E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৫ মে, ২০২৩ / ২১ বৈশাখ, ১৪৩০

মতাদর্শের চর্চা

ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (নয়)

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য


● কর্মসূত্র যোগ দর্শনের কেন্দ্রীয় বিষয়। কর্মই আমাদের সংসারের চক্রে বেঁধে রাখে, সংসারই আমাদের কষ্ট এবং মায়ার বিভ্রমকে স্থায়ী করে। মায়ার থেকেই বিভ্রম বা অজ্ঞতা। এই মায়াই আমাদের অহঙ্কার এবং মহাবিশ্বর ঐক্যবদ্ধ অভিজ্ঞতার মধ্যে আড়াল সৃষ্টি করে।

● জৈন প্রচারক মহাবীর বা গৌতম বুদ্ধ নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের আগে যোগচর্চা করতেন। সেইজন্যই যোগকে কোনো দর্শন হিসাবে না ধরে প্রাচীন অনুশীলন রূপে দেখা যুক্তিযুক্ত। যোগাভ্যাস সম্ভবত, সচেতন মনের চিন্তার প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ। যোগ মতে মানুষের দেহ ও মন প্রকৃতির ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি। প্রকৃতির নানা বস্তুর সঙ্গে আমাদের আন্তঃসংযোগ ঘটে, আন্তঃক্রিয়াও ঘটে। আমাদের শরীর ও মনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা চারপাশের প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারি। অসাধারণ ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে এই প্রচেষ্টা আদিমকালেও চলেছিল। পতঞ্জলিও অসীম ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। একে তিনি ‘বিভূতি’ নামে অভিহিত করেছিলেন।

● ঈশ্বরের অস্তিত্ববাদে যোগদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংখ্য দর্শনের মিল রয়েছে। যোগ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল - ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণাকে সাংখ্য দর্শনে যুক্ত করা ঈশ্বরবাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা ও সাংখ্য মতে মহাবিশ্বের তত্ত্বের প্রচারকে সহজতর ও গ্রহণযোগ্য করা। যোগসূত্র অনুসারে ঈশ্বর সৃষ্টিও করেন না, শাসনও করেন না। ‍‌তিনি মানুষের কর্মফলে পুরস্কার বা শাস্তি কোনটাই দেন না। যোগচর্চা করে ঈশ্বরের সাথে ‍‌মিলিত হওয়ার প্রচেষ্টা যোগদর্শনের চরম লক্ষ্যও নয়। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে অতিরিক্ত ক্ষমতা অর্জনের প্রাচীন অনুশীলন পদ্ধতি ছাড়া যোগচর্চা আর কিছু নয়। এই আকাঙ্ক্ষা আদিম, নিঃসন্দেহে একথা বলা যায়। তবে এতে প্রকৃতির প্রতি একটা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত রয়েছে।

যোগসূত্র আটটি যোগাঙ্গের সমষ্টি - (১) যম (সংযম), (২) নিয়ম (শৃঙ্খলা), (৩) আসন (অঙ্গভঙ্গি), (৪) প্রাণায়াম (শ্বাস নিয়ন্ত্রণ), (৫) প্রত্যাহার (ইন্দ্রিয় প্রত্যাহার), (৬) ধারণা (মনসংযোগ), (৭) ধ্যান, (৮) সমাধি।

● বিভিন্ন দার্শনিক নানা ব্যবস্থাসহ যোগব্যায়ামের এই প্রাচীন উত্তরাধিকারকে পরবর্তী সময়ে স্বকীয় ধারার যোগ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছেন। একইসঙ্গে মৌলিক দার্শনিক সত্যের সঠিক উপলব্ধির জন্য নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করার উপায় হিসাবে যোগ অনুশীলন করার স্বতন্ত্র প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। কিন্তু যোগচর্চার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণত পৃথক এক বিষয়গত জ্ঞান যা কোনো দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না - এভাবেই বিশিষ্ট দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন।

