৫৯ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৫ নভেম্বর, ২০২১ / ১৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
এক ইস্পাতে গড়া মানুষের গল্পঃ নভেম্বর বিপ্লব স্মরণে
পল্লব সেনগুপ্ত
নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি
বইটির এ অবধি প্রায় পৌনে ৪ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। পৃথিবীর নানা ভাষায় এর অনুবাদ বেরিয়েছে; বাংলাতেও - ‘ইস্পাত’ নামে। আমরা অল্প বয়সে ন্যাশনাল বুক এজেন্সির সেই প্রকাশনা পড়েছি। এবং মুগ্ধ হয়েছি।... বইটি বিখ্যাত হয়েছে তার ইংরেজি অনুবাদের নামেঃ ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পারড’। না, ধাতুবিদ্যার বই নয়! লোহা কীভাবে ইস্পাতে পরিণত হয় - তার বিবরণ নয়। নভেম্বর বিপ্লব তার আগের এবং পরের কতকগুলি বছরের পটভূমি এবং তার মাঝে পাভেল কোর্চাগিন নামে এক ইউক্রেনীয় ছেলের সাচ্চা কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার অসামান্য সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ কাহিনি এই বইতে বিধৃত হয়েছে।
নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির লেখা এই বইটির মূল যা রুশি নাম ছিল, তার বাংলায় অর্থ হলো, ‘একজন নায়কের নির্মাণ’ (মেকিং অব এ হিরো)। ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রথমে বেরিয়েছিল ‘ইয়ং গার্ড’ পত্রিকায়, ১৯৩২ থেকে ’৩৪-এর বিভিন্ন সংখ্যায়। পরে বইয়ের চেহারায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৬-এ; অস্ত্রোভস্কির জীবনাবসানও ঘটে ওই সময়েই মাত্র ৩২ বছর বয়সে। এর বিশ্বজোড়া খ্যাতি তাঁর দেখে যাওয়ার সুযোগটুকু মেলেনি! এখানে একটা কথা বলবো; পত্রিকায় প্রকাশিত কাহিনির সমাপ্তিটা বইয়ে কিছুটা পালটে দিয়েছিলেন তিনি।
।। দুই ।।
নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি-র ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পারড’-এর ইংরেজি সংস্করণ
অস্ত্রোভস্কির এই উপন্যাস ৮৫ বছর আগে প্রকাশিত হলেও, আজও এর গুরুত্ব কিন্তু কম নেই। আজকের পৃথিবীতে - এমনকি আমাদের দেশের প্রেক্ষিতেও এই বই অত্যন্তই তাৎপর্যপূর্ণ। কেন, সেই কথায় পরে আসছি। তার আগে কাহিনিটার সঙ্গে নতুন করে একটু পরিচিত হয়ে নেওয়া একটু বাঞ্ছনীয়। সেটারই চেষ্টা করা যাক বরং -
ইউক্রেনের ছোটো একটা মফস্সল শহর শেপেটোভকা। পাভেল কোর্চাগিনরা সেখানকারই এক নিম্নবিত্ত পরিবার। পাভেল যাকে বলে বেয়াড়া, বাঁদর টাইপের ছেলে - সব সময়ে কিছু নটখটিতে মন তার। ওর যখন ১২ বছর বয়স, খাবার জন্যে রাখা পাউরুটির মধ্যে তামাক ভরে রাখার জন্যে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো ওকে। বিতাড়িত হয়ে কিছু একটা রোজগারের ধান্দায় ওকে নিতে হলো একটা খাবারের দোকানে বাসনপত্র ধোওয়ার কাজ। সেখানেও মারপিট করে অন্যদের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই। একবার প্রচণ্ড মার খাচ্ছিল ও - ওর দাদা আর্তিওম এসে পড়ে ওকে বাঁচায় সে যাত্রায়। এইভাবেই পাভেলের দিন কাটে।
এরপরে গল্পটা চার বছর এগিয়ে যায়। পাভেলের তখন ১৬ বছর বয়স। একটা বিদ্যুৎ তৈরির কারখানায় ও তখন মজদুর। স্বভাবের বিশেষ বদল-টদল হয়নি অবশ্য! একদিন এরই মধ্যে পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়ানো এক বলশেভিক কর্মী - জউখারাই - তার সঙ্গে ওর দেখা হয়ে যায়। জউখারাইয়ের কাছে শোনে বলশেভিকদের কথা, তাদের কাজকর্মের কথা; আর লেনিন নামে তাদের এক বড়োমাপের নেতার কথাও তার কাছে শোনে পাভেল। কথাগুলো সব যে বোঝে ও, এমনটা নয়। তবে শুনতে ভালো লাগে ওর। গরিব মানুষদের জন্য কাজ করে বলশেভিকরা, লেনিন তাদেরকে শেখান কী করতে হবে - এইসব জেনে পাভেলের একটা পরিবর্তন হতে থাকে। তানিয়া বলে একটি মেয়ের সঙ্গেও ওর এই সময়েই পরিচয় হয়, একটা অবোধ্য আকর্ষণও ও অনুভব করে তার প্রতি।
