৫৮ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৫ মার্চ, ২০২১ / ২০ ফাল্গুন, ১৪২৭
ময়দানে সংযুক্ত মোর্চা
শমীক লাহিড়ী
এতো মহা মুশকিলে পড়া গেল। লোক জুটে গেল, মাঠ ভরে গেল। বিরিয়ানি, মায় ডিম-ভাত খাওয়ানোর গল্প বের করা গেলনা। চিড়িয়াখানা-ভিক্টোরিয়া দেখতে কলকাতা আসার গল্পও নেই। পাকাচুলে ভরতি ব্রিগেডের সবুজ ঘাসকে সাদা দেখানো - সেটাও খাওয়ানো যাচ্ছে না। ছবি অন্য কথা বলে দিচ্ছে।
দুপুরে ব্রিগেড সভা চলার সময়েই মাথা চুলকে, ঘাড়ের ঘাম মুছে তৃণমূল-বিজেপি-র ভোট ম্যানেজাররা ভেবে কূল পাচ্ছিল না - এবারের ব্রিগেড নিয়ে কি বলা হবে!
লাইন কী হবে?
একজন লাইন দিল - ‘২০১৯ সালেও ব্রিগেড ভরেছিল - কিন্তু ভোট পেয়েছিল ৭ শতাংশ। তাই এবারের ব্রিগেড ভরলেও ভোট সেই ৭ শতাংশ।’ এটাই চালানো হোক।
পালে পালে লোক হাজার হুমকি, বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে, গাঁটের পয়সা খরচ করে শত-শত মাইল পথ পেরিয়ে ব্রিগেড এসেছে। এই ব্রিগেড ফিরে গিয়ে বুথেও মরণপণ লড়াই চালাবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?
৭ শতাংশ + ৫ শতাংশ = ১২ শতাংশ ভোট ছিল মরা ভোট বাজারেও, ২০১৯-ভাটার টানেও।
তাই এত লঘু বস্তাপচা কথায় ভোট ম্যানেজার কোম্পানির বাবুদের মন ভরলো না। ভাবো ভাবো। সময় নেই। এক্ষুনি টিভিতে নেমে পড়তে হবে। কাগজে লাইন নামাবার জন্য কয়েক ঘণ্টা সময় পাবে, কিন্তু টিভিতে এক্ষুনি লাইন চালু করতে হবে। একবার যদি মানুষের মাথায় ঢুকে যায় বিজেপি-তৃণমূল এই দুইয়ের বিকল্প আছে, তাহলেই ঘোর বিপদ।
অবশেষে কয়েকটা লাইন পাওয়া গেল -
লাইন ১ - আব্বাস সিদ্দিকি মাঠে ঢোকার সময়ে, জনতার উচ্ছ্বাসে থামতে হলো অধীর চৌধুরীকে।
না! শুধু এতে কি হবে? বলো - ‘ক্ষুব্ধ অধীর চৌধুরীকে ভাষণ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করতে হলো আব্বাস সিদ্দিকির জন্য।’
কিন্তু এটাতে ঠিক সিপিআই(এম)-কে জড়ানো গেল না। আরও কিছু চাই। ৩০ মিনিট বাদে ভাষ্য পাল্টে হলো- ‘সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম, লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরীকে ভাষণ শেষ করতে বললেন, আব্বাস সিদ্দিকি মঞ্চে প্রবেশ করার সময়ে। অপমানিত অধীর চৌধুরীকে কোনোক্রমে বিমান বসু সামাল দিলেন, তাঁকে আবার বলতে দিয়ে।’
ঠিক আছে - চলবে। তবে তেমন চলবে না। অধীর চৌধুরী স্বয়ং বলছেন, তিনি ‘অসন্তুষ্ট’ হননি।
মাথা ঘামালেই উপায় বেরোয়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বুদ্ধিমান জীব পুষেছে বিজেমূল, আর উপায় বেরোবে না, তা হয় নাকি!
এবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে।
নতুন লাইন নেমে পড়ল।
সূর্যাস্তের আগেই।
লাইন ২ - ছি ছি! একটা কমিউনিস্ট পার্টি শেষে কি না ধর্মীয় নেতার হাত ধরে ব্রিগেডের স্টেজে তুলে এই আদিখ্যেতা করল! ভাবা যায়! এখানে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য’রা বক্তৃতা করতেন। সেখানে শেষে কি না...!