ন্যায়-বৈশেষিক-দর্শন

● দীর্ঘ সময় ধরে ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল ও পরে একীভূত হয়ে যায় বলেই একসাথে ন্যায়-বৈ‍শেষিক দর্শন নামে অভিহিত করা হয়। তবে আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমে পৃথকভাবে ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের আলোচনা করা হবে।

ন্যায়-দর্শনঃ সংস্কৃত শব্দ, যার প্রতিশব্দ হলো ‘শাসন’ অথবা ‘পদ্ধতি’। ভারতীয় দর্শনগুলির মধ্যে অন্যতম। ন্যায় দর্শনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তি (Logic) ও জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) সম্পর্কে ব্যাখ্যা। ন্যায় দর্শনের যে অবদান (দর্শনের জগতে)-এর জন্য বিখ্যাত তা হলো, জ্ঞানের উপায় (Means) হিসাবে অনুমান (Intervence) সম্পর্কে বিশদ আলোচনা।

● ভারতীয় দর্শনের অন্য কয়েকটির মতো ন্যায় তত্ত্বও দার্শনিক ও ধার্মিক। এর মূল বিষয় হলো মানুষের কষ্টের অবসান ঘটানো। বাস্তবতার সম্পর্কে অজ্ঞতাই কষ্টের মূল কারণ। সঠিক জ্ঞান প্রকৃত মুক্তি সম্ভব করে। সঠিক জ্ঞান অর্জনের উপায় হিসাবে ন্যায় দর্শন।

● ন্যায় সূত্রের রচনাকার ছিলেন গৌতম। গৌতম বুদ্ধ ও ইনি কিন্তু একই ব্যক্তি নন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ন্যায় সূত্র রচিত হয়েছে। তবে এব্যাপারে ভিন্নমতও রয়েছে। কয়েকজন অত্যন্ত উঁচুমানের বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ন্যায়ের আদি অংশ গৌতম রচনা করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে। ন্যায়সূত্র রচনা হয় ১৫০ খ্রিস্টাব্দে। অক্ষাপদ (Aksapada) ছিলেন রচনাকার। ন্যায় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রাচীন ন্যায় ও নব্য ন্যায় এই দুইটি ধারার অস্তিত্ব রয়েছে। গৌতম থেকে শুরু করে প্রথম ব্যাখ্যাকার বাৎসায়ন (৪৫০ খ্রিস্টাব্দ) এবং ১০ম শতাব্দীর উদয়নাচার্য পর্যন্ত সকলের রচনাকে প্রাচীন ন্যায় বলা হয়। ১১০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ‘নব্য ন্যায়’ ধারার উদ্ভব হয়। নব্য ন্যায়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক পরিচিত দার্শনিক হলেন, ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘গদাধর’, যিনি ভারতীয় যুক্তিবাদের আধুনিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা।

ন্যায় সূত্রগুলি

ন্যায় সূত্রগুলি প্রকৃত জ্ঞান আহরণ পদ্ধতির দৃঢ়ভিত্তি স্থাপন করেছিল। প্রখ্যাত ভারতীয় দার্শনিক ডঃ রাধাকৃষ্ণাণের মতে একে ‘প্রমাণ শাস্ত্র’ বলা যেতে পারে। ন্যায় সূত্র যে পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই পদ্ধতি অনুযায়ী জ্ঞান প্রতিষ্ঠায় চারটি মৌলিক উপাদান প্রয়োজন।

● প্রমত (জ্ঞান প্রার্থী)
● প্রমেয় (যা জানতে হবে অর্থাৎ যার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।)
● প্রমাণ (জানার উপায়)
● প্রমিতি (অর্জিত জ্ঞান)
● চারটি উপাদানের মধ্যে ‘প্রমাণ’ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

ন্যায় দর্শনের বক্তব্য হলো; চার ধরনের প্রমাণ রয়েছে। সেগুলি হলো - যথাক্রমে প্রত্যক্ষ, অনুমান, তুলনা বা উপমন এবং শব্দ (বিশেষজ্ঞ মতামত)। বাতিল যে জ্ঞান তার উপায় হলো - স্মৃতি, সন্দেহ, ভ্রান্তি এবং অনুমান নির্ভর যুক্তি।

