৫৮ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৬ আগস্ট, ২০২১ / ২০ শ্রাবণ, ১৪২৮
অসম মিজোরামের সীমা সংঘাত
দুই রাজ্যের মানুষের সম্প্রীতি ধ্বংসের চেষ্টায় বিজেপি
কমলেশ গুপ্ত
গুয়াহাটিতে সিপিআই(এম)’র ডাকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখছেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক দেবেন ভট্টাচার্য।
রয়েছেন পার্টির প্রবীণ নেতা হেমেন দাস সহ অন্যান্যরা।
গত ২৬ জুলাই অসম মিজোরাম সীমা বিবাদ চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছায়। কোনো বৈদেশিক রাষ্ট্র নয়, ভারতেরই একটি অঙ্গ রাজ্যের পুলিশ প্রতিবেশী রাজ্যের পুলিশের বিরুদ্ধে সন্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে। এমন পরিস্থিতি ভারতে বিদেশি শাসনের পূর্বে কখনো ঘটেছে বলে জানা যায় না। মিজোরাম পুলিশের আক্রমণে ইতিমধ্যেই ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৭১ জন। তারমধ্যে অসম পুলিশের ৪৭ জন রয়েছেন। আহতদের বেশ কয়েজনের আঘাত গুরুতর। মিজোরাম পুলিশের দাবি মিজোরামে আহতের সংখ্যা ৩০ জনের বেশি। এই সীমা- উত্তেজনা দু’রাজ্যেই আরো বৃদ্ধি পেয়েছে দুই মুখ্যমন্ত্রীর ‘টুইটার’ যুদ্ধ এবং দুই রাজ্যের বিভিন্ন ছাত্র-যুব সংগঠনের পরস্পর বিরোধী বিবৃতি এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনের ফলে। দু’পক্ষই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত।
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হলো কেন? তার একদিন আগেইতো কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে অসম এবং মিজোরোমর মুখ্যমন্ত্রীদ্বয় ড. হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এবং জোরামথাঙ্গা সীমা বিবাদ নিয়ে শিলঙে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন বলে সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল। ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই অসম-মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত লাইলাপুর এবং ভাইরেংটি রক্তাক্ত হলো।
অসম-মিজোরামের সীমা বিবাদ দীর্ঘদিনের। স্মরণ করা যেতে পারে বর্তমান মিজোরাম ছিল অসমের লুসাই পাহাড় জেলা। এই জেলার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮৭৫ সালে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা সে সময় লুসাই (মিজো) জনগোষ্ঠীর প্রধানদের সাথে আলোচনা করেই বরাক উপত্যকার সমভূমি থেকে আলাদা করে জেলার অভ্যন্তরীণ সীমা স্থির করেন। ১৯৩৩ সালে ওই ব্রিটিশ শাসকেরা আবার নতুন করে কাছাড়, মণিপুর এবং লুসাই পাহাড়ের সীমা নির্ধারণ করে। বর্তমানের মিজো নেতারা বলছেন যে, ১৯৩৩ সালে মিজো প্রধানদের সাথে আলোচনা না করে নির্ধারিত সীমা নয়, ১৮৭৫ সালের নির্ধারিত সীমাই সঠিক। সেইমতোই সীমা ঠিক করা হোক। স্বাধীনতার পর লুসাই পাহাড়ে এমএনএফ-এর নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র বিদ্রোহ হয় ষাট এবং সত্তর দশকে। তখন ওই জেলাকে অসম থেকে কেটে ১৯৭২ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং ১৯৮০ সালে পূর্ণ রাজ্য গঠন করা হয়। ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধী মিজো শান্তি চুক্তি করে কংগ্রেস সরকারের পরিবর্তে লালডেঙ্গার এমএনএফ-কে রাজ্য সরকার গঠনের সুযোগ দেন। রাজ্য গঠনের সময় সাংবিধানিক সীমা নির্দিষ্ট হয়েছিল। সেসময় চুপ থাকলেও পরবর্তীকালে ১৮৭৫ সালে নির্ধারিত সীমার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। সেই বিবাদ চলতে থাকে। ইতিপূর্বে দুই রাজ্যের উচ্চস্তরীয় বৈঠকে স্থির হয়েছিল যে, দুই রাজ্যই স্থিতাবস্থা বজায় রাখবে এবং বিতর্কিত অঞ্চলগুলো ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হিসেবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকবে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য