E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৫ মার্চ, ২০২১ / ২০ ফাল্গুন, ১৪২৭

শপথের ব্রিগেডঃ নতুন সূর্যোদয়ের পথ

সৌম্যদীপ রাহা


গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাক্ষী থাকলাম এক ঐতিহাসিক ব্রিগেড সমাবেশের। কুয়াশা কাটতে বেশ একটু দেরি হয়েছিল রবিবার। মাঝে মাঝে সূর্য উঁকি মারছিল ঠিকই; ইঙ্গিত দেখে বোঝা যাচ্ছিল, যত বেলা বাড়বে তত সে তার সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে প্রকাশিত হবে। সত্যিই তাই হয়েছিল। এদিকে লোকাল ট্রেনের টিকিটের লাইনেও বেশ ভিড়। যদিও ছুটির দিন, তবুও আজ ভিড় হওয়ার একটা কারণ আছে। সবারই গন্তব্য স্থল এক, আমার-ই মতো ব্রিগেড। কেউ রিকশা-ভ্যা ন চালক, কেউ অটো-টোটো চালক, কেউ জোগাড় খাটা মজুর, দাম না পাওয়া কৃষক থেকে শুরু করে খুচরো ব্যছবসায়ী, কেউ কেউ গৃহপরিচারিকার কাজের সাথে যুক্ত, আবার এঁদের সাথেই আছে সদ্য পাশ করা অজস্র ছেলে-মেয়ে। কেউ অনিশ্চয়তার কাজের সাথে যুক্ত আবার কেউ কেউ চাকরি পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির শিকার হয়েছিল এতদিন। সবার-ই মনে ক্ষোভ, দু’চোখে জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জেনেছেন একমাত্র বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিই পারবে তাঁদের মাথা তুলে দাঁড় করাতে।

যথারীতি সঠিক সময়ে স্টেশনে ট্রেন আসাতেই আবেগে বা উৎসাহে যাই বলি না কেন এক স্বতঃস্ফূর্ততায় গোটা ট্রেন যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল একটু সময়ের মধ্যেই। ট্রেন যখন স্টেশনকে বিদায় জানাচ্ছিল মুহুর্মুহু দৃপ্ত কণ্ঠে উঠছিল স্লোগান। মানুষের জাগরণের কণ্ঠ যান্ত্রিকতাকে বা বলা ভালো ট্রেনের হর্নকেও ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সে কি উদ্যম, অন্তরে গণসংগীতের জোয়ার, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস সবাই যেন তখন একেবারে জীবন্ত। চলছে মেলবন্ধনের শপথ গ্রহণ।

নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন থামতেই, স্টেশন পার করেই শুরু হলো মিছিল। শুধু ট্রেনই নয়, বাসে এমনকি সুন্দরবনের দুইটি নদী পেরিয়ে এসেছে বেকার যুবক-যুবতী সহ খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া ভিড়ে যেন হাজার হাজার স্বপন কোলে, সৈফুদ্দিন মোল্লা, সুদীপ্ত গুপ্ত, মইদুল ইসলাম মিদ্যারা হেঁটে চলেছে তাঁদের হক্ বুঝে নেওয়ার জন্য। মিছিল যেন বলছে-না প্রতিহিংসার, না দলবদল এতো শুধু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আর দিনবদলের লড়াই। ব্রিগেডের অভিমুখে মিছিল, কিন্তু তার শেষ কোথায় জানা নেই।

সূর্যের উত্তাপ বেশ গভীর হতে শুরু করেছে তখন। কিন্তু ব্রিগেডে মিছিল প্রবেশের পর বোঝা গেল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা। প্রবল রোদকেও তোয়াক্কা না করে মানুষের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস, যা আমাকে স্পর্শ করল। গাছতলাতে চলছে নাটক। পরিবেশন করছে ভারতীয় গণনাট্যগ সঙ্ঘের শিল্পীরা। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের কর্মীরা রোদের তাপকে উপেক্ষা করে মাটিতে বসে তাঁদের সাহিত্য পত্রিকা বিক্রয় করছেন আর তাঁদেরই পাশে ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতীরা তাদের তৈরি টি-শার্ট বিক্রির সাথে সংগ্রহ করতে থাকে সংগ্রামী তহবিল। আরেকদিকে সাংস্কৃতিক মঞ্চে তখন দিনবদলের কবিতা-গান আর কথা। প্রকৃতিকে চ্যাথলেঞ্জ জানিয়ে জেগে ওঠার স্পর্ধা দেখিয়েছে উপস্থিত জনতা। বেলা দীর্ঘ হওয়ার সাথে সাথে মানুষের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করে। এদিকে, সময় চিনতে আর দিনবদলের রসদ কিনতে গণশক্তি আর ন্যাশনাল বুক এজেন্সির পুস্তক বিপণিতে ভিড় চোখে পড়ার মতো।

বেকার যুবক-যুবতীরা যারা হাজার-হাজার টাকার ফর্ম ফিলাপ করেও চাকরি জোটাতে পারেনি। এদিকে এক পৃষ্ঠার ‘বায়োডাটা’-য় ‘এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন’ লিখতে লিখতে স্থানের ঘাটতি পড়ছে। কবি জয়দেব বসু’র এক কবিতার পঙ্‌ক্তি টেনে বলতে ইচ্ছা করছে - ‘‘...এদিকে প্রতিদিন, প্রায় প্রতিদিন মনের মতো বই কিনতে না পারার অক্ষমতা/মনের মতো একটা পযাক্ন্ট বানাতে না-পারার অক্ষমতা/রিটায়ার্ড বাবাকে দু’বেলা বাজার ঘাট করতে দেখার ক্ষমতা-/এসব সহ্য করতে করতে টের পাই হাড়ে আমার দুব্বো গজিয়ে যাচ্ছে...।’’

তারা প্রত্যে কে আশার আলো দেখছেন এই ব্রিগেডে। মূল মঞ্চের বক্তব্য থেকে তারা পেয়েছেন এক নতুন বার্তা। ডাক দেওয়া হয়েছে সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্বে বাংলার নাগরিকদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের সরকার গঠনের। যে সরকার সমস্ত শূন্য পদের নিয়োগ করবে, কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে তার সাথে প্রতিষ্ঠিত করবে সামাজিক ন্যায়কে। যখন প্রশ্ন ওঠে ন্যায্য খাটুনির ন্যায্য মজুরির, মহিলাদের নিরাপত্তা, কাজের গ্যারান্টির; মানুষ বুঝেছেন একমাত্র বামপন্থীরাই এসব নিশ্চিত করতে পারবে। তাই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই লড়াই চালিয়ে যাবেন আগামী বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার মাধ্যমে নিজেদের সরকারকে প্রতিষ্ঠা করার।

দুই শাসকের যে হিংস্র রূপ, কাজ না পাওয়া যুবকের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে যে উন্মাদ নৃত্য - তাকে পরাজয় করার ডাক দিয়েছে এই ব্রিগেড। জনপ্লাবনের যে বন্ধন এই ব্রিগেডে তা হুঁশিয়ার করেছে অত্যাসচারীদের। কবি কনক মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতার শেষ চার পঙ্‌ক্তি উল্লেখ করে ইতি টানব এ লেখার - ‘‘...সরে যাও দস্যু -/আজ আমার দুর্জয় অভিযান/তোমার শেষ কবরের উপর রচিত/সভ্যকতার নূতন সূর্যোদয়ের পথে।’’

এটাই তো ২৮-শের ব্রিগেডের শপথ, লড়াইয়ের ময়দানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আমাদের মন্ত্র।