ন্যায় দর্শনে কার্যকারণ তত্ত্বে কারণ (cause)-কে কার্যের (effect)-এর শর্তহীন ও অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী হিসাবে উপস্থিত করা হয়। ন্যায় দর্শনে ক্রম (sequence)-এর প্রশ্নটিকে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। কার্য কারণের মধ্যে পূর্বে বিদ্যমান (pre-exist) নয়। এই ক্ষেত্রে ন্যায় তত্ত্বর সাংখ্য, যোগ ও বেদান্ত দর্শনের সাথে গুরুতর পার্থক্য রয়েছে। এমনকী বৌদ্ধ দর্শনেও কার্য, কারণ সমস্ত কিছুকে তাৎক্ষণিক (Momentary) বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তার সাথেও ন্যায় দর্শনের পার্থক্য সুস্পষ্ট। তবে এক্ষেত্রে ন্যায় দর্শনের পাশ্চাত্য প্রবর্তক যুক্তিবাদের মিল রয়েছে।

ন্যায় দর্শনে তিন ধরনের কারণ (Cause)-এর কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, সহজাত বা বস্তুগত কারণ (বস্তু যাকে ভিত্তি করে কার্যর উদ্ভব হয়), দ্বিতীয়ত, অ-সহজাত (Non-inherent) কারণ অর্থাৎ কারণের উদ্ভবে ভূমিকা পালন করে। তৃতীয়ত, দক্ষ কারণ (বস্তুগত কারণের ফলে কার্যের উদ্ভবের শক্তি)। এই মহাবিশ্বের বস্তুগত কারণ নয়। পরমাণু ও আত্মা এগুলি তো চিরন্তন। কিন্তু মহাবিশ্বের দক্ষ কারণ হলো ঈশ্বর।

● বি‍শেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো, কৌটিল্যের সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালে ন্যায় দর্শনের অস্তিত্ব ছিল না। তাই তিনি এইভাবে সূত্রায়িত করেছিলেন - ১ বিদ্যাকে আণবিকসিকি, (অভিজ্ঞতা যা আসছে বা যা যা শাস্ত্রমত হিসাবে উপস্থিত হয়েছে তাকে ভালো করে যাচাই করা), ত্রয়ী অর্থাৎ তিনটি বেদ, ভর্ত (কৃষি ও প্রাণীপালনের বিজ্ঞান), দণ্ডনীতি (রাজনীতি)। দর্শনকে তিনি সাংখ্য, যোগ, লোকায়ত ও আণবিকসিকি হিসাবে উপস্থিত করলেন। কৌটিল্য ন্যায়সূত্রকে আণবিকসিকি হিসাবে উপস্থিত করায় এটাই বোঝা যায় যে, ওই সময়কালে (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) ন্যায় সূত্র নামটি পরিচিত ছিল না।

● ন্যায় সূত্রে চার ধরনের যে প্রমাণের কথা বলা হয়েছে এর মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ব্যক্তিগত সংবেদনশীল অনুভব দ্বারা অর্জিত জ্ঞান।

● অনুমান প্রমাণের অর্থ হলো যখন নানা বিষয়ের আন্তঃসম্পর্কের বিশ্লেষণে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। যেমন ধোঁয়ার বার হওয়া আগুনের অস্তিত্ব বোঝায়। দূরে বা আড়ালে আগুন দেখা না গেলেও আগুনের অস্তিত্ব অনুমান করতে পারা যায়। উপমান প্রমাণের অর্থ হলো - এক জাতীয় বিষয় বা ঘটনার ব্যাখ্যায় সমতুল উপমান ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, পৃথিবী গোলাকৃতি বোঝাতে বল বা কমলালেবু দেখানো যায়। অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে, পুলিশ ঘটনাস্থলে অপরাধীদের সাহায্যে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করেন।

