৫৯ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৫ নভেম্বর, ২০২১ / ১৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরম্পরায় নভেম্বর বিপ্লব
শুভময়
জারের উইন্টার প্যালেস অভিযান।
মানবমুক্তির লক্ষ্যে সারা দুনিয়া জুড়ে বৈপ্লবিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এক যুগসন্ধিপর্ব রুশ দেশের নভেম্বর বিপ্লব। সুতরাং নভেম্বর বিপ্লব কোনো স্বতন্ত্র স্বয়ম্ভূ একক সংগ্রাম নয়। কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ লেনিন-ই আমাদের শিখিয়েছেন বিশ্বজোড়া বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরম্পরায় নভেম্বর বিপ্লবকে স্থাপন করে তাকে বিশ্লেষণের পাঠ গ্রহণ করতে। মানবমুক্তির পরবর্তী সংগ্রাম, ক্রমসংগ্রাম, বিরতিহীন সংগ্রামের লক্ষ্যেই।
বস্তুত নভেম্বর বিপ্লবের পূর্বেই সমাসন্ন বিপ্লবকে তিনি সংগ্রামিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যথাযথভাবে স্থাপনের পাঠ রচনা করে রাখছেন। ১৯১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরেই তিনি লিখছেন ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে নভেম্বর বিপ্লবে পৌঁছে দেওয়ার ম্যানুয়াল ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ম্যানুয়াল। এই পাণ্ডুলিপিতেই (নভেম্বর বিপ্লব অবধি ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পাণ্ডুলিপিই, এই লিখন গ্রন্থরূপ পাচ্ছে নভেম্বর বিপ্লব বেশ খানিকটা পার হয়ে) দেখা গেল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন কী গভীর ও উদ্ভাবনী মনোনিবেশে পাঠ করেছেন প্রচলিত রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের দিনকাল ও কালান্তর এবং সেই কালান্তরের মার্কস ও এঙ্গেলস-এর বিশ্লেষণ।
আসলে বিপ্লবের মুখ্য নির্মাতা হিসাবে তাঁর বিনিদ্র লক্ষ ছিল পূর্বজ সংগ্রামগুলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে রুশ দেশে ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তুত হওয়া বৈপ্লবিক সম্ভাবনাকে দ্রুত সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সাফল্যে পৌঁছে দেওয়া। ইউরোপ জুড়ে সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে-দেওয়া সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে সর্বহারার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল তিলমাত্র অযথা কালক্ষেপ ছাড়াই অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল খাদ্য ও শান্তির জন্য। তাঁর স্বদেশের জনতার জন্য তো বটেই, সমগ্র ইউরোপের জনতার জন্য খাদ্য ও শান্তি। কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সামনে এ ছিল এক ঐতিহাসিক আশু বাধ্যবাধকতা। মানবতার জন্য বাধ্যবাধকতা।
এবং এই আশু বাধ্যবাধকতা পার হয়ে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল সমগ্র ইউরোপের সামনে, উপনিবেশীকৃত দেশগুলির সামনে, সমগ্র দুনিয়ার সামনে সমাজতান্ত্রিক সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে- দেওয়া। মুক্তির সম্ভাবনার দুয়ারগুলি খুলে-দেওয়া। না, একা কমরেড লেনিনের লক্ষ্য নয়, তাঁর সমগ্র সহযোদ্ধাদের লক্ষ্য। সমগ্র বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব কর্মীস্তরের লক্ষ্য।
এটুকু বরং বলে নেওয়া যেতে পারে, মুক্তিচেতনার এই আন্তর্জাতিকতা মহামতি লেনিন তাঁর পার্টির সর্বনিম্ন কর্মী ও দরদিস্তরেও সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন অনমনীয় একাগ্রতায়।
ঠিক উলটো দিক থেকে বলতে হলে, পূর্বতন বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরম্পরায় তখনও না-ভূমিষ্ট নভেম্বর বিপ্লবকে লেনিন স্থাপন করেছিলেন আরো একটি প্রখর কারণে। তদানীন্তনের প্রতিষ্ঠিত মার্কসবাদীরা, সমাজতন্ত্রের নাম নেওয়া দল গোষ্ঠী ও পার্টিগুলি যেন নভেম্বর বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট এমনকি বিলম্বিত করতে না পারে। তখন ইউরোপে রাজনৈতিক চিন্তা জগতে প্রবলভাবেই সক্রিয় রয়েছেন বহুমান্য মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও সংগঠক গেওর্গি ভ্যালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ (১৮৫৬-১৯১৮),কার্ল কাউটস্কি (১৮৫৪-১৯৩৮) কিংবা এদুয়ার্দ বার্নস্টাইন (১৮৫০-১৯৩২)। বার্নস্টাইনকে লেনিন আদ্যন্ত সুবিধাবাদী হিসাবে সাব্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু যাঁদের তিনি সম্মানার্হ গণ্য করতেন, সেই প্লেখানভ ও কাউটস্কি ১৯১৭-র সেই সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে বিপ্লব সূচনার বিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ফলে, বিপ্লবের দিকে একাগ্র দৃঢ়তায় এগিয়ে যাওয়ার কর্মসূচিতে যাতে বিন্দুমাত্র বিচলন ও দ্বিধা না ঘটে সেজন্যই লেনিনকে পূর্বতন সংগ্রামগুলির সূত্রে মার্কসীয় বিশ্লেষণকে প্রয়োগ করেই প্রতিপন্ন করতে হয়েছিল কেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল প্রয়োজন রাষ্ট্রব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার লক্ষেই।
পূর্বতন সংগ্রামগুলির পরম্পরায় নভেম্বর বিপ্লবের সম্ভাবনাকে জাগ্রততর করে তুলতে হয়েছিল লেনিনকে এবং সেই সূত্রেই মার্কস ও এঙ্গেলস-এর বিচার, সূত্র ও আকাঙ্ক্ষাগুলি হুবহু বিন্যস্ত করতে হয়েছিল তাঁকে যাতে মার্কসবাদের ব্যাখ্যানে ও প্রয়োগে কোনো ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি না ঘটে, শ্লথতা ও সাহসহীনতা প্রশ্রয় না পায়।
এইখানেই আমাদের দায়, নভেম্বর বিপ্লবের নির্দেশ। প্রচলিত ক্ষমতাতন্ত্র, ধনবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার নানা ধরনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সম্ভাবনার জমিন প্রস্তুত করা নিরন্তর শ্রমে ও ত্যাগে, অবিচল একাগ্রতায় এবং সেই সম্ভাবনাকে ক্রমশ বিকশিত করে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পথে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করা। এমনকি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নাম নিয়ে যে কোনো আপস সমঝোতা ও সুবিধাবাদের প্রকোপ থেকে সেই সম্ভাবনাকে রক্ষা করা, কিছুতেই তাকে বিনষ্ট হতে না-দেওয়া।
[ দুই ]
‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’-এর তৃতীয় অধ্যায়ে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন প্যারি কমিউন নিয়ে মার্কসীয় বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে নভেম্বর বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বিচার করেছেন, নভেম্বর বিপ্লবের ফলে কোন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে তা নির্ণয় করেছেন এবং জনগণতন্ত্রের স্বরূপ নির্ধারণ করেছেন।
আমরা যখন সদ্য পার হয়ে এলাম প্যারি কমিউনের সার্ধশতবর্ষ, সেই প্রেক্ষিতে এই আলোচনার দিকে মনোনিবেশ অনিবার্য বলেই বোধহয়।
আলোচনার সূচনাতেই লেনিন স্মরণ করছেন প্যারি কমিউনের ক্রান্তিকালে মার্কসের ভূমিকা।
লেনিন লিখছেন, ১৮৭০ সালের হেমন্তে, প্যারি কমিউনের কয়েক মাস আগে মার্কস প্যারির শ্রমজীবীদের সতর্ক করেছিলেন যে সরকার ফেলে দেওয়ার যে কোনো উদ্যোগই হতাশাজনক ভুল হবে। কিন্তু যখন যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলো এবং প্যারির জনতা সংগ্রাম শুরু করে দিল, বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে সেই অভ্যুদয়কে স্বাগত জানালেন মার্কস। উদ্বেগ আশঙ্কাকে নিজের মধ্যে রেখেই।
কেন স্বাগত জানালেন মার্কস?
লেনিন উত্তর দিয়েছেনঃ কারণ যে কোনো প্রায়োগিক পদক্ষেপ মার্কস-এর কাছে শয়ে শয়ে কর্মসূচি ও যুক্তিতর্কের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
উলটো দিকের একটি উদাহরণও দিয়েছেন লেনিনঃ প্রথম রুশ বিপ্লবকে ১৯০৫-এর নভেম্বরে সমর্থন জানিয়েছিলেন প্লেখানভ। কিন্তু ডিসেম্বরে রুশ দেশের মানুষ যখন প্রবল আত্মত্যাগে লড়াইয়ের মধ্যে, প্লেখানভ লিখে দিলেনঃ এদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া উচিত হয়নি।
এই তুলনামূলক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে লেনিন দেখিয়ে দিলেন, শ্রমজীবী জনতা যখন আত্মত্যাগের সংগ্রামের ময়দানে, কোনো মার্কসবাদীই যুক্তিতর্কের দোহাই পেড়ে তার থেকে দূরে থাকতে পারে না।
প্যারি কমিউনের অভিজ্ঞতা থেকেই রণনীতিতে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন মার্কস। ১৮৭২ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর যে জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে, ২৪ জানুয়ারি দিনাঙ্ক মুদ্রিত ভূমিকায় মার্কস এঙ্গেলস জানাচ্ছেন, ‘শ্রমিকশ্রেণি সহজভাবে রেডিমেড রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখলে রাখতে পারে না এবং তার নিজের লক্ষে একে ব্যবহার করতে পারে না।’
লেনিন লিখছেন, মার্কস-এর এই বক্তব্যকে সুবিধাবাদীরা ভুল অর্থে ব্যবহার করে এসেছে। এবং এই বক্তব্যকে ব্যবহার করেই সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্যোগকে পিছিয়ে দেওয়া যায়।
লেনিন উদ্ধৃত করছেন প্যারি কমিউনের ওই ৭২ দিনের মধ্যেই কুগেলমানকে লেখা মার্কস-এর চিঠি। ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল মার্কস লিখছেন, ‘তুমি যদি আমার ১৮ ব্রুমেয়ার-এর শেষ অধ্যায় পড়, দেখবে আমি বলে দিয়েছি, ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী লক্ষ্য কখনোই হবে না আমলাতান্ত্রিক সমরযন্ত্রকে এক হাত থেকে অন্য হাতে তুলে দেওয়া। লক্ষ্য হবে একে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া। এবং এটাই হবে এই মহাদেশে যে কোনো যথার্থ জনতার বিপ্লবের পূর্বশর্ত। আর ঠিক এইটাই প্যারিতে আমাদের বীর পার্টি কমরেডরা এখন করতে চাইছেন।’
এই চিঠির সূত্র ধরেই লেনিন নভেম্বর বিপ্লবের কর্মসূচি নির্ণয় করছেন, আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন জনতার সংগ্রাম প্রস্তুত করা এবং তাকে পরিচালনা করার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পাঠ।
লেনিন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, কীভাবে প্যারির শ্রমিকরা রাষ্ট্রপোষ্য সামরিক ও পুলিশবাহিনী ভেঙে দিয়েছিল, বিপ্লবী জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল হাতিয়ার। নির্দেশ দিয়েছিল আমলাদেরও পারিশ্রমিক দেওয়া হবে শ্রমিকের মজুরির হারে এবং আমলারাও পরিচালিত হবে প্রতিটি এরনদিসমাঁ বা প্রশাসনিক ইউনিটে নির্বাচিত শ্রমিক প্রতিনিধিদের হাতেই। এবং সকল কর্মচারী বাধ্য থাকবে জনতার কাছে জবাবদিহিতে।
ওইখানেই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী উত্তর--রেডিমেড রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে তাহলে গড়ে তোলা কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা? ওইখানেই প্যারি কমিউন থেকে নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা - কোন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য আমাদের শ্রম ও সংগঠন নিরন্তর।
সেই সঙ্গে লেনিন মার্কস-কথিত সেই ‘যথার্থ জনতার বিপ্লব’-এর সূত্র ধরে জানিয়ে দিচ্ছেন সেই অমোঘ নির্দেশ যা আমাদের দেশের জন্য মুহূর্তমাত্র ভুলে যাওয়া চলে নাঃ জনতার বিপ্লবে জনতার ঐক্যের অর্থ শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য, যা প্যারির লড়াকু মানুষ শুরু করতে চেয়েছিল, প্রতিদিন সমৃদ্ধ ও সম্পূর্ণ করতে হবে আমাদের।
[ তিন ]
প্যারি কমিউন থেকে নভেম্বর বিপ্লব - বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরম্পরায় লেনিন মাঝে রাখছেন ১৯০৫-এর প্রথম রুশ বিপ্লবকে।
আমরা কিছুতেই ভুলে যাব না, প্রথম রুশ বিপ্লবের আগুন ভারতকে দিয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনের প্রেরণার স্ফুলিঙ্গ। গান্ধী দেখছেন কত দূর থেকেঃ রাশিয়ার শ্রমিক-জনতা হেঁকে দিয়েছে হরতাল। জারের বাহিনীর বেয়নেটও আর তাকে কাজের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। মহাত্মা লিখছেনঃ ‘এমনকি শাসকও শাসিতের সহযোগিতা ছাড়া শাসন চালাতে পারে না।’
বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরম্পরা নিয়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নিয়ত পাঠ শাসিতের জন্য শোষিতের জন্য দিন বদলের অবিচল লক্ষ্যে।