৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০
দু’শতক বাদেও বিকল্প কোথায়?
শমীক লাহিড়ী
২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮ সাল। লন্ডনে একটা ২৩ পাতার ছোট্ট ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হলো। লন্ডনের বিশপস গেটের ৪৬, লিভারপুল স্ট্রিটে ছোট্ট একটি ছাপাখানায় এটি ছাপা হয়েছিল। মাত্র কয়েকশো কপি ছেপে বেরিয়েছিল একদম সাদামাটা চেহারার পুস্তিকাটি। নাম ‘ম্যানিফেস্টো ডেয়ার কমুনিস্টিশেন পার্টাই’- কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার ২৩ পাতার এই ঘোষণাপত্র পৃথিবীর ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবার ঠিকানা হবে, এটা সেদিন কেউই বোঝেননি। এই ঘোষণাপত্রে প্রথম শোষণহীন পৃথিবীর ঘোষণা করেছিলেন মার্কস এবং এঙ্গেলস। এই ইশতেহারে তাঁরা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণিকে দেখালেন - পুঁজিবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এই পরাজয়কে তরান্বিত করার জন্য শ্রমিকশ্রেণির কর্তব্য পুঁজির বিরোধিতা করা ও বুর্জোয়াদের উচ্ছেদের জন্য বৈপ্লবিক সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়া। এইখানেই তাঁদের ঐতিহাসিক ঘোষণাঃ ‘‘সমগ্র ইয়োরোপ কমিউনিজমের ভূত দেখছে।’’
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে দীর্ঘ ২৪ বছর এটি আর ছাপা হয়নি। আর আজকের পৃথিবীতে, যখন প্রায় গোটা পৃথিবী পুঁজিবাদীদের দখলে, সেখানেও সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় অন্যতম এই ২৩ পাতার ঘোষণাপত্রটি।
তাঁর মৃত্যুর ১৪০ বছর বাদে পুঁজিবাদ আজও কমিউনিজমের ভূত দেখে। তাঁরা যতই প্রচার করুক মার্কসবাদ অচল, পুরানো দস্তাবেজ কিন্তু প্রতিদিন মার্কসবাদকে আক্রমণ করেই পুঁজিবাদের সমর্থক অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকদের বক্তৃতা করতে হয় অথবা লিখতে হয়। মার্কসবাদ যদি এত অপ্রাসঙ্গিকই হবে, তাহলে প্রতিদিন তাঁর সমালোচনায় এত আগ্রহী কেন পুঁজিবাদীরা।
এটা ঠিক জীবদ্দশায় শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মার্কসকে প্রতিদিন সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। কখনো তাঁর বিরোধী মতবাদের বিরুদ্ধে আবার কখনো তীব্র দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ তাঁকে তাড়িয়েছে। কেন? কারণ তাঁরা মার্কস-এর বিপ্লবী তত্ত্বকে ভয় পেয়েছিল। পুঁজিবাদের পক্ষের গবেষকরা অনেক সময়ে মার্কসকে একজন ‘ব্যর্থ বিপ্লবী’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী ‘প্যারি কমিউন’ ছিল ব্যর্থ বিপ্লব। মার্কসের কথায় নাকি বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ অথবা বুদ্ধিজীবীরা কেউই প্রভাবিত হননি। ব্যঙ্গ করে তাঁরা বলেন - মার্কস-এর মৃত্যুর সময় তাঁর সমাধিতে মাত্র ১১ জন উপস্থিত ছিলেন।
তাঁরা আরও যুক্তি দেন - কমিউনিস্ট ইশ্তেহার তো ২৪ বছর ধরে ছাপাই হয়নি। এমনকী ১৮৬৭ সালে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ দাস ক্যাপিটাল-এর প্রতিও কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ৪বছরে মাত্র ১ হাজার কপি জার্মান সংস্করণ বিক্রি হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর ৩ বছর পরে ১৮৮৬ সালে এটা প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ১৮৪৫ সালে মার্কস-এর লেখা ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কেউ প্রকাশই করেনি। ওই সময়ে তাঁর লেখা ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ অথবা ‘প্যারি ম্যানুস্ক্রিপ্ট অফ ১৮৪৪’ অপ্রকাশিত ছিল ১৯২০ সাল পর্যন্ত। এইরকম অনেক উদ্ভট উদাহারণ দিয়ে মার্কসবাদ বিরোধীরা মার্কসকে আক্রমণ করেন। কিন্তু একবারও বলেন না যে, তাঁর মৃত্যুর পর এঙ্গেলস-এর নেতৃত্বে ক্যাপিটাল-এর আরও ২টি খণ্ড প্রকাশিত হয়, যেগুলি আজও পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের মধ্যে অন্যতম।