● যে সব বিষয় আমরা স্বল্প সময়ে জানতে পারি না, তার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে হয়। সেতু বা ব্রিজ ভেঙে পড়ার কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় না, নানা ধরনের বিশেষজ্ঞ, বিশেষত বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ নিতে হয়। অজানা ভাইরাসকে চিহ্নিত করা ও ভাইরাস আক্রমণের মোকাবিলায় বি‍শেষজ্ঞদের পরামর্শ ও সাহায্য নিতে হয়। এরই দার্শনিক নাম - শব্দ প্রমাণ।

● নিছক প্রস্তাবিত কোনো জ্ঞান-এর ধারণাকে ন্যায় সূত্র প্রত্যাখ্যাত করেছিল। প্রমাণ হওয়া বা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রমাণই হলো জ্ঞানের বাছাই ও যাচাইয়ের পথ। ন্যায় সূত্র মতে বিশুদ্ধ চিন্তা ভাবনার পরিবর্তে বস্তুবাদী অনুশীলনই জ্ঞান অর্জনের পথ।

● জ্ঞানের ক্ষেত্রে ন্যায় সূত্র কয়েকটি লক্ষণের কথা উল্লেখ করে। যেমন সান্নিধ্য - হৃৎস্পন্দন দেখে জীবিত না মৃত বোঝা যায়। মৃত ব্যক্তির হৃৎস্পন্দন হয় না, জীবিত ব্যক্তির হৃৎস্পন্দন হয়। খাবারের গন্ধ থেকেই সদ্য রান্না করা খাবার আর বাসি খাবার পৃথক করতে পারি।

ষোলটি বিষয়ের গণনার মাধ্যমে ন্যায় সূত্রের শুরু। সেইগুলি হলো যথাক্রমে - (১) সঠিক জ্ঞানের প্রমাণ; (২) প্রমেয় অর্থাৎ সঠিক জ্ঞানের বস্তু বা বিষয়; (৩) লক্ষ্য (প্রয়োজন); (৪) দৃষ্টান্ত; (৫) সমস্যা; (৬) সিদ্ধান্ত; (৭) অবয়ব বা ভিত্তি; (৮) তর্ক; (৯) নির্ণয় বা নির্ধারণ; (১০) বাদ (Debate); (১১) জল্প (Disputations); (১২) বিতণ্ডা (ধ্বংসমূলক সমালোচনা); (১৩) ভ্রান্তি (Fallacy); (১৪) বকাবকি; (১৫) খণ্ডন বা যতি; (১৬) নিগ্রহস্থান (বিরোধী মতের পরাজয়ের ক্ষেত্র)। একমাত্র এই ‘নিগ্রহস্থান’-এর মধ্য দিয়েই ‘মিথ্যাজ্ঞান’ যার বারেবারে আবির্ভাব ঘটে তারপর ধারাবাহিক পরাজয় হয়। এটাই ন্যায় তত্ত্বের দ্বিতীয় সূত্র। এর মধ্য দিয়েই মুক্তি বা ‘অপবর্ণ’ অর্জিত হয়।

● ন্যায় দর্শনে ‘শব্দ’-র অর্থ হলো বিশ্বস্ত কর্তৃত্বের - অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানীর সাক্ষ্য।

ন্যায় দর্শন অনুযায়ী ‘দৃষ্টান্ত’ বলতে সেটাই বোঝায়, সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞদের কাছে যার রয়েছে সম অর্থ। ন্যায় সূত্রে চার ধরনের সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে। (১) সর্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত - যা সকলের কাছেই গ্রহণীয়; (২) প্রতিতন্ত্র সিদ্ধান্ত - যা সম ধরনের চিন্তার সকলের কাছে গ্রহণীয়, কিন্তু অন্য অংশের বিরোধিতার মুখে; (৩) অধিকারণ সিদ্ধান্ত - যা গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলিও স্বাভাবিকভাবেই তার অনুসরণ করবে; (৪) অভিউপগম সিদ্ধান্ত - বিরোধীদের সেই যুক্তি যা বিনা সমালোচনায় গ্রহণ করে বিতার্কিক (Dehator) এই যুক্তির পরিণতিগুলিকে খণ্ডন করে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন এবং বিরোধীদের বুদ্ধি ও জ্ঞানকে অসম্মানিত করেন।

