৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০
একবিংশ শতাব্দীতে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা
সূর্য মিশ্র
।। এক ।।
মার্কসবাদ কোনো আপ্তবাক্য নয়, এটা একটা ‘সৃষ্টিশীল বিজ্ঞান’, যা কর্মক্ষেত্রে ‘পথ নির্দেশক’। কথাগুলো লেনিনের এবং এ যাবৎ আমাদের পার্টির সমস্ত মতাদর্শগত প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়ে আসছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন এবং পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলিতে বিপর্যয়কর ঘটনাবলি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিপিআই(এম)-এর বিংশতিতম কংগ্রেসে (কোজিকোড, কেরালা, ৪-৯ এপ্রিল, ২০১২) ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব’ গৃহীত হয়েছিল। এটি হচ্ছে পার্টির মতাদর্শগত অবস্থান নিয়ে সর্বশেষ প্রস্তাব। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল - ‘‘মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্যই হলো, যখন এর শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সামাজিক ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয় তখনই তা কেবলমাত্র অতিক্রম করা যেতে পারে। সুতরাং যতক্ষণ ধনতন্ত্রকে অতিক্রম করা না যাচ্ছে ততক্ষণ ধনতন্ত্রের মধ্যে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা কোনোদিনই বাতিল করা যাবে না। পুঁজিবাদ পরবর্তী সময়েও মার্কসবাদী দর্শন ও বিশ্ববীক্ষাকে ভিত্তি এবং বৈজ্ঞানিক নির্দেশিকা করে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ ঘটবে এবং সাম্যবাদে উত্তরণ ঘটবে।’’ (প্যারা ৯.৬)
মার্কস ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’ প্রসঙ্গে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ এই দুই স্তরের পার্থক্যগুলি নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বর্তমান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি বা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইয়োরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কোনোটিই সাম্যবাদী সমাজের উত্তরণের পর্বে পৌঁছায়নি। এই উত্তরণ যে এক সুদীর্ঘ কালপর্বের বিষয় একথা সন্দেহাতীত। সিপিআই(এম) তার মতার্দগত প্রস্তাবে এই উত্তরণ যে একটা সরলরৈখিক প্রক্রিয়া নয় বা ‘একমুখো অগ্রগতি’ নয় তা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছে। পূর্ব ইয়োরোপে ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনে তা প্রমাণিত হয়েছে। এর কারণগুলিও বিশদভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে কয়েকটি মতাদর্শগত বোঝাপড়া নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে ৮১টি অংশগ্রহণকারী কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি নিয়ে সিপিআই(এম) চতুর্দশ কংগ্রেসে পুনর্মূল্যায়ন করে বলেছিল যে - ওই বিবৃতির বিশ্লেষণ তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতায় গুরুতর ভ্রান্তি ছিল যারফলে বিশ্ব সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ধনতন্ত্রের ‘সাধারণ সংকটের তৃতীয় পর্বে’ আশু বিপর্যয় অনিবার্য। বলা বাহুল্য এই মূল্যায়নে বিশ্ব ধনতন্ত্রের ক্ষমতাকে খাটো করে, সমাজতন্ত্রের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেখা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, সমাজতন্ত্র একটানা প্রগতির পথে যাবে, একবার সমাজতন্ত্র কায়েম হওয়ার পর তা বাধাহীন সরলরেখায় এগিয়ে যাবে শ্রেণিহীন কমিউনিস্ট সমাজের স্তরে। মার্কস বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র সাম্যবাদের প্রথম স্তর অর্থাৎ সংজ্ঞার দিক থেকেই পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থা ও শ্রেণিহীন সাম্যবাদের মধ্যবর্তী পর্বেও শ্রেণি সংঘাত নির্মূল হওয়া তো দূরের কথা এবং তা তীব্রতর হয়। কারণ বিশ্ব ধনতন্ত্র তার হারানো জমি উদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করে। সুতরাং এই পর্ব বহু বাঁক মোড় পেরিয়ে জটিল হতে বাধ্য। বিশেষকরে ধনতান্ত্রিক বিকাশে পেছিয়ে-থাকা যে দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে সেখানে তা হতে বাধ্য। লেনিন সেই কারণেই অনেক ঝুঁকি নিয়েই নয়া অর্থনীতির (নিউ ইকনোমিক পলিসি-এনইপি) পথ নিয়েছিলেন যা এখন চীন, ভিয়েতনাম ইত্যাদি সমাজতান্ত্রিক দেশেও কমবেশি অনুসরণ করতে হচ্ছে।