দু’রাজ্যই সমান উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কিন্তু না রাজ্য সরকারগুলো, না কেন্দ্রীয় সরকার, সীমা সমস্যার জটিলতা কাটাতে কেউ উদ্যোগ নেয়নি। গত ছয়মাস ধরে অসম-মিজোরাম সীমান্তে চলছে উত্তপ্ত পরিস্থিতি। কেন্দ্রে এবং অসমে চলছে বিজেপি সরকার। মিজোরামের এমএনএফ সরকার আবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-এর শরিক। এদিকে অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ‘উত্তরপূর্ব গণতান্ত্রিক মোর্চা’ (এনইডিএ/নেডা) যার আহ্বায়ক হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এবং অন্যতম সদস্য হচ্ছে মিজোরামের জোরামথাঙ্গা। ২৫ জুলাই অমিত শাহের উপস্থিতির শিলঙে আলোচনার পর রাত পোহাতেই দু’রাজ্যের যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে আলোচনার আন্তরিকতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ এমন ধারণাও পোষণ করছেন যে, এই সীমা সমস্যা নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়েছে তার চাইতে বেশি হয়েছে আগন্তুক নির্বাচনের রণকৌশল এবং প্রস্তুতির গোপন এজেন্ডা নিয়ে।
অসমের সাথে উত্তর-পূর্বের ত্রিপুরা ছাড়া প্রায় সবকটি রাজ্যেরই সীমা বিবাদ রয়েছে। নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, অরুণাচল এবং মিজোরাম এই সবকটি রাজ্যই অসম থেকে আলাদা হয়ে গঠিত হয়েছে। মিজোরামের লাইলাপুর-ভাইরেংটি অঞ্চল, মেঘালয়ের সাথে লাম্পি, হাহিম, খানাপারা, নাগাল্যান্ডের সাথে মেরাপানি, মরিয়নি, অরুণাচলের সাথে লিকাবালি, বান্দরদেয়া প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে বিবাদ দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত হয়ে আছে। এই সীমাবিবাদের ফলে এইসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পত্তিহানির অজস্র ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি অসম-নাগাল্যান্ড সীমান্তে নাগা আক্রমণে মরিয়নির বিধায়ক কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছেন। মিজোরাম সীমায় এবার কাছাড় জেলার ডিসি এবং এসপি’র কনভয়ে থাকা যানবাহনের বিস্তর ক্ষতিসাধন হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত দুটি প্রাথমিক স্কুল বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে। সীমান্তবর্তী মানুষের ঘর-বাড়ি, দোকান পাট ধ্বংস করে দেওয়ায় সাধারণ নাগরিকরা জীবন নিয়ে আশ্রয় শিবিরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।
২৬ জুলাই সকাল থেকেই সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দেয়। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গার অভিযোগ, ওই দিন সকালে অসম পুলিশের আইজিপি, কাছাড় জেলার ডিসি এবং এসপি’র নেতৃত্বে দুই শতাধিক পুলিশ সকাল সাড়ে এগারোটায় মিজোরামের কোলাশিব জেলায় ঢোকে। অসম পুলিশ মিজোরামের এক পুলিশ এবং সিআরপি’র এক জওয়ানকে প্রথমে মারধর করে। তারপর ভাইরেংটি শহরে কয়েকজন অটো চালককে উদ্দেশ্য করে টিআর গ্যাস ছোঁড়ে এবং লাঠি চালনা করে। পরিস্থিতি শান্ত করতে কোলাশিবের পুলিশ অসমের আইজিপি এবং জেলা শাসকদের চলে যেতে অনুরোধ করেন। এরইমধ্যে মিজোরামের কয়েকশো লোক সমবেত হয়ে অসম পুলিশের ওপর পাথর ছোঁড়ে। তাদের নিরস্ত্র করতে অসম পুলিশ প্রথমে শূন্যে গুলি চালায়। তারপর মিজোরাম পুলিশ গুলি চালায়। দীর্ঘসময় ধরে গোলাগুলি চলে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, মিজোরাম পুলিশ লাইট মেশিন গান থেকে গুলি চালিয়ে অসম পুলিশের জওয়ানদের হত্যা করেছে। তিনি ঘটনার অন্য বিবরণ দিয়েছেন। ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। সিপিআই(এম) সঙ্গত কারণেই উচ্চ আদালতের বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে। সাথে সাথে দু’রাজ্যের সীমা সমস্যা সমাধান না হওয়ার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছে। সিপিআই(এম) আরও দাবি করেছে, বিবাদের স্থায়ী সমাধান এবং সীমান্তবাসী মানুষের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষার। অসম সরকারের ব্যর্থতাকেও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছে সিপিআই(এম)।