● ন্যায় দর্শনে পাঁচ ধরনের ভিত্তি (Premise)-এর কথা বলেছে। (১) প্রতিজ্ঞা - যা প্রমাণ করতে হবে ঘোষণা; (২) হেতু - কারণগুলি যা সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করে; (৩) উদাহরণ - ইতিবাচক বা নেতিবাচক দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণ; (৪) উপনয় - উদাহরণের দ্বারা সমর্থন; (৫) নিগমন - যা প্রমাণিত সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো।

● প্রথম ন্যায় সূত্রে তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, ভ্রান্তি, চাল, যতি এবং নিগ্রহস্থান - এগুলির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

● ন্যায় সূত্রে ‘প্রমাণ’ অর্থাৎ সঠিক জ্ঞানের উপায়ের যারা বিরোধিতা করেছেন তাদের মতগুলিকে খণ্ডন করা হয়েছে। আবার আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ নিয়ে ন্যায় সূত্রে আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তী গ্রন্থে (ন্যায় সূত্রের) দোষ-এর প্রসঙ্গে আলোচনায় বলা হয়েছে, অজ্ঞানতা যাকে ‘মোহ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে তাকে সমস্ত দোষের মূল কারণ বলা হয়েছে। রাগ, দ্বেষ - এগুলিকে দোষ হিসাবে উপস্থিত করা হয়েছে। ন্যায় সূত্রের পঞ্চম গ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের নিগ্রহস্থান অর্থাৎ খণ্ডনকে সাজিয়ে উপস্থিত করা হয়েছে। যদিও এই পঞ্চম গ্রন্থটি ন্যায় সূত্রে পরবর্তী সময়ের সংযোজন।

ন্যায় দর্শন যুক্তিবাদের কিছু ধারণাকে ভ্রান্ত বলে অস্বীকার করেছিল -

(১) জল্প - জল্প-এর উদ্দেশ্য সত্য অনুসন্ধান নয়, বরং কোনো না কোনভাবে বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া। জল্প প্রকৃত জ্ঞান থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়।

(২) বিতণ্ডা - বিতণ্ডা হলো নিজের যুক্তিবিন্যাস প্রতিষ্ঠা না করে অন্যের বিরোধিতা করা। এই প্রক্রিয়া নিছক বিতর্ককে প্রলম্বিত করে অপ্রয়োজনীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ও প্রকৃত সত্যে পৌঁছতে দেয় না।

(৩) চাল - ভুল শব্দ ব্যবহার করে বিতর্ককে বিভ্রান্ত করাকেই চাল বলা হয়। যেমন ‘আমি ধ্যানমগ্ন’ মানে ব্যক্তিটি ‘মদ্যপ’ বলে চালানো যায়।

(৪) যতি - যথাযথ উত্তর না দেওয়ার একটা পদ্ধতি।

আমাদের বর্তমান আইনি ব্যবস্থা ও কার্যকলাপ এগুলিকে অনুসরণ করে।

● ন্যায় দর্শন সম্পর্কে আলোচনায় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ন্যায় দর্শনের নব ধারার উদ্ভব ঘটল ১২০০ খ্রিস্টাব্দে মিথিলার গঙ্গেশ উপাধ্যায়ের মাধ্যমে। তিনি প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দ এদের মধ্যেই তাঁর আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তবে তাঁর অনুমান সম্পর্কিত আলোচনার ব্যাপক প্রভাব বাংলার নবদ্বীপ অঞ্চলে পড়ে। গঙ্গেশ উপাধ্যায়ের রচনা ‘তত্ত্বচিন্তমণি’র অংশ সম্পর্কে বহু আলোচনা, মতামত লিখিত হয়। বহু স্বাধীন রচনা ‘শব্দ’ ও ‘অনুমান’ বিষয়ক বাংলার বিদগ্ধ পণ্ডিতরা উত্থাপন করেন। কয়েক শতাব্দী ধরে প্রায় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ন্যায় দর্শনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল নবদ্বীপ। প্রাসঙ্গিক বলে এটা উল্লেখ করা হলো।

(ক্রমশ)