৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০
ইলন মাস্কের যুগে কার্ল মার্কস
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী
ইলন মাস্কের বান্ধবী গ্রিমেসের সেই ছবি।
হাতে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো।
আমরা ইলন মাস্কদের যুগে আছি। যাঁরা পুঁজির কেন্দ্রীভবনের হাত ধরে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন যে তাঁরা এখন মানুষবিহীন এক ব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। যেখানে গাড়ি চালাতে চালক লাগবে না, গাড়ি বানাতেও শ্রমিক লাগবে না। গোল্ডম্যান স্যাকের তৈরি করা একটি হিসেব, যা সম্প্রতি ফোর্বস পত্রিকা প্রকাশ করেছে, তাতে তারা বলছেন যে, ২০৩০-এর মধ্যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দৌলতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হবেন। অর্থাৎ তাদের কাজ এবার করবে রোবট এবং কম্পিউটার। ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরির জন্য বিনিয়োগ হয়েছে ৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ২০২২ সালের মার্চ মাসে স্থির করে যে, গোটা দুনিয়ার খাদ্য সংকট দূর করার জন্য আগামী ১৫ মাসে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করা হবে। ওপরের দুটি পরিসংখ্যান থেকে বোঝাই যায়, এই সময়ে পুঁজিবাদের মাথাদের নজর কোন দিকে। মানুষবিহীন ব্যবস্থা। বা আরও ভাল করে বললে শ্রমিকবিহীন উৎপাদন। এর ফলে কর্মচ্যুতি তো আছেই, আছে অর্থনৈতিক অভিঘাতও। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার এক গভীর মার্কসবাদ বিরোধী মতাদর্শগত অভিঘাতও আছে। যদি পুঁজিবাদী উৎপাদন শ্রমিকবিহীন হয়, তাহলে তো তা শোষণবিহীনও। তাহলে এমন এক উৎপাদনের যুগে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতাই বা কী?
মার্কস এবং এঙ্গেলসের তৈরি মতবাদের নামকরণ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস বলেছিলেন যে, আমাদের মতবাদের মূল দু’টি বিষয় মার্কসের আবিষ্কার, তাই মতবাদের নামের সাথে শুধু মার্কসের নামই যুক্ত থাকবে। মার্কসের সেই মূল দুটি আবিষ্কার হলোঃ (ক) ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা, বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, (খ) উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। প্রথমটির ক্ষেত্রে মার্কস যা আবিষ্কার করেছিলেন তা এই, উৎপাদিকা শক্তি বিকশিত হতে হতে এমন একটি পর্যায় আসে যখন বর্তমান উৎপাদন সম্পর্ক এই বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তখন সমাজের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্বার্থে পুরনো উৎপাদন সম্পর্ককে ভেঙে ফেলতে হয়। এটাই সমাজ বিপ্লব। এই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। আমরা বরং দ্বিতীয়টি দিয়ে শুরু করি, অর্থাৎ, উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। এককথায় বললে, শ্রমিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যদি তার মজুরির সমান মূল্য মালিকের হাতে তুলে দেয় তাহলে মালিকের মুনাফা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সহজভাবে বললে মজুরি শ্রমিক যে মূল্য তৈরি করলে মালিকের মুনাফা হবে তার সমীকরণটা অনেকটা এরকম - মজুরি বাবদ খরচ + কাঁচামাল ও কারখানা চালানোর খরচ + উৎপাদিত পণ্য বাজারে নিয়ে যাওয়ার খরচ + খুচরো বিক্রেতার লাভ + মালিকের মুনাফা। বোঝাই যাচ্ছে, শ্রমিক যদি তার মজুরির সমান মূল্যের থেকে বহুগুণ বেশি মূল্য তৈরি করতে না পারে, বা মালিক যদি শ্রমিককে দিয়ে বহুগুণ বেশি উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করিয়ে নিতে না পারে তাহলে পুঁজিবাদ টেকে না। বেশি বেশি পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করার জন্য পুঁজিবাদ দুটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। প্রথম পদ্ধতিটি হলো, সরাসরি কাজের সময় বাড়িয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়িয়ে নেওয়া (যাকে বলা হয় absolute surplus value)। পুঁজিবাদের উত্থানের সময় থেকে তাই কাজের সময় নিয়ে শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে পুঁজিবাদের বিরোধ চলে আসছে। ইংল্যান্ডের ১০ ঘণ্টা কাজের আইন, ঐতিহাসিক মে দিবসের দাবি, এ সবই কাজের সময়কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাদ সবসময়ই আইনি পথে বা বেআইনিভাবে কাজের সময় বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যায়। যেমন, আমাদের দেশে নতুন শ্রমকোড তৈরি করে ১২ ঘণ্টা কাজ করিয়ে নেওয়াকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। আবার ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর নামে কার্যত ২৪ ঘণ্টা, যে কোনো সময় কাজ করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। বিরামহীন কাজ করিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের হাতিয়ার আধুনিকতম প্রযুক্তি। যেমন ধরা যাক, তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সারাদিন কাজ করার পর শ্রমিকদের ছুটি হলেও কাজ বন্ধ হচ্ছে না। ওখানে রাত মানে ভারতে দিন। সেই কাজই করে যাচ্ছে ভারতের শ্রমিকরা। কিন্তু কাজের সময় বাড়ানোর সীমাবদ্ধতা আছে। একদিনে ২৪ ঘণ্টার বেশি তো আর কাজ করানো যায় না। তাই উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ানোর আরেকটি উপায় হলো - একই সময় কাজ করিয়ে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বেশি উৎপাদন বাড়িয়ে নেওয়া (যাকে বলা হয় relative surplus value)। পুঁজিবাদ তার জন্মলগ্ন থেকে কম সময়ে বেশি উৎপাদন করা যায়, এমন প্রযুক্তির পেছনে দৌড়ে বেড়ায়। বা বলা যায় যত কম লোক দিয়ে বেশি উৎপাদন করা যায় তার জন্য পুঁজিবাদ সর্বদা সচেষ্ট। শুধু কম সময়ে বেশি উৎপাদনই নয়, উৎপাদন প্রক্রিয়া এতটাই যন্ত্র নির্ভর করে তোলা যেখানে শ্রমিকের কাজ হয়ে দাঁড়াবে শুধুমাত্র যন্ত্রের (বা প্রযুক্তির) নিয়মমতো যন্ত্রবৎ কাজ করে যাওয়া। পুঁজিবাদের এই সহজাত প্রবৃত্তিরই সাম্প্রতিকতম চেহারা হলো আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রবোটিকস্। যেখানে শ্রমিক ছাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন করতে চায় পুঁজিবাদ। তাহলে শ্রমিকহীন পুঁজিবাদ কি এক শোষণহীন পুঁজিবাদের জন্ম দেবে? মাকর্স দেখিয়েছেন যে, উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হলেই মুনাফা (Profit) হয় না। উদ্বৃত্ত মূল্য ভোগ (realization) করা হলেই মুনাফা আসে। অর্থাৎ পণ্য বাজারে বিক্রি হওয়াবর আগে অবধি উদ্বৃত্ত মূল্য মুনাফায় রূপান্তরিত হয় না। এখানেই সংকট। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা অটোমেশনের প্রক্রিয়ার সাথে শ্রমিকের দ্বন্দ্বকে যদি তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে কী হবে? ধরা যাক, পুঁজিবাদ এমন জায়গায় পৌঁছল যেখানে দুনিয়ার সমস্ত উৎপাদন যন্ত্রের দ্বারা হয়, একজনও শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। তার মানে মজুরি শ্রমিক নেই। তার মানে বাজারে কিনতে যাওয়ার একটাও লোক নেই। বাজার নেই। যদি দুনিয়ার সমস্ত উৎপাদন শুধুমাত্র যন্ত্রের সাহায্যে, প্রযুক্তির সাহায্যে হয় তাহলে সেই সমস্ত পণ্য পুঁজিবাদকে হয় সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে, নয় তো বিলিয়ে দিতে হবে। আসলে পুঁজিবাদ এই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদেরই ধ্বংসের বস্তুগত শর্ত তৈরি করছে।