এরপরে গল্পটা আরও এগিয়ে আসে। ১৯১৭-র উত্তাল সময়ে। দেশে গণ-বিপ্লব সফল হয়েছে বটে, কিন্তু তখনও বলশেভিকরা সর্বত্র পায়ের তলায় শক্ত জমি খুঁজে পায়নি। ঘরে-বাইরে শত্রু তাদের।... জারের পতন হলেও তার অনুগামী সৈন্যরা, বলশেভিকদের বিরোধীরা, নিজেদের মধ্যেই বিভেদ সৃষ্টিকারী মেনশেভিকরা যেমন, তেমনই আবার কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের পাঠানো সৈন্যরাও বহু জায়গায় বিপদের সৃষ্টি করছে। মায় জার্মান সৈন্যরাও মহাযুদ্ধকে টেনে এনেছে ইউক্রেন অবধি, পাভেলদের শহরটাতেও ঢুকে পড়েছে তারা। বলশেভিকদের সঙ্গে সঙ্গে পাভেলও তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেয় - জার্মানরা হটে যায় বটে, তবে সেইসঙ্গে ওরও একটা চোখ বিষমভাবে জখম হয়।
জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হবার পরও পাভেল বলশেভিকদের সঙ্গে থাকে। ও হয়ে যায় তাদেরই একজন। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় যেসব আঞ্চলিক গৃহযুদ্ধ হতে থাকে, পাভেল সেখানেও বলশেভিক বাহিনীর হয়েই লড়াই করে। ততদিনে ওর আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে স্বভাবে, একদা বিচ্ছু, উড়ুম্বা ছেলে হয়ে উঠেছে একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট।
ধীরে ধীরে দেশের অবস্থা স্থিতিশীল হয়। ও তখন একজন পরিশ্রমী রেল শ্রমিক। কিন্তু দুর্ঘটনায় পাভেল খোয়ায় তার একটি হাত এবং দুই পা। ও চলে যায় ক্রিমিয়ায় - বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাতে মনস্থ করে। সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে পাভেল লেখে নিজের আত্মকথাঃ ‘কেমন করে কাঁচা লোহা থেকে ইস্পাত তৈরি হয়’ ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পারড’ - এইখানেই উপন্যাসের সমাপ্তি।
।। তিন ।।
Nikolai Ostrovsky-র লেখা ‘How the Steel was Tempered’-এর মূল রুশ সংস্করণ ('как закалялась сталь' written by Николай Островский)
কাহিনিটা তো আপাতদৃষ্টিতে বেশ সাদামাটাই; তবু এর এমনতর ব্যাপক জনপ্রিয়তা কেন? প্রথম কথা, এর মধ্যে মানুষের অপরাজেয় যে সত্তাকে প্রত্যক্ষ করেন একজন পাঠক, তার মধ্যে তিনি নিজেরই প্রতিবিম্বকে খোঁজেন যে! দ্বিতীয়ত, অল্প বয়সে যে ছেলে বেয়াড়া, দিশাহীন এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান - সে কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গড়ে তুললো একজন প্রকৃত সংগ্রামী মানুষ হিসাবে - একটা ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’ ছেলে (লেনিনের ভাষায়!) কেমন করে সংগ্রামী কমিউনিস্ট হয়ে উঠলো - সেই চমৎকার ইতিবৃত্ত মানুষকে তো টানে, আকৃষ্ট করে! তা সেই পাঠক কমিউনিস্ট হোন বা না হোন!... এই পাভেল রুশ সাহিত্যের আর এক পাভেলের মতোই (গোর্কিন ‘মাদার’-এর সংগ্রামী নায়ক) আত্মপ্রত্যয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে, তবে অন্যভাবে। গোর্কির পাভেল পাঠককে উপলব্ধি করায় একটা বিরাট পালাবদল আসন্ন। আর এই পাভেল সেই পালাবদলের সময়ে এবং তার অব্যবহিত পরের যে ব্যাপ্ত হওয়া তুমুল টালমাটাল - তার মাঝেও অটল আত্মপ্রতীতিতে নিজেকে গড়ে তুলছে, সহ্য করছে সমস্ত ঝড়ের ঝাপ্টা। এই পাভেলকে তাই গোর্কিরই ভাষায় ‘স্টর্মী পেট্রেল’ বলতে পারেন - ঝড়ের পাখি! যে অদম্য, অপরাজিত, অপরাজেয়!
নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি এই উপন্যাসের নায়ক পাভেলকে খানিকটা পর্যন্ত নিজের আদলে সৃষ্টি করেছেন। সাহিত্য-সমালোচনার পরিভাষায় যাকে ‘অল্টার ইগো’ বা ‘আত্ম প্রতিকল্প’ বলে। তাঁর নিজের জীবনের অনেক ঘটনা এবং উপলক্ষ পাভেলের মাধ্যমে তিনি তুলে এনেছেন। অভিজ্ঞতার প্রতিফলন তো হয়েছেই। ইউক্রেনের একটি অখ্যাত শহরের দরিদ্র পরিবারে জন্মানো; স্কুলছুট হয়ে যাওয়া; রেল স্টেশনের সস্তা খাবারের দোকানে চাকরি করা; অক্টোবর বিপ্লবের আগেই বলশেভিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া; বিদ্যুৎ তৈরির কারখানায় চাকরি করা, জার্মানরা ইউক্রেন আক্রমণ করলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে বলশেভিকদের পক্ষে যোগ দেওয়া; শারীরিকভাবে অপটু হয়ে পড়া; জার্মান হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধে একটি চোখে আঘাত পেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যাওয়া... বহু কিছুই পাভেলের সঙ্গে তার স্রষ্টার জীবনের মিলে যায়। এমনকি পরে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসাবে অস্ত্রোভস্কির জীবনচর্যাতেও বিপ্লবোত্তর পর্বের পাভেল কোর্চাগিনের বেশ কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হয়তো নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে কলম ডুবিয়ে এই উপন্যাস লিখেছিলেন বলেই অস্ত্রোভস্কির লেখা এমন জীবন্ত, এমন মূর্তিমন্ত হতে পেরেছে। নিজেরই নির্মিতির স্মৃতিচিত্র তো পাভেলও লিখেছিলঃ ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পারড’!
।। চার ।।
আসলে অস্ত্রোভস্কির এই পাভেল তো শুধু তাঁর ‘অল্টার ইগো’ নয়, সে পৃথিবীর কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী সমস্ত মানুষের সামনেই একটা সমুজ্জ্বল প্রতীকী চরিত্রও বটে। সমস্ত দীনতা, হীনতা, বিঘ্ন, বিপর্যয়, ক্ষতির প্লাবন থেকে নিজের উত্তরণ ঘটানোর যে কাহিনি পাভেলের জীবনবৃত্ত থেকে উদ্ভাসিত হয়েছে, সেটা তো বিশ্বের যে-কোনো সংগ্রামী মানুষের কাছেই অনুপ্রেরণার উৎসঃ কমিউনিস্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ যাঁরা, তাঁদের কাছে তো বটেই!
নভেম্বর বিপ্লবের পর ১০৪ বছর কেটে গেছে। এটা ঠিকই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে কমিউনিস্ট আন্দোলন যে চেহারায় ছিল - এখন তার যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু ‘কমিউনিজম এখন অতীতের প্রেতচ্ছায়া’ - এইসব বলে যাঁরা আত্মশ্লাঘার ভান করেন, আসলে নিজেদের আতঙ্ককে সঙ্গোপনে রাখতে চেয়ে সেইসব প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার ধারক-বাহকরা এটা খুব ভালো করেই জানেন যে, 'কমিউনিজম' হলো মিথকথার ফিনিক্স পাখির মতোঃ তাকে প্রজ্জ্বলন্ত অগ্নিমশালের আগুনে দগ্ধ করলেও - সে সহসাই পুনর্জীবিত হয়ে ওঠে নতুনভাবে। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাবার পর প্রচারিত হয়েছিল, বিশ্বে নাকি কমিউনিজমের দিন শেষ! কিন্তু নতুন করে যে, নতুনভাবে বামপন্থীরা দেশে দেশে আবার বিপুল গণ সমর্থন পেয়ে ফিরে আসছে ভাই! পূর্ব ইয়োরোপে, দক্ষিণ আমেরিকায়, আফ্রিকায়। এদেশেও তার ব্যত্যয় হবার কারণ নেই। দুই ‘‘পাভেলই এখন প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’’ আর সেজন্যই নিশ্চিতভাবে বলতেই পারিঃ ‘‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়!’’ নভেম্বর বিপ্লবের স্মরণে সেটাই হোক আমাদের সোচ্চার চিন্তা।