‘ইলেভেন থিসিস অন ফয়েরবাখ’ যা মার্কস ১৮৪৫ সালে লিখেছিলেন এবং ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানেই তাঁর বিখ্যাত উক্তি - “এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সব দার্শনিক নানাভাবে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু আসল কথা হলো পরিবর্তন করা।” অন্যান্য দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদদের চাইতে এইখানেই মার্কস অনন্য। তিনি এমন এক পৃথিবীর স্বপ্নকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে এনেছিলেন, যাকে অস্বীকার করার মতো কোনো তত্ত্ব কেউ এখনও পর্যন্ত আনতে পারেননি। শোষণমুক্ত সমাজ কোনো স্বপ্ন নয়, এটা সম্ভব। কেমনভাবে সম্ভব - সেই তত্ত্বের আবিষ্কার মার্কসকে মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে। যাঁরা বলতেন মার্কস বিপ্লবী কিন্তু কেবল স্বপ্ন দেখান, যা কখনো সম্ভব নয়, মাত্র ৭১ দিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্যারি কমিউন তাঁদের প্রথম ধাক্কা দিয়েছিল। এরপর ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র গঠনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বড়ো ধাক্কা খায় মার্কসবাদ বিরোধীরা। এরপর পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ বিংশ শতকের মধ্যভাগে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাস্তায় হেঁটেছিল।
তৎকালীন সোভিয়েতের সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদী দুনিয়ার অর্থনীতিকে পিছনে ফেলে প্রমাণ করেছিল, মার্কস-এর মতবাদ মানবমুক্তির এবং মানবসভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মতবাদ। ১৯২০/১৯৩০-এর দশকে যখন আমেরিকা সহ সমগ্র ইয়োরোপ গভীর সংকটে, তখন তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্র নিজের দেশের সব মানুষের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজ, উন্নত জীবনধারণের ব্যবস্থা করে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কেন এই ব্যবস্থা ১৯৯০-এর দশকে ভেঙে পড়েছিল, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক বিবাদ আলোচনা গবেষণা হয়েছে এবং এখনও চলছে। এটা এই ছোট্ট নিবন্ধের আলোচনার বিষয় নয়।
মার্কস-এর জীবন ছিল এক প্রকৃত বিপ্লবীর জীবন। সমগ্র জীবন তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বিপ্লবের জন্য। বিপ্লবী মার্কসকে তৎকালীন শাসকশ্রেণির কোপে পড়তে হয়েছিল বারবার। তিনি দারিদ্র্যকে গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। কোনদিন আত্মসমর্পণ করেননি। নিজের মতবাদকে কোনদিন ত্যাগ করেননি শত দরিদ্রতা সত্ত্বেও। তৎকালীন বিখ্যাত জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা মার্কস স্বচ্ছল জীবনযাপনের রাস্তা ত্যাগ করে সমগ্র জীবন বিপ্লবের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর প্রথম ৩ সন্তান অত্যন্ত অল্প বয়সে মারা যায় এবং তাঁ স্ত্রী জেনি চতুর্থ সন্তান মৃত অবস্থায় প্রসব করেন। এসবই দারিদ্র্যের কারণে ঘটেছিল।
শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁর তীক্ষ্ণ লেখা প্রথমে প্রকাশিত হতো জার্মানির ‘রাইনেস জাইটুং’ পত্রিকায়। এই কারণে তাঁকে জার্মানির কোলন শহর থেকে বিতাড়িত করা হয় ১৮৪৩ সালে। তিনি চলে যান প্যারিস শহরে। এখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ফেডরিখ এঙ্গেলস-এর। ১৮৪৪ সালে ‘কাফে দে না রিজেন্স’-এ এঙ্গেলস এর সাথে তাঁর দীর্ঘ ১০ দিনের মত বিনিময়ের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধুত্ব, যা সমগ্র পৃথিবীর বিপ্লবী শক্তির সামনে উপস্থিত করেছিল একের পর এক দিকদর্শনকারী বিপ্লবী তত্ত্ব। এঙ্গেলস-এর পিতা ছিলেন একজন বস্তু উৎপাদনকারী শিল্পপতি। ধনী পরিবারের সন্তান এঙ্গেলস-এর অনুপ্রেরণা এবং অর্থ সাহায্য ছাড়া মার্কস তাঁর যুগান্তকারী লেখনী কখনই প্রকাশ করতে পারতেন না।
১৮৪৫ সালে ফ্রান্স থেকে শাসকশ্রেণি তাঁকে বিতাড়ন করে। তিনি চলে যান বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরে। সেখান থেকে শাসকশ্রেণি আবার তাঁকে বিতাড়ন করে। তিনি লুকিয়ে আবার প্যারিস শহরে চলে যান। ১৮৪৯ সালে আবার তাঁকে বিতাড়িত হতে হয় প্যারিস শহর থেকে। তাঁর পরিবার নিয়ে এবার তিনি লুকিয়ে পালিয়ে যান লন্ডন শহরে। এখানেই ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও জাদুঘরে অর্থনীতি নিয়ে তিনি পড়াশুনা শুরু করেন। এখানেই তিনি তাঁর বিখ্যাত দাস ক্যাপিটাল গ্রন্থ লেখার জন্য গবেষণা শুরু করেন। এই শহরেই তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বসবাস করেন এবং তাঁকে হাইগেট কবরস্থানে সমাধিত করা হয় ১৮৮৩ সালে।
১৮৪৩-১৮৫৩ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনে দারিদ্র্য আর অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। ১৮৫২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এঙ্গেলসকে একটি চিঠিতে তিনি লিখছেনঃ “আজ যখন তোমার চিঠিটা পৌঁছাল, বাড়িতে তখন খুবই গুরুতর অবস্থা। বৌয়ের অসুখ, রেনিচেনের অসুখ, লেনচেনের মাথার ঠিক নেই। ডাক্তার আগেও ডাকিনি, এখন ডাকব তাও সম্ভব নয় কারণ ওষুধ কেনবার পয়সাই নেই আমার কাছে। গত আটদিন কি দশদিন বাড়ির লোকদের আমি শুধু রুটি আর আলু খাইয়ে রেখেছি, কিন্তু আজ সেটুকুও জোটাতে পারব কীনা সন্দেহ। বোঝাই যাচ্ছে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা যতোটুকু হয়েছে তাতে কাজ হয়নি।”
কিন্তু এর মধ্যেই তিনি কোলন বিচার সম্পর্কিত পুস্তিকা লিখে আমেরিকায় প্রকাশের জন্য পাঠালেন। কিন্তু এমন আর্থিক সংকটের মধ্যেও তাঁর রসিকতা বোধ ছিল প্রবল। ১৮৫২ সালের ৭ ডিসেম্বর আডলফ্ ব্লুস-কে লিখেছিলেনঃ “পশ্চাদদেশের ও পদযুগলের যথেষ্ট আবরণের অভাবের জন্য গ্রন্থকার কার্যত গৃহবন্দি হয়ে আছেন।” কিন্তু এই প্রবল দরিদ্রতা সত্ত্বেও মার্কস অথবা তাঁর স্ত্রী জেনির কোনো আক্ষেপ ছিল না। মার্কস ১৮৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ার ইওসেফ ভেডেমাইয়ারকে লিখেছিলেনঃ “ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়েও আমার লক্ষ্যের দিকে আমাকে যেতেই হবে। বুর্জোয়া সমাজ আমাকে একটা টাকা উপার্জনের যন্ত্রে পরিণত করুক তা আমি কিছুতেই হতে দেবো না।”
১৮৫০ সালের ২৯ নভেম্বর মার্কস-এর প্রাণের সন্তান হাইনরিখ গুইডো মাত্র ১ বছর বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। এর মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তাঁদের ছোট্ট মেয়ে ফ্রানৎসিস্কাকে হারালেন মার্কস এবং জেনি। এর মাত্র তিন বছরের মাথায় তাঁদের প্রিয় পুত্র এডগার যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মার্কস এবং জেনি ভেঙে পড়লেন। ১৮৫৫ সালের ৬ এপ্রিল শোকাচ্ছন্ন মার্কস এঙ্গেলসকে লিখেছিলেনঃ “হতভাগ্য মুশ বিদায় নিলো। আজ ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে আমার কোলে ও ঘুমিয়ে পড়ল। তুমি তোমার বন্ধুত্ব দিয়ে এই ভয়ংকর সময়টা আমাদের কাছে সহনীয় করেছ, সেকথা আমি কখনো ভুলবো না। আমাদের আদরের সন্তানটি মারা যাবার পর বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে, অনাথ হয়ে গিয়েছে। জীবনের সমস্ত রকমের দুর্ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে আমি এসেছি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সত্যিকারের ট্র্যাজেডি কাকে বলে।”
