুঝি! তার দৃপ্ত জবাব - ‘‘দিদি, অনলাইনে পড়া এমনি ঘোড়ার ডিম হচ্ছে, তারপর তো চাকরির এই দশা। কলেজে কোনো ইউনিয়ন নেই।’’ বাবার কাছে গল্প শুনেছে বাম আমলের ছাত্র রাজনীতির। এখনকার ছবি দেখে পুরনো দিন ওর কাছে ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথার গল্প বলেই মনে হয়। তবু ব্রিগেডের মাঠের কথা, নেতৃত্বের কথা, ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়েই ফিরবে বাড়ি। ছড়িয়ে দেবে বার্তা বেঞ্চ থেকে বেঞ্চে বা হয়তো কোনো সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপেই। দু’দিন আগেও মায়ের মিছিল মিটিং করতে যাওয়ায় নাক সিটকানো সদ্য কলেজে ওঠা মেয়েটা আজ নিজেই বন্ধুদের সাথে ব্রিগেডে এসেছে। নিজের জীবন দিয়ে আজ বুঝছে বামপথেই সংগ্রাম। দাঙ্গাবাজ-গুন্ডাবাজের বাংলা না সোনার বাংলা-ই আজ তাই মঞ্জিল।
হাওড়ার গ্রাম থেকে প্রভাদি তো বলেই ফেললেন, ‘‘দেখুন ধর্ম তো মানি, বাড়িতে পুজো দেই। কিন্তু এই মমতা-মোদী মিলে ভোটের জন্য মানুষকে খ্যাপাচ্ছে’’। পুজো দিতে একদিন দেরি হলেও অসুবিধা নেই, কিন্তু পাড়ায় কারো অসুবিধায় উনি সবার আগে। এটাই তো আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম-বিশ্বাস আর মানুষকে ভালোবাসার মাঝে তো তলোয়ার-হুঙ্কার-রামের নামে খুন-রক্ত কিছুই ছিল না। আমাদের সংস্কৃতির পরশ গায়ে মেখেই, বৈচিত্র্যের ওড়না জড়িয়েই তো চিনতে হবে দেশকে-রাজ্যকে, আমাদের চারপাশটাকে। বাংলার এক মেয়ে যখন দাঙ্গা বয়ে আনছে তখন উলটোদিকের হাজার মেয়েরা ঐক্যের সংস্কৃতিকে বুকে জড়িয়েই আগামীকে গড়ছে।
সমাজবিজ্ঞানের কথায় যে কোনো সমাজের গঠনে, প্রতিপালনে, তার ঐতিহ্য-সংস্কৃতির নির্মাণে মেয়েদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ব্রিগেডের ময়দান থেকে পাড়া-মহল্লা জুড়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ, সুদৃঢ় প্রতিটা কথা জানান দিয়ে যায় এক কন্যে যতই ধ্বংস করুক আরও হাজারো কন্যে আজও বুকে আগলেই আমাদের চারপাশটাকে গড়বে, যত্ন করবে। গুন্ডাহীন কলেজ ক্যাম্পাসের দাবিতে, পাড়ায় সুস্থভাবে চলার অধিকার পেতে, চাকরির দাবিতে, দুর্নীতিমুক্ত পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন থেকে মিছিল হয়ে সমাবেশ - মেয়েরাও সামনের সারিতে থেকেই লড়ছে কাকদ্বীপ থেকে কুশমুণ্ডি, বেলদা থেকে বেহালা।
নিজের জন্মদিনের উপহার হিসেবে সদ্য ১৮’র মেয়েটা বাবা মায়ের কাছে আবদার করে ব্রিগেড যাওয়ার; তখন বোঝা যায় ওরা যতই অপপ্রচার করুক, ব্রিগেডের বার্তা-লড়াইয়ের বার্তা কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটা মানুষের হাত ধরেই। এবার কেবল ‘না’ বলাই যথেষ্ট নয়, বিকল্পের বার্তা - ভবিষ্যতের সুস্থ বাংলা গড়ার অঙ্গীকার নিয়েই ফিরে গেলেন গোঘাটের লালপুরের আনোয়ারা-রা। আগের ব্রিগেড থেকে ফিরে গিয়ে মার খেয়েছিলেন তৃণমূলের হাতে, ভোট দিতে পারেন নি, তারপরও আবার লালঝান্ডা কাঁধে ব্রিগেডে এসেছেন। ভাত-কাজের-শিক্ষার দাবিকে যারা ভুলিয়ে দিয়ে জাত-পাতের আর দল বদলের রাজনীতি করছেন তাদের বিরুদ্ধে দিন বদলের বার্তা নিয়েই আনোয়ারা-রা বলছে, ‘‘এবার মারতে এলে আর মার খাব না। দেবলীনাদিরা বলেছেন - ‘ছাড়বক নাই’। এবার মারতে এলে ওদেরও মারতে প্রস্তুত আছি।’’ কাকদ্বীপে মরে তেলেঙ্গানায় বেঁচে ওঠা অহল্যা থেকে আনোয়ারা, ছবি মাহাতো থেকে সুজেটদের দৃপ্ত-দৃঢ় প্রতিরোধ-ই ভবিষ্যৎ। তাই ভবিষ্যৎ আমাদের।