৫৮ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৫ মার্চ, ২০২১ / ২০ ফাল্গুন, ১৪২৭
ব্রিগেডের মাঠে ‘আমি’রা হলো ‘আমরা সবাই’
সৌম্যজিৎ রজক
ব্রিগেডের ঐতিহাসিক সমাবেশ শেষ হওয়ার প্রায় ৩২ ঘণ্টা পরে লিখতে বসেছি এই প্রতিবেদন। সুজয়ের এখনও মনখারাপ।
বাড়ির যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, একটা না একটা কাজে ঢুকে পড়তেই হবে এক্ষুনি। যেমন তেমন হোক! ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে খেপ খাটা, জুটে গেলে কখনো কখনো অতি সামান্য কিছু অভিনয়ের কাজ, যখন যেমন পাওয়া যাচ্ছে দু’টো পয়সা ইনকাম! এভাবে তো পাকাপাকি চলতে পারে না। ঘরে ঠাকুমার চিকিৎসার খরচ বাড়ছে, বাড়ছে বিদ্যুৎ-গ্যাস-তেলের দাম, সংসার খরচ। কমছে বাবার আয়। সরকার যমের দুয়ারে। সুজয়ের পাশে নেই। যদিও সে জানে, বেকারত্বের এই যন্ত্রণা, এই নিরাপত্তাহীন জীবন, অভাব শুধু তাকেই তাড়া করে ফিরছে না। ঘরে ঘরে সুজয়ের মতো বেরোজগার ছেলেমেয়ে ডুকরে মরছে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্যা ফ্যা করে। খুব ইচ্ছে ছিল ফেব্রুয়ারির শেষ রোববার ব্রিগেডের মাঠে নিজের মতন আরও লাখো যুবক-যুবতীর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর। বাধ সাধল বেকারত্বই। ঘটনাচক্রে সেইদিনই পড়ে গিয়েছিল ইন্টারভিউয়ের ডেট। বেসরকারি এক সংস্থায়। যেতে পারেনি, সুজয়ের এখনও তাই মনখারাপ।
ব্রিগেডের ঐতিহাসিক সমাবেশের প্রায় ৩২ ঘণ্টা পরেও উত্তেজনা কমছে না ফারুকের। একটি বেসরকারি এজেন্সিতে সেলসের কাজ ছিল তার। মাস গেলে ১০,৫০০ টাকা মাইনে। লকডাউনে কাজ গেছে। গত দেড় মাস হলো, কাজ একটা জুটেছে কোনোমতে। অন্য একটি এজেন্সিতে সেই একই কাজ, সেলসের। কিন্তু মাইনে এবারে দেড় হাজার টাকা কম। বাধ্য হয়েই বস্তির মুখে টেবল পেতে সন্ধেবেলা চা, বিস্কুট বিক্কিরি শুরু করেছে সে। ফারুক সেদিন যখন বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে পৌঁছেছে, দক্ষিণ দিক থেকে তখন এসে মিশেছে আরেকটি মিছিল। জনসাগরের মোহনায় দাঁড়িয়ে চোখে ঘোর ঘনিয়েছে লাল পতাকার সারি। ব্রিগেডের মাঠে পুরনো অনেক বন্ধুর সাথে যেমন দেখা, তেমনই আলাপ হয়েছে নতুন মানুষের সাথেও। মানুষ নতুন, তবু কী আশ্চর্য, ফারুক দেখেছে যন্ত্রণা এক, অভিন্ন। সে কথাই বলছিল, “আমি একা নই। এই দিক্কৎটা আমার একার নয়। আরও কতজনের। বিরগেডের মাঠে যেন সবার তকলিফ মিশে গেল আমার তকলিফে। ওই কয়েক ঘণ্টা, কী করে বুঝতে পারছি না, ব্যথাটা উবে গেল যেন!”
দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর থেকে জৈনুদ্দিন আলি তো এসে পৌঁছেছিলেন আগের রাতেই। সুদূর বীরভূম থেকে আসা মানুষগুলো যখন মিছিল করে ঢুকছেন মাঠে, গাছের তলায় দাঁড়িয়ে জৈনুদ্দিন সেই দিকে তাকিয়ে ছিলেন অপলক। শিবুর সাথে জৈনুদ্দিনের আলাপ হয়েছে মাঠেই। এরকম তো প্রতিবারই হয়, তবে এবারে বাড়তি উপাদান ছিল সংহতির।
২৮ ফেব্রুয়ারি, তখন মঞ্চে গণআন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা বিমান বসু বলছেন, “একদিকে বিজেপি তৃণমূল, আরেকদিকে আমরা সবাই”। সেই মুহূর্তে মাঠের আনাচে কানাচে, এমনকি মাঠে ঢুকতে না পেরে ভিক্টোরিয়া, রেস কোর্সের সামনের রাস্তা, প্ল্যানেটোরিয়াম, অ্যাকাডেমির সামনে দাঁড়ানো লাখো লাখো মানুষ কেউই একা নেই আর। প্রত্যেকের ব্যথা মিশে গেছে সকলের যন্ত্রণায়। সকলের সংগ্রামে শামিল হয়েছে প্রত্যেকজনের টুকরো টুকরো লড়াইগুলো। অসংখ্য ‘আমি’রা হয়ে উঠেছে ‘আমরা সবাই’। হয়েছে একাত্ম।
২৮ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশ এই একাত্মতারই মহাসমাবেশ। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহেই এক মাইল ফলক।
বহু সংগ্রামের অভিজ্ঞতালব্ধ এই ব্রিগেড ময়দান দেখেছে লাল পতাকার গালিচা। শুনেছে শ্রেণি আন্দোলনের দুর্বার আহ্বান। সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষকে সেই সংগ্রামে শামিল করে নেওয়ার আন্তরিক ডাকও সে শুনেছে আগে। কিন্তু এত স্পষ্ট আর জোরালো আর তীক্ষ্ণ এবং বলিষ্ঠ ভঙ্গিমায় রুটি-রুজির লড়াই ও সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রামকে একাত্ম হতে কি দেখেছে কখনও?
কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদল, দুই চরম দক্ষিণপন্থী-প্রতিক্রিয়াশীল দল যখন বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে তীব্র করেছে ভেদ-বিভেদের মেরুকরণ; ঠিক তখনই অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে শোষিত-দলিত-নিপীড়িত জনতার অভূতপূর্ব ঐক্যের নজির গড়েছে ব্রিগেড সমাবেশ। বিকল্পের ব্রিগেড সমাবেশ।
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের ডাক তো আছেই। বিকল্প প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিজয় অর্জনের আহ্বান তো আছেই। ২০২১ সালের ব্রিগেড সমাবেশে আছে তারচেয়েও গভীরতর এক ব্যঞ্জনা। আছে বার্তা - হিন্দুত্ববাদী-মনুবাদী-ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের চোখে চোখ রেখে প্রতিরোধের। মজুর-চাষি-খেতমজুর-খেটেখাওয়া-গরিব-বেকার-আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘু-মহিলা-প্রান্তিকায়িত যৌন পরিচিতির মানুষের এক সার্বিক সংগ্রামী ঐক্যের বার্তা।
২৮ তারিখ ব্রিগেডের মাঠ থেকে যে বার্তা নিয়েই ফিরে গেছেন বাঁকুড়ার বুধন, মালদার তাসলিমারা। যে বার্তা ভয়াবহ কাঁপন ধরিয়েছে শাসককুলের বুকে।
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে একত্রিত হতে প্রস্তুত ‘আমরা সবাই’।