৫৯ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৫ নভেম্বর, ২০২১ / ১৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
কমরেড উদয় সরকারের জীবনাবসান
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বর্ধমানের জনপ্রিয় সিপিআই(এম) নেতা, অবিভক্ত বর্ধমান জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি কমরেড উদয় সরকারের জীবনাবসান হয়েছে। তিনি সিপিআই(এম) পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং সারা ভারত কৃষক সভার নেতা ছিলেন। কমরেড উদয় সরকার ২০২০ সালের মার্চ মাসে অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হন। শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তাঁকে বর্ধমান শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার তাঁর অবস্থার আরও অবনতি হয়ে তিনি কোমায় চলে যান। গভীর রাতে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। বয়স হয়েছিল ৬৭। একজন সুবক্তা, মিষ্টভাষী, তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও একমুখ নির্মল হাসি মানুষকে আকৃষ্ট করত। এমন একজন গরিবের বন্ধু, লড়াকু মানুষকে হারিয়ে স্বজনহারা কান্নায় ভেঙে পড়েন বহু মানুষ।
কমরেড উদয় সরকারের মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন সিপিআই(এম) নেতা মদন ঘোষ, অঞ্জু কর, অমল হালদার, অচিন্ত্য মল্লিক, আভাস রায়চৌধুরী, সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সভাপতি বিপ্লব মজুমদার প্রমুখ। সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় কাউন্সিল সদস্য কমরেড উদয় সরকারের জীবনাবসানে শোক জানিয়েছেন কৃষক সভার সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ।
২৯ অক্টোবর বর্ধমানে শাহেদুল্লাহ-বিজয় ভবনে সকালে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয়। প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গ্রাম-গঞ্জ থেকে বহু মানুষ ছুটে এসেছেন। সেখানেই প্রয়াত কমরেডের মরদেহে লাল পতাকা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান অঞ্জু কর, অমল হালদার, অচিন্ত্য মল্লিক, আভাস রায়চৌধুরি। তারপর তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই চার নেতৃত্বসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মালা দেন মরদেহে। এছাড়াও মালা দিয়েছেন পার্টিনেতা সৈয়দ হোসেন, প্রবীণ নেতা অরিন্দম কোঙার, গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি, বিবেকহোম চৌধুরী, সুকান্ত কোঙার, সমর ঘোষ, তাপস সরকার, গণেশ চৌধুরী, তাপস চ্যাটার্জি, শুকুল শিকদার, সুদীপ্ত বাগচী, বীরেশ মণ্ডল, অপূর্ব চ্যাটার্জি প্রমুখ। বিভিন্ন গণসংগঠন ও বামপন্থী দলগুলির পক্ষ থেকেও তাঁর মরদেহে মালা দেওয়া হয়েছে। মালা দিয়েছেন তাঁর দুই পুত্রও। তাঁর মরদেহ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে গবেষণার জন্য তুলে দেওয়া হয়।
কমরেড উদয় সরকার ছাত্র জীবনে শ্যামসুন্দর কলেজ থেকেই পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৭৪ সালে তিনি পার্টি সদস্যপদ অর্জন করেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি যুব আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং রাজ্যস্তরে নেতৃত্বে উঠে আসেন। রায়নার স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কাটোয়া সম্মেলনে বর্ধমান জেলা কৃষক সভার সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি দক্ষিণ দামোদর পার্টির জোনাল কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৫ সালে তিনি অবিভক্ত বর্ধমান জেলায় পার্টির জেলা কমিটির সদস্য হন। ২০০৪ সালে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় বালি মাফিয়াদের সাথে তাঁর তীব্র সংঘাত তৈরি হয়। বালি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই তিনি জেলার রাজস্ব বৃদ্ধি করতে পথ দেখিয়েছিলেন। এরজন্য তাঁর উপর হামলাও হয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষের প্রতিরোধে তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর তিনি ২০০৩ সালে অবিভক্ত বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি নির্বাচিত হন। ২০১৩সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন। সেই সময় গ্রামীণ জনজীবনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১০০ দিনের কাজে, গ্রামীণ বিদ্যুদয়নে ও বাড়ি বাড়ি শৌচাগার নির্মাণের আন্দোলনের পাশাপাশি সাক্ষরতা আন্দোলনেও তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। তিনি সেই সময় গ্রামে গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলে গরিব মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে জোর দিয়েছিলেন। গ্রামে কৃষকদের উঠান থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করে সেই ধান থেকে চাল তৈরি করে গ্রামের মানুষের যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছিল তা রাজ্যে প্রশংসিত হয়। জেলা কৃষক সভার সভাপতি হিসাবে কৃষক আন্দোলনের ময়দানেও তাঁর সাহসী লড়াই জমি, মজুরি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ২০১১ সালের পর লুটের পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি পঞ্চায়েতে মনোনয়ন জমা থেকে ভোটের লড়াইয়ে সাহসী ভূমিকা রেখে গেছেন।
২০২০ সালে তিনি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়েও ঘরে বসে থাকেননি। নির্বাচনের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই সময়ে পার্টির কাজে কঠোর পরিশ্রম করেন। আবার তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে তাঁকে ভরতি করতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর ছয় দশকের লড়াইয়ের জীবন থেমে যায়।