।। দুই ।।
সিপিআই(এম) ২০০০ সালেই, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ২০-২৩ অক্টোবর, তিরুবনন্তপুরমে অনুষ্ঠিত বিশেষ সম্মেলনে, ১৯৬৪ সালের ৩১ অক্টোবর কলকাতায় অনুষ্ঠিত সপ্তম কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচি সময়োপযোগী করে গ্রহণ করেছিল। সেখানে ‘সমসাময়িক বিশ্বে সমাজতন্ত্র’ শীর্ষক অংশটি যুক্ত করা হয় (প্যারা ২.১-২.৯)। সেখানে অধুনালুপ্ত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিরাট সাফল্যগুলির উল্লেখ করার পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইয়োরোপের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি যে গুরুতর ভুল করেছিল তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছিল। এই ভুলের উৎসগুলিও সেখানে উল্লেখ করে বলা হয়েছিলঃ ‘‘সমাজতন্ত্র নির্মাণের দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব, পার্টি ও রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, অর্থনীতি ও তা পরিচালনার ক্ষেত্রে সময়মতো যথাযথ পরিবর্তন আনার ব্যর্থতা, পার্টি, রাষ্ট্র ও সমাজে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, আমলাতান্ত্রিকতার বৃদ্ধি এবং মতাদর্শগত চেতনার অবক্ষয়। এইসব কারণ সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের নিরন্তর প্রচেষ্টাকে সাহায্য করেছিল। এইসব বিকৃতি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যথার্থতাকে নস্যাৎ করে না বরং তা বৈপ্লবিক তত্ত্ব ও প্রয়োগ থেকে বিচ্যুতির প্রতিফলন (নিম্নরেখ এই প্রবন্ধ লেখকের)। এই দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন হলো একবিংশ শতাব্দীতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক তা ব্যাখ্যা করার জন্য।
।। তিন ।।
মার্কস দেখিয়েছিলেন, কেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকট অনিবার্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যখন নিত্যনতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটছে তখন পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক কিভাবে মুষ্টিমেয় পুঁজির মালিকদের হাতে বিপুল সম্পদ বৃদ্ধির সাথেসাথে বিপুল সংখ্যক ক্রয়ক্ষমতাহীন শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা তথাকথিত অতি উৎপাদনের সংকট তৈরি করে। তিনি এটাও বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, এই সংকট থেকে উদ্ধার পেতে, উৎপাদিকা শক্তির একটি অংশকে ধ্বংস করে, উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। এইভাবেই প্রতিটি সংকট থেকে পুঁজি আরও শক্তিশালী হয়। মার্কসই এই প্রক্রিয়ায় কীভাবে পুঁজির পুঞ্জীভবন (concentration) ও কেন্দ্রীভবন (centralisation) ঘটে তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এই শিক্ষাকে অনুসরণ করে লেনিন বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করেছিলেন। মার্কসবাদের বিকাশে লেনিনের অবদানের কথা মনে রেখেই, লেনিনের মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কথাটি প্রচলিত হয়। এখানে মার্কসের অভিন্ন হৃদয় সাথী এঙ্গেলস ও পরবর্তীকালে লেনিনের অবদান নিয়ে লেখার অবকাশ নেই। এঁদের পরবর্তী মার্কসবাদীদের অবদান তো দূরের কথা, তাঁদের নাম উল্লেখ করার মতো স্থান সংকুলান করা গেল না। এখানে সবটা জুড়ে রয়েছে একুশ শতকে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা। একুশ শতকেও যে মার্কসবাদ প্রাসঙ্গিক তা এই চলতি বছরের বিশ্বব্যাপী মন্দা ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে স্পষ্ট হয়েছে। মার্কস পুঁজিবাদের ইতিহাসে পুঁজির সঞ্চয় যে দুইভাবে ঘটে তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সহজ কথায় বললে তার একটা হলো শোষণ (appropriation) এবং অপরটি হলো লুণ্ঠন (expropriation), প্রথমটি হলো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্ত