কিন্তু এত যন্ত্রণা ও দরিদ্রতা সত্ত্বেও মার্কস-এর স্ত্রী জেনি হতাশাগ্রস্ত না হয়ে মার্কসকে প্রতি মুহূর্তে উৎসাহিত করতেন। ১৮৫০ সালের ২০ মে ইওসেফ ভেডেমাইয়ারকে লেখা একটি চিঠিতে জেনি লিখছেনঃ “ভেবো না যে এসব তুচ্ছ দুর্দশা আমাকে ভেঙে ফেলেছে। আর একথা আমি ভালো করে জানি যে, আমাদের সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন নয়। আমার মতো ভাগ্য আর কতজনের আছে। আমার প্রিয় স্বামী, আমার জীবনের ভরসা, এখনও আমার পাশেই আছেন এর চাইতে বড়ো ভাগ্য আর কী হতে পারে।” রাজনৈতিক কর্তব্য পালনের জন্য সবরকমের ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে, দারিদ্র্য ও জীবন যন্ত্রণাকে সহজভাবে আলিঙ্গন করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন বিপ্লবী মার্কস ও তাঁর যোগ্য স্ত্রী জেনি।
একদিকে প্রবল অনুসন্ধিৎসু মন, অপরিসীম মেধা, অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা আবার অন্যদিকে বিপ্লব সমর্পিত প্রাণ কার্ল হাইনরিখ মার্কস পৃথিবীর অন্যতম সেরা দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ। পুঁজিবাদকে বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখাগুলিকে মর্যাদা দিতে বাধ্য হয় আজকের পৃথিবীর নামজাদা পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাও। তাঁর মৃত্যুর পর এঙ্গেলস লিখেছিলেনঃ “মানবজাতি এমন একটি মস্তিষ্ক হারাল যেটি ছিল আমাদের সময়ের সবচেয়ে সেরা মস্তিষ্ক। শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন চলতে থাকবে কিন্তু সেই কেন্দ্রীয় বিন্দুটি আর থাকছে না, যার কাছে চূড়ান্ত মুহূর্তগুলোতে এসে দাঁড়াতেন ফরাসিরা, রুশরা, আমেরিকানরা ও জার্মানরা। এখানে এসে তাঁরা পেতেন স্বচ্ছ ও অবিংসবাদী পরামর্শ, যা একমাত্র দিতে পারেন তাঁর মতো প্রতিভাবান ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ব্যক্তি।”
১৮৮৩ সালের ১৭ মার্চ হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে স্ত্রী জেনির সমাধির পাশে সমাধিত কার্ল মার্কস-এর সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন বিপ্লবী শপথ নিয়েছিলেনঃ “আমরা শোক করব না, যে মহানকে হারালাম তাঁর চেতনায় কাজ করে যাবো। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করব তিনি আমাদের যা শিখিয়েছেন, যা আশা করেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বাস্তব করে তুলতে। আমাদের পক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি এটাই হবে শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা। হে প্রয়াত বন্ধু, তোমার সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিলাম, তুমি আমাদের যে পথ দেখিয়েছ সেই পথে শেষ পর্যন্ত অভিযান চালাব।”
