৫৮ বর্ষ ২৯ সংখ্যা / ৫ মার্চ, ২০২১ / ২০ ফাল্গুন, ১৪২৭
বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা
গৌতম রায়
বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে এখন বেজায় মাথা ঘামাতে শুরু করেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাহান্নর একুশের লড়াই মুসলমানের লড়াই, বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে মানভূমের লড়াই, কাছাড়ের লড়াই হিন্দুর লড়াই। তাই সেটাই খাঁটি বাংলাভাষার মর্যাদার জন্যে লড়াই। একুশের যে অর্জন তা পানি, গোসল, দাওয়াত, খালার অর্জন। সেই অর্জনের উত্তরাধিকার হিন্দু বাঙালির নয়। সেই উত্তরাধিকারের ভাগীদার মুসলমান বাঙালির। সংস্কৃতভাষা থেকে তৈরি বাংলাই হিন্দু বাঙালির ভাষা। তাই সেটাই শুদ্ধ বাংলা ভাষা। আরবি, ফারসি আর উর্দু (এই ভাষার আদিতে যে সংস্কৃত এবং হিন্দুস্থানি, হিন্দি নয়, ভাষারই প্রাধান্য, সেটা জানার বা বোঝার মতো মানসিক স্থৈর্য্যও এদের নেই) বহুল বাংলা, মুসলমানের বাংলা, অর্থাৎ; বাংলাদেশের বাংলা - এই ‘পাণ্ডিত্য’ নিয়েই হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করতে চায়। সেই উদ্দেশ্যেই তারা তাদের বাংলা মুখপত্র ‘স্বস্তিকা’-তে (২২\০২\২০২১) ‘বাংলাদেশী বাংলার দাপটে স্বকীয়তা হারাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা’ (চন্দ্রিমা বন্দ্যোপাধ্যায়) শিরোনামে একটি প্রবন্ধের ভিতর দিয়ে মারাত্মক বিষ ছড়িয়েছে।
ভাষার কোনো দেশ নেই। ভূগোল নেই। কাঁটাতারও নেই। ভাষা একটি বহতা নদী। কখনোই বন্ধ জলাশয় নয়। ভাষাকে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত করবার মানসিকতার মতো কূপমণ্ডুকতা আর হয় না। সামাজিক ওলোটপালটে একটি ভাষাতে যখন স্থবিরতা আসে, তখন যে জঙ্গমতার সৃষ্টি হয়, সেটা অচিরেই ভাষাকে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত করে। আর এই বদ্ধ জলাশয়ের শৈবালদাম ভাষার ক্ষিপ্রতাকে দেয় বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে। যার জেরে ভাষাটি ক্রমে যাদুঘরের ভাষাতে রূপান্তরিত হয়। যেমন হয়েছে সংস্কৃত ভাষা।
বাংলাভাগের হাজারোটা কুফল সত্ত্বেও এই একটি মাত্র সুফল যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে বাংলাভাষা চর্চার যে বিজ্ঞানসম্মত ধারাপ্রবাহ একটা প্রবল স্রোতের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তা কখনোই ভাষার সাম্রাজ্যে উপলদাম জমতে দেয় না। ফলে ভাষা চর্চাতে যে প্রবহমানতা থাকে, তা থেকে যে নিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা চলে, সেটি বাংলাভাষাকে বিশ্বের যে কোনো জীবন্ত ভাষার ভিতরে একটা বড়ো রকমের প্রাণবন্ত ধারার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। এই প্রবহমানতাটাই ভারতে হিন্দু মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বরদাস্ত করতে পারে না, যেমনটা পারে না বাংলাদেশে ইসলামীয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীরা। কারণ, ভাষার এই প্রবহমানতা, অপর ভাষা থেকে শব্দ আহরণ এবং সেই শব্দকে আত্মস্থ করে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সেই শব্দবন্ধের আত্মীকরণ ঘটানোটা হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির শ্রেণিস্বার্থে আঘাত করে। তাই বাংলাদেশে ইসলামীয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীরা বাংলাভাষাতে ‘হিন্দুর ভাষা’ ঢুকে যাচ্ছে বলে গেল গেল রব তোলে। আর ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীরা বাংলাভাষাতে ‘বাংলাদেশির ভাষা’ (ওরা জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়ার ‘বাংলাদেশি’ শব্দটা ব্যবহার করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ‘বাংলাদেশের’ শব্দটি ব্যবহার করে না) ঢুকে পড়ছে বলে সোচ্চার। কারণ, রাজনৈতিক হিন্দুদের কাছে ভারত মানে হিন্দুদের আবাস ভূমি আর বাংলাদেশ মানে মুসলমানদের আবাস ভূমি। তাই তাদের কাছে ‘বাংলাদেশের ভাষা’ বা ‘শব্দাবলী’ বলে যে আজগুবি শব্দের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তার গূঢ় অর্থ হলো, মুসলমানের দেশের ভাষা। তাই হিন্দু মৌলবাদীদের এতো আপত্তি।
