E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০

নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা - এক অসাম্প্রদায়িক গণউৎসব

বুদ্ধদেব ঘোষ


কয়েক সপ্তাহ আগে আমরা পা দিলাম নতুন বছরে - ১৪৩০ বঙ্গাব্দে। নতুন বছরকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই উৎসবের আমেজ। আমরা উৎসবের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু উৎসবসর্বস্বতাও যেন আমাদের গ্রাস না করে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। একথা স্মরণ করা দরকার যে, নববর্ষের উদ্‌যাপন যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপ নিতে পারে তা প্রথম দেখিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। বাংলার সমাজজীবনের বৈচিত্র্যময় চরিত্র ও রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদ থেকেই বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ’৮০’র দশকে স্বৈরশাহী এরশাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে নববর্ষ উদ্‌যাপনের অঙ্গ হিসেবে অভিনব লোককৃষ্টি আর সম্প্রীতির গণউৎসব 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' বের হয়ে আসছে। যা ইউনেস্কো দ্বারা ২০১৬ সালে ‘অধরা বিশ্ব ঐতিহ্যে’র মর্যাদায় অভিষিক্ত।

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব নববর্ষ উৎসব থাকে - বাংলায় ১ বৈশাখ। ভাষা ধরলে বাঙালি জাতির বয়স এক হাজার বছর। তার আগে কয়েক হাজার বছর ছিল - বাঙালি হয়ে ওঠার প্রস্তুতিকাল। বাঙালি রক্ত সংমিশ্রণের জাতি। বিভিন্ন জনধারায় মিশে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এ জাতির উদ্ভব। আর সে জন্যই বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রবাহ একমাত্রিক নয় বহুমাত্রিক। তাই মোদি-অমিত শাহদের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের একরকমের রাষ্ট্রবাদী প্রকল্পের বিরুদ্ধে এই মাটিতে স্বাভাবিক বিরোধ হবে। সেই স্বাভাবিক বিরোধিতার জায়গাটা প্রসারিত করতে হলে বাংলার লোককৃষ্টির মধ্যে যে আশ্চর্য সমন্বয় - সেই সম্প্রীতির জায়গাটা তুলে ধরতে হবে। সঙ্ঘ পরিবার প্রতিনিয়ত যে বিদ্বেষের চাষ করছে দেশজুড়ে সেই প্রেক্ষিত বিন্দুকে ছুঁয়েই আমরা ২০১৭ সাল থেকে এরাজ্যে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' করতে নামি। অভূতপূর্ব সহযোগিতা করেছিলেন ঢাকার 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র তথা চারুকলার একঝাঁক শিল্পী।

প্রয়োজনীয় আর একটি দিকও ছিল। সমস্ত মাধ্যমকে ব্যবহার করে অপসংস্কৃতি-র বিষাক্ত চাদর যেন আচ্ছাদিত করে ফেলছে আমাদের। অপসংস্কৃতি বললেই ব্যাকরণগত বিতর্ক হতে পারে। সে বিতর্ক থাক। বরং সুস্থ সংস্কৃতির স্বরূপটা বোঝা দরকার। যে সংস্কৃতি মানবগোষ্ঠীর জীবনকে সুস্থ বিকাশের দিকে এগিয়ে দেয়, গোষ্ঠীকে সমগ্রভাবে জীবন ও মননের পুষ্টিতে সাহায্য করে - তাকেই সুস্থ সংস্কৃতি বলে। শাসকশ্রেণি যে বৃহৎ করপোরেট লুণ্ঠন চালাচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর, এর বিরুদ্ধে যাতে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে তার জন্য সুস্থ সংস্কৃতির সমস্ত সৌধ, সমস্ত অর্জনগুলো আগে ভেঙে ফেলে তারা। পালটা পচাগলা সংস্কৃতি তথাকথিত গণতান্ত্রিকভাবে গেলায় - এটাই অপসংস্কৃতি। সমাজের ক্ষমতা, সম্পদ ও ভোগ্যপণ্য বণ্টনের অসাম্যই অপসংস্কৃতির উৎসস্থল - একথা আমরা বলতেই পারি। আমাদের বিনোদনের উপাদানগুলোতে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং তৃতীয়ত আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত ব্যবহার ও প্রথাতে - অপসংস্কৃতির লক্ষণ সবচেয়ে বেশি করে ধরা পড়ছে। শুধু মনস্তাপে ফাটা ডিম জোড়া লাগে না। শুধু প্রতিক্রিয়ামূলক কর্মসূচিতে (Reactive programme) হবে না। এটা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা থেকে করতে হতে পারে। কিন্তু দরকার সৃজনের কর্মসূচি (Proactive creative programme)।

