৫৯ বর্ষ ১২ সংখ্যা / ৫ নভেম্বর, ২০২১ / ১৮ কার্ত্তিক, ১৪২৮
এক টুকরো রুটির জন্য সংগ্রাম
অর্ণব ভট্টাচার্য
গ্রামে কুলাকদের বিরুদ্ধে গরিব কৃষক ও শ্রমিকদের মিছিল।
১৯১৮ সালের বসন্ত। রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে রুটির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সাধারণ শ্রমিকরা। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম রুটি। পেট ভরবে কীভাবে? কীভাবে বেঁচে থাকা যাবে শিশু সোভিয়েত রাষ্ট্রে? সত্যিই কী রাশিয়ায় তখন খাদ্য উৎপাদন অত্যন্ত কম নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র?
সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার ইতিহাস থেকে হতে পারে শত শত ছবির চিত্রনাট্য - এমনই ঘটনাবহুল এবং রোমহর্ষক সেদেশে শ্রমজীবী মানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলবার কাহিনি। বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্য যে প্রতিবিপ্লবী শক্তি রাশিয়ায় সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার অন্যতম ছিল কুলাক বা ধনী চাষির দল। গ্রামীণ রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে তারাই ছিল সবচেয়ে বড়ো বাধা। বিপ্লবের ছ’মাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই রাশিয়ার বুর্জোয়াদের সহায়তায় কুলাকরা গোটা দেশে কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অনাহার আর মৃত্যুর গভীর অতলে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল।
বলশেভিকদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করবার জন্য বুর্জোয়া এবং ধনীরা গ্রাম থেকে শহরে যাতে খাবার না যায় তার পরিকল্পনা করে। মানুষের মৌলিক চাহিদার ওপরে এই ভয়ংকর আঘাত হেনেছিল রাশিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শক্তি এবং প্রাথমিকভাবে তারা সফলও হয়েছিল। সরকারিভাবে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করার কাজে বাধা দেয় কুলাকরা। রাশিয়ার শস্য উৎপাদক বিভিন্ন প্রদেশ যেমন তামবভ, সামারা, সারাতভ থেকে এক দানা খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা যায়নি। দেশের 'শস্য ভাণ্ডার' বলে পরিচিত কুবান থেকে শহরাঞ্চলে ১৯১৮ সালের মার্চ মাসের আগে পর্যন্ত ১ কেজি খাদ্যশস্যও যায়নি। সরকারকে নির্দিষ্ট মূল্যে খাদ্যসংগ্রহ করতে না দিয়ে খাদ্যশস্যের ফাটকাবাজি সহ নানারকমের পদক্ষেপ নেয় ধনী চাষির দল যাতে কিছুতেই শিল্পাঞ্চলের মানুষ খাদ্যদ্রব্য না পায়, সরকারের ওপর অসন্তোষ বাড়ে এবং খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা না মেটাতে পেরে সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে।
পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন হয়ে যায় যে, ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মস্কো এবং পেত্রোগ্রাদে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য আসার কথা ছিল তার মাত্র ৭.১ শতাংশ এসে পৌঁছায়। ফেব্রুয়ারি মাসে তা হয় ১৬ শতাংশ, এপ্রিলে ৬.১ শতাংশ এবং মে মাসে মাত্র ৫.৭ শতাংশ।
পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করার লক্ষ্যে এক ধরনের বিনিময় অর্থনীতির প্রবর্তন করে বিপ্লবী সরকার। রাশিয়ার শিল্পাঞ্চল থেকে বিভিন্ন কৃষি উপকরণ, পোশাক ইত্যাদি গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে সেগুলির বিনিময়ে খাবার সংগ্রহের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুলাকদের তীব্র বিরোধিতার জন্য খাদ্য সংগ্রহের কাজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। কুলাকরা কেবলমাত্র খাদ্য সংগ্রহ আটকে দিচ্ছিল তা নয় - তারা বিভিন্ন জায়গায় শ্বেতরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল, খাদ্য পরিবহণে বাধা সৃষ্টি করছিল। এমনকী যে বিদেশি শক্তি রাশিয়ার বিভিন্ন অংশ দখল করে নিয়েছিল তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে প্রতিবিপ্লবকে রাশিয়ার বুকে জয়যুক্ত করার কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল কুলাকরা। পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে লেনিন বলেনঃ ‘‘আমাদের দেশে সংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ শোষকশ্রেণি আমাদের বিরুদ্ধে শেষ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।’’
এদিকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফসলের দাম বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি মাঝারি চাষিরা পছন্দ করেনি। ফলে মাঝারি চাষিরা এসময় কুলাকদের সহায়তা করে। একমাত্র গরিব চাষিরা সেসময় ছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রের পক্ষে কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির সহায়তা ছাড়া গরিব চাষির পক্ষে শোষক কুলাকদের চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব ছিল না।
এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিকে সামাল দেবার জন্য অত্যন্ত দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার সাথে পরিকল্পনা করে রুশ কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯১৮ সালের মে মাসের ৯ তারিখে সমস্ত প্রাদেশিক সোভিয়েত, ফুড কমিটি এবং পিপলস কমিশার ফর রেলওয়ে কমিউনিকেশনের কাছে লেনিন এই বার্তা দেনঃ ‘‘পেত্রোগ্রাদ এক অভূতপূর্ব বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে - সেখানে কোনো রুটি নেই। লাল রাজধানী অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি। প্রতিবিপ্লব মাথা তুলছে এবং সোভিয়েত ক্ষমতার বিরুদ্ধে ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষোভ পরিচালিত করবার চেষ্টা করছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নামে আমি অবিলম্বে পেত্রোগ্রাদের জন্য সাহায্য চাইছি।’’ খাদ্যের অভাবে পেত্রোগ্রাদে ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে ২৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং বড়ো শিল্পে অর্ধেকের বেশি শ্রমিক কাজ ছেড়ে দেয়। মস্কো ও পেত্রোগ্রাদের হাজার হাজার শ্রমিক গ্রামাঞ্চলে চলে যায় রুটি ও কাজের খোঁজে। তবে শুধু তো পেত্রোগ্রাদ নয় অন্যান্য সমস্ত শিল্পকেন্দ্রিক প্রদেশ ছিল ভয়ংকর খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। লেনিনের এই আবেদন সামগ্রিকভাবে গোটা রাশিয়াতে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করবার জন্য বলশেভিকদের পথে নামতে উদ্বুদ্ধ করে।
ইতিমধ্যে শহরাঞ্চলে খাদ্য সংকট দূর করবার জন্য সোভিয়েত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ব্যবসায়ী, ফাটকাবাজ, বুর্জোয়াদের গোপন খাদ্য ভাণ্ডার থেকে খাদ্য উদ্ধার করা হয়। খাদ্যের রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়। শিশু এবং শ্রমিকদের খাদ্য পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় যৌথ হেঁসেল চালু করা হয়। সরকারি উদ্যোগে ক্যান্টিন এবং মোবাইল কিচেনের ব্যবস্থা করে সোভিয়েত সরকার। বেকারদের জন্য বিনা পয়সায় খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু প্রধান কাজ ছিল, গ্রামাঞ্চল থেকে সমস্ত বাধা চূর্ণ করে দিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যশস্য জোগাড় করা। আর সেই কাজ করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকদের কাছে এবং পার্টি সদস্যদের কাছে আহ্বান জানায়, যাতে তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দায়িত্ব সহকারে পালন করতে পারে। পার্টির 'অল রাশিয়া সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি' ১৯১৮ সালের ৯ মে গ্রামীণ বুর্জোয়াদের ক্ষমতা চূর্ণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহ করা এবং খাদ্যের ফাটকাবাজি বন্ধ করবার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পেত্রোগ্রাদের শ্রমিকদের উদ্দেশে লেনিন আহ্বান জানানঃ ‘‘কমরেড, বিপ্লব এক অত্যন্ত সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। মনে রাখবেন - কেবলমাত্র আপনারাই বিপ্লবকে রক্ষা করতে পারেন, অন্য কেউ তা পারবে না। এ সময় আমাদের প্রয়োজন - বাছাই করা, রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর শ্রমিকদের যারা কোনরকমভাবে কোনো প্রলোভনে পা দেবে না, লুটতরাজে জড়িয়ে পড়বে না এবং কুলাক, মুনাফাখোর, চোরাকারবারি, ঘুষখোর এবং রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লৌহদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে।... মনে রাখবেন যদি আমরা এ কাজ না করতে পারি তাহলে আকাল ও বেকারি রোধ করা যাবে না এবং বিপ্লবের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়বে।’’
২৬ মে, ১৯১৮ লেনিন লিখলেন তার ‘‘থিসিস অন দা কারেন্ট সিচুয়েশন’’। যেখানে তিনি বললেনঃ ‘‘গ্রামাঞ্চলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণি এবং গ্রামের গরিবদের এক নির্ণায়ক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে এবং তার জন্য আগামী তিন মাসে নয়-দশমাংশ কাজ হবে কেবলমাত্র এই খাদ্য সংগ্রহের জন্য নিবেদিত।’’ গ্রামীণ বুর্জোয়াদের যাবতীয় প্রতিরোধ চূর্ণ করে দিয়ে উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহ করা এবং অতিরিক্ত খাদ্যের একটা অংশ গরিব কৃষকদের মধ্যে বিলি করার আহ্বান তিনি জানালেন। কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এবং শোষকদের প্রতিরোধ করার দৃঢ় সংকল্প বুকে নিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক গ্রামাঞ্চলের দিকে রওনা দিল।
লেনিন বললেন ‘‘আপাতভাবে মনে হতে পারে যে এই সংগ্রাম হচ্ছে রুটির জন্য সংগ্রাম, কিন্তু আসলে এই সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের জন্য।’’ শহরাঞ্চল থেকে শ্রমিকরা গিয়ে গ্রামে প্রথমেই গরিব চাষিদের নিয়ে গড়ে তুললেন 'কমিটি অফ পুওর পেজ্যান্টস'। এই কমিটির পক্ষ থেকে যখন উদ্বৃত্ত খাদ্য কুলাকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবার কাজ শুরু হলো তখনই গ্রামাঞ্চলে তীব্রতর হলো শ্রেণিসংগ্রাম। কমিটির উদ্যোগে খাদ্যশস্যের সংগ্রহমূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে মধ্য চাষিরা কুলাকদের পাশ থেকে সরে এসে মজুর ও গরিব চাষিদের পাশে এসে দাঁড়ায়। শহর থেকে যে শ্রমিকরা গ্রামাঞ্চলে গিয়েছিলেন গরিব কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে কুলাকদের অত্যাচার খর্ব করে খাদ্য সমস্যার সমাধান করবার জন্য তারা অচিরেই তাদের সততা, নিষ্ঠা, শ্রেণিচেতনা এবং বলপ্রয়োগের বদলে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার প্রচেষ্টার ফলে সহজেই গরিব কৃষকদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। গরিব কৃষকরা অনুভব করেন যে, এই শ্রমিকরা কুলাকদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে তাদের মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক ও সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এভাবেই রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী বাস্তবে গড়ে ওঠে।
গরিব কৃষকদের সংগঠন, 'কমিটি অফ পুওর পেজ্যান্টস'-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে কুলাকরা। যে সমস্ত সোভিয়েতে কুলাকরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা সেখানে হয় এই কমিটি তৈরি হতে দেয়নি, অথবা কোথাও কোথাও পুওর পেজ্যান্টস কমিটির নামে যে কমিটি হয়েছে সেখানে কেবলমাত্র কুলাকরাই স্থান পেয়েছিল। তবে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে প্রায় সর্বত্রই এই গরিব কৃষকদের কমিটি গড়ে ওঠে। ইয়োরোপীয় রাশিয়ার ৩৩টি প্রদেশে ১ লক্ষ ৫ হাজার এহেন কমিটি তৈরি হয়। লেনিন বলেন যেঃ ‘‘গ্রামাঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এই কমিটি গঠন। এটিই সেই 'টার্নিং পয়েন্ট' যার দ্বারা শহরের শ্রমিকশ্রেণি যারা কিনা সমস্ত কৃষকের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জমিদারদের চূর্ণ করেছিল; তারা সেই স্তর থেকে আরও কঠিন এবং ঐতিহাসিকভাবে উন্নততর সমাজতান্ত্রিক কাজ অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং তার সাথে কৃষকদের মনোজগতে প্রবেশ করতে পেরেছিল।’’ এই কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল উদ্বৃত্ত জমির পুনর্বণ্টন। রাশিয়াতে কমিটির উদ্যোগে ৫০ লক্ষ হেক্টর উদ্বৃত্ত জমি কুলাকদের কাছ থেকে উদ্ধার করে গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। গ্রামাঞ্চলে গরিব কৃষকদের পক্ষে শ্রেণিগত ভারসাম্য পরিবর্তন, তাদের জীবনমানের উন্নয়ন এবং কুলাকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য ধ্বংস করার পথে এ ছিল এক অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ।
গরিব চাষিদের এই কমিটির নেতৃত্বে রাশিয়ায় খাদ্য সংগ্রহ লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসের শেষে গোটা দেশে আট কোটি পাউন্ড খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। ১৯১৭-১৮'র তুলনায় ১৯১৮-১৯ সালে খাদ্য সংগ্রহের পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। কিছুটা হলেও খাদ্য সংকটের সমাধান করার পথে অগ্রসর হয় শিশু সোভিয়েত রাষ্ট্র। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো বিপত্তি হাজির হয় খাদ্য পরিবহণের সময়। খাদ্য সংগ্রহ করা যেমন ছিল এক কঠিন সংগ্রাম, তার চেয়েও বড়ো বিপদ হাজির হয় খাদ্য সরবরাহ করার সময় যখন রেলপথের ওপর উপর্যুপুরি আক্রমণ করে প্রতিবিপ্লবী শ্বেতরক্ষী বাহিনী। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে প্রাভদা পত্রিকায় মস্কোর এক শ্রমিক একটি নিবন্ধ লেখেন যার শিরোনাম ছিল - ‘‘এক টুকরো রুটির গল্প’’। এই নিবন্ধে সেই বীর শ্রমিক লেখেন - কী করে মস্কো থেকে ৬০ জন শ্রমিক তেইশটি ওয়াগনে কৃষির যন্ত্রপাতি নিয়ে যাচ্ছিল জারিৎসিন অঞ্চলে। তাদের দায়িত্ব ছিল এই যন্ত্রের বিনিময়ে খাদ্য সংগ্রহ করা। সেই যাত্রাপথে কীভাবে প্রতিপদে শ্বেতরক্ষী ও কুলাকদের আক্রমণ প্রতিহত করে এগোতে হয়েছে, সারারাত ধরে যুদ্ধ করতে হয়েছে, ভেঙে দেওয়া রেলওয়ে লাইন আবার সারাই করে এগোতে হয়েছে গন্তব্যের দিকে - তার বীরত্বপূর্ণ কাহিনি এই নিবন্ধে রয়েছে। ১৯১৮ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর - মাত্র ছ’মাসের মধ্যে ২২,০০০ সোভিয়েত কর্মচারী কুলাক ও তাদের সহায়ক প্রতিক্রিয়ার শক্তির হাতে প্রাণ দেন। খাদ্য সংগ্রহের কাজে যুক্ত ৭,৩০০ শ্রমিক ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই শহিদের মৃত্যু বরণ করেন।
প্রতিবিপ্লবী শক্তির এই চূড়ান্ত হিংস্র আক্রমণকে প্রতিহত করার সংগ্রামে কমিউনিস্টরা গরিব চাষির পাশাপাশি মধ্যবিত্ত কৃষকের সহায়তা লাভ করে। বুর্জোয়া এবং কুলাকদের সমস্ত বাধা চূর্ণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সুফল গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কমিউনিস্ট যোদ্ধাদের কাছে শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয় প্রতিবিপ্লবের শক্তি। ধীরগতিতে হলেও বাড়তে থাকে যৌথ খামারের সংখ্যা। গ্রামগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টির শাখার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং সোভিয়েতগুলিতে কমিউনিস্ট প্রতিনিধির সংখ্যা উল্লেখজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। অচিরেই কৃষকদের প্রধান নেতৃত্ব হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে মহান নভেম্বর বিপ্লবের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ষষ্ঠ 'অল রাশিয়া এক্সট্রাঅর্ডিনারি কংগ্রেস অফ সোভিয়েতস' অনুষ্ঠিত হয়। লেনিন বলেনঃ ‘‘আমরা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে বিপ্লবের কাজ শুরু করেছিলাম, যা কিনা ভবিষ্যতে কোনো শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবকে মোকাবিলা করতে হবে না। তাই আমরা যে পথ পরিক্রম করে এসেছি সে সম্পর্কে মানুষকে জানানো অত্যন্ত জরুরি।’’ বিপ্লবের প্রথম বছরেই প্রধানতম সাফল্যগুলির অন্যতম ছিল বিপ্লবী শ্রমিকদের সাথে সংগ্রামী কৃষকদের মৈত্রীর ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক সমাজের মজবুত ভিত্তি রচনা করা। সেই ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে শ্রেণিশত্রুর ভয়ংকর ষড়যন্ত্র এবং তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মজুর ও গরিব চাষির আত্মপ্রত্যয় ভরা সংগ্রাম। রুশ বিপ্লবের ১০৪ বছর পরেও পৃথিবীর বুকে প্রথম শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য রুশ কমিউনিস্টদের সেই মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামের আখ্যান রক্তে শিহরণ জাগায়, ভবিষ্যতের পথ খুঁজে নিতে অনুপ্রাণিত করে।