৫৯ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৫ নভেম্বর, ২০২১ / ১৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
নভেম্বর বিপ্লবের বার্তা চিরন্তন
অরিন্দম কোঙার
‘সোলজারস্ অব দ্য রেভোলিউশন’
শিল্পীঃ ভ্লাদিমির খোলুয়েভ
মার্কসবাদ
প্রকৃতি, মানুষ এবং তার সমাজ, সেই সমাজের বিকাশ নিয়ে চর্চা মানুষ শতকের পর শতক ধরে করে আসছে। পণ্ডিতেরা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। এইরকম পরিস্থিতিতে সমাজবিকাশের ধারায় পুঁজিবাদী সমাজে উনিশ শতকে মার্কস (১৮০৮-১৮৮৩) এবং তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু ও সহযোদ্ধা এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)-এর কাটে সারাজীবন। তাঁরা জ্ঞানী মানুষতো ছিলেনই, সর্বোপরি তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী। তাঁরা শুধু জ্ঞান আহরণই করেননি, তাকে সংশ্লেষিত করেছেন এবং পরিবর্তনের উপায় নির্ধারণ করেছেন, যা অভিহিত হয়েছে ‘মার্কসবাদ’ হিসাবে। কী সেই পরিবর্তন? মার্কসের ভাষায়, ‘‘দার্শনিকেরা দুনিয়াটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, তাকে পরিবর্তন করা।’’ (ফয়েরবাখ সম্পর্কে থিসিসসমূহ) এই পরিবর্তন হচ্ছে শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়নের পৃথিবীকে শোষণহীন, বৈষম্যহীন, নির্যাতন-নিপীড়নহীন পৃথিবীতে পরিবর্তন। সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তন, সেই সমাজতান্ত্রিক সমাজের উত্তরণ সাম্যবাদী সমাজে। মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্য কী? লেনিনের মতে, ‘‘আমাদের মতবাদ আপ্তবাক্য নয়, কর্মের দিগ্দর্শন’’ - সর্বদাই এই কথা বলতেন মার্কস ও এঙ্গেলস, ‘সূত্র’ মুখস্থ ও তার মামুলি পুনরাবৃত্তিকে সঙ্গত কারণেই বিদ্রূপ করতেন; সর্বোতম ক্ষেত্রে সে সূত্রে কেবল সাধারণ কর্তব্য নির্দেশ সম্ভব, কিন্তু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি বিশেষ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ-নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সে কর্তব্যের প্রয়োজনীয় রদবদল ঘটে।’’ (রণকৌশল প্রসঙ্গে পত্রাবলি)।
মার্কস-এঙ্গেলসের যোগ্য উত্তরসুরি লেনিন (১৮৭০-১৯২৪) মার্কসবাদ আয়ত্ত করেছিলেন, পূর্বোক্ত বক্তব্য অনুযায়ী মার্কসবাদ বুঝেছিলেন, মার্কসবাদ প্রয়োগ করেছিলেন, মার্কসবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। এর ফলে ‘মার্কসবাদ’ হয়ে ওঠে ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’। ঘটে যায় একটা দেশে বিপ্লব। নভেম্বর বিপ্লব - সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। একটা দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার রাস্তা খুলে যায়। নভেম্বর বিপ্লবের রূপকার লেনিন লেখেন, ‘‘আমরা শুরু করে দিয়েছি। কখন, কোন তারিখে এবং কোন সময়ে কোন দেশের সর্বহারারা এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করবে, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, বরফ ভাঙা হয়েছে; রাস্তা খোলা হয়েছে এবং পথ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ (অক্টোবর বিপ্লবের চতুর্থবার্ষিকী) নভেম্বর (রাশিয়ার পুরনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অক্টোবর) বিপ্লব দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়।
নভেম্বর বিপ্লব
নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিক কিছু দিকের প্রতি আমরা প্রথমে নজর দিতে পারি।
১৮৮৩ সালে যে বছর মার্কসের মৃত্যু হয়, সেই বছরই রাশিয়ায় মার্কসবাদী সাহিত্য প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নেন প্লেখানভ (১৮৫৬-১৯১৮)। ১৮৮৭ সালে লেনিন একটা মার্কসবাদী চক্রে যোগ দেন। ১৮৯৩ সালের মধ্যে তিনি একজন পাকাপোক্ত মার্কসবাদী হয়ে ওঠেন। ১৮৯৫ সালে শ্রমিকশ্রেণির একটা বিপ্লবী পার্টি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি নামে একটা পার্টি স্থাপিত হয়, কিন্তু তখন তিনি সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে।