পৃথিবীতে যতদিন অসাম্য-বঞ্চনা-ক্ষুধা-অশিক্ষা-দারিদ্র্য থাকবে, ততদিন মার্কসবাদ প্রাসঙ্গিক থাকবে। আজকের উদারনীতি অর্থনীতির যুগে মার্কস আরও প্রাসঙ্গিক। করপোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা বাড়ছে লাফিয়ে, আর শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমছে। পৃথিবীর ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৯০ শতাংশ সম্পদ আর ৯০ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র ১০ শতাংশ সম্পদ। সম্পদের এই অসম বণ্টনের কোনো উত্তর পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা দিতে পারেন না। কেবলমাত্র এমন হওয়া উচিত নয় - এমন দায় এড়ানো মন্তব্য করার মধ্যে নিজেদের সীমিত রাখেন। মার্কসই পৃথিবীতে প্রথম দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদের নিজস্ব নিয়মেই এই অসাম্যের সমাজ গঠিত হয়। তাঁর উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব পুঁজিবাদী শোষণের আসল চেহারা তুলে ধরেছিল, যার যুক্তিগ্রাহ্য কোনো বিকল্প তত্ত্ব এখনও পর্যন্ত কেউ উপস্থিত করতে পারেননি।
পুঁজি যখন লাগামহীন হয় তখন তার আচরণ হয় পাগলা ঘোড়ার মতন। মুনাফার জন্য যা খুশি করবার চেষ্টা করে পুঁজি। শ্রমিকনেতা টি. ডানিং-কে উদ্বৃত করে মার্কস যা উল্লেখ করেছিলেন তা অনেকটা এরকমই - পুঁজি যদি ২০ শতাশ মুনাফার সুযোগ পায় তাহলে বিনিয়োজিত হতে চায়। যদি ৫০ শতাংশের সুযোগ পায় তাহলে বিনিয়োজিত হওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠে। যদি ১০০ শতাংশ মুনাফার সুযোগ খুঁজে পায় তাহলে ছটফট করতে থাকে বিনিয়োজিত হওয়ার জন্য। আর ৩০০ শতাংশ মুনাফার সুযোগ দেখলে পৃথিবী ধ্বংস করতে পিছুপা হয় না পুঁজিপতিরা। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনি দখলের জন্য নির্বিচারে ৩ কোটির বেশি মানুষকে হত্যা করতে পিছপা হয়নি আমেরিকা-ইয়োরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি।
একমেরুর বিশ্বে এখন পুঁজিবাদই রাজা। মার্কস বহু আগেই দেখিয়েছিলেন পুঁজির আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে মুনাফার জন্য সে কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে কাজ করে। আজকের ধান্দার পুঁজিবাদ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) মার্কস-এর ব্যাখ্যাকেই সঠিক বলে প্রমাণ করছে। ধান্দার পুঁজিবাদ আরও মুনাফার জন্য দেশের সাধারণ মানুষের সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনকানুন সব পাল্টে ফেলছে। স্থায়ী শ্রমিকের বদলে অস্থায়ী শ্রমিক রাখো - এর ফলে মজুরির খরচ কমবে, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বাবদ খরচ কমবে - মুনাফা বাড়বে পুঁজিপতিদের। তাই পৃথিবীতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় একই জায়গায় বিগত ১ দশক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও পুঁজিপতিদের মুনাফা বেড়েছে বহুগুণ। আমাদের দেশ ভারত সহ প্রায় সব দেশে চিকিৎসা-শিক্ষা-বাসস্থান ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বরাদ্দ টাকা ক্রমাগত কমেই চলেছে।
এই ক্রমবর্ধমান অসাম্য-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মার্কসবাদ ছাড়া লড়াইয়ের হাতিয়ার আর কী আছে। পুঁজিবাদের মানবিক মুখ যাঁরা সন্ধান করেন মার্কস তাঁদের মুখোশ খুলে দিয়ে বলেছিলেন, পুঁজিবাদের উচ্ছেদ এবং সমাজতন্ত্র নির্মাণই একমাত্র শোষণ-নির্যাতন-বঞ্চনা-অসাম্য-যুদ্ধ থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাঁর জন্মের পর পৃথিবী আরও ২০৫ বছর পথ হেঁটেছে। তাঁর মৃত্যুর পর ১৪০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজও পৃথিবীর সব অর্থনীতিবিদ-দার্শনিককে তাঁদের চিন্তায়, লেখায়, বক্তৃতায় মার্কসকে উদ্ধৃত করতেই হয়, সে তিনি মার্কসবাদীই হোন অথবা মার্কসবাদ বিরোধীই হোন। মার্কস-এর মতবাদের কোনো বিকল্প মতবাদ কেউ উপস্থিত করতে পারেননি আজও। কারণ এখনও পর্যন্ত মার্কসবাদই দর্শন এবং অর্থনীতির সবচাইতে আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।