অসম-মিজোরাম আন্তঃরাজ্য সীমায় অসমের হাইলাকান্দি জেলার ১০০০ হেক্টর জমি মিজোরাম দখল করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত - এই পাঁচ বছরে অসম পুলিশ জমি দখলের ৪৩টি মামলা রুজু করেছে। কিন্তু একজন দুর্বৃত্তকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। অন্যদিকে গত ২৮ জুলাই দিল্লিতে সমস্যা সমাধানের জন্য যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাতেও কেন্দ্রীয় সরকার দৃঢ় অবস্থান নেয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে সাংবিধানিক সীমার স্থিতিতে অবস্থান করার নির্দেশ দিতে পারত। মিজোরাম গঠনের সময় সাংবিধানিক সীমা গৃহীত হয়েছিল। তা না করে কেন্দ্র এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দুই রাজ্যের ওপর ঠেলে দিয়েছে। সাথে বিবদমান জমিতে কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে অসম সরকার মিজোরামের বিরুদ্ধে উচ্চতম আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। অর্থাৎ এই সীমা বিবাদ দ্রুত সমাধানের আশা নেই। কেন্দ্র সমস্যা সমাধানে হস্তক্ষেপ না করে ঝুলিয়ে রাখল।
অসম-নাগাল্যান্ড সীমা বিবাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ১৯৮৮ সাল থেকে উচ্চতম আদালতে ৩৩ বছর ধরে মামলার শুনানি চলছে, আজও তার মীমাংসা হয়নি। এই ৩৩ বছরে নাগাল্যান্ডের দুর্বৃত্তরা প্রায় ৪০০ বার বিবাদমান এলাকাতে আক্রমণ সংগঠিত করেছে। শতাধিক অসামরিক ব্যক্তির সীমা সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে। প্রায়ই অসম সরকার অভিযোগ করে যে নাগাল্যান্ড সীমান্তের বিবদমান অঞ্চলে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনী নিরপেক্ষ নয়। তারা নাগাল্যান্ডকে সাহায্য করছে, যার ফলে দুর্বৃত্তরা ঘন ঘন অসমের জমিতে প্রবেশ করে আক্রমণ সংগঠিত করছে। অরুণাচল প্রদেশের সাথে ১৯৯২ সাল থেকেই সুপ্রিমকোর্টে মামলা চলছে সীমা বিবাদ নিয়ে, আজও সমাধান হয়নি। মেঘালয়ের সাথেও ১২টি অঞ্চল নিয়ে বিবাদ চলছে। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় বাহিনী বা মামলায় সীমা সমস্যা সমাধান করে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে সে সম্ভাবনা কম। তাই জনমত গঠন করে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করর জন্য সিপিআই(এম) অসম রাজ্য কমিটি রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে দ্রুত সমাধানের দাবি উত্থাপন করেছে।
এভাবে সীমান্ত উত্তপ্ত হলে প্রতিবেশী রাজ্যের হাজার হাজার মানুষের জীবনচক্র জটিল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অসমকে বাদ দিয়ে প্রতিবেশী রাজ্যগুলো চলতে পারবে না। মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচলের জনসাধারণের খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী অসমের ভিতর দিয়েই যায়। উত্তর-পূর্বের এই ভৌগোলিক পরিবেশ এবং জনবিন্যাস অস্বীকার করা অসম্ভব। এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি’র সহযোগিতায় বরাক উপত্যকার একাংশে মিজোরামের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করেছে। এর পেছনেও রয়েছে সরকার এবং দলের অকর্মণ্যতা। এই অকর্মণ্যতার জন্যই প্রতিবেশী রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। অন্যান্য অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি, জন গোষ্ঠীর সম্প্রীতি বিজেপি যেভাবে ধর্ম, ভাষা প্রভৃতির নামে ধ্বংস করছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এটা তাদের অতিরিক্ত সংযোজন, ব্যতিক্রম নয়।