এই লাইনটা বেশ ভালো। ২০১৯ সালে যেসব বাম সমর্থক তৃণমূলকে হারানোর প্রবল স্পৃহায় এবং বামেদের জয়ের প্রতি সন্দিহান হয়ে বিজেপি’র ওপর আস্থা রেখেছিল, তাদের বাম ঘরে ফিরে যাওয়াও রোখা যাবে।
এই অংশের বাম সমর্থকেরা আবার ভাবতে শুরু করেছে- বামরা রাস্তায় লড়ছে। হাজার হাজার বাম ছাত্র-যুব কর্মী বেকারত্বের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ছে। সহযোদ্ধার মৃত্যু বা পুলিশের ভয়াবহ অত্যাচারও এদের দমাতে পারেনি। বাম মহিলা কর্মীরা আত্মমর্যাদার দাবিতে সমবেত হয়ে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েও পালায়নি। এসব মানুষ দেখছে। মিডিয়া না দেখালেও বিকল্প সামাজিক মাধ্যমে দেখছে।
বামদের ছেড়ে যাওয়া সমর্থকদের ফেরার পালা শুরুর আগেই এই ফিরে যাওয়া আটকাতেই হবে। তাই নেমে পড়ো সংবাদমাধ্যম। বসে পড়লো আলোচনা। যাদের ধরে আনা হলো, তারা যেখানে জমাতে পারলেন না ভালো, সেখানে সঞ্চালক/সঞ্চালিকারাই লজ্জার মাথা খেয়ে নেমে পড়লেন, চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে। পরের দিন সকালের কাগজে গুছিয়ে গল্প লেখা হলো। কোথাও আলিমুদ্দিনের অন্দরমহলের কল্পিত খবর, কোথাও মাঠে আসা কল্পিত প্রবীণ বা নবীনের মুখে বলে নিজেদের ভাষ্য প্রচার - সবই চলছে বাজারি কাগজে।
ভাঙতে হবে সংযুক্ত মোর্চা
লাইন ৩- কিন্তু শুধু এতেও হবে না। সংযুক্ত মোর্চাকে ভাঙতেই হবে। কিছুতেই একসাথে এত শক্তিকে রাখা যায় না। বিজেপি-তৃণমূল এই দুয়েরই ভোট কেটে নেবে এরা, আর এটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে এই দুই দলের স্পনসর কর্পোরেট আর তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া? এ হতেই পারে না।
খোঁচাও কংগ্রেসের নেতাকে, খোঁচাও আইএসএফ নেতাদের। দেখো খুঁচিয়ে কিছু বলানো যায় কি না! সংযুক্ত মোর্চা ভাঙার এই খেলায় টাকার বন্যা বইবে। মিথ্যে প্রচারের বন্যা বইবে। বাজারে অনেক এজেন্ট/এজেন্সি ঘুরবে। কারণ সংযুক্ত মোর্চার ঐক্য দুই শাসকদলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
দেশ-রাজ্যের হালহকিকত
রাজ্যের হালহকিকত কি - সবারই জানা। রাজ্যে ১০বছরে কোনো নতুন কলকারখানা হয়নি। আগেরগুলোর অনেকটাই তোলাবাজির ঠেলায় পালিয়েছে রাজ্য ছেড়ে। লক্ষ লক্ষ সরকারি পদ খালি, কোনো নিয়োগ নেই। নিয়োগ মানেই ঘুষ দাও তৃণমূলের নেতাদের। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী রাজ্য ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হতে গেলে টাকা দাও। নম্বর যতই থাকুক টাকা না দিলে প্রবেশ নিষেধ। মাস্টারমশাই/দিদিমণি এই তোলাবাজির বিরুদ্ধে বললে, ধরে পেটাও।
চাষির ফসল সরকার আইন করে কার্যত ফড়ে-দালালদের হাতে তুলে দিয়েছে। ফল? চাষি আলুর দাম পায় ৫/৬ টাকা, আর সেই আলু ক্রেতাকে কিনতে হয়েছে এমনকি ৪৫ টাকাতেও। অবাধ পয়সা লুটছে ফড়ে-দালালরা।
গ্যাসের দাম-তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। দেশে ৭০ বছরে যেটুকু সরকারি সম্পদ তৈরি হয়েছে, সব তুলে দাও আদানি-আম্বানি বা অন্য কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে। মানুষের জমানো ব্যাঙ্ক-বিমার টাকা লুটের সুযোগও উন্মুক্ত হোক বেসরকারিকরণে- এটাই বিজেপি’র লক্ষ্য।
স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদ - জ্বলন্ত উনুন আর ফুটন্ত কড়াই
রাজ্যের-কেন্দ্রের সরকারের এইসব কাজের সমালোচনা অথবা প্রতিবাদ করলেই হামলা নয়তো মিথ্যা মামলা। এই রাজ্যে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। এমনকি ভোটও দিতে পারেনা বহু মানুষ। পঞ্চায়েত/পৌরসভার ভোটে দাঁড়ানোর অধিকারটুকুও নেই। ওদিকে পার্লামেন্টে সাংসদদেরও ভোট দিতে দেয়না বিজেপি সরকার।
রাজ্যের ক্ষমতায় স্বৈরাচারী শক্তি। কেন্দ্রে ফ্যাসিস্ত শক্তি। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষ কী করবে? জ্বলন্ত উনুন আর ফুটন্ত কড়াইয়ের মধ্যেই তাদের জীবন আটকে থাকবে?
এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টি বা বাম আন্দোলন কী ভূমিকা গ্রহণ করবে? এটাই যদি প্রশ্ন হয় তাহলে উত্তর - দুই শক্তিকেই পরাস্ত করতে হবে। লেসার এভিল বা কম ক্ষতিকর গল্প চলেনা জীবন মরণের মুখে দাঁড়িয়ে। গোখরো না কেউটে - কোন্টা বেছে নেবেন, এই আলোচনা পাগলেও করেনা।
লড়াই কোন্ পথে?
কিন্তু কী ভাবে এই দুই শক্তিকেই হারানো আর ঠেকানো সম্ভব? এটা সম্ভব হবে তখনই, যখন সব স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী মানুষ-রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনকে একসাথে এক মঞ্চে এনে লড়াই শুরু করা সম্ভব হবে। এই সব মানুষ বা রাজনৈতিক দল বা সামাজিক শক্তিগুলো অনেক প্রশ্নেই ভিন্ন মত পোষণ করতে পারে, কিন্তু এই দুই মারণ-শক্তিকে পরাস্ত করার বিষয়ে সহমত থাকলেই, এদের ঐক্যবদ্ধ করার সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাতে হবে।
সেই লক্ষ্যেই তৈরি হয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। এই মোর্চার লক্ষ্য ব্রিগেড সভা থেকেই ঘোষিত হয়েছে।
বাজারি সংবাদমাধ্যম এবং বিজেপি-তৃণমূল যৌথভাবে এইজন্যই রে রে করে উঠেছে। নানা ভেক ধরে নানা প্রশ্ন তুলছে।
ভেকধারীদের মায়াকান্না কেন?
৭ শতাংশ ছিলে তাই থাকো। ৫ শতাংশ কংগ্রেসকে সাথে নেওয়ার সাথে সাথে কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কি সাংঘাতিক মাথা ব্যথা এক অংশের সংবাদমাধ্যমের। ৭ আর ৫ যোগ করলে তো মাত্র ১২। তাতে এত সমস্যা হচ্ছে কেন? কারণ এরা ভালোই জানে ভোটের অঙ্কে ৭+৫ সব সময় ১২ হয় না। এই যোগফলটাই গত বিধানসভা নির্বাচনে ছিল ৩৬ শতাংশ। কারণ বিকল্প শক্তি জিততে পারে, এই বার্তাটাই বহু অতিরিক্ত ভোট টেনে আনে। আর বিচ্ছিন্ন হয়ে লড়লে কী হয় এই ৩৬ শতাংশ ভোটের, সেটা গত লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে।
তাই এই যোগ যাতে না হয়, সেই জন্যই বিজেপি-তৃণমূলের ভোট ম্যানেজাররা অনেক এজেন্ট/এজেন্সিকে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। এদের সাদা চোখে দেখা যায় না। এরা কেউ ৭২-৭৭ সালে অত্যাচারিতের ভেক ধরে লিখছে। কেউ এই জন্যই সিপিআই(এম) ছাড়লাম, বলে ঘোষণা করছে। নবগঠিত সংযুক্ত মোর্চার ভেতরে পঞ্চম বাহিনীর কেউ আছে কিনা খুঁজতে বেরিয়েছে টাকার থলে নিয়ে এরা।
এবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া। তফশিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষরা গত ২/৩ বছর ধরেই ফুঁসছিল, তৃণমূল সরকারের বিশ্বাসঘাতকতায়, আর বিজেপি’র দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণে। নানা সংগঠনের ছাতার তলায় এরা সংগঠিত হচ্ছিল।
এবার এরা সবাই মিলে একটা বড়ো মঞ্চ তৈরি করেছেন - ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। সভাপতি হয়েছেন শিমূল সোরেন আর সম্পাদক আব্বাস সিদ্দিকি। এদের লক্ষ্যও বিজেপি ঠেকাও, তৃণমূল হঠাও।
বাজারে বিজেপি-তৃণমূল এজেন্টরা এদের কাছে টানার জন্য কি না করেছে গত কয়েক মাস ধরে। সাফল্য না পেয়ে এখন মায়াকান্না জুড়েছে। এরা কত সাম্প্রদায়িক, জাতপাতের রাজনীতি করছে, সেই প্রচারে মত্ত হাতির মতো আচরণ করছে কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম।
ভিক্ষা নয়, চাই সংবিধান স্বীকৃত অধিকার
সোরেন-সিদ্দিকির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই নতুন দল ব্রিগেড মঞ্চে কী বলেছে?