মূল্য যা শ্রমিক সৃষ্টি করে তা মালিক আত্মসাৎ করে। দ্বিতীয়টি হলো বলপ্রয়োগ করে সরাসরি লুটের মাধ্যমে সঞ্চয় যাকে মার্কস আদিম সঞ্চয় বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। অতীতে উপনিবেশগুলি থেকে নৃশংস পদ্ধতিতে জবরদস্তি করে দখল নেওয়া পুঁজি বা এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণ ইত্যাদি লুণ্ঠনের পর্যায়ে পড়ে। এই দুই ধরনের পুঁজির সহাবস্থান পুঁজিবাদের সমগ্র যুগ ধরেই চলে আসছে। অবশ্য এর মধ্যে কোনটি কখন প্রধান হয়ে দাঁড়ায় সেটা বিশ্লেষণ করতে হয়। এটা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, এখন বিশ্ব পুঁজিবাদের মূল চরিত্র হল লুটেরা পুঁজির আধিপত্য - উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশগুলিতে। আদিম (সঞ্চয়) বনাম আধুনিক এই ধরনের দুটি ইতিহাসগত পর্যায় বলে ব্যাখ্যা করা ভুল। মার্কসবাদীরা এটিকে বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি বলেই ব্যাখ্যা করেন। প্রসঙ্গত, এখানে মার্কস লিখিত ‘লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার থেকে উদ্ধৃতি দিতে হচ্ছে। কীভাবে ফ্রান্সে পার্লামেন্ট ভেঙে, সংবিধান শিকেয় তুলে রেখে লুই বোনাপার্ট তাঁর পছন্দের সামরিকবাহিনীর প্রধান এবং লুম্পেনবাহিনীর সাহায্যে স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন সেই প্রেক্ষাপটে মার্কস ফিনান্স অভিজাতবর্গের মনোভাব তাদের ইউরোপীয় মুখপত্র, লন্ডনের Economist পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন ‘কুদেতার ঠিক ৪ দিন আগে... ১৮৫১ সালের ২৯ নভেম্বর Economist নিজের নামে ঘোষণা করলঃ রাষ্ট্রপতিই শৃঙ্খলার রক্ষক এবং ইয়োরোপের প্রতিটি শেয়ার বাজার তাঁকে এখন সেইভাবে দেখছে।’’ এখানে রাষ্ট্রপতি বলতে কুদেতার নেতা লুই বোনাপার্টকে বোঝানো হচ্ছে। মার্কস এরপর ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ ‘‘ফিনান্স অভিন্নতা বলতে এক্ষেত্রে কেবল তাদের বোঝাচ্ছে না, যারা বৃহৎ ঋণ ব্যবসায়ী এবং শেয়ার বাজারে যারা ফাটকা খেলে, অর্থাৎ যাদের সম্বন্ধে অবিলম্বেই বোঝা যায় যে, তাদের স্বার্থ এবং রাষ্ট্রশক্তির স্বার্থ অভিন্ন। সমগ্র আধুনিক ফিনান্স, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা সম্পূর্ণত সরকারি ঋণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এদের কারবারি পুঁজির একাংশ আবশ্যিকভাবেই সরকারি ফান্ডে নিযুক্ত থাকে যে ফান্ড তাড়াতাড়ি বেচে নগদ টাকায় পরিণত করা চলে, সেখানেই সুদে খাটে। তাদের ডিপোজিট, অর্থাৎ যে পুঁজিটা এদের হাতে ন্যস্ত হয় ও এরা বণিক ও শিল্পপতিদের ভাগ করে দেয়, তার কিয়দংশ আসছে সরকারি সিকিউরিটির মালিকদের লভ্যাংশ থেকে। প্রতি যুগেই যদি রাষ্ট্রশক্তির স্থিতিশীলতা সমগ্র মুদ্রার বাজার এবং তার পূজারিদের দৃষ্টিতে মোজেস ও পয়গম্বরদের মর্যাদা পেয়ে থাকে, তবে এই যুগে সে মনোভাব আরও বৃদ্ধি পাবে না কেন, যখন প্রতিটি প্রলয়, বন্যা পুরাতন রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ঋণও ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ভয় দেখাচ্ছে? ‘‘শিল্প বুর্জোয়ারাও শৃঙ্খলার প্রতি অন্ধবিশ্বাসবশত’’ যে উপরোক্ত ফিনান্স পুঁজির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তা লেনিনের লেখা সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্যগুলির অনেক আগেই কি মার্কস বলে যাননি? কীভাবে অন্যান্য পত্র-পত্রিকাগুলি Economist-এর বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল এবং ‘‘গির্জার পুরোহিতের মঞ্চ থেকে এই ঘোষণা হচ্ছেঃ গোলযোগের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনায় শেয়ারে চঞ্চলতা এবং কার্যনির্বাহক (লুই বোনাপার্ট - লেখক) এ ক্ষমতার জয়লাভ উপলব্ধি হওয়ামাত্র শেয়ারে স্থিরভাব এই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।’’
এখন আমাদের দেশে কর্পোরেট-হিন্দুত্ব জোটের ফ্যাসিস্তসুলভ রাজত্বে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট ও তার পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে মার্কসের উপরোক্ত বিশ্লেষণ (১৭০ বছর আগে) কি এখনও প্রাসঙ্গিক নয়?
।। চার ।।
মার্কসবাদ আকাশ থেকে পড়েনি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানিতে ফয়েরবাখের বস্তুবাদী দর্শন এবং হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্বের মধ্যে অসম্পূর্ণতাকে পূরণ করেই মার্কসবাদী দর্শনের উদ্ভব হয়েছিল। তার আগে সুপ্রাচীন বস্তুবাদী দর্শন থেকে শুরু করে ফয়েরবাখ পর্যন্ত বস্তুবাদ বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ‘বস্তুর অস্তিত্বের রূপই হলো গতি’, এবং গতির সেই বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলির বিকাশের সঙ্গে সাজুয্য রেখে মার্কস তাকে বিকশিত করেছিলেন। তেমনি হেগেলের অধিবিদ্যক (মেটাফিজিক্স) দ্বন্দ্বতত্ত্বকে তিনি বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বে উন্নীত করেছিলেন, যার মূল কথা হলো - ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ’।
এ পর্যন্ত বিজ্ঞানের যা বিকাশ হয়েছে তার সঙ্গে কেবল মার্কসবাদী দর্শন সঙ্গতিপূর্ণ। মার্কসের সময় চিরায়ত অর্থশাস্ত্রের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিল ব্রিটেনে। অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশ্লেষণে বহুদূর অগ্রসর হয়েও যেখানে আটকে গিয়েছিলেন, উদ্বৃত্তমূল্যের তত্ত্ব আবিষ্কার করার পাশাপাশি ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে ‘পুঁজি’র অনাবিষ্কৃত রহস্যের সমাধান করেছিলেন। এর প্রথম খণ্ডটি মার্কসের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হলেও পরবর্তী খণ্ডগুলি মার্কসের স্বরচিত খসড়ার ওপর নির্ভর করেই এঙ্গেলসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। বর্তমান পুঁজিবাদের লুটেরা পুঁজির আধিপত্য যেমনটা পূর্বেই বলা হয়েছে, ‘ক্যাপিটাল’-এ ‘আদিম সঞ্চয়’-এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত মাত্র। সমাজবাদ-সাম্যবাদ ইত্যাদি শব্দগুলি মার্কসের আগেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেগুলি ছিল মূলত ‘কাল্পনিক’। মার্কস-এঙ্গেলস তাকে বৈজ্ঞানিক রূপ দিয়েছেন। যার মূল কথা হলো - সংকট যত তীব্র হোক না কেন ধনতন্ত্র আপনা আপনি ভেঙে পড়ে না। যেমনটা আমাদের মতাদর্শগত দলিলে বলা হয়েছে - ‘‘সুতরাং ধনতন্ত্রকে উৎখাত করতে হয়। তা নির্ণায়কভাবে নির্ভর করছে সমাজের সেই বস্তুগত শক্তিকে শক্তিশালী করার ওপর, যে শক্তির নেতৃত্বে থাকছে শ্রমিকশ্রেণি, যা গণসংগ্রামসমূহের মাধ্যমে শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্রতর করে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিযান চালাতে পারে। এই বস্তুগত শক্তি প্রস্তুত করা এবং তাকে শক্তিশালী করাই হলো ‘বিষয়ীগত উপাদান’। তার জোর বাড়ানো একটি অত্যাবশ্যক শর্ত। বস্তুগত উপাদান - অর্থাৎ সংকটের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি - বিপ্লবী অগ্রগতির পক্ষে যতই সহায়ক হোক, ‘বিষয়ীগত উপাদান’-কে শক্তিশালী না করে সেই পরিস্থিতিকে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আঘাতে পরিণত করা যায় না।’’