যে কোনো ভাষাতে বিদেশি শব্দের মিশ্রণ, আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার ভাষার সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করে, ভাষার প্রবহমানতার ভিতর দিয়ে তার আয়ু বৃদ্ধি ঘটায়। ডগলাস স্টুয়ার্টের ‘সাগি বেইন’ গত ২০২০ সালে বুকার প্রাইজ পায়। ইংরেজি ভাষা বলতে যে কেবল অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ আর ডাউনিং স্ট্রিটের ভাষা নয়, ইয়োরোপের অন্যান্য দেশগুলির আঞ্চলিক শব্দাবলী কিভাবে যুগ যুগ ধরে ইংরেজি ভাষার ভিতর প্রবহমান স্রোতকে বজায় রেখে, সেই ভাষার ভিতর এতটুকু শ্যাওলা জমতে দেয়নি, তার যেন সাহিত্যের ভাষায়, সামাজিক দলিল এই বইটি। যে আয়ারল্যান্ড থেকে একটা সময় মার্গারেট নোবেল, স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র ব্রত নিয়ে ভারতে এসে, ভগিনী নিবেদিতা হয়ে উঠেছিলেন, সেই আয়ারল্যান্ডের আঞ্চলিক শব্দাবলী কিভাবে ধ্রুপদিয়ানার ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের উঠোনকে শস্য শ্যামলা করে তুলছে, তা বোঝার জন্যে সাম্প্রতিক ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সেরা সৃষ্টি ‘সাগি বেইন’ আমাদের সকলের অবশ্য পাঠ্য হওয়া দরকার।
এই ধরনের গ্রন্থ পাঠের অর্জন থেকেই বোঝা যায়, কোনো সংকীর্ণ স্বার্থ নিয়ে মহান একুশের আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের অর্জনকে খাটো করে দেখাতে চায় হিন্দু মৌলবাদী শক্তি। একুশের অর্জনের সুর যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিরোধিতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা- এইগুলি সবই চক্ষুশূল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির। তাই ভাষা আন্দোলনের শহিদদের অপমান করতে ‘বাংলাদেশি’ ভাষার দ্বারা বাংলাভাষার অপমান, অপদস্ত হওয়ার এই সাম্প্রদায়িক, বিভেদমূলক তত্ত্বের অবতারণা।এই তত্ত্বের ভিতর দিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যে কেবল মহান একুশের ভাষা শহিদ এবং সৈনিকদেরই অপমান করছে, তাই নয়। মানভূম বা কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে সেই আন্দোলনগুলির শহিদ এবং সৈনিক, সবাইকেই তারা অপমান করছে। মাতৃভাষার অধিকারের ভিতর দিয়ে শাসকের অত্যাচার, অন্যায়, জুলুমের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন একুশের আন্দোলনকারীরা। একইভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন মানভূম এবং কাছাড়ের আন্দোলনকারীরাও। এঁদের প্রত্যেকের আন্দোলনের মূল সুর ছিল মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার ভিতর দিয়ে ভাষা ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিবাদ। ভাষাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিষ সংক্রমণের প্রতিবাদ। তাই একটি আন্দোলনকে গৌরবান্বিত করতে অপর আন্দোলনকে খাটো করে দেখানোর এই যে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী প্রবণতা, সেটি যেমন একুশের শহিদদের অপমান, তেমনিই মানভূমের আন্দোলনকারী বা কাছাড়ের ভাষা শহিদ, ভাষা সৈনিকদের প্রতিও চরম অপমানজনক। এভাবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে কখনো ভাষা প্রেম হয় না।
ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া দিয়ে রাজনৈতিক সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির চিরদিন সক্রিয় থাকে। জাতীয় আন্দোলনের সূচনা পর্বেও আগে হিন্দু ও মুসলিম উভয় তরিকাতেই যখন সংস্কারের জোয়ার, তখন থেকেই এই ভাষার তথাকথিত শুদ্ধতা ঘিরে একাংশের মানুষদের এতটাই মাথাব্যথা শুরু হয়, যা অচিরেই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথকে পরিষ্কার করে। তাহলে হাদিস তরিকা ‘কাকাতুয়া’ শব্দে হিন্দুয়ানি খুঁজে পায়। তারা কাকাতুয়ার নাম দেয় ‘চাচাতুয়া’। এই সময়ের সামাজিক ইতিহাস আমরা পাই গৌরকিশোর ঘোষের ত্রিলজির ‘প্রতিবেশী’তে।