না, মুখ্যমন্ত্রীর মতো আব্বাস সিদ্দিকি কথায় কথায় ইনশাল্লাহ বলেননি। ইমাম ভাতা বা হজ যাত্রায় ভাতার দাবি তোলেননি। বলেছেন কর্মসংস্থানের কথা। প্রশ্ন করেছেন কেন চাকরি চাইতে আসা ছাত্র-যুবদের লাঠি মারলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পুলিশ। কেন পঞ্চায়েত-পৌরসভা-সরকারের টাকা লুট হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো সাম্প্রদায়িক?
কোন্ কথাটা সাম্প্রদায়িক? কেউ তা বলতে পারছে না। বলছে কেন ফেজটুপি? মুখ্যমন্ত্রী হিজাব টেনে ভাষণ দিতে পারেন অসুবিধা নেই, কিন্তু একজন মুসলমান কেন ফেজ টুপি পড়েছেন সেই প্রশ্ন তুলছেন এরা কী উদ্দেশ্যে, সেটা স্পষ্ট।
তৃণমূলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করলে অসুবিধা নেই, যোগী আদিত্যনাথ ঘৃণা ও খুনের রাজনীতির কথা প্রকাশ্যে বলেও বিজেপি’র নেতা হলে অসুবিধা নেই, গুজরাট দাঙ্গার নায়ক নরেন্দ্র মোদীকে ভোট দেওয়া যায়, কিন্তু সব বেকারের চাকরির দাবি জানানো আব্বাস সিদ্দিকি সাম্প্রদায়িক?
বাহঃ। চমৎকার যুক্তি!!
মুসলমান, তফশিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসী মানুষ কোনো ভিক্ষা চায় না, চায় সংবিধান স্বীকৃত অধিকারের বাস্তবায়ন। ব্রিগেডের মঞ্চে এই কথা বলে কি সাংঘাতিক অপরাধই না করেছে সোরেন-সিদ্দিকির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আইএসএফ!
ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতা
অনেক বাম সমর্থক ভাবছেন, কাজটা কি ঠিক হ’লো! একজন ধর্মীয় নেতার দলের সাথে বাম দল কেন মোর্চা করবে?
প্রথমত, ধর্ম বিশ্বাস আর সাম্প্রদায়িকতা কি এক? কেবল নাস্তিকরাই কি বামপন্থী হবে? ধর্মাচরণে ব্রতীরা কি তবে ব্রাত্য বামদের কাছে?
ধর্ম নিয়ে কার্ল মার্কসের বিখ্যাত উক্তির পুরোটা অনেকেই বলেন না, বলেন একটা অংশ - ধর্ম হ’লো আফিম। কার্ল মার্কস ‘A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Rights’ লেখায় উল্লেখ করেছিলেন- “ধর্ম হলো শোষিতদের মর্মযাতনা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম হলো আফিম।”
কার্ল মার্কস এই উক্তিটির মাধ্যমে ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু কেন?
এই বিষয়টির গভীরে না গিয়ে, মোল্লা, পুরোহিত, ধর্ম ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপ না বুঝে কিংবা না জেনে একরৈখিকভাবে সরল মানুষগুলোর কাছে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষকে কমিউনিস্ট বিদ্বেষী গড়ে তোলার জন্যই এর প্রকৃত ব্যাখ্যা উপস্থিত করেনা কমিউনিস্ট বিরোধীরা। এমনকি অনেক কমিউনিস্ট কর্মীও এই বিষয়টির সঠিক মর্মার্থ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে পুরো বিষয়টিকেই গুলিয়ে ফেলেন।
আসলে মূল বিষয়টি হচ্ছে, আজকালকার মতো তখনকার সময়ে আফিম কোনো নেশার দ্রব্য ছিল না। তখনকার চিকিৎসকরা ব্যাথা বা চেতনা নাশক হিসাবে আফিমকে ব্যবহার করতেন। আর মার্কস নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিম স্বরূপ বলতে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে - সমাজ থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট, অন্যায়, নির্যাতন লাঘবের চেষ্টায় যখন কোনো ব্যক্তি ব্যর্থ হয়, তখন সৃষ্টিকর্তার কাছে সমস্ত অন্যায়ের বিচারের ভার সে অর্পণ করে।
ধর্মকে আশ্রয় করেই তার সকল যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করে কিংবা ভুলে থাকতে চায়। নিজে যখন বদলা নিতে ব্যর্থ হয়, তখন সে মনে করে, এক দিন না একদিন তার প্রতি এ অন্যায়ের বিচার সৃষ্টিকর্তাই করবেন। এ প্রেক্ষাপটেই মার্কস এ উক্তিটি করেছিলেন।
ধর্ম ও রাষ্ট্র
লেনিনের লেখা ধর্ম প্রসঙ্গে প্রবন্ধাবলির মধ্যে ‘সমাজতন্ত্র ও ধর্ম’ প্রবন্ধটি এই প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি বলছেন - ‘‘ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে ঘোষণা করা উচিত। এই উক্তিতেই সাধারণত ধর্ম সম্পর্কে সমাজতন্ত্রীদের মনোভাব স্পষ্ট হয়।... রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে বিবেচনার দাবি করছি। ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো গরজ থাকা চলবে না এবং ধর্মীয় সংস্থাসমুহের রাষ্ট্রের ক্ষমতার সাথে জড়িত থাকা চলবে না। যে কোনো ধর্মে বিশ্বাস অথবা কোনো ধর্মে বিশ্বাস না রাখার অধিকারে সবাই থাকবে স্বাধীন।’’
এই প্রবন্ধেই তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন - কেন কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের পার্টি কর্মসূচিতে নাস্তিকতাবাদ ঘোষণা করেনি এবং কেন তা উচিত নয়। স্থানাভাবে সমগ্র উদ্ধৃতি উল্লেখ করলাম না, আগ্রহী পাঠকরা সমগ্র প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন।
এই প্রসঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে ব্রাজিলীয় ধর্মতাত্ত্বিক ফ্রেই ব্রিট্টোর একাধিক সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত একটি বইয়ের উল্লেখ হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৮৫ সালে ‘ফিদেল অ্যান্ড রিলিজিয়ন’ নামে এই বইটি প্রকাশিত হয়।
কিউবার বিপ্লবের পর স্পেনের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখা এবং তাদের সাহায্য করার জন্য সেই দেশের চার্চের প্রধানদের বিতাড়িত করেছিল নতুন বিপ্লবী সরকার। কিন্তু ধীরে ধীরে চার্চের ভূমিকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই দেশের সমাজতান্ত্রিক সরকারও তাদের পরিবর্তিত অবস্থান ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালে স্বঘোষিত নাস্তিকদের দেশ কিউবা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে ঘোষণা করে।