খুব সুন্দরভাবে কথাটি বলেছেন কাজী আব্দুল ওদুদ।

তিনি বলেছেন, ঘরে যখন আগুন লাগে তখন তাৎক্ষণিকভাবে সবাই জল ঢালে। আগুন নিভে যাওয়ার পরে দায়িত্ব শেষ করে দেয়। কিন্তু দাহ্য বস্তুকে বাদ দিয়ে ঘর বানালে আগুন লাগার সম্ভাবনাই কমে যায়। আমাদের মধ্যে পরস্পর অপরিচয়ের দূরত্বকে কাজে লাগায় সাম্প্রদায়িক শক্তি। আমাদের ঐক্যের জায়গাটা খুঁজতে হবে। ভাষা-সংস্কৃতি-লোককৃষ্টি-উৎপাদন সম্পর্ক-শ্রেণিবোধের মধ্য দিয়ে অভিন্ন মানবরতনের খোঁজেই তাই 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' হাঁটছে শুরুর দিন থেকে।

মাঝে মাঝে কিছু অর্বাচীন কথাও শোনা যায় - শ্রমজীবী মানুষের আবার দেশ কি? ভাষা-সংস্কৃতি-জাতিসত্তা এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় - ইত্যাদি। এর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক অনেকে ধরতে পারেন না।

কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস ঘোষণা করেছিলেন, "শ্রমিক শ্রেণির কোনো দেশ নেই।" কথাটা নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণি কোনো জাতির জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয় একথা তাঁরা বলেননি। বরং তাঁদের ইতস্তত কিছু লেখায় একথাই উঠে আসে, যাতে মনে হয় কোনো জাতির সর্বহারা শ্রেণি সেই জাতির সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধারণ করে, প্রকৃত জাতীয় হয়েও আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে। পল লাফার্গকে এবিষয়ে স্বয়ং মার্কস সংশোধন করে দিয়েছিলেন। আর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় এ বিষয়ে লেনিনের মতো বোঝাপড়া দুনিয়াতে বিরল। কমিউন প্রসঙ্গে মার্কস বলেছেন - ফরাসি সময়ের যা সুস্থ উপাদানের প্রতিনিধি হয়ে উঠে প্রকৃত জাতীয় সরকারে পরিণত হয়েছিল। একইসঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির সরকার হিসাবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির বলিষ্ঠ উদ্গাতা হিসাবে এটা ছিল জোরালোভাবে আন্তর্জাতিক। বাংলার গুরুসদয় দত্ত যিনি লোকসংস্কৃতির অসামান্য সংরক্ষক - কি বলেছেন - ‘‘বিশ্বমানব হবি যদি শাশ্বত বাঙালি হ।’’ ইউরো-কেন্দ্রিক বা সর্বভারতীয় মডেল দিয়ে হবে না। ভারত বহুত্ববাদী দেশ। বহুত্ববাদ আজ আক্রান্ত। অনেক সময় আগ্রাসনকে ঐক্যের নাম দিয়ে চালানো হয়। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছিলেন, অজগর সাপের ঐক্য। গিলে খাওয়াটাই যার ধর্ম। সেই দেশ, সেই পৃথিবী কখনও গণতান্ত্রিক হতে পারে না, যেখানে শতফুল বিকশিত হওয়ার সুযোগ নেই। তথাকথিত বিশ্বায়ন আমাদের ভাষা, লোককৃষ্টি, এই সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করে সমসত্তা বিশিষ্ট রোবট বানাতে চাইছে আমাদের। এই যুক্তিহীন রোবট মৌলবাদের খপ্পরে না পড়ার কারণ নেই।

আমাদের যদি মৌলবাদের বিষাক্ত প্রচারের বিরুদ্ধে লড়তে হয় তবে রাজনৈতিক প্রচারের বাইরেও ভাষা সংস্কৃতি বিশেষত লোকসংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে একপাও এগোতে পারব না। এ লড়াই শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণির মধ্যে সেমিনার করে হবে না। কোনো সংস্কৃতিই অবিমিশ্র ভালো বা মন্দ হতে পারে না। কোনো সংস্কৃতি শ্রেষ্ঠ আর বাকিটা নিকৃষ্ট - এ ধরনের ব্যাখ্যা আধুনিক নৃ-বিজ্ঞান মানে না। সব সংস্কৃতিই উন্নত হতে পারে যদি একটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। এই বোধকে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' ধারণ করে। তাই বাঙালিয়ানার নাগরিক উদ্‌যাপনের হয়েও এই উৎসব মিলনের।