দেশভাগের পরেও মৌলানা আক্রম খাঁর মতো নেতাদের আক্রমণের শিকার ছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রতিবেশী সুফিয়াকে তিনি আক্রমণ করতেন এই ভাষায়, সুফিয়া কামাল খালাম্মা ডাক শোনার থেকে কাকিমা শুনতেই বেশি পছন্দ করেন।
আজ আরএসএস-র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এবং আরএসএস নিয়ন্ত্রিত হাজারটা তথাকথিত সমাজসেবী সংস্থা, সে যুগের মুসলিম লিগ নেতা মৌলানা আক্রম খাঁর সুরেই বাংলাভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করার বাগাড়ম্বর থেকে এমন সব শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডার থেকে বাদ দিতে চায়, যেগুলির গায়ে তারা মুসলমানি লেবাস পড়িয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশেও জামাত এমনভাবেই নিজেদের দেশে বাংলাভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখতে চায়। বাংলাভাষাতে হিন্দুয়ানির স্পর্শ বাঁচিয়ে তারা পুণ্যের পথে হাঁটতে চায়। অথচ হিন্দুস্তানি, এই সাম্প্রদায়িক শিবিরের সৃষ্ট শব্দবন্ধ যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত একটি শব্দ, আসল শব্দ যে ‘হিন্দুস্তানি’ সেদিকে সাম্প্রদায়িক শিবিরের কোনো নজরই নেই। এমনকি নিজেদের যাঁরা প্রগতিশীল বলে দাবি করেন, তাঁরাও হিন্দুস্তানিকে হিন্দুস্থানি, এই বিকৃত শব্দে রূপান্তরিত করা নিয়ে সেভাবে প্রতিবাদই করেন না।
‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানে’র স্লোগান দিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে সচেষ্ট। সুদূর অতীতে আর্যজনস্রোতের জিহ্বার উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্যে সিন্ধুর ‘স’, ‘হ’ হলেও ধর্মান্ধ দ্যোতনার হিন্দু কখনোই হয়নি। সনাতন ধর্মকে হিন্দু নামক সাম্প্রদায়িক কোটরবদ্ধ করবার যে প্রবণতা, সেই প্রবণতার সঙ্গে হিন্দু আদি শঙ্করাচার্য, রামানুজ, কবীর, দাদু, শ্রীচৈতন্যসহ প্রাচীন ও মধ্যকালীন ভারতের মরমিয়া সাধকদের দর্শনের এতটুকু সঙ্গতি নেই। উনিশ শতকে আধ্যাত্মিকতাকে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে আবৃত করেছেন মানবকল্যাণে, সেই শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদামণি, স্বামী বিবেকানন্দও কখনো ধর্মকে সাম্প্রদায়িক, কৌনিক অবস্থান থেকে দেখেননি। আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম বেঠিক, এই বোধকে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন ডগম্যাটিক ভাবনা। ওয়াজেদ আলি খান, যিনি গোবিন্দ রায় নামেও পরিচিত, তিনি ছিলেন পবিত্র ইসলামীয় ধারাতে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনার গুরু। আজ যেসব শব্দগুলিকে মুসলমানি শব্দ বলে, বাংলাদেশি শব্দ বলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা বাংলাভাষা থেকে মুক্ত করে, বাংলাভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করতে চান, সেইসব শব্দাবলি (যেমন, সানকি, পানি)-র ব্যবহার শ্রীরামকৃষ্ণ যে অহরহ করতেন, তার প্রমাণ শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতেই আমরা পাই।
নির্বাচনী সংগ্রামের মুখে এভাবে মহান একুশের ভূমিকাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে চিহ্নিত করে সামাজিক মেরুকরণের কাজটি আরও নিবিড়ভাবে করতে চাইছে আরএসএস। যেমনটা গত লোকসভা ভোটের পর ভাটপাড়ার রাস্তাতে দাঁড়িয়ে বাঙালি-অবাঙালি প্রসঙ্গের অবতারণা করে এই সাম্প্রদায়িকতার ডিমে তা দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান সেদিন যে ভাষায় ভিন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে রুটি-রুজির টানে আসা মানুষদের আক্রমণ করেছিলেন, সেই আক্রমণের ধারাবাহিকতাই শুনতে পাওয়া গেল মহান একুশকে কেন্দ্র করে আরএসএস-র সাম্প্রদায়িক প্রবণতার ভিতর দিয়ে। আরএসএস-র কাজটিই এতকাল মমতা করে আসছিলেন। আজ আরএসএস বুঝছে, মমতার দৌলতে তাদের কোমরে এতটাই জোর এসেছে যে, এবার প্রতিবেশী দেশের ভাবাবেগকে আক্রমণ করে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াবার প্রশ্নেও তারা আর পিছপা হচ্ছে না।