৫৮ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৬ আগস্ট, ২০২১ / ২০ শ্রাবণ, ১৪২৮
দক্ষিণবঙ্গে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বানভাসি
বিপন্ন মানুষ, ত্রাণ ও পানীয় জলের হাহাকার
উদয়নারায়ণপুরে অসহায় বানভাসি মানুষ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বানভাসি বিপন্ন মানুষ কোনো ধরনের ত্রাণ সাহায্য না পেয়ে পথে নেমে অবরোধ-বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি অতি বর্ষণ ও ব্যারেজের জল ছাড়ার ফলে হাওড়া, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ব্যাপক অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিস্তীর্ণ কৃষিজমি জলপ্লাবিত হওয়ায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এই দুর্বিপাকের মধ্যে বিপন্ন মানুষ উঁচু বাড়ির ছাদে, কোথাও পিচ রাস্তায় ত্রিপল টাঙিয়ে কোনোমতে দিনগুজরান করছেন। এই প্লাবনে এখন পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। বিগত কয়েকদিন ধরে দুর্গত মানুষদের অসহায় দিন কাটাতে হলেও প্রশাসন ও সরকারের কার্যত দেখা মেলেনি। দেখা মেলেনি শাসকদলেরও। ৩ আগস্ট পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি পশ্চিম মেদিনীপুরে বন্যা পরিদর্শনে এসে ত্রাণ ও পানীয় জলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও জলমগ্ন অসহায় মানুষরা এতটুকু সাহায্য পাননি। তাই ঘাটাল-দাসপুর ব্লকের বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
এই অবস্থায় গত ৪ আগস্ট দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সড়কপথে উদয়নারায়ণপুর, আমতা-২ নম্বর ব্লকে বন্যাকবলিত এলাকা সফরে আসেন। তিনি সর্বসাকুল্যে ১৫ মিনিট এই অঞ্চলে থেকে ডিভিসি’র জল ছাড়ার জন্য ‘ম্যান মেড ফ্লাড’ বলে অভিযোগ করেন। কিন্তু ডিভিসি কর্তৃপক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগকে কার্যত উড়িয়ে দিয়েছে। ডিভিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে জল ছাড়ার আগে রাজ্য প্রশাসনের সব মহলে আগাম জানিয়েই জল ছাড়া হয়েছে।
বন্যা বিধ্বস্ত ঘাটালে রাজপথে নৌকাই সম্বল।
প্রবল বর্ষণের কারণে দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে বিপুল পরিমাণে জল ছাড়ার জন্য দক্ষিণবঙ্গের ৪টি জেলা গত ৩১ জুলাই থেকে মারাত্মকভাবে জলপ্লাবিত হয়েছে। ঘাটাল ও দাসপুর ব্লকের ৭৫০টির মতো মৌজা সম্পূর্ণ জলের তলায়। কোথাও কোথাও জলস্তর দশ থেকে বারো ফুট। দাসপুরে সামাট হোসেনপুর, রাজনগর, রামগড়, রায়কুণ্ডু, নাড়াজোল এলাকার ৯৭ ভাগ জলের তলায়। ঘাটাল শহরের ৬ থেকে ১৩ নম্বর ওয়ার্ড প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া দাসপুর-ঘাটালের ৫১টি স্থানে বাঁধ ভেঙে পড়েছে। এই জেলায় জলের তোড়ে এখন পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্যোগের মধ্যে কেশপুর, দাসপুর ব্লকের বিভিন্ন স্থানে আন্ত্রিক সহ পেটের রোগ দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় পানীয় জল, খাদ্য সহ ন্যূনতম ত্রাণ সামগ্রী না পেয়ে দাসপুরের হোসেনপুরে পাঁচটি মৌজার মানুষ নিরুপায় হয়ে পথ অবরোধ করেন।
হুগলি জেলার আরামবাগ, গোঘাট, খানাকুল, পুঁড়শুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায় চলে যায়। খানাকুল ১ ও ২নং ব্লকের বিস্তীর্ণ কৃষিজমি ও গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। খানাকুল ১নং ব্লকের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টি জলের তলায় চলে যায়। এই সমস্ত অঞ্চলেও সরকারি ত্রাণ না মেলায় সর্বত্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও ডিভিসি’র জল ছাড়ায় হুগলির খানাকুল ১ ও ২নং ব্লকের ব্যাপক কৃষি জমি ও গ্রাম বন্যা কবলে। পানীয় জলের প্রবল সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
এই অতিবৃষ্টি এবং ডিভিসি’র জল ছাড়ায় তারকেশ্বর ব্লক এলাকার কেশবচক, কাঁড়ারিয়া, নজিপুর গ্রাম, তালপুর অঞ্চলের নস্করপুর এবং চাপাডাঙা অঞ্চলের বিনগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। এদিকে গত ৪ আগস্ট সিপিআই(এম) হুগলি জেলা কমিটির এক প্রতিনিধিদল খানাকুলে আসেন এবং বন্যা দুর্গত মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন।
এদিকে ডিভিসি’র জল ছাড়ার ফলে হাওড়া জেলার আমতা ২নং ও উদয়নারায়ণপুর ব্লকেও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। ৩১ জুলাই বিকাল থেকেই আমতা ও উদয়নারায়ণপুর ব্লকে বন্যার আশঙ্কা দেখা দেয়। উদয়নারায়ণপুরের ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪০টি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। এর মধ্যে হোদল, হরিহরপুর, কুড়চি, টৌকাপুর, আকনা, দ্বিতীয় সেনপুর, শিবানীপুর অঞ্চল জলের তলায় চলে যায়। এরই পাশাপাশি আমতা ২নং ব্লকের একটি বিরাট অংশ জল প্লাবিত হয়।
পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমার মন্তেশ্বর ব্লকের বেশ কিছু এলাকাতেও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। মন্তেশ্বর ব্লকের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী বয়ে চলা বাঁকা নদীর কূল ছাপিয়ে জল ঢুকে পড়ে খেত-খামার এমনকি গ্রামের ভেতরেও। এমনকী বর্ধমান শহরেও কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, দাসপুর, চন্দ্রকোনা ও কেশপুরের প্লাবিত অঞ্চলগুলোতে প্রশাসনের চিহ্নমাত্র দেখা যায়নি। যোগাযোগহীন একটা মৌজা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের চেহারা নেয়। পাঁচদিন ধরে বন্যার প্লাবনে দুর্বিষহ দিন কাটানোর পর ঘাটালের আজবনগরে পরিদর্শনে আসেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। তিনি গ্রামবাসীদের সাথে কোনো কথা না বলে পুলিশি পাহারায় দূর থেকে নৌকায় ঘুরে চলে যান। এতেই বিক্ষোভ দেখান দুর্গত মানুষ। এর আগে তৃণমূল নেতা শঙ্কর মাঝি সরকারি নৌকায় আজবনগরে আগাম ব্যবস্থা করতে গিয়ে স্থানীয় মহিলাদের ঝাঁটা হাতে বিক্ষোভের মুখে পড়েন। সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকায় উপযুক্ত ত্রাণ ও খাদ্য, পানীয় জল সরবরাহের দাবি জানানো হয়েছে।