৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০
মার্কস-এর 'পুঁজি'র কথা
ঈশিতা মুখার্জি
কার্ল মার্কস-এর “পুঁজি” বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পঠিত, অনূদিত এবং বিতর্কিত বই। “পুঁজির” তিনটি খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদের সাথেই আমরা বেশি পরিচিত। তবে অনূদিত বইগুলির অনেক বেশি খণ্ডও আছে। এর প্রথম খণ্ড মার্কসের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হলেও অন্য দুটি খণ্ড তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ করেন ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস। কী উদ্দেশ্য ছিল এই বইয়ের? কী বোঝাতে চেয়েছিলেন কার্ল মার্কস এই বইতে?
এই বইয়ের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদ এবং পুঁজিবাদের বিকাশকে শ্রমিকশ্রেণির চোখ দিয়ে দেখা, ব্যাখ্যা করা। মার্কস তাঁর জীবদ্দশায় পুঁজিবাদের উত্থান দেখেছেন। সেই উত্থান দেখে, শ্রমিকশ্রেণির জীবনযাপন দেখে তিনি পুঁজিবাদের ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর বই “পুজি”র প্রথম খণ্ডতে বোঝানো হয়েছে, পুঁজির উৎপাদনের পদ্ধতি। দ্বিতীয় খণ্ডে বোঝানো হয়েছে, পুঁজির ঘূর্ণাবর্ত বা চলনের কথা। তৃতীয় খণ্ডে বোঝানো হয়েছে, উদ্বৃত্ত মূল্যের কথা। প্রথম খণ্ডই বেশি প্রচলিত। বইটির কয়েকটি মৌলিক বিষয় নিচে আলোচিত করা হলো।
পণ্য
পুঁজিবাদ পণ্য উৎপাদন ছাড়া গড়ে ওঠে না। এমন নয় যে প্রাক্-পুঁজিবাদী যুগে পণ্য উৎপাদন হতো না, কিন্তু এক নির্দিষ্ট উপায়ে পণ্যের উৎপাদন এমন যদি হয় যে সেই উৎপাদনের ফলে পুঞ্জীভবন হয় এবং পুঁজির পুঞ্জীভবনের সাহায্যেই উৎপাদন বাড়তে থাকে, চক্রাকারে একজনের হাত থেকে অন্যের হাতে ঘুরতে থাকে তখনই পুঁজিবাদ গড়ে ওঠে। পুঁজিবাদের ভিত্তি হলো পণ্য উৎপাদন। কিন্তু পুঁজির এই পণ্য উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। পুঁজি শ্রমকে নিযুক্ত করে। শ্রমই পণ্য উৎপাদন করে। শ্রম ছাড়া কোনো উৎপাদন সম্ভব হয় না। পুঁজিবাদের মধ্যে আছে পণ্য-সর্বস্বতা। কিন্তু শুধু পণ্যের দিকে তাকালেই কি উৎপাদনের প্রকৃত চরিত্র বোঝা যাবে? যে শ্রম ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয়, সেই শ্রমই তো পণ্যের মূল্য সৃষ্টি করে। শ্রমের চোখ দিয়ে না দেখলে পণ্যের চরিত্রও সামনে আসে না। পণ্যের দাম পণ্যের মূল্যের উপর নির্ভর করে। পণ্য কি কাজে লাগে তাই দিয়ে তৈরি হয় পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য। কিন্তু ব্যবহারিক মূল্যের সাথে দামের সম্পর্ক নেই। পণ্যের বিনিময়যোগ্যতা তৈরি করে পণ্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত শ্রম। পণ্যের এই বিনিময়মূল্য পণ্যের দাম স্থির করে। কিন্তু এই বিনিময়যোগ্যতার স্রষ্টা শ্রম। পণ্য সর্বস্ব পুঁজিবাদ পণ্যকেই সবচেয়ে উপরে স্থান দেয়।
নয়া উদারীকরণের যুগে আমরা এই পণ্য সর্বস্বতা খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম। সবকিছুকে পণ্য হয়ে উঠতে হবে; না হলে তো তার পুঁজিবাদে অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মানুষ যদি প্রকৃতি থেকে পাওয়া উপাদানগুলিকে পরিবর্তিত করে তার ব্যবহারের উপযোগী না করে তুলত, পণ্যসর্বস্ব পুঁজিবাদ কীভাবে বজায় থাকত? শ্রম মূল্য তৈরি করে - এটা প্রযুক্তি ব্যবহার হলেও সত্যি।
মুদ্রা বা টাকা
পণ্য উৎপাদন হয় বিনিময়ের জন্য বা বাজারে বিক্রির জন্য। বাজারে পণ্য কেনাবেচা হয় মুদ্রার বিনিময়ে। তাহলে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় দুটি পণ্য কেনাবেচা হলে হাত বদল হলো এবং এই হাতবদলের মাঝখানে রইল মুদ্রা। মুদ্রার দুটি কাজ। এক, মুদ্রা পণ্যের মূল্যের এক পরিমাপ। দুই, মুদ্রা এক বিনিময় মাধ্যম। এই মুদ্রা বাজারে এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরতে থাকে। মুদ্রা বা টাকার মাধ্যমে পণ্যের দামের প্রকাশ হয়।
বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মধ্যে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় প্রতিযোগিতা আছে। মুদ্রার প্রতিযোগিতা বা কোনো একটি দেশের মুদ্রার একাধিপত্য পুঁজিবাদী বাজারে নিয়ন্ত্রণ নির্দিষ্ট করে। যেমন মার্কিন ডলারের বাজারে একাধিপত্যের কথা উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। আন্তঃপুঁজিবাদী দ্বন্দ্ব বহুসময়ে মুদ্রার দামের ওঠাপড়া দেখে বোঝা যায়।
এই মুদ্রা পুঞ্জীভবনে সাহায্য করে। দুটি পণ্য যখন বাজারে কেনাবেচা হয়, মাঝে থাকে মুদ্রা। কিন্তু কেনাবেচা তো কখনও পুঁজিবাদে অন্তিম লগ্নে পৌঁছে যায় না; কেনাবেচা হতেই থাকে। এই ক্রমাগত হতে থাকা কেনাবেচার শুরুতে যে পরিমাণ মুদ্রা ছিল, তা তো এই ক্রমাগত কেনাবেচার মাধ্যমে হাত ঘুরতে ঘুরতে বাড়তে থাকে। মুদ্রার এই বাড়ানোর প্রক্রিয়া ঘটে নতুন উৎপাদনের মাধ্যমে। এর ফলে মুদ্রা পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন পুঁজির সৃষ্টি হয় এবং মুদ্রার মালিক হয় পুঁজিপতি।
উদ্বৃত্ত মূল্য
পুঁজিপতি মুনাফা লাভ করে। কিন্তু কোথা থেকে আসে এই মুনাফা? বাজারে কেনাবেচা করে এই মুনাফা আসে। পুঁজির মূল্যের বৃদ্ধি এই মুনাফার কারণ। পুঁজিপতি যখন উৎপাদন ব্যবস্থার প্রক্রিয়াটিকে দেখেন তিনি উপাদানের মূল্য দেখেন আর পণ্যরূপে শ্রমশক্তিকে দেখেন। এইভাবে তিনি শ্রমশক্তির দাম দেন এবং তাকে মজুরি বলেন। তাহলে যে পুঁজি নিয়ে উৎপাদন শুরু হলো, তার দুটি ভাগ - স্থির পুঁজি এবং পরিবর্তনশীল পুঁজি। স্থির পুঁজি হলো উপাদান, প্রযুক্তি ইত্যাদির খরচ। কিন্তু শ্রমের জন্য যা খরচ তা পরিবর্তনশীল পুঁজি। কিন্তু যেহেতু শ্রম ছাড়া পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়, উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সবসময় স্থির পুঁজি আর পরিবর্তনশীল পুঁজির চেয়ে বেশি। মূল্য না বাড়ানো গেলে তো উৎপাদন করতে পুঁজিবাদী উৎসাহ পাবেন কেন? যদি উৎপাদনের খরচ আর দাম এক হয়ে যায়, তবে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সে উৎপাদন হবে না। কিন্তু পণ্যের মূল্য যে বেড়ে গেল, তা তো শ্রমের জন্যই। অর্থাৎ শ্রম পণ্যের মূল্য সৃষ্টি করে। পণ্যের মূল্য তাহলে স্থির পুঁজির মূল্য, পরিবর্তনশীল পুঁজির মূল্য এবং আরও কিছু বেশি যা হলো উদ্বৃত্ত মূল্য। এই উদ্বৃত্ত মূল্য মুদ্রার হিসেবে হয় পুঁজিপতির মুনাফা। উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া হলো, শ্রমের মূল্য বা পরিবর্তনশীল পুঁজির মূল্য কমিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ মজুরি কমালে, মুনাফা বাড়ে। শুধু এই কারণে পুঁজিবাদী উৎপাদনে শ্রমিকের শোষণ হয় তা নয়। শ্রমিকের শোষণের কারণ হলো, শ্রমিক যে পরিমাণ শ্রমদান করে তার জন্যই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয়। পুঁজি একা উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করতে পারে না।
তাহলে শ্রমিকের চোখ দিয়ে মার্কস যখন পুঁজিবাদী উৎপাদনকে দেখতে চাইলেন, তিনি কী দেখতে পেলেন? তিনি আমাদের দেখালেন যে, আসলে পণ্যের গোটা মূল্যই শ্রমের সৃষ্টি। তাই দুটি পণ্যের বিনিময় বাজারে তখনই সম্ভব যখন দুটি পণ্যের মধ্যে সামাজিক প্রয়োজনীয় শ্রমের সমতা হয়। এই সামাজিক প্রয়োজনীয় শ্রম মার্কসের ভাষায় বিমূর্ত শ্রম।শ্রমের একটি বস্তুগত প্রকৃতি আছে, অন্যদিকে তার এক সামাজিক প্রকৃতি আছে। বিমূর্ত শ্রমকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এই বিমূর্ত শ্রম পণ্যের মূল্য তৈরি করে, কিন্তু সবসময় তার চেয়ে কম মূল্য পায়। এটাই শ্রমের শোষণ। এই শোষণ ছাড়া পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা সম্ভব হয় না।
মজুরি
মার্কসই প্রথম এই বইতে বলেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদিত পণ্যের যে মূল্য সৃষ্টি হলো, তা এক নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় পণ্যের দামে রূপান্তরিত হয়। সেখানে শ্রমিকের শোষণের মাত্রার উপর এই দাম নির্ভর করে। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় শ্রমশক্তির বাজার দর হলো মজুরি, কিন্তু তা কোনমতেই শ্রমের মূল্য নয়। পণ্যের মোট মূল্যই শেষ অর্থে শ্রমের মূল্য, যা শ্রমিকের হাতের বাইরে থাকে। শ্রমশক্তির দাম আছে যা পুঁজিবাদ মজুরি বলে; কিন্তু শ্রমের কোনো মূল্য নেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় - সবটাই শোষণ।
নয়া উদারনীতিতে শোষণ বাড়ে এবং সেই মতো মুনাফা বাড়ে, কোটিপতির সৃষ্টি হয়। তাই নয়া উদারনীতির ফলে আমরা দেখছি, মজুরির হার ক্রমাগত কমেই চলেছে। কিন্তু মুনাফা বাড়ছে অর্থাৎ বিমূর্ত শ্রমের মূল্য বাড়ছে। এখানেই শ্রমিকের শোষণ।
পুঞ্জীভবন
পুঁজির বৃদ্ধি বা পুঞ্জীভবন পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখে। পুঞ্জীভবন শুধুমাত্র পুঁজির পরিমাণকে একই জায়গায় টিকিয়ে রাখে না, তা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে। এই বৃদ্ধি করাই পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া। এই বৃদ্ধি করার অর্থ প্রতিটি পুঁজিবাদী উৎপাদন একইসঙ্গে পুঁজির প্রজননও ঘটায়। উৎপাদনের উপাদান ক্রমাগত যেমন তৈরি করে যেতে হয়, যা প্রজনন, উৎপাদনের মূল্যও বৃদ্ধি করতে হয়, যা পুঞ্জীভবন। এই পুঞ্জীভবন ছাড়া পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্ভব হয় না। এই প্রক্রিয়া ক্রমাগত নতুন উৎপাদন, প্রজনন এবং উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে চলেছে অবিরত।
পণ্য এবং পণ্যের উপাদানের মালিকানা পুঁজিপতির। শ্রমিকের আছে শুধু শ্রম দেওয়ার ক্ষমতা। তাই এই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা শুধুমাত্র পণ্য কেনাবেচা নয়; তা পুঁজিবাদী সমাজ তৈরি করে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক আসলে উৎপাদনে তার অবস্থানের উপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ “পুঁজি” বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগে পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য এত স্পষ্টভাবে বস্তুনিষ্ঠভাবে জানা যায় নি। উৎপাদনের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতেই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয়, এইভাবেই সমাজ গড়ে ওঠে। সেই সমাজ শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। পুঁজি এবং শ্রমের চিরাচরিত দ্বন্দ্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই পুঁজিবাদী সমাজ।
ধীরে ধীরে এই পুঁজিবাদী সমাজ টিকিয়ে রাখতে হলে উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ানো প্রয়োজন। উদ্বৃত্ত মূল্য তো পরবর্তী সময়ের পুঁজি এবং রাজস্বে বিভক্ত। পুঁজির প্রয়োজন বাড়ে অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য। উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়াতে হলে আরও শ্রমশক্তির প্রয়োজন। কিন্তু মজুরি না কমালে মুনাফা বাড়বে না। আর মজুরি কমে গেলে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে না। অতিরিক্ত উৎপাদনের ফাঁদে পড়ে যাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা। “পুঁজি” বইটিতে এইভাবে পুঁজিবাদী সংকটের কথা বলা আছে।
বর্তমান দুনিয়ায় বিশ্বের কোনো দেশেই পুঁজিবাদ কোনো সুস্থ সমাজ দিতে পারছে না বলে প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষকরে নয়া উদারীকরণ, অতি দক্ষিণপন্থা, আরও শোষণ, আরও মুনাফা বাড়িয়ে করপোরেট রাজ দিয়ে পুঁজিবাদ তার সংকটকে আড়াল করতে চাইছে। বিশ্বজুড়ে মানুষ মার্কসের “পুঁজি” বইটি আরও বেশি বেশি করে পড়ছে। বইটির বিক্রি ভীষণভাবে বেড়েছে, এই বইটি আলোচিত হচ্ছে বারে বারে। বর্তমান অতি দক্ষিণপন্থার পুঁজিবাদকে বুঝতে বা সাধারণভাবে পুঁজিবাদী সমাজকে বুঝতে মার্কসের “পুঁজি” ছাড়া আর কোনো বিকল্প বই নেই।