‘আজকের যুগে যিশু জন্ম নিলে তিনি অবশ্যই আমাদের বিপ্লবীদের মতই প্রচার করতেন’ - একথা ফিদেল ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্র ও ধর্ম প্রতিষ্ঠানের পৃথক অস্তিত্বের কথাই বলে। কেউ কারোর কাজে নাক গলাবে না, এটাই আধুনিক রাষ্ট্রের মূল কথা - এটাই মনে করে কমিউনিস্টরা।
যারা এতদিন কমিউনিস্টদের নাস্তিক, ধর্ম বিরোধী বলে প্রচার করতো, তারাই এখন ধর্মীয় মানুষের সাথে কেন কমিউনিস্টরা হাত মেলাচ্ছে বলে গলা ফাটাচ্ছে।
ধার্মিক মানে সাম্প্রদায়িক নয়
আমার মা ধার্মিক ছিলেন। নিয়মিত পূজা আর্চা ধর্ম পালন করতেন। কিন্তু তাতে আমাদের বাড়িতে আসমাদি’র কাজ করতে কোনো সমস্যা হয়নি। ওর রাঁধা ভাত আমরা দিব্যি পেটপুরে খেয়েছি। আসমাদি আমাদের বাড়ির ঠাকুর ঘরের সামনেই নমাজ পড়তেন, মা’কে কোনোদিন আপত্তি করতে শুনিনি। আমার মা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ছিলেন ধার্মিক।
তাই ধর্মাচরণে অভ্যস্ত বা ধর্মীয়যাজকদের সাথে পথ চলতে অসুবিধা কীসের, যদি তিনি স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরোধী হন? আব্বাস সিদ্দিকি কি ব্রিগেডের বক্তৃতায় বা তাঁদের দলের ইশ্তিহারে কোথাও ধর্মীয় কোনো দাবি পেশ করেছেন? তিনি তো কাজ-শিক্ষা-অধিকার নিয়ে সরব হয়েছেন।
যোগী আদিত্যনাথেরা ধর্ম পালন করে না, ঘৃণার আগুন ছড়ায়। বিজেপি স্পনসর্ড ভোগ বিলাসে মত্ত ‘বাবা রামরহিম বা আশারাম বাপু’-রা ধর্মের নামে ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামায়। নরেন্দ্র মোদী ধর্মকে ব্যবহার করেন ক্ষমতা দখলের জন্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর ব্যতিক্রম নন।
উঠে এসেছে বিকল্প শক্তি
বিজেপি-তৃণমূলের আইটি বাহিনী প্রশ্ন তুলছে - কেন পীরজাদা ব্রিগেডে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই ত্রিশক্তির মিলনে বিজেপি-তৃণমূল আর এদের ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া কর্পোরেটরা কেন থরহরিকম্প। এতদিন প্রচার চালাচ্ছিল - বিজেপি তৃণমূলের বিকল্প কেউ নেই, তাই অপছন্দ হলেও বাঁ হাতে মনসা পূজার মতো এই দুজনের কাউকে ভোটটা দিয়ে দিন।
এখন প্রকৃত বিকল্প সামনে উঠে আসছে। যারা ধর্ম জাতপাতের বদলে কাজ, শিক্ষা, গণতন্ত্র, সংবিধান স্বীকৃত অধিকারগুলোর বাস্তবায়নের দাবি করছে।
এতদিন মুসলমানদের সামান্য কিছু ইমাম-মোয়াজ্জেন ভাতা ধরিয়েই ঠান্ডা রেখে, দিব্যি এদের ভোট পকেটস্থ করতে পারছিল তৃণমূল। মুসলমানদের জুজু দেখিয়ে হিন্দুদের ভোটটাও পাচ্ছিল বিজেপি। কিন্তু ভাত-রুটি-কাজ- অধিকারের দাবি তুলে সব ঘেঁটে দিয়েছে সংযুক্ত মোর্চা। তাই দেশের লগ্নি পুঁজির ধারক বাহকেরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে, শিশু অবস্থাতেই একে হত্যা করতে।
এতদিন জাতপাত ধর্ম দিয়ে বেশ ভুলিয়ে রাখা গেছিল সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই অংশকে। কিন্তু বামপন্থীরা এদের ভাত-কাপড়-কাজ-অধিকারের লড়াইতে এনেছে। দেশের মূল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় সম্পৃক্ত করার চেষ্টায় নেমেছে সিপিআই(এম)। হ্যাঁ, এটাই মূল কাজ এখন বামপন্থীদের। জড়ো করো বঞ্চিত, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত সব মানুষকে, নিজের হক বুঝে পাওয়ার লড়াইতে।
বামপন্থা ও ইতিহাস