আমাদের লোককৃষ্টির উজ্জ্বল উদাহরণগুলি তুলে ধরে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। ধরুন টুসু উৎসব। আমাদের আদিবাসী জীবন থেকে এসেছে। কোনো প্রতীক বা মূর্তিকে সন্তানের মতো লালন পালন করার প্রবৃত্তি তাদের স্বভাবগত। এইরকম রোমান্টিক কল্পনা নিয়ে গড়ে ওঠা রাঢ় বাংলার টুসু উৎসব মূলত পুতুল খেলারই পল্লবিত রূপ। টুসু মানে পুতুল। তাকে কেউ কন্যা, পুত্র কল্পনা করে গান গায়। পুতুলের বিবাহ দেয়, সই পাতায়। এর মধ্য দিয়ে রাঢ় বাংলার মানুষ সমাজ-শাসিত অনুশাসনের বেড়া ডিঙিয়ে এক আত্মিক মিলনের স্বাদ পায়।

বাংলার পেঁচা, বিষ্ণুপুরের ঘোড়া, মেছোবিড়াল, ময়ূরপঙ্খী, নাও, নানাধরনের মুখোশ এই সমস্ত ফোক মোটিফ বিশাল আকারে বানানো হয়। থাকে রাতজাগা আলপনা। ঢাক-ঢোল, বাঁশি, দোতারা, আরও কত কি সম্ভার থাকে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'য়। থাকেন লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ - নজরুল - বিজয় সরকার - শাহ-আব্দুল করিমের গান, অনুভব। 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র অংশগ্রহণকারীরা নির্বাক দর্শক নয় (passive spectator)। তাঁদের অংশগ্রহণ নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে সক্রিয় (active), বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

বাংলার এই উজ্জ্বল লোককৃষ্টিকে হাতিয়ার করবেন না সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে? আমাদের তলোয়ার নয় - এগুলোই অস্ত্র। রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ভয় না পেয়ে সময়ের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে।

'মঙ্গল শোভাযাত্রা' দু-বাংলাতেই আজ আক্রান্ত। ওপারে ইসলামি মৌলবাদ ফতোয়া দিচ্ছে। এপারে হিন্দুত্ববাদীরা এবছর নামটা পর্যন্ত চুরি করেছে। বোঝা যাচ্ছে, 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' সঠিক জায়গাতেই আঘাত করতে পেরেছে। চিৎকার না করেও। সঙ্ঘ পরিবার 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নাম নিয়ে 'হিন্দু নববর্ষ' বলে প্রচারে নেমেছে। শশাঙ্ক নাকি বাংলা ক্যালেন্ডারের জনক। সত্য হচ্ছে সম্রাট আকবর এই ক্যালেন্ডার চালু করেছিলেন। এর মধ্যে সৌরমাস, চান্দ্রমাস দুটোর সংমিশ্রণ আছে। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের আশ্চর্য সমন্বয়। এ বাংলায় সত্যপীরের পুজো হয়। গো-বলয়ের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমজ বেদনাকে মধ্যযুগের মুসলমান কবি পদাবলিতে ব্যক্ত করেন। সেই ইতিহাস সহজ লোকায়ত ঢঙে উঠে আসে এই উদ্‌যাপনে। সন্তানের কানে লালনের গান দিন, সঙ্ঘীদের বিষবাষ্প ঢুকবে না। বাংলার সমস্ত আদিবাসী সমাজ তার তার সংস্কৃতি নির্বিঘ্নে যাতে পালন করতে পারে সেই গণতান্ত্রিক চেতনা 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র সকলের বোধের মধ্যে আছে। আমরা আমাদের উপরে আগ্রাসনের বিরোধিতা করব, আবার আমরাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপরে নিজেরা আগ্রাসন চালাব এটা হতে পারে না। তাই যখন দেখি সাঁওতাল ছাত্র তার ভাষায় প্রশ্নপত্র পায়নি বলে সাদা খাতা জমা দিতে বাধ্য হয়েছে, আমরা বিষণ্ণ হয়েছি। এটা কাম্য ছিল না।

দক্ষিণ কলকাতার গাঙ্গুলিবাগান থেকে যে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে - রাজ্যজুড়ে এই ক’বছরে ১৩ জায়গায় উদ্‌যাপিত হয়েছে। আগামী বছরে সব জেলায় হবে। এই সংকল্প নিয়েই মানুষের কাছে আহ্বান রইলো এই সম্প্রীতির ও সমন্বয়ের সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন।