৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০
অন্ধকারের উৎস হতে - অভিব্যক্তির আলোকে
তপন মিশ্র
শিরোনামের প্রথম অংশটি কবিগুরুর এবং দ্বিতীয় অংশটি টি. ডবজেন্সকির (১৯০০-১৯৭৫)। বাঙালি পাঠকদের কাছে প্রথম অংশটির ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় অংশটি সোভিয়েত বংশোদ্ভূত জিনতত্ত্ববিদ এবং সুপ্রজনন বিজ্ঞানের প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী ডবজেন্সকির। ডবজেন্সকির বিখ্যাত উক্তি হলোঃ “Nothing in Biology makes sense except in the light of evolution” অর্থাৎ জীববিজ্ঞানের সমস্তটাই অভিব্যক্তির আলোকে আলোকিত।
২০১৮ সালের ফিজিওলজি কিংবা মেডিসিনের নোবেল বিজেতা ইম্যুনোলজির গবেষক আমেরিকাবাসী বিজ্ঞানী জেমস আলিসন বিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান পাঠ্য হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন কারণ, সেই সময়ে খ্রিস্টান মিশনারি পরিচালিত ওই বিদ্যালয়ে ডারউইনের তত্ত্ব পড়ানো হতো না। পরে তিনি বলেন “Biology without Darwin was like physics without Newton”। ২০২২ সালের ফিজিওলজি কিংবা মেডিসিনের নোবেল বিজেতা ভান্তে পাবো-র গবেষণার বিষয় ছিল মানব অভিব্যক্তি। ভান্তে পাবোর গবেষণার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে দেশের বিখ্যাত জিন তত্ত্ববিদ ভিড় সিং লেখেনঃ “২০২২ সালের নোবেল পুরস্কারের কেন্দ্রীয় থিম হলো আধুনিক মানুষকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার একটি প্রচেষ্টা। ডিএনএ হতে পারে সত্যিকারের সামাজিক সম্পর্কের সেতু। আমাদের সাধারণ উৎস সম্পর্কে যদি আমাদের সচেতনতা থাকে তবে সমাজের মধ্যে ঐক্যের বোধ তৈরি হবে।”
চার্লস ডারউইনকে অভিব্যক্তিবাদের নায়ক বলা যায়, কারণ তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ১৮৫৯ সালে অভিব্যক্তিবাদের প্রমাণ হাজির করেন (Origin of Species through Natural Selection)। তার ১২ বছর পর অর্থাৎ ১৮৭১ সালে ডারউইনের আরেকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ 'The Descent of Man' মানব বিবর্তনের সম্যক ধারণা দেয়। অবশ্য ডারউইনের আগে অনেকেই জীবজগতে বিবর্তনের পক্ষে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু ডারউইনের মতো কেউ বিবর্তনের পদ্ধতিকে সূত্রায়িত করতে পারেননি।
ইভোলিউসন (Evolution) বা বাংলায় যা আমরা ‘অভিব্যক্তি’ বা ‘বিবর্তন’ বলে থাকি তা ডারউইনের ব্যবহৃত শব্দ নয়। ডারউইন তাঁর যুগান্তকারী বই (Origin of Species by means of Natural Selection)-এর প্রথম খণ্ডে বর্তমানে ব্যবহৃত বিবর্তনের ধারণাকে বোঝানোর জন্য 'descent with modification' কথাটি ব্যবহার করেন। তবে জীববিজ্ঞানে না’হলেও ‘ইভোলিউসন’ কথাটির ব্যবহার অনেক আগে থেকেই ছিল। অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার হলেও জীববিজ্ঞানে সম্ভবত ডারউইনের সহযোগী আরনেস্ট হেকেল (Ernst Haeckel) ‘descent with modification’ শব্দবন্ধের পরিবর্তে ‘evolution’ কথাটি ব্যবহার করেন। অনেক পরে ‘On the Origin of Species’-এর ৬ষ্ঠ সংস্করণে (১৮৭২ সালে) কিছু কিছু জায়গায় ‘evolution’ কথাটি ডারউইন ব্যবহার করেন। ডারউইনের মৃত্যুর পর নতুন সংস্করণে নতুন শব্দ ব্যবহারের আর সুযোগ ছিল না, যা হয়েছে তা হলো আগের সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ। সহজ কথায় বললে জীবজগতের ইতিহাসই অভিব্যক্তি।
ব্রাত্য অভিব্যক্তিবাদ
এনসিইআরটি-র ফরমানে সিবিএসসি-র পাঠক্রম থেকে অভিব্যক্তি সম্পর্কিত সমস্ত কিছু যেমন জাঁ ব্যাপ্টিস্ট লামার্কের তত্ত্ব, ডারউইনের তত্ত্ব, ফসিল সম্পর্কে ধারণা, স্পেসিস বা প্রজাতির উদ্ভব সম্পর্কে ধারণা - এই সমস্ত কিছু দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের পাঠক্রমের ৯ নম্বর অধ্যায় থেকে বাদ যাচ্ছে।
জীববিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণার বিষয় হলো অভিব্যক্তি। হিন্দুত্ববাদীদের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, বিজ্ঞানের সমস্ত ধারায় মৌলিক গবেষণা বন্ধ করা। এব্যাপারে মৌলবাদীদের কোনো জাত হয় না। তাদের একটিই জাত - তা হলো যুক্তিবাদকে পরাহত করো। ডারউইনের প্রথম বই প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা সোচ্চার হয়। আমেরিকায় ১৯২৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ডারউইনবাদের পরিবর্তে দেশের কোনো কোনো অংশে সৃষ্টি তত্ত্ব পড়ানোর জন্য আদালতে কয়েকটি মামলা হয়। মঙ্কি ট্রায়াল বা স্কোপস ট্রায়াল, ডিসকভারি ইনস্টিটিউটে ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন পড়ানোর প্রতিবাদে পেনসিলভানিয়াতে ‘Kitzmiller বনাম Dover Area School District’ ইত্যাদি মামলায় চার্চের প্রতিনিধিদের হার হয়। রম্যার পোপ এই হার স্বীকারও করে নেন।
ইসলামিক মৌলবাদীরাও কম বিরোধিতা করেননি। সৌদি আরবের রিয়াধের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মহম্মদ আলাসিরি ২০১৯ সালে একটি সমীক্ষা করে লেখেনঃ “সৌদি আরব, ওমান, আলজেরিয়া এবং মরক্কো অভিব্যক্তি সম্পর্কে পঠনপাঠন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। লেবাননে ধর্মীয় চাপের কারণে পাঠ্যক্রম থেকে অভিব্যক্তির তত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছে। জর্ডনে ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে অভিব্যক্তিবাদ কাটছাঁট করে পড়ানো হয়। মিশর এবং তিউনিসিয়াতে অভিব্যক্তিবাদকে একটি অপ্রমাণিত অনুমান হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। কাতার, ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, মিশর এবং তুরস্কের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে।’’
এক অসাংবিধানিক পদক্ষেপ
ভাবতে ঘৃণা হয় যে, এই তালিকার সাথে যুক্ত হচ্ছে ভারত। হিন্দু, খ্রিস্টান বা ইসলাম ইত্যাদি সমস্ত ধরনের মৌলবাদীদের একই রা - যুক্তিবাদের বিরোধিতা। তাদের মূল উদ্দেশ্য, মৌলিক বিজ্ঞানের পঠনপাঠন এবং গবেষণার বিরোধিতা করা। কিন্তু ফলিত বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ব্যবহারে কোনো আপত্তি নেই। যে দেশের সংবিধানের 51 A(h) ধারায় লেখা আছে - “It shall be the duty of every citizen of India to develop scientific temper, humanism and the spirit of inquiry and reform” - সেই দেশে বিজ্ঞান ও যুক্তিবোধের উপর এই আক্রমণ মেনে নেওয়া যায় না। বিজ্ঞান মানসিকতাই ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতাবাদ এবং অনুসন্ধিৎসু মন তৈরিতে সহায়তা করে। এটি দেশের এবং নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য হিসাবে সংবিধানে ১৯৭৬ সালে এক সংশোধনী হিসাবে যুক্ত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মান এবং ইটালীয়দের তীব্র জাত্যভিমান একগুচ্ছ উজ্জ্বল বিজ্ঞানীকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। এঁদের মধ্যে জার্মানি থেকে আলবার্ট আইনস্টাইন, ম্যাক্স বর্ন, হানস ক্রেব এবং ইটালিতে মুসোলিনির রাজত্বে এনরিকো ফেরমি, কামিলো আরটম প্রমুখ বিজ্ঞানীকে দেশ ছেড়ে হয় আমেরিকা বা ব্রিটেনে আশ্রয় নিতে হয়। এই অমানবিক এবং বিজ্ঞান বিরোধী পদক্ষেপের জন্য এই দেশগুলিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
কেন এই পদক্ষেপ
ডারউইন ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান...’-এর তৃতীয় অধ্যায় ‘Comparison of the Mental Powers of Man and the Lower Animals’-এর শেষ দিকে লিখছেনঃ “মানুষের উন্নত মানসিক অবস্থা মানুষকে প্রথমে ঈশ্বর বিশ্বাস এবং পরে ফেটিসিজম, পলিথেসিজম এবং শেষে মনোথেসিজম-এ বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে ফলে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কুসংস্কার বাসা বেধেছে এবং যুক্তিবোধ দুর্বল হয়েছে। তখন মানুষ বলি প্রথা, ডাইনি প্রথা, মানুষকে বিষ এবং আগুন দিয়ে হত্যা করা ইত্যদি ঘৃণ্য প্রথার দাস ছিল।” তিনি আরও লিখছেনঃ “আমাদের মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ অণুষদের এই দুঃখজনক এবং পরোক্ষ পরিণতিগুলিকে নিম্ন প্রাণীদের প্রবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।”
এখানেই মৌলবাদীদের আপত্তি। যে বিজ্ঞান গবেষণা বা জ্ঞান মুক্তচিন্তার আবহ তৈরি করে, যুক্তিবাদকে বিকশিত করে তা বর্জন করাই মৌলবাদীদের একমাত্র লক্ষ্য। মৌলবাদীদের উদ্যোগে জীবজগতকে অনেকদিন ধরেই রাখা হয়েছিল সমস্ত পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে। কারণ হিসাবে মনে করা হতো, ঈশ্বরের সৃষ্টি জীবজগৎ সর্বাঙ্গীণ সুন্দর আর নিখুঁত। তাই এদের কোনো পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনার প্রয়োজনীয়তা কোনদিন ছিল না। এর অর্থ, সকল জীব, সকল প্রজাতি সুস্থির, আবহমানকাল ধরে অপরিবর্তিত আছে এবং থাকবে। চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্ব মূলত জীবজগতের অপরিবর্তনীয়তার এই মিথটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। তাদের তত্ত্বই প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছিল যে, জীবজগৎও স্থির নয়, জড় জগতের মতো জীবেরও পরিবর্তন হয়, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনের লয় খুবই ধীর। এঙ্গেলস ‘Dialectics of Nature’- এর সূচনার এক অংশে লিখেছেন, “The more deeply and exactly this research was carried on, the more did the rigid system of an immutable, fixed organic nature crumble away at its touch।" এখানে এঙ্গেলস যে ‘রিসার্চ'-এর কথা বলেছেন তা হলো, অভিব্যক্তি বিজ্ঞানের গবেষণার কথা। এই গবেষণা যত এগিয়েছে জীবজগতের অপরিবর্তনীয়তার ধারণা ততটাই পিছিয়ে গেছে। এরই সূত্র ধরে এঙ্গেলস বলছেন যে, নতুন প্রজাতির আবিষ্কার (যেমন Amphioxus এবং Lepidosiren) এবং নতুন ফসিলের আবিষ্কার জীবজগতের বিবর্তনের অনেক তথ্য যোগ করেছে। এঙ্গেলস হলেন তেমনই একজন মানুষ যিনি অভিব্যক্তি বিজ্ঞানের কেবল দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নয় একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গিতেও দেখার চেষ্টা করেন।
১৮৮৫ সালে রিচার্ড লেভিস এবং রিচার্ড লেওন্টিনের ‘দা ডায়ালেক্টিকাল বায়োলজিস্ট’ প্রকাশিত হওয়ার পর কেউ কেউ বললেন যে, বইটি আসলে এই দুই বিজ্ঞানীর অভিব্যক্তি বিজ্ঞানের দর্শনচর্চা এবং অভিব্যক্তি বিজ্ঞানের সমাজের উপর প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে চর্চা। এই চর্চা আদপে রাজনৈতিক চিন্তার প্রকাশ। বিজ্ঞানের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। জীবজগতে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা পরিবর্তন এবং প্রত্যেকটি ছোটো বড়ো ঘটনাকে সামগ্রিকতার বিচারে আলোচনা করা এবং সমগ্রকে ছোটো ছোটো ঘটনার সমন্বয় হিসাবে দেখা বিজ্ঞানের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বই কিছুই নয়।
উপক্রমনিকায় তাঁরা লিখছেনঃ “ডারউইনের তত্ত্ব হলো বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকে এক বৌদ্ধিক বিপ্লবের ইঙ্গিত।” আরও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁরা লিখছেন যে -
- প্রথমত ডারউইনবাদ এক বস্তুবাদী ভাবনা এবং এই ভাবনার মধ্য দিয়ে Platonicidealism (প্লাটোর চিন্তা)-এর বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ শানানো হয়েছে। প্লাটোর চিন্তা হলো বিমূর্তবাদী দর্শন।
- দ্বিতীয়ত ডারউইনবাদ হলো পরিবর্তনের তত্ত্ব এবং সমস্ত ধরনের স্থবিরতার বিরুদ্ধে। বস্তুবাদী চিন্তা এবং পরিবর্তনশীলতা হলো দ্বান্দ্বিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- তৃতীয়ত অভিব্যক্তিবাদ হলো কারটেসিয়ানিজম অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রেনে ডেকার্তের (Rene Descartes) মতাদর্শ বা যুক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেকটা জীবের প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনের ক্ষমতা হলো ডারউইনের যুক্তি যার উপর অভিব্যক্তিবাদ দাঁড়িয়ে আছে। জীবের এবং তার চারপাশের পরিবেশের আলাদা আলাদা সত্তা আছে। পরিবেশের পরিবর্তন হয় বিভিন্ন স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তা সত্ত্বেও জীব সেই পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে যতটা সম্ভব নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।