প্রযুক্তির সাথে শ্রমিকের এই দ্বন্দ্বের মূলগত চরিত্রটা কী? মার্কসের কথায় যন্ত্র বা প্রযুক্তি আসলে পূর্বতন কোনো শ্রমের বস্তুগত চেহারা (objectified labour) বা পুঞ্জীভূত শ্রম (ossified labour)। এই পুঞ্জীভূত পূর্বতন শ্রম ব্যবহৃত হচ্ছে জীবন্ত শ্রম (living labour)-কে শোষণ করার জন্য। মার্কস শিখিয়েছেন, এটাই হলো পুঁজি। মার্কসের কথায় পুঁজি হলো মৃত শ্রম (dead labour) যা জীবন্ত শ্রমকে শোষণ করে। যন্ত্র বা প্রযুক্তি (যা আসলে শ্রমিকের শ্রমজাত) পুঁজিবাদী মালিকানা সম্পর্কের কারণে পুঁজির চরিত্র ধারণ করেছে। বা উলটো করে বললে পুঁজিবাদী মালিকানার কারণেই শ্রমিকের শ্রমের ফসল যে প্রযুক্তি বা যন্ত্র তার সাথে জীবন্ত শ্রমিকের সম্পর্ক একটি বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব যন্ত্র বা প্রযুক্তির সাথে শ্রমিকের নয়। এই দ্বন্দ্ব আসলে যন্ত্র বা প্রযুক্তির মালিকানার সাথে, অর্থাৎ পুঁজির সাথে শ্রমের দ্বন্দ্বেরই প্রতিফলন।
এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা কোথায়? আমরা আগেই দেখেছি যে, প্রযুক্তির যতই বিকাশ হোক না কেন সে পুঁজিবাদকে বাজারের সংকট বা অতি উৎপাদনের সংকট থেকে মুক্ত করতে পারবে না। বরং বাজারকে সংকুচিত করবে। আরও বড়ো সংকট ডেকে আনবে। এবং এই সংকট থেকে বাঁচতে পুঁজিবাদের উৎপাদিকা শক্তিকেই ধ্বংস করবে। সবার আগে ধ্বংস করবে উৎপাদিকা শক্তির মূল উপাদান, অর্থাৎ মানুষের শ্রমকে। ছাঁটাই হবে, বেকারি বাড়বে, বৈষম্য বাড়বে, এমনকী কারখানা বন্ধ হবে, উৎপাদনই নিম্নমুখী হতে থাকবে। ২০০৮ সালের বিশ্বজনীন সংকট শুরু হওয়ার পর ২০০৯ সালে কারখানাজাত উৎপাদন কমে যায়ঃ জাপানে ৩১%, কোরিয়ায় ২৬%, রাশিয়ায় ১৬%, ব্রাজিলে ১৫%, ইতালিতে ১৪%, জার্মানিতে ১২%। শুধু এক বছরে উন্নত দেশগুলোতে কাজ হারায় ২ কোটি মানুষ। অথচ তার উলটোটাও হতে পারে। আধুনিকতম প্রযুক্তি এবং মানুষের কর্মক্ষমতার সংশ্লেষ এমন প্রাচুর্যের সম্ভাবনা তৈরি করেছে যা গোটা দুনিয়ার মানুষের অভাব দূর করতে পারে। পুঁজিবাদের প্রবণতাই হলো শ্রম নিবিড়তার পরিবর্তে প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের দিকে সভ্যতাকে নিয়ে যাওয়া, যা শেষমেষ বাজারের সংকট তৈরি করে এবং সেই প্রযুক্তিরই আরও প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মুনাফা কমতে থাকলে পুঁজিবাদ প্রযুক্তিকেও ধ্বংস করে। জ্ঞান, বিজ্ঞানের যে ধারা এই মুহূর্তে মুনাফা জোগাতে ব্যর্থ (তা সে যতই জরুরি হোক না কেন) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে পুঁজিবাদ নতুন প্রযুক্তি খোঁজে, আরও বড়ো মুনাফার লক্ষ্যে। সমস্ত মানুষের বৌদ্ধিক ও শারীরিক শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সার্বিক অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় পুঁজি নামক উৎপাদন সম্পর্ক। এঙ্গেলস বর্ণিত মার্কসের প্রথম অবদান, অর্থাৎ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, আসলে এই সত্যটিই আবিষ্কার করেছিল। পুঁজিবাদ ইলন মাস্কদের মঙ্গলে বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে, আর পৃথিবীর মাটিতে মাথার ওপর ছাদহীন পরিযায়ী শ্রমিকের ভিড় বাড়ছে। আজকের সময়ের পুঁজিবাদ উৎপাদিকা শক্তির যে অভাবনীয় বিকাশ সংগঠিত করেছে তা আসলে মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থে পুঁজি নামক উৎপাদন সম্পর্কের বদল দাবি করছে। আসলে মার্কসের কথা মার্কসের সময়ের চেয়েও আজ বেশি প্রাসঙ্গিক।
গত জানুয়ারি মাসে ইলন মাস্কের বান্ধবী, কানাডার গায়িকা, গ্রিমেসের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। এই বিচ্ছেদের কথা ঘোষণা করে গ্রিমেস সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবি দেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, গ্রিমেস একটি বাদামী রঙের কোট পরে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়ছেন। ম্যানিফোস্টর মলাটে বড়ো করে আঁকা মার্কসের ছবি। গ্রিমেস জেনে বুঝে ওই ছবি দিয়েছিলেন কী না তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু ইলন মাস্কদের সাথে চিরবিচ্ছেদের চেয়ে ভালো প্রতীক আর কী বা হতে পারে!