৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০
প্রসঙ্গ জাতীয়তাবাদঃ রবীন্দ্রনাথের হয়ে ওঠা
শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর সুবিখ্যাত গান, ‘সার্থক জনম আমার’। অন্যদিকে ১৯০৯ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচনা করেন তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’। রচনাকাল দেখেই স্পষ্ট যে রবীন্দ্রনাথের গানটি প্রথমে লেখা। গান দু’টিতে মনে হয় দু’টি ভিন্ন বয়ান তুলে ধরা হয়েছে দেশপ্রেমের। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর গানে বলেছেন, ‘সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। আর রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে লিখেছিলেন, ‘জানি নে তোর ধনরতন আছে কিনা রানীর মতন, শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে’। জাতীয়তাবাদের আদর্শের গভীরে নিহিত যে শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ তা সচেতন বা অচেতনভাবেই হোক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অসাধারণ দেশাত্মবোধক গানটির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। অপরপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করতে গিয়ে তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানোকে জরুরি মনে করছেন না। স্বদেশ রানির মতো ধনসম্পদের অধিকারী কিনা সেটা তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক, তিনি শুধুমাত্র তার স্নেহচ্ছায়ার আশ্রয়কেই জড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। জাতীয় চেতনা নির্মিত হওয়ার ওই সময়টি ছিল ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার সম্পর্কে কিংবা অতীতের গৌরবময় অধ্যায়কে আবার ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। বিদেশি শাসনে পদানত দেশের জাতীয় চেতনার ধরনটাই ছিল তেমন। সেই প্রবাহের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রম। উপরে উল্লিখিত গানের মধ্যেই তা সুপরিস্ফুট। পরের দশকে জাপান ও আমেরিকায় দেওয়া নানা বক্তৃতার সংকলন হিসেবে জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর যে বইটি প্রকাশিত হয় সেখানেই পূর্ণতা পেয়েছে তাঁর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণা।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনার এই বিশিষ্টতা হঠাৎ করে অর্জিত হয়নি। এমনকী রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবনের নানা পর্বের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে নিজের ভাবনার অসম্পূর্ণতাকে সমালোচনার মুখে দাঁড় করিয়ে নিজেই সেখান থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। যে সময়ে রবীন্দ্রনাথ জন্ম নিয়েছিলেন সেই সময়টা ছিল এক যুগসন্ধিক্ষণ। যে পরিবারে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন সেই পরিবারও ছিল সেই যুগান্তরের প্রত্যক্ষ অংশীদার। চীনে এক বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি ১৮৬১ সালে জন্মেছি। ইতিহাসের কোনো উল্লেখযোগ্য দিন ছিল না সেটা। কিন্তু সে সময়টা ছিল বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়পর্ব যখন তিনটি আন্দোলন একসাথে এসে মিশেছিল বাঙালির জীবনে।... তিনটি আন্দোলনেই আমার পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।... আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই তিনটি আন্দোলনের মোহনায়, যার প্রতিটিই ছিল বৈপ্লবিক’। যে তিনটি আন্দোলনের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, তার প্রথমটি রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে আরম্ভ হওয়া ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। দ্বিতীয়টি বঙ্কিমচন্দ্রের হাত দিয়ে আবির্ভাব নেওয়া সাহিত্য আন্দোলন, আর তৃতীয়টি জাতীয় চেতনার উন্মেষের রাজনৈতিক প্রকাশ। এই ত্রিধারার সবক’টিতেই রবীন্দ্রনাথের নিজেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। যদিও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি পর্যায়ে সেখান থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নেওয়ার পর সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ কখনোই অংশ নেননি। যদিও রাজনৈতিক ভাবনা থেকে তিনি কখনোই দূরত্বে অবস্থান করেননি।
ব্রিটিশ শাসনের অভিঘাতে কলকাতা নগরকেন্দ্রিক যে জাতীয়তার চেতনার অঙ্কুরোদ্গম ঘটে তার সাথে রাজনৈতিক বিদ্রোহের কোনো স্থান ছিল না। ছিল আত্মপরিচয়ের সন্ধান। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ভারতীয় জনগণের ঐক্য গড়ে তোলার জন্যে রামমোহন চেয়েছিলেন একেশ্বরের সাধনার মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক স্থাপন করতে। ব্রাহ্ম আন্দোলনেরও উদ্দেশ্যও ছিল না কোনো স্বতন্ত্র ধর্মমতের প্রবর্তনের। রামমোহনের মৃত্যু, সিপাহি বিদ্রোহ নামে কথিত ভারতীয় জনগণের প্রথম জাতীয় বিদ্রোহের পরাজয় ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের পথে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে এই প্রচেষ্টাগুলিতে। প্রথমত, রামমোহনের মৃত্যুর পরই ব্রাহ্ম আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের পারস্পরিক বিনিময়ের পথ থেকে সরে এসে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আন্দোলনের রূপ নেয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরে। পরবর্তীতে কেশবচন্দ্রদের তৎপরতায় ব্রাহ্ম আন্দোলন হয়ে যায় একটি স্বতন্ত্র ধর্মমত, সে অন্য কথা। অন্যদিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে ১৮৫৯ সালে ঠাকুর বাড়িতে ‘হিন্দুমেলা’র আয়োজনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালের দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনীতির প্রাথমিক অঙ্কুরোদ্গম হয়ে যায়। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ১৮৫৯ সালের ‘হিন্দুমেলা’কেই দ্বিজাতিতত্ত্বের অঙ্কুরোদ্গম বলেছেন। জাতীয়তাবোধের এই বয়ানে মুসলিমরা বহিরাগত হিসেবেই বর্ণিত হয়েছে। হিন্দুজাতির অতীত গৌরবের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই ছিল হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য। বাড়ির পরিবেশে আয়োজিত এই হিন্দুমেলার আবহে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার হয়, সেখানেও ছিল এই পুনরুত্থানবাদী ভাবনার প্রভাব। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নামে যে নাটক লেখেন তার জন্যে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’ গানটি লেখেন যা নাটকে মুসলিম আক্রমণের মুখে নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষায় রাজপুত রমণীদের চিতায় প্রবেশের দৃশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই গানের একটি পঙক্তি ছিল ‘শোন রে যবন, শোন রে তোরা/ যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে/ সাক্ষী র’লেন দেবতা তার/ এর প্রতিফল ভুগিতে হবে’। বৈদিক অতীতের পুনরুজ্জীবন এবং বর্ণব্যবস্থার যথাযথ পালনকে অবলম্বন করে বিদেশি মোহমুক্ত শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণের পূর্ববর্তী সময় অবধি। রবীন্দ্র জীবনে এরকম নানা পর্ব ছিল। ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০৫ অবধি ব্যাপ্ত সময়পর্বে রবীন্দ্রনাথ তিলকের পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তাবাদী ভাবনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর তখনকার নানা কবিতা, বক্তৃতায় সেটা স্পষ্ট। শান্তিনিকেতনে প্রাচীন ভারতীয় আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম যেখানে কঠোরভাবে পালিত হতো বর্ণবিভাজনের রীতিনীতি। ব্রাহ্মণ ছাত্ররা অব্রাহ্মণ ছাত্রদের সাথে একাসনে বসে আহার করত না। অব্রাহ্মণ শিক্ষকদের প্রণাম করারও অনুমতি ছিল না ব্রাহ্মণ ছাত্রদের। এই সময়ে তাঁর আদর্শ বালগঙ্গাধর তিলক ও বন্ধু ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। মুসলিম সম্প্রদায়কে শাসক ও বহিরাগতের বাইরে গিয়ে তিনি প্রথম দেখেন সম্ভবত ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে পূর্ববঙ্গে পারিবারিক জমিদারি পরিদর্শনের দায়িত্ব নিয়ে যাওয়ার পর। জাতপাত ধর্ম ও শ্রেণিবৈষম্যের নিষ্ঠুর চেহারা প্রত্যক্ষ করেন নিজেদের জমিদারির সেরেস্তাতেই। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, সেরেস্তায় জাজিমের একটা অংশ তুলে রাখা। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলেন, ওটা মুসলমান ও নমশূদ্র চাষিদের বসবার জায়গা। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। ভারতীয় সমাজের সহজাত সামঞ্জস্যবোধ সম্পর্কে তাঁর এতদিনকার প্রত্যয়ে ঘা লাগে। পদ্মা ও গড়াই নদীর বুকে বোটে ভ্রমণ করার সময় আরো কাছ থেকে দেখতে পান বাংলার পল্লি ও তার সমাজকে। ফলেই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পথে নেমে প্রথম যে কর্মসূচিটি করেন, তা হল চিৎপুর রোড ধরে পদযাত্রা করে নাখোদা মসজিদে নিজে উপস্থিত হয়ে সেখানকার ইমামের হাতে রাখি বেঁধে দেওয়া। ১৪ বছর বয়সে দাদার নাটকের জন্যে গান লিখে দেওয়া থেকে থেকে জাতীয় চেতনা উন্মেষের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ১৯০৫ সালে নাখোদা মসজিদের ইমামের হাতে রাখি পরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে নিশ্চিতভাবেই তার একটি পর্বান্তর ঘটে। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট টাউন হলের সভায় তিনি পরিবেশন করেন তাঁর নতুন গান, ‘আমার সোনার বাংলা’। এখানে বাংলাকে দেখা হচ্ছে তার পল্লিসমাজের আবহমানতার মধ্যে। যে নমশূদ্র ও মুসলিম প্রজাদের জন্যে তাদের সেরেস্তায় জাজিম তুলে রাখা হতো, সেই অপমাণিত অবমানিত সমাজের প্রতি প্রায়শ্চিত্তের সুরেই যেন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই তোমার রাখাল তোমার চাষি’। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে, আমাদের জাতীয়তাবোধের ফাঁকি এবং ভণ্ডামিগুলি তাঁর চোখে আরো স্পষ্ট হয়। বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বানের মধ্যে গরিব ও নিঃস্ব মানুষের উপর যে অন্যায় চাপিয়ে দেওয়ার দিক রয়েছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারেন। একটা পর্যায়ে তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে সরে আসেন। ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে এ নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই।... আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না– ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।’ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে স্বদেশি আন্দোলনের সশস্ত্র ধারার যে আন্দোলন শুরু হয় তার সাথেও তিনি অভিন্নমত হতে পারেননি। সমস্ত ঘটনার অভিঘাতে ভারতের নানা দিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার একটা ঢেউ চলে এলো। অন্যদিকে ঊনবিংশ শতকের অন্তিম পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ার যুদ্ধের সময়েই রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেন ঔপনিবেশিকতার নিষ্ঠুর যুদ্ধবাদিতার দিক।
এই সমস্ত মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা জগতের এই যে উত্তরণ তার সাক্ষ্য বহন করছে ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস সহ অসংখ্য প্রবন্ধাবলি ও বক্তৃতা সমূহ। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়পর্বে জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বিভিন্ন বক্তৃতায় তাঁর চিন্তা পরিণতি পায়। তিনি লিখেছেন, ‘অন্ধতা নেশনতন্ত্রেরই মূলগত ব্যাধি। মিথ্যা দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক, নিজেদের কাছে নিজেকে বড়ো করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা প্যাট্রিয়টিজ্মের প্রধান অবলম্বন। গায়ের জোর, ঠেলাঠেলি, অন্যায় ও সর্বপ্রকার মিথ্যাচারের হাত হইতে নেশনতন্ত্রকে উপরে তুলিতে পারে, এমন সভ্যতার নিদর্শন তো আমরা এখনো য়ুরোপে দেখিতে পাই না।পরস্পরকে যথার্থরূপ জানাশুনা কেমন করিয়া সম্ভব হইবে। নেশনের মেরুদণ্ডই যে স্বার্থ। স্বার্থের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী, এবং স্বার্থের সংঘাতে মানুষকে অন্ধ করিবেই। ইংরাজ যদি সুদূর এশিয়ায় কোনোপ্রকার সুযোগ ঘটাইতে পারে ফ্রান্স্ তখনই সচকিত হইয়া ভাবিতে থাকিবে, ইংরাজের বলবৃদ্ধি হইতেছে। প্রত্যক্ষ সংঘাত না হইলেও পরস্পরের সমৃদ্ধিতেও পরস্পরের চিত্তকে বিষাক্ত করে। এক নেশনের প্রবলত্ব অন্য নেশনের পক্ষে সর্বদাই আশঙ্কাজনক। এ স্থলে বিরোধ, বিদ্বেষ, অন্ধতা, মিথ্যাপবাদ, সত্যগোপন, এ-সমস্ত না ঘটিয়া থাকিতে পারে না।’ আজকের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এই ছিল রবীন্দ্রনাথের পরিণত অনুভব। তিনি মানবতাকে জাতীয়তার আদর্শের অনেক ওপরে স্থান দিয়েছেন। একটি চিঠিতে জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখান করে মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, আমি হীরের দামে কাঁচ কিনতে চাই না।
আজকের ভারতের শাসকেরা চাইছে, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার গড়ে ওঠার সময়ের যে অপরিণত এবং অসম্পূর্ণ চিন্তা তাকে ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথকে গ্রাস করে নেওয়া। রবীন্দ্রনাথের যে গানটি সচরাচর গাওয়াই হয় না, সেই অপরিণত মুসলিম বিদ্বেষের ইঙ্গিতপূর্ণ ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’ নিয়ে নৃত্যালেখ্য পরিবেশিত হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে। আরএসএস প্রধান, রবীন্দ্রনাথের পুনরুত্থানবাদী ভাবনার পর্বের লেখালেখি উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথকে আরএসএস-এর ভাবনার কাছাকাছি নিয়ে আসতে চাইছে। নিজের গানের বিষয়ে এ ধরনের প্রবণতার উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছেন, ‘কয়েক বৎসর পূর্বে অন্য একটি কাগজে অন্য একজন লেখক আমার রচিত ধর্মসংগীতের একটি সমালোচনা বের করেছিলেন। তাতে বেছে বেছে আমার কাঁচা বয়সের কয়েকটি গান দৃষ্টান্ত স্বরূপ চেপে ধরে তিনি তাঁর ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত গড়ে তুলেছিলেন। যেখানে আমি থামিনি সেখানে আমি থেমেছি এমন ভাবের একটা ফোটোগ্রাফ তুললে মানুষকে অপদস্থ করা হয়। চলতি ঘোড়ার আকাশে-পা-তোলা ছবির থেকে প্রমাণ হয় না যে, বরাবর তার পা আকাশেই তোলাছিল এবং আকাশেই তোলা আছে।’ রবীন্দ্রনাথকে আত্মসাৎ করতে গিয়ে আরএসএস-ও একই কাজ করছে।
ফলে আজকের শাসকেরা যতই রবীন্দ্রনাথকে উগ্রদক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদের স্বপক্ষে করায়ত্ত করা চেষ্টা করুক, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রাষ্ট্রের প্রতিকল্পে সমাজ এবং জাতীয়তাবাদের প্রতিকল্পে স্বাদেশিকতার প্রবক্তা যার সাথে আজকের শাসকদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।