ওরা চেয়েছিল - বামপন্থীরা ছুঁতমার্গ দেখিয়ে এদের দূরে সরিয়ে রাখুক। ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা ছিঃ, ও যে চণ্ডালিনীর ঝি - এই মন্ত্র বামপন্থীরা গেলেনি কোনোদিনই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বামপন্থীদের থেকে সুকৌশলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল এই নিপীড়িত মানুষদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে। যেই ওদের ছলা-কলা-কৌশল বুঝে আদিবাসী, তফশিলি জাতি-উপজাতি, সংখ্যালঘুরা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ের সাথি হিসেবে বামপন্থীদের বেছে নিয়েছে- তখনই শুরু হয়েছে মিথ্যার নির্মাণ।
যে সমস্ত স্বঘোষিত বামপন্থী প্রশ্ন তুলছেন কেন ধর্মীয় নেতার সাথে হাত মেলাচ্ছে সিপিআই(এম), তাঁরা কি ইতিহাস ভুলে গেছেন, না কি ইচ্ছে করে বলছেন না সেই অধ্যায়গুলো। সারা ভারত কৃষক সভার প্রথম সভাপতির নাম ছিল স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনে প্রথম পূর্ণ স্বরাজের দাবি সদ্যগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে উত্থাপন করেছিলেন কারা? একজন মৌলানা হসরত মোহানি এবং অপরজন স্বামী কুমারানন্দ। এইসব ইতিহাস ওরা আলোচনা করবে না, কারণ বকলমে তৃণমূলের হয়ে ঠিকেদারির অগ্রিম গ্রহণ করে ফেলেছে এইসব স্বঘোষিত বামপন্থীদের অনেকেই।
পথ দীর্ঘ, সাবধানে চলতে হবে।
তবে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদের সাথে লড়াইটা হবে দীর্ঘ। লম্বা পথ। এই পথ অনেকটা দিল্লিগামী ট্রেনের মতো। হাওড়া থেকে ওঠা সব যাত্রী দিল্লি যায়না। অনেকে মাঝপথে নানা স্টেশনে নেমে যায়, আবার মাঝপথেই অন্য যাত্রী ওঠে। এই ওঠানামা চলতেই থাকে। সবাই দিল্লি পর্যন্ত যায়না। এই লড়াইয়ের দীর্ঘ পথেও তাই হয়।
সাবধান! অনেক ঝানু লোক মিত্র সেজে ঘুরছে সদ্যগঠিত সংযুক্ত মোর্চা ভেঙে দেওয়ার জন্যই। কেউ টাকার থলে নিয়ে, কেউ পরামর্শ দেওয়ার ছলে, কেউ বা নারদের ভূমিকায়।
পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতার মতো পাশ কাটিয়ে, কথা খেলিয়ে, কিছু কথা পেটে কিছু কথা ঠোঁটে, আর অন্য কিছু মাথায় রেখে কথা বলা এখনো আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি, রাজনীতিতে নবাগত আব্বাস সিদ্দিকি। তাই একে দিয়ে ঐক্য বিরোধী কথা বলিয়ে নেওয়ার জন্য ঝানু সাংবাদিকদের লাগিয়ে রেখেছে কর্পোরেট মিডিয়া। সতর্ক অবশ্যই থাকতে হবে সংযুক্ত মোর্চার অন্তর্ভুক্ত সব কটি দলের নেতাদেরই।
তবে হ্যাঁ মনে রাখতে হবে সংযুক্ত মোর্চায় অনেক দল আছে। তাই সব প্রশ্নে সবাই একমত হবে কেন? তাহলে তো একটা দলেই সবাই মিশে যেত। সবাই একমত হয়েছে - তৃণমূলকে হটিয়ে, বিজেপি’কে ঠেকিয়ে নতুন বাংলা গড়তে হবে, আগামীর জন্য। এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই ফ্যাসিবাদ-স্বৈরাচার বিরোধী পথ চলতে হবে।
সামনের দিনগুলো ঐক্য ও সংগ্রামের
এখন সুবর্ণ এক সুযোগ ও অধ্যায় সৃষ্টির মুখে বাংলা। জাতপাত ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে ভাত-রুটি-কাজ-অধিকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সংযুক্ত মোর্চা। এই ঐক্য অটুট রাখার দায় যেমন নেতাদের, তেমনি কর্মী-সমর্থকদেরও। মানুষের জন্যই এই ঐক্য অটুট রাখতেই হবে। ব্রিগেডের লড়াই নিয়ে পৌঁছে দিতেই হবে বাংলার পাহাড় থেকে সুন্দরবনের প্রতিটি বুথে। আগামী দু’টি মাস ঐক্য আর সংগ্রামের মাস।