পার্টি হলো। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির চরিত্র কোথায়? পার্টির কর্মসূচি নেই, নিয়মাবলি নেই, পত্রিকা প্রচারে সেই গুরুত্ব নেই। তাই নির্বাসনে থাকাকালীন লেনিনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ১৯০২ সালে প্রকাশিত লেনিনের বই - ‘কী করতে হবে?’ ১৯০৩ সালে রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় রাশিয়ার বাইরে। শুরু হয় বেলজিয়মের ব্রাসেলসে ৩০ জুলাই। শেষ হয় ইংল্যান্ডের লন্ডনে ২৩ আগস্ট। লেনিন যোগ দেন। তর্ক-বিতর্ক, ভোটাভুটি, এমনকী কখনও কখনও লেনিনের প্রস্তাব ভোটাধিক্যে খারিজ হয়ে যায়। তবু কংগ্রেস সফল। কর্মসূচি, নিয়মাবলি, পার্টির মুখপত্র হিসাবে সংবাদপত্রের বিশেষ কর্তব্য স্থির হয়। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় লেনিনের বই - ‘এক পা আগে, দু’পা পিছে’। লেনিন লিখলেন, ‘‘রুশ বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে আমাদের পার্টি কংগ্রেস হলো একক ও অভূতপূর্ব একটা ঘটনা। এই প্রথম একটা গোপন বিপ্লবী পার্টি গোপন জীবনের অন্ধকার থেকে প্রশস্ত দিবালোকে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হলো, আমাদের পার্টির অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের সমগ্র গতি ও পরিণতি এবং কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনের প্রশ্নে আমাদের পার্টির ও তার মোটামুটি লক্ষ্যগোচর প্রত্যেকটা অংশের সমগ্র প্রকৃতি - এসব কিছু তুলে ধরল দুনিয়ার সামনে।’’
তারপর কত লড়াই। লেনিনের শিক্ষা - ‘‘বৈপ্লবিক তত্ত্ব ছাড়া কোনো বৈপ্লবিক আন্দোলন হতে পারে না।’’ লেনিনের শিক্ষা - ‘‘ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে সংগঠন ছাড়া প্রলেতারিয়েতের আর কোনো হাতিয়ার নেই।’’ লেনিনের শিক্ষা - ‘‘সংবাদপত্র যৌথ প্রচারক এবং যৌথ আলোড়কই শুধু নয়, যৌথ সংগঠকও বটে।’’ লেনিন পার্টি পরিচালনায় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতি প্রবর্তন করেন। মার্কসবাদ প্রয়োগের তত্ত্ব (Theory of Practice)। কেবল প্রয়োগের তত্ত্বই নয়, প্রয়োগজাত অভিজ্ঞতার তত্ত্বও (Theory of Praxis)। নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণই মার্কসবাদের প্রাণস্বরূপ। লেনিন এইভাবেই পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেছেন, মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, মার্কসবাদকে সমৃদ্ধ করেছেন।
মার্কস-এঙ্গেলসের সময়ই পুঁজিবাদ নতুন স্তরে যাচ্ছিল। পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতায় একচেটিয়া আধিপত্য বাড়ছিল। লেনিনের সময় সেটা সাম্রাজ্যবাদের চেহারা নিলো। কেবল পণ্য নয়, পুঁজিও রপ্তানি হতে থাকল। শিল্প পুঁজি ও ব্যাঙ্ক পুঁজি মিলে হলো লগ্নিপুঁজি। বাজারের জন্য সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াটাকে নতুন করে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতে চায় আর তার জন্য মানুষের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায়। তাই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতিকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। একান্তই যদি যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে নিজের নিজের দেশে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের দুর্বল অংশে আঘাত হানতে হবে, যেমন রাশিয়ায়। এসবই মার্কসবাদের ভিত্তিতে মার্কসবাদ প্রয়োগ ও সম্প্রসারণে লেনিনের অবদান।
১৯০৫ সালে রাশিয়ায় বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি আক্রান্ত হয়েছে পার্টির বাইরে থেকে, পার্টির ভিতর থেকে। মার্কসবাদী দর্শন আক্রান্ত হয়েছে। সব লেনিন সামলেছেন এবং রাশিয়ার বাইরে থেকে। ‘বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা’, ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’, ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর মতো বই লিখেছেন। যথা সময়ে রুটি, জমি, ব্যক্তি স্বাধীনতার দাবির সঙ্গে ‘শান্তি’-র দাবি যুক্ত করেছেন। দাবিগুলিকে জনগণের দাবিতে পরিণত করেছেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়। জারের শাসনের অবসান ঘটে। অস্থায়ী কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। পার্টিতে বিতর্ক ওঠে। সরকারকে সমর্থন না উচ্ছেদের ডাক। দেশের বাইরে থেকে লেনিন এলেন, বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ হাজির করলেন। তিনি বললেন - ‘‘সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে।’’ শেষ পর্যন্ত নভেম্বর মাসে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। অস্থায়ী সরকার উৎখাত হয়। শ্রমিক-কৃষক রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
বিপ্লব হলো - এইবার বিপ্লবকে রক্ষা করতে হবে। বিপ্লবের কয়েকঘণ্টার মধ্যে ডিক্রি জারি হলো - শান্তির জন্য, কৃষকের জমির জন্য। জার্মানির সঙ্গে শান্তি চুক্তি হলো। দেশের বাইরে থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আক্রমণ, দেশের ভিতরে প্রতিবিপ্লবী শক্তির আক্রমণ। বাইরে-ভিতরের আক্রমণ থেকে বিপ্লবকে রক্ষা করতে হলো।
১৯১৮-১৯২১ সালে যুদ্ধ সাম্যবাদী নীতি (War Economy) চালু হলো। ১৯২১ সাল থেকে নয়া-অর্থনৈতিক নীতি (New Economic Policy - NEP) শুরু হলো। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ লিখেছেন, ‘‘এগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে শেষজীবনে লেনিন নির্দেশ করেন নয়া অর্থনৈতিক নীতির পর্যায় থেকে সমাজতন্ত্রে উপনীত হওয়ার সাধারণ নির্দেশিকা, যার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল বিদ্যুদয়নের প্রযুক্তি, সমবায়ীকরণের সমাজতত্ত্ব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং পার্টির ভিতরে শক্তিশালী কেন্দ্রের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। লেনিন নিজের জীবদ্দশায় এই নির্দেশিকাগুলির বাস্তব প্রয়োগ দেখে যেতে পারেননি। তাঁর উত্তরসুরিদেরই সেটা করতে হয়েছে। তাঁরা কঠোরভাবে এই নীতিগুলি প্রয়োগ করেছেন, যদিও সেটা করতে গিয়ে তাঁদের গুরুতর ভুলভ্রান্তিও কিছু হয়েছে। লেনিনের প্রদর্শিত পথ অনুসরণের ফলে জার আমলে পশ্চাৎপদ রাশিয়া থেকে আধুনিক অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতি সংবলিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।’’ (বিংশ শতাব্দী ও লেনিন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করে, মানবসভ্যতাকে রক্ষা করে। বিশ্বযুদ্ধের পর দুনিয়ায় শক্তির ভারসাম্য সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে, একটা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভারতসহ একটার পর একটা দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। স্তালিনের মৃত্যু হয় ১৯৫৩ সালে। সেই সময়ে বেশকিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয়, যা নাম্বুদিরিপাদ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারপর সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন বিচ্যুতি ঘটে যে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পরে, সমাজতন্ত্র পিছু হটে। সমাজতান্ত্রিক শিবির অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, দুনিয়ায় শক্তির ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে যায়।
নভেম্বর বিপ্লব সফল হবার কারণ বারে বারে আলোচনা হয়েছে এবং আরও হবে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের কারণও তিন দশক ধরে অনুসন্ধান হচ্ছে। বিপর্যস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সারা দুনিয়ার ঘটনাবলির গতি-প্রকৃতিও বিশ্লেষিত হচ্ছে। তাতে বস্তুনিষ্ঠভাবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মার্কসবাদ অচল হয়নি, সমাজতন্ত্র বাতিল হয়নি, পুঁজিবাদ ইতিহাসের শেষ নয়। ১৯৯২ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) তার চতুর্দশ কংগ্রেসে কিছু পর্যালোচনা করে। সেই পর্যালোচনায় যে কারণগুলি চিহ্নিত করা হয়, তার কয়েকটা হচ্ছে - সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শ্রেণি-চরিত্র অনুযায়ী কাজ করার ক্ষেত্রে বিকৃতি, সমাজতন্ত্র নির্মাণের দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব, অর্থনৈতিক পরিচালন ব্যবস্থায় সময়মতো পরিবর্তন আনতে না পারা, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও গভীর করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, আমলাতান্ত্রিকতা বৃদ্ধি, বিপ্লবী নৈতিকতার মানের অবনতি, মতাদর্শগত ক্ষেত্রে গুরুতর বিচ্যুতি পার্টি ও রাষ্ট্র থেকে জনগণের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি ভূমি রচনা করে। এর ফলে দেশের ভিতরে প্রতিবিপ্লবী শক্তি এবং দেশের বাইরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্মিলিতভাবে সমাজতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করার তৎপরতা চালিয়ে যেতে পেরেছে।
সেই পর্যালোচনা (কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় প্রসঙ্গে প্রস্তাব) করার সময় পার্টি মনে করেঃ ‘‘পরিস্থিতির জটিলতা এবং যে বিষয়গুলি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তা মানবসভ্যতার প্রায় এক শতাব্দীর ইতিহাসকে ঘিরে। তার ফলে ব্যাপক, বিস্তৃত, গভীরভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। ঘটনার গতি এবং চরিত্র অনুযায়ী কয়েকটি প্রাথমিক উপসংহারই টানা যায়।’’ (অনুচ্ছেদ ১.৪) প্রাসঙ্গিকভাবে প্রস্তাবের আর একটা অংশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। প্রস্তাবের ১.৯ অনুচ্ছেদে আবার লেখা হয়েছেঃ ‘‘বিংশ শতাব্দীর বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলি এবং সমসাময়িক বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও প্রয়োগের গভীর ছাপকে সমস্ত সাফল্য-ব্যর্থতা, অগ্রগতি-বিপর্যয় সহ যথাযথভাবেই মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।’’ এই মূল্যায়ন কিছু কিছু হচ্ছে এবং সেগুলোকে আমাদের সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে।
মূল কথা
বিপ্লব যেমন করতে হয়, বিপ্লবকে তেমনি রক্ষা করতেও হয়। তার জন্য চাই উপযুক্ত প্রস্তুতি, যথাযথ সতর্কতা। মার্কসবাদের প্রয়োগ ও বিকাশ, কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনা সেইভাবে করতে হয়। মার্কসবাদী তত্ত্ব, কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো অনড়, অপরিবর্তনীয় নয়। মার্কসবাদ কেবল পুঁথির পাতার শুষ্ক তত্ত্ব নয়, তাহলে সেটা হয়ে যায় কেতাবি মার্কসবাদ। মার্কসবাদের প্রয়োগ কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যকে নিজের মধ্যে, পার্র্টির মধ্যে, জনগণের মধ্যে করতে হয় - নিজেকে তৈরি করতে, পার্টিকে পরিচালনা করতে, জনগণকে অধিকার বোধে সচেতন করে উচ্চ থেকে উচ্চস্তরের আন্দোলনে শামিল করতে। মার্কসবাদ বিশ্ববীক্ষা। মার্কসবাদ ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা দেয়।
লেনিন মার্কসবাদকে এতই যোগ্যতার সঙ্গে কাজে লাগান যে, বিমূর্ত মার্কসবাদ মূর্ত হয়ে ওঠে। তিনি নভেম্বর বিপ্লবের আগে একটা বড়ো সময় দেশান্তরে, অন্তরীণে কিংবা আত্মগোপনে থেকেছেন। কিন্তু মতাদর্শগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে পার্টি পরিচালনা করেছেন। পার্টি পরিস্থিতি অনুযায়ী স্লোগান তুলেছে, সেই স্লোগানকে প্রচার, প্রচারের স্তর থেকে আলোড়ন, আলোড়নের স্তর থেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের স্তরে নিয়ে গেছে। লেনিন দেখিয়েছেন, ‘‘মার্কসবাদ গণআন্দোলনকে কোনো একটামাত্র বাঁধাধরা রূপের মধ্যে আবদ্ধ রাখে না। সংগ্রামের বহু বিচিত্র রূপকে মার্কসবাদ স্বীকৃতি দেয়; মার্কসবাদ সংগ্রামের রূপ বানায় না। বিপ্লবী শ্রেণিগুলির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংগ্রামের যেসব রূপ স্বতঃই জেগে ওঠে, মার্কসবাদ সেগুলিকেই একটা সাধারণ রূপ দান করে, সংগঠিত করে সচেতন অভিব্যক্তি জোগায়। সমস্ত বিমূর্ত সূত্র এবং তত্ত্বগত নির্দেশ নাকচ করে মার্কসবাদ প্রবহমান গণসংগ্রামের প্রতি মনোযোগী দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যত আন্দোলন গড়ে ওঠে জনগণের শ্রেণি-চেতনা বাড়ে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট তীব্র হয়, তত রক্ষণ ও আক্রমণের নানা নতুন নতুন পদ্ধতি ধারাবাহিকভাবে উদ্ভূত হতে থাকে।’’ (গেরিলা অভিযান)
ভারতসহ বর্তমান বিশ্বে বেশ কিছু দেশে দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে পুঁজিবাদ তার সংকট থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না। নয়া-উদারবাদী নীতি কাজ করছে না। দেশে দেশে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। লাতিন আমেরিকায়, ইয়োরোপে। তবে বহিঃপ্রকাশ এখনও দুর্বল। ভারতেও মানুষ রাস্তায় নামছে, বিশেষ করে কৃষকসমাজ। শ্রমিক-কৃষক ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। তাই নভেম্বর বিপ্লবের বার